দার্জিলিংয়ে গিয়ে যে নারীর খাতায় কবিতা লিখেছিলেন নজরুল

১৯৩১ সালে দার্জিলিংয়ে গিয়েছিলেন নজরুল। গিয়ে দেখা হলো জাহানারা চৌধুরী নামে পূর্বপরিচিত এক গল্পকারের সঙ্গে। তাঁর খাতায় তিনি লিখলেন কবিতা। নজরুলের নরক গুলজারের কাহিনি।

কাজী নজরুল ইসলাম (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬-১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ)
ছবি: সংগৃহীত

নজরুলকে দার্জিলিংয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতার প্রকাশক মনোরঞ্জন চক্রবর্তী। অলিখিত চুক্তি ছিল শৈলশহরটির মনোরম প্রকৃতির সান্নিধ্যে নিবিড়-নির্জনতায় বসে কবি রচনা করবেন হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জীবনীকাব্য মরু ভাস্কর। সেটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের স্বত্ব দেবেন মনোরঞ্জনবাবুকে।

সেটা ১৯৩১ সাল। তারিখ নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে দার্জিলিংয়ে রচিত নজরুলের প্রথম কবিতাটির নিচে যেহেতু কবির নিজের হাতে ‘১৪ জুন’ তারিখটি লেখা আছে, ধারণা করা যায়, এর আগেই তিনি সেখানে পৌঁছেছিলেন।

এ সফর শারীরিক ও মানসিকভাবে কবিকে দারুণ উদ্দীপ্ত করে তুলেছিল। মাত্র এক বছর আগে প্রিয় পুত্র বুলবুলকে হারিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে বাজেয়াপ্ত হয়েছে তাঁর কাব্যগ্রন্থ প্রলয়-শিখা, এদিকে আবার কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়া ও আকস্মিক অব্যাহতির ঘটনাও ঘটে ১৯৩১ সালের মার্চে। সব মিলিয়ে তাঁর মানসিক যে অবস্থা, তার মধ্যে মনোরঞ্জনবাবুর প্রস্তাব যে ‘বরিষ ধরা–মাঝে শান্তির বারি’ হয়ে এসেছিল, তাতে সন্দেহ নেই।

কিন্তু বেচারা মনোরঞ্জন কি জানতেন যে নির্জনতার সন্ধানে কবিকে নিয়ে এতটা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে এলেন তিনি, সেখানে আগেই একটা উত্সবের সম্ভাবনা তৈরি হয়ে আছে! নজরুল এসে পৌঁছানোর দু-এক দিন পর বাকি আয়োজনও যেন সম্পন্ন হলো। শুরু হয়ে গেল উদ্‌যাপন। মনোরঞ্জনবাবুর কপাল পুড়ল!

আসলে নজরুল এসে পৌঁছানোর অব্যবহিত আগে-পরে অনেক বাঙালি কবি-লেখক-শিল্পীর সমাগম হয়েছিল দার্জিলিংয়ে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন ছিলেন দার্জিলিংয়ে। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবী ও মৈত্রেয়ী দেবীদের নিয়ে সপরিবার অবকাশ যাপন করতে এসেছিলেন তিনি।

জাহানারা যখন দার্জিলিংয়ে এসে পৌঁছালেন তাঁর ভাই আলতাফ চৌধুরীর সঙ্গে, তখন নজরুলের কাব্যপ্রবাহ উচ্ছল হয়ে উঠবে সন্দেহ কী, বিশেষত জাহানারা নিজেই যখন একটু প্রগলভ হয়ে দাবি করেন অন্য কোথাও নয়, তাঁর খাতার পাতাতেই লিখে দিতে হবে কবিতা।

একই শহরে দুই কবি আছেন, তাঁদের দেখা-সাক্ষাৎ না হলে হয়! অখিল নিয়োগী, মন্মথ রায়রা নজরুলকে ধরে বললেন, তাঁর নেতৃত্বে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। নজরুলও রাজি। বড় একটা বাহিনী নিয়ে তিনি হাজির হলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথও মহাখুশি নজরুলকে পেয়ে। অখিল নিয়োগী লিখেছেন, ‘সেদিন কবি কৌতুকে আর সরস আলাপনে সরব হয়েছিলেন। বিশেষ করে নজরুলকে কাছে পেয়ে তাঁর আনন্দের সীমা ছিল না।’

‘বর্ষবাণী’ পত্রিকার সম্পাদক, গল্পকার জাহানারা চৌধুরী
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

রবীন্দ্র-নজরুলের এই সাক্ষাৎ নিয়ে পরবর্তীকালে অনেকেই লিখেছেন। এমনকি ‘শনিবারের চিঠি’র মতো ছিদ্রান্বেষী পত্রিকাও তাদের নিজস্ব ঢঙে এই সংবাদ প্রকাশ করেছিল।

নজরুলের আরেক ঘনিষ্ঠজন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র ও তাঁর প্রতিভাময়ী সুন্দরী কন্যা নোটন মৈত্রও এসেছিলেন আগেই। নজরুল প্রতিদিনই চলে যেতেন সুরেন্দ্রনাথসকাশে, উদ্দেশ৵ একটাই, নোটনের পিয়ানোবাদন শোনা। মনোরঞ্জনের মন বিষণ্ন করে দিয়ে নজরুল যখন নাট্যকার মন্মথ রায়, অখিল নিয়োগীসহ আরও কয়েক লেখক-সাহিত্যিক বন্ধুর সঙ্গে দিনরাত হুল্লোড় আর সন্ধ্যার পর গানের আসর জমাচ্ছেন, ঠিক সে সময় খবর এল—‘নাট্য-নিকেতনে’র প্রবোধচন্দ্রগুহ সদলে দার্জিলিংয়ে এসে হাজির। সেই দলে আছেন শিল্পী নীহারবালা। অখিল নিয়োগীর ভাষায়, ‘যাকে বলে নরক একেবারে গুলজার হয়ে উঠল।’

নীহারবালা নজরুলের নাটকে গান গেয়েছিলেন। দার্জিলিংয়ে এসে সেই স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলার সুযোগ পাওয়া গেল। অখিল নিয়োগী বলছেন, ‘আমরা সবাই সুরের সাগরে সাঁতরাতে শুরু করে দিলাম। নীহারবালা থামেন তো, কাজীদা আবার হারমোনিয়াম টেনে নেন, সে যেন একেবারে বাধাবন্ধনহীন গানের ফোয়ারা। ডাবরভর্তি পান, পাশে জর্দার কৌটা, ঘন ঘন চায়ের পেয়ালা আর সেই সঙ্গে সংগীতের সুরধুনী ধারা। দার্জিলিংয়ে নজরুল সাহচর্যে যে আমরা কী আনন্দ পেয়েছি, তা কোনো দিনের তরে ভুলতে পারব না।’

অখিল নিয়োগী যেমন নজরুল সাহচর্যের কথা ভুলতে পারেননি, তেমনি নজরুলও বোধ হয় তাঁর এই আনন্দসফরকে বাকি জীবন ভুলতে পারেননি। কারণ, এ সফরের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল পূর্বপরিচিত জাহানারা চৌধুরীর সঙ্গে। জাহানারা চৌধুরী ছিলেন গল্পকার ও ‘বর্ষবাণী’ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক। উত্তরবঙ্গ ও বিহারের সর্ববৃহৎ মুসলমান জমিদার পরিবারের সন্তান এই জাহানারা। তাঁর রূপ ও গুণ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হয়েছেন সেকালের লেখক-সাহিত্যিকেরা। যেমন প্রবোধকুমার সান্যাল লিখেছেন, ‘এমনি করে একটা সময়ে একটি সাহিত্যোত্সাহী ও সুশ্রী তরুণী লেখকসমাজের মধ্যে কোথা থেকে যেন ছটকিয়ে আসে। মেয়েটির দেহলাবণ্য ও নবীন তারুণ্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ওর মিষ্ট মুখশ্রী মধুর হাসি, ভদ্র ব্যবহার এবং প্রত্যেক লেখক-লেখিকার প্রতি আন্তরিক অনুরাগ—ওকে অল্প কালের মধ্যে সকলের প্রিয় করে তোলে।’

কাজী মোতাহার হোসেনের কন্যা যোবায়দা মির্যা জাহানারা চৌধুরীকে বলেছেন, ‘বিখ্যাত সুন্দরী’, মাহমুদ নুরুল হুদার উচ্ছ্বাস—‘এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলা’, আর বন্দে আলী মিয়ার মতে, ‘জাহানারা অসামান্য রূপবতী’।

এহেন জাহানারা যখন দার্জিলিংয়ে এসে পৌঁছালেন তাঁর ভাই আলতাফ চৌধুরীর সঙ্গে, তখন নজরুলের কাব্যপ্রবাহ উচ্ছল হয়ে উঠবে সন্দেহ কী, বিশেষত জাহানারা নিজেই যখন একটু প্রগলভ হয়ে দাবি করেন অন্য কোথাও নয়, তাঁর খাতার পাতাতেই লিখে দিতে হবে কবিতা।

কাজী নজরুল ইসলাম (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬-১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ)
ছবি: সংগৃহীত

নজরুল এবার গিয়ে উঠলেন জাহানারা ও তাঁর ভাই আলতাফ যে ডাকবাংলোতে উঠেছিলেন সেখানে। জাহানারার ডাক নাম মীরা। ‘মীরাকে, দার্জিলিং’—এটুকু লিখে স্বহস্তে অনেক কবিতা লিখে তাঁর খাতা ভরে দিয়েছিলেন নজরুল। সেসব কবিতা দীর্ঘকাল অপ্রকাশিত, লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। কিন্তু মৃত্যুর কিছুকাল আগে জাহানারার মনে হলো, ‘এত দিন একান্ত ব্যক্তিগত অমূল্য সম্পদের মতোই এগুলো কৃপণের মতো নিজের কাছে বন্ধ করে রেখেছিলাম। এত দিন এগুলি অজ্ঞাত ছিল, আজ তাদের আলোর মাঝে মুক্ত করে দিয়ে প্রকাশ করার সময় এসেছে।’

দেরিতে হলেও এই উপলব্ধির কারণে নজরুলের কিছু অপ্রকাশিত কবিতা এল পাঠকের দরবারে। সব কবিতাই প্রেমের। সুতরাং নজরুলের দার্জিলিং পর্বটাও অনেকটাই উন্মোচিত হলো, যদিও জাহানারা লিখেছেন, ‘এই কবিতাগুলি কারো উদ্দেশে অর্থাৎ কাউকে উদ্দেশ্য করে রচনা করা হয়েছে, সে রকম মনে করলে ভুল হবে।’ শেষ বয়সে এ কথা লিখে হয়তো নিজের দিক থেকে কিছুটা নির্ভার হতে চেয়েছেন জাহানারা। কিন্তু কবির ‘উদ্দেশ্য’ তো শেষ পর্যন্ত খুঁজে বের করবেন তাঁর পাঠক ও গবেষকেরাই।

আগেই বলেছি, মনোরঞ্জনবাবুর কাজ হাসিল হয়নি, মরু-ভাস্কর রচনা সম্পন্ন হয়নি দার্জিলিং সফরে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ, নোটনের পিয়ানোবাদন শোনা, নীহারবালার সঙ্গে গানের মুশায়েরা, সর্বোপরি গানে-কবিতায় জাহানারা চৌধুরীর খাতার পাতা ভরিয়ে তুলে দার্জিলিংয়ে জীবনের অসাধারণ কিছু সময় কাটিয়েছিলেন কবি।

তথ্যঋণ: ‘লেখার রেখায় রইল আড়াল: কাজী নজরুল ইসলামের অপ্রকাশিত কবিতা ও গান’, সম্পাদক: আবদুল মান্নান সৈয়দ, নজরুল ইনস্টিটিউট, ১৯৯৮।