হুমায়ূন আহমেদের ‘এলেবেলে’ কি শুধুই এলেবেলে!

হুমায়ূন আহমেদের তীব্র তির্যক রসবোধ আর ব্যঙ্গরম্যের চমৎকার নিদর্শন হলো এলেবেলে। এ লেখকের অনেক বই নিয়ে কথা হলেও দুই খণ্ডের এই বই নিয়ে কথা কিছুটা কমই হয়েছে। এবার এলেবেল-এর দিকে নজর দেওয়া যাক খানিকটা এলেবেলেভাবেই।

এলেবেলেসহ হুমায়ূন আহমেদের রঙ্গচিত্র
অলংকরণ: আরাফাত করিম

মানুষের হাসি পায় কেন, এমন একটা প্রশ্ন একবার নাকি হুমায়ূন আহমেদকে করেছিলেন মজিদ সাহেব নামের এক রিটায়ার্ড পুলিশের এসপি। প্রশ্নটা শুনে হুমায়ূন বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘হাসি পায় তাই হাসে!’ নাছোড়বান্দা মজিদ সাহেব বললেন, ‘সেটাই তো প্রশ্ন হাসি পায় কেন?’ হুমায়ূন দেখলেন এই লোক উত্তর না শুনে যাবেন না। তিনি বললেন, ‘মজিদ সাহেব, আমি আপনাকে একটা গল্প বলি। গল্পটা শুনে আপনি হাসবেন। তখন আপনি নিজেই বের করতে পারবেন কেন হাসলেন।’

গল্পটা এমন। এক লোক একটা সিনেমা ৩১ বার দেখেছে। এ কথা শুনে ওই লোকের বন্ধু বলল, ‘৩১ বার দেখার মতো কী আছে সেই সিনেমায়!’ লোকটা বলল, ‘সিনেমার এক জায়গায় নায়িকা গোসল করতে যায়। কাপড় খুলতে যাবে এমন সময় একটা ট্রেন চলে আসে। ৩১ বার দেখেছি, কারণ কোনো না কোনোবার ট্রেন লেট করবে।’ এই গল্প শুনে মজিদ সাহেব অবাক হলেন। বললেন, ‘ট্রেন লেট হবে কেন? প্রতিবার তো একই ব্যাপার হবে।’ মজিদ সাহেব হাসলেন তো না-ই উল্টো গম্ভীর ও বিরক্ত মুখে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। এ ঘটনা বলে হুমায়ূন আহমেদ সিদ্ধান্ত টেনে বলেছেন, ‘রসিকতা করার ঝুঁকি আছে। বেইজ্জতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। হাসির কথায় কেউ না হাসলে বেইজ্জতি ছাড়া কী!’ আসলেই রসিকতা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এ জন্যই বোধ করি বাংলায় রম্যসাহিত্যের এত অভাব।

আসলে সেন্স অব হিউমার সব দেশের লেখকদের মধ্যেই আছে। আমাদের এখানে এই হিউমার ব্যবহারের প্রবণতাই কম।
হুমায়ূন আহমেদ

রাজশেখর বসু বা সৈয়দ মুজতবা আলী যে অর্থে রম্যসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ সে অর্থে রম্যসাহিত্যিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন মূলত ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, হুমায়ূন আহমেদের মধ্যে একজন উঁচু দরের রম্যসাহিত্যিকের যাবতীয় গুণ বরাবরই ছিল। তাঁর সবচেয়ে সিরিয়াস সাহিত্যকর্মটিও উইট আর হিউমারে ঠাসা। উদাহরণ হিসেবে এমনকি তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক জোছনা ও জননীর গল্প উপন্যাসের কথাও বলা করা যাবে। উপন্যাসটি সংগত কারণেই আগুনের হলকা, উৎকণ্ঠা, হত্যাযজ্ঞ ও হানাদার বাহিনীর বহু বিচিত্র ইত্যাদিতে ভরা। এর মধ্যেও হুমায়ূন তাঁর রসবোধকে বিসর্জন দেননি। কথাটা একটু বড় শোনালেও বলা দরকার, বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে বোধ করি হুমায়ূনের মতো তীব্র রসবোধসম্পন্ন গল্প বলিয়ে ও ঔপন্যাসিক খুব একটা পাওয়া যাবে না। নিজের মধ্যে রম্যরসের তীব্র উপস্থিতির উপলব্ধিই কি তাঁকে দিয়ে অনেকগুলো হাসির নাটক বানানোর পাশাপাশি এলেবেলে নামের দুটি খণ্ডের বই লিখতে উৎসাহিত করেছিল!

সাহিত্যে হিউমার বিষয়ে সচেতন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। শাহরিয়ার কবির এক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘হিউমার সব সময় আপনার প্রিয় বিষয়?’ উত্তরে হুমায়ূন বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ।’ ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বিভূতিভূষণ, শরদিন্দু, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মানিক, অ্যাসিমভ, স্টেইনবেক, মার্ক টোয়েন, চার্লস ডিকেন্স, টমাস হার্ডি, বালজাক, মোপাসাঁসহ ভুবনখ্যাত আরও অনেক লেখকের রচনায় হিউমারের উপস্থিতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘আসলে সেন্স অব হিউমার সব দেশের লেখকদের মধ্যেই আছে। প্রচুর পরিমাণেই আছে। আমাদের এখানে (বাংলাদেশে) এই হিউমার ব্যবহারের প্রবণতাই কম।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘বোধ হয় তারা মনে করে, লেখা হালকা হয়ে যাবে। হয়তো একটা সিরিয়াস কথা বলছি। হয়তো মনে হতে পারে লেখক হিসেবে, হয়তো আপনি মনে করেন যে এর মধ্যে একটা ফালতু কথা দিয়ে লেখাটার ভার বোধ হয় যে একটা উঁচু লেবেলে চলেছিল, সেটাকে নিচে নামিয়ে ফেলা হয় কি না, সেটা অনেকে চিন্তা করতে পারেন। কিন্তু আমার লেখার সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে হিউমার আসে। আমি যে খুব চিন্তাভাবনা করে লিখি, তা কিন্তু না।’ এ কারণে উন্মাদ পত্রিকা থেকে এলেবেলে লেখার অনুরোধ করলে তিনি হেঁয়ালিচ্ছলে বলেছিলেন, ‘আমার সমস্ত লেখাই এলেবেলে। আমি আবার আলাদা করে এলেবেলে কেন লিখব?’ তবু তিনি এলেবেলে লিখেছিলেন। এলেবেলে প্রথম পর্ব বইটির ভূমিকায় একটা বড় দাবি করা হয়েছে, ‘আমরা মনে করি, বাংলা সাহিত্যের রম্যরচনায় এলেবেলেকে স্থান দিতেই হবে। সাময়িক পত্রিকায় হারিয়ে যাওয়ার মতো লেখা এগুলো নয়।’

ঢোকা যাক এলেবেলে দ্বিতীয় পর্ব বইয়ের একটি রচনায়। লেখাটা এক পাগলকে নিয়ে। এক রাজনৈতিক নেতা বক্তৃতা করছেন। হুমায়ূনের ভাষায়, ‘রোগামতো এক নেতা গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন।’ তখনই অঘটনটি ঘটল। এক পাগল অবিকল ওই নেতার মতো হাত-পা নেড়ে নেড়ে আরও জ্বালাময়ী ভাষা-ভঙ্গিতে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে লাগল। ভদ্রলোক অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। ‘বেশ কয়েকবার “হ্যালো, হ্যালো, মাইক্রোফোন টেস্টিং ওয়ান টু থ্রি” বলে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করলেন।’ কিন্তু শ্রোতারা তখন দারুণ আনন্দ আর কৌতূহল নিয়ে শুনছে পাগলের বক্তৃতা। একপর্যায়ে পাগল বস্ত্র সমস্যা নিয়ে কথা বলতে লাগল, ‘বস্ত্র সমস্যার সমাধান করিতে হইবে’ বলে নিজের লুঙ্গি খুলে গামছার মতো করে কাঁধে ফেলে হাসিমুখে তাকাল সবার দিকে। দর্শকেরা তুমুল হাততালি দিয়ে অভিনন্দিত করল। এমন সময় ওই নেতার ইশারায় কিছু লোক পাগলকে ধরে বাইরে নিয়ে গেল। নেতা আবার বক্তৃতা করতে লাগলেন। কিন্তু কেউ আর মনোযোগ দেয় না। একপর্যায়ে তিনি বস্ত্র সমস্যা নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। এবার দর্শক-শ্রোতারা চেঁচাতে লাগলেন, ‘পায়জামা খুইল্যা তারপরে কন। আগে পায়জামা খুইল্যা কান্দে ফেলেন।’ সংলাপের ভাষার এই বাঙালপনা যদি কাউকে জসীমউদ্‌দীনের বাঙ্গালীর হাসির গল্প-এর অকৃত্রিমতার কথা মনে করিয়ে দেয়, তবে অবাক হব না।

রম্যতার বোধ কোনো পড়ে পাওয়া জিনিস নয়। জীবন, মানব মনস্তত্ত্ব আর চারপাশ সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি, পর্যবেক্ষণ ও নিরাসক্তি না থাকলে এগুলো নিয়ে রসিকতা করা যায় না। শুধু গভীর উপলব্ধি, পর্যবেক্ষণ ও নিরাসক্তি থাকলেই হয় না, রম্য লেখকের থাকতে হয় অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিমিতিবোধ। রম্যরচনার পরিমিতিবোধের তুলনা শুধুই রম্যরচনার পরিমিতিবোধের সঙ্গেই হতে পারে। উপন্যাস-গল্পে লেখকের যে সংযম থাকে, তার সঙ্গেও এর তুলনা চলে না। উপন্যাসে বা গল্পে দু-চার লাইনের বা অনুচ্ছেদের বাড়তি বর্ণনা পাঠক হজম করতেও প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু একটি রম্যরচনায় দু-চারটি বাড়তি বাক্য পয়মাল করে দিতে পারে পুরো লেখাটিকে। এখানে লেখককে ঔচিত্যবোধের পরীক্ষা দিতে হয় প্রতিটি বাক্যে। ভাষাকে দুমড়ানো-মোচড়ানো, ভাষার মধ্যে অঙ্গভঙ্গির হুবহু অনুকৃতি ও স্বরপ্রক্ষেপণের বিশেষত্বের কথা না হয় না-ই বললাম। মাত্রাজ্ঞান ছাড়া রম্য বা হিউমার তো ভাবাই যায় না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পঞ্চভূত গ্রন্থের ‘কৌতুকহাস্যের মাত্রা’ প্রবন্ধে বলেছেন, মাত্রাভেদে একই অসংগতি হাস্যজনক না হয়ে দুঃখজনক, বিরক্তিজনক, বিস্ময়জনক, রোষজনকও হয়ে উঠতে পারে। আসলে ‘অসংগতির তার অল্পে অল্পে চড়াইতে চড়াইতে বিস্ময় ক্রমে হাস্যে ...পরিণত হইতে থাকে।’ আমি বলি, গানের আগে গিটারের তার টিউন করার মতো। বেশি টাইট দিলে ছিঁড়ে যাবে, আবার কম টাইট হলে সুরের ঝংকারটা ভালো উঠবে না। ফলে রম্যরচনা এক দুরূহ শিল্পই বটে।

এই দুরূহ শিল্পটাই ছিল হুমায়ূন আহমেদের কাছে সহজ একটি বিষয়। বড় মৃৎশিল্পী যেমন হাতে মাটি পেলেই আনমনে তা টিপে টিপে জীবন্তপ্রায় পুতুল বানিয়ে তুলতে পারেন, হুমায়ূনও তেমনি সরল ভাষায়, আটপৌরে জীবনের অন্ধিসন্ধি থেকে তাল তাল রম্যের সোনা বের করে এনেছেন তাঁর এলেবেলে-এর দুই খণ্ডে।

হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসই মধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে লেখা। এলেবেলে রম্যগ্রন্থ দুটি এর খুব বাইরে যায়নি। কিন্তু এসব রচনা মধ্যবিত্তের মতো খুব বেশি নিরীহ নয়। কারণ এসব রচনায় তিনি ব্যঙ্গের আর বিদ্রূপের চাবুকে অস্থির করে তুলেছেন আমাদেরই চারপাশের অসংগতিগুলোকে। কারণ, ব্যাঁকাত্যাড়া সোজা করার দায় উইট ও হিউমারের জন্মগত অধিকার। ‘আঁতেল মধ্যবিত্ত’, আলগা ফ্যাশনসর্বস্ব ঐতিহ্যপ্রিয় মধ্যবিত্ত, হুজুগে বাঙালি, ডাক্তার, পুলিশ, ‘নিউ জেনারেশন’—কাউকেই তিনি রেহাই দেননি। এ কারণে এলেবেলে শুধু রম্যরচনা নয়, বই দুটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের মানুষের জীবনেরই একটি তির্যক ব্যাকরণ।