ওলগা তোকারচুকের ইতিহাস দর্শন

ওলগা তোকারচুকছবি: সংগৃহীত

সাহিত্যে ইতিহাসের উপস্থাপনা নতুন কিছু নয়। ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও ঘটনাবলির আলোকে লেখা উপন্যাস গুণগত দিক থেকে কতটা উঁচু মানের হতে পারে, কালজয়ী রুশ লেখক লেভ তলস্তয় তার প্রমাণ রেখে গেছেন ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ উপন্যাসে। রাশিয়াকে পদানত করার লক্ষ্যে নেপোলিয়নের গ্র্যান্ড আর্মির রুশ ভূখণ্ডজুড়ে অগ্রসর হওয়া এবং পুরো ইউরোপকে একত্র করে ফরাসি সেই সমরনায়কের গড়ে তোলা বিশাল সেনাবাহিনীর অপমানজনক পরাজয় উপন্যাসের মূল উপাদান হলেও কাহিনির প্রায় সবটাই আবর্তিত হয়েছে সেই সময়ের রুশ সমাজ, বিশেষত সমাজের যারা নিয়ন্ত্রক, সেই সামন্ত প্রভুদের বিলাসবহুল জীবনের আড়ালে থেকে যাওয়া বিয়োগান্তক কিছু ঘটনাবলির আলোকে। ফলে গল্পের কাঠামোতে ইতিহাস থেকে গেলেও এর বাইরের সবটাই ধরে নেওয়া যায় লেখকের কল্পনার মিশ্রণে গড়া। ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাসের সার্থকতা মনে হয় এখানেই। ইতিহাস গল্পের কাঠামোকে বলিষ্ঠ বন্ধনে ধরে রাখলেও সেটাই সেখানে সবকিছু নয়। বরং ইতিহাসের ওপর ভর করে লেখক কাহিনির বিন্যাস নিজে থেকে গড়ে নেন। আর সেই প্রক্রিয়ায় লেখকের পারদর্শিতা ও গল্প বলার দক্ষতা পাঠকদের আকৃষ্ট করে এবং উপন্যাস হয়ে ওঠে আলোচিত, বহুল পঠিত ও গ্রহণযোগ্য।

প্রায় এক দশক আগে সে রকম একটি উপন্যাস পাঠকদের উপহার দিয়েছেন সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী পোল্যান্ডের ঔপন্যাসিক ওলগা তোকারচুক। পোলিশ ভাষায় ‘কসেইগি ইয়াকুভোবে’ নামের সেই উপন্যাস মূল ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে ২০১৪ সালে, অর্থাৎ লেখিকার নোবেল পুরস্কার লাভের চার বছর আগে। এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ২০২১ সালে তোকারচুকের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার তিন বছর পর। ইংরেজিতে উপন্যাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘বুকস অব জ্যাকব’, যা পোলিশ নামকরণের আক্ষরিক অনুবাদ। লেখিকা এখানে ইতিহাসের সার্বিকভাবে আলোচিত কোনো ঘটনার ওপর আলোকপাত করেননি, বরং পোল্যান্ড ও প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের বাইরে যার পরিচয় একেবারেই জানা নেই, সে রকম এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্বের জীবনের উত্থান-পতনের কাহিনি পাঠকদের সামনে তিনি তুলে ধরেছেন। সেই জীবন একই সঙ্গে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে বসতি গড়া ইহুদি সংখ্যালঘুদের বেঁচে থাকার সংগ্রামের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। পাশাপাশি বাতাসে নড়ে ওঠা ধর্মের কল কীভাবে কারও কারও জন্য বিত্ত আর বৈভব নিয়ে আসার ক্ষেত্রে যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনাও সেখানে আমরা পাই।

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র নিজের গণ্ডির বাইরে খুব বেশি পরিচিত ব্যক্তিত্ব না হওয়ায় তোকারচুকের জন্য ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করা সহজ কাজ ছিল না। সেই কাজ এ কারণে আরও বেশি কঠিন ছিল যে নিজে তিনি ইহুদি ধর্মাবলম্বী নন এবং এর ফলে ইহুদি ধর্মের ভেতরের নানা রকম আচার-আচরণ ও বিষয়াবলি সম্পর্কে জানতে বিস্তৃত গবেষণা করতে হয়েছে তাঁকে। তবে কঠিন সেই দায়িত্ব তিনি কেবল নিষ্ঠার সঙ্গেই পালন করেননি, বরং একই সঙ্গে খুব সহজেই তিনি যে ঘটনার ভেতরে পাঠকদের টেনে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, উপন্যাসের পাঠ তা আমাদের বলে দেয়।

শিল্পীর তুলিতে ইয়াকোভ ফ্রাঙ্ক
ছবি: সংগৃহীত

কাহিনির মূল চরিত্র ইয়াকোভ ফ্রাঙ্ক নামের ধর্মশিক্ষায় দীক্ষিত এক ইহুদি। ইহুদিধর্মের আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে বিবেচিত রাব্বাই তিনি নন। তবে তা সত্ত্বেও অনুসারীদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন দেবতাতুল্য এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর জন্য সবকিছু করতে অনুসারীরা ছিলেন সদা প্রস্তুত। ঘটনার শুরু ১৭৫২ সালের অক্টোবর মাসের এক সকালে, ইয়াকোভ যেদিন উপস্থিত হয়েছিলেন পোল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলের রোহাতিন গ্রামে। তার সেই উপস্থিতি রহস্যঘেরা থেকে গেলেও রোহাতিন থেকে শুরু হওয়া যাত্রা ক্রমান্বয়ে তাকে নিয়ে যায় পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া সংযুক্ত সাম্রাজ্যের বাইরে অস্ট্রো-হাঙ্গেরি ও ওসমানীয় তুরস্কের বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠা ইহুদি জনবসতীগুলোতে। আর এ যাত্রার মধ্য দিয়ে একসময় তিনি হয়ে ওঠেন মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে বসতি গড়া ইহুদিদের একটি উপধারার অনুসারীদের ধর্মীয় নেতা।

ইহুদিধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে ‘তোরা’, বাইবেলের ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর অনেক উপাদান যেখানে আছে। ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রথম পাঁচটি বই তোরার ভিত্তি, যেগুলো শুরু হয়েছে জেনেসিস বা সূচনা পর্ব দিয়ে। এর পরের বইগুলো হলো—এক্সোডাস বা দেশত্যাগ, ঈশ্বরের ডাক, সংখ্যা ও বাক্য। এই পাঁচ গ্রন্থের পাঠে ঈশ্বরের স্বর্গ ও পৃথিবী তৈরি করে নেওয়া এবং ঈশ্বরের পৃথিবীতে ইহুদিদের আবির্ভাব থেকে শুরু করে ফেরাউনের মিসর ছেড়ে তাদের চলে যেতে বাধ্য হওয়া, ধর্মীয় আচার, সিনাই পর্বতে ঈশ্বরের কাছ থেকে মুসা নবীর পাওয়া বিধান, তোরার গঠন এবং মুসা নবীর হাত ধরে ধর্মগ্রন্থের আত্মপ্রকাশ—সেই বিষয়গুলোর সবকিছু অন্তর্ভুক্ত আছে।

তোরাকে নিয়ে ইহুদিধর্মে বিতর্ক তেমন নেই, যেমন আছে তালমুদ বা তোরার ব্যাখ্যা-সংক্রান্ত বর্ণনামূলক গ্রন্থকে ঘিরে। তোরার আবির্ভাব প্রাক্‌-খ্রিষ্ট যুগের মিসরে। তবে ধারণা করা হয়, তোরার বিভিন্ন বর্ণনার ব্যাখ্যা দেওয়া গ্রন্থ এসেছে তৃতীয় থেকে চতুর্থ শতকের মধ্যে সেই সময়ের ধর্মীয় নেতাদের হাত ধরে। ফলে সেই ব্যাখ্যা কতটা মুসা নবীর বর্ণনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে অনেক দিন ধরে। পূর্ব ইউরোপের ইহুদিরাও একসময় সেই বিতর্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে এবং ইয়াকোভ ফ্রাঙ্ক সময়ের বিবর্তনে হয়ে ওঠেন তালমুদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা। ইহুদিদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করার স্বার্থে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার উপদেশও একসময় তিনি অনুসারীদের দিয়েছিলেন।

পূর্ব ইউরোপের ইহুদিরা বসতি গড়ে নেওয়া বিভিন্ন দেশে সব রকম নাগরিক অধিকার থেকে ছিল বঞ্চিত। ফলে কোনো একটি জনবসতিতে স্থায়ীভাবে থিতু হয়ে বসার সুযোগ তাদের সামনে সেভাবে ছিল না। জমির মালিকানা তারা লাভ করতে পারত না। সেই নিষেধাজ্ঞা, এমনকি কিছু দেশে ব্যবসায় জড়িত থাকার মধ্য দিয়ে তাদের বিত্তবান হয়ে ওঠার পরও একই রকম কার্যকর ছিল। উপরন্তু ব্যবসায়ও মূলত ঝটপট সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে দ্রুত অন্যত্র সরে যাওয়ার পথে যা বাধা হয়ে দেখা দেয় না, সে রকম কিছু কাজ ও পেশা তাদের বেছে নিতে হতো। পাগ্রোম বা জাতিগত নিধনের মুখোমুখি হতে হলে ঘরবাড়ি, বিত্তবৈভব—সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া ছিল তাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী। আর সেই অনিশ্চিত অবস্থার মুখে মূল্যবান ধাতু ও পাথর কেনাবেচার ব্যবসায় এদের অনেকে এ কারণে জড়িত হতো যে বিপদ দেখা দিলে প্রাথমিক পুঁজি হিসেবে লগ্নি করা মূল্যবান সেই সম্পদ কাপড়ের থলেতে ভরে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া ছিল জীবন ও সম্পদ রক্ষার অপেক্ষাকৃত সহজ পথ।

ওলগা তোকারচুকের বইয়ের প্রচ্ছদ

ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের ইহুদিদের মোকাবিলা করতে হওয়া সে রকম বঞ্চনার বিরুদ্ধে কথা বলে ইয়াকোভ ফ্রাঙ্ক একসময় প্রভাবশালী একটি ইহুদি গোষ্ঠীর নেতা হয়ে উঠেছিলেন, যে সামাজিক অবস্থান অন্যদিকে আবার তার জন্য খুলে দিয়েছিল বৈভবের দুয়ার। অনুসারীরা নিয়মিত অর্থ প্রদান করা ছাড়াও তাকে এমন এক অবতার হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন, মানবজাতিকে দুর্যোগ থেকে উদ্ধার করে নবী মুসার পথে আবারও ফিরিয়ে নিয়ে যেতে যার আবির্ভাব। তবে ইয়াকোভ ফ্রাঙ্ককে ঘিরে অনুসারীদের সেই ব্যাখ্যা অন্যদিকে আবার পূর্ব ইউরোপের ইহুদিদের মধ্যে বিভক্তির জন্ম দেয় এবং তালমুদ অনুসরণ করা সনাতন ইহুদিরা হয়ে ওঠে নতুন এই ধারার সবচেয়ে কঠোর সমালোচক। সনাতনপন্থীদের যোগসাজশে পোল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ একসময় ইয়াকোভকে কারারুদ্ধ করে চেস্তাকোভার ক্যাথলিক মঠে আটক রেখেছিল। পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়াজুড়ে তখন চলছিল সামন্ত অধিকর্তাদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, যে সুযোগ গ্রহণ করে রাশিয়া পুরো ভূখণ্ড দখল করে নিলে রুশ সমরনায়ক বিবিকোভ ইয়াকোভকে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে তুরস্কের ভূখণ্ডে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তুরস্কে আশ্রয় নেওয়ায় সনাতন ইহুদিদের হামলার হাত থেকে ইয়াকোভ ও তাঁর অনুসারীরা রক্ষা পেলেও বেশি দিন সেখানে থাকা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ইয়াকোভ সেখানে একসময় তিনটি প্রধান ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে তোলা নতুন এক পথের নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

তবে শেষ পর্যন্ত অবশ্য ইয়াকোভকে তুরস্ক ছেড়েও চলে যেতে হয়। তিনি আশ্রয় খুঁজে পান অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী ভিয়েনায়, সম্রাজ্ঞী মারিয়া তেরেসার পৃষ্ঠপোষকতা যেখানে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল ক্ষমতার কাছাকাছি। অনুসারীদের জোগানো অর্থে বৈভবের জীবন ইয়াকোভ নিজের জন্য গড়ে নিয়েছিলেন। বিত্তের পথ ধরে ব্যভিচার ও স্খলন তখন হয়ে উঠেছিল ইয়াকোভ ও তাঁর অনুসারীদের নিত্যদিনের সঙ্গী। বিলাসবহুল সেই জীবন চলমান রাখতে ঋণের ভারে ইয়াকোভ একসময় জর্জরিত হয়ে পড়েন। ঋণের বোঝা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকায় ভিয়েনা থেকে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রুশিয়ার ওফেনবাখ শহরে। ১৭৯১ সালের ডিসেম্বরে সেই ওফেনবাখ শহরে ইয়াকোভের মৃত্যু হলেও পরবর্তীকালে কন্যা এভা ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতৃত্ব ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন।

মূলত মোটাদাগে গল্পের এ রকম কাঠামোর ভেতরে উঠে এসেছে আরও অনেক কাহিনি ও নানা চরিত্র, লেখিকার গল্প বলার দক্ষতার গুণে যার অধিকাংশ হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য ও আকর্ষণীয়। ৯৬০ পৃষ্ঠার বিশাল সেই উপন্যাসে নানা ধরনের চরিত্রের দেখা মেলে, যার কোনো কোনোটির দেখা বইয়ে পাওয়া যায় দীর্ঘ বিরতির পর, কোনোটি হয়তো ছড়িয়ে দেয় জাদুর মায়াবী ছোঁয়া। সেই দ্বিতীয় দলের একটি চরিত্র হচ্ছে ইয়ান্তে, মারা যাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকেও যার মৃত্যু হয় না। অনেকটা ভাসমান অবস্থায় থাকার মধ্য দিয়েই তিনি যেন দেখতে পান কী ঘটে চলেছে চারপাশের পরিচিত সমাজে।

শিল্পীর কল্পনায় মৃত্যুশয্যায় ইয়াকোভ ফ্রাঙ্ক

উপন্যাস লিখতে গিয়ে উপন্যাসের পরিচিত গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেননি ওলগা তোকারচুক। ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরার প্রক্রিয়ায় তিনি কেবল সেই সময়ের বিভিন্ন লেখার উদ্ধৃতিই টেনে আনেননি, একই সঙ্গে ব্যবহার করেছেন ইয়াকোভের সমকালীন সময়ে আঁকা বিভিন্ন স্কেচ ও লিথোগ্রাফ, যেগুলোর মধ্যে ইয়াকোভের দেখাও আমরা পাই। বইয়ের শেষ দিকে যুক্ত একটি স্কেচে দেখা যায় অনেকটা রাজকীয় পরিবেশে মৃত্যুশয্যায় শায়িত ইয়াকোভ ফ্রাঙ্ককে। ওলগা তোকারচুক ইয়াকোভের জীবনের বিতর্কিত নানা রকম দিকের বর্ণনা তুলে ধরলেও তিনি যে তাঁর সেই জীবনকে কেবলই নেতিবাচক অবস্থান থেকে দেখেছেন, তা অবশ্য বলা যায় না। বরং সহানুভুতির পাল্লা সেখানে মনে হয় অনেক বেশি ভারী, হয়তো এ কারণে যে পূর্ব ইউরোপের বিস্তৃত পরিসরে বসতি গড়ে তোলা ইহুদিদের মোকাবিলা করতে হওয়া লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার ইতিহাসকে ইয়াকোভ ফ্রাঙ্কের জীবনের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পাঠকদের সামনে তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন।

ওলগা তোকারচুকের উপন্যাস পোলিশ ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার পর এর প্রথম বিদেশি অনুবাদ প্রকাশিত হয় হিব্রু ভাষায়। ইসরায়েলে প্রকাশিত সেই অনুবাদ এ কারণে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইসরায়েলের ইহুদি জনগোষ্ঠীর পূর্ব ইউরোপীয় বংশোদ্ভূতদের মধ্যে এটা নিয়ে প্রচুর উৎসাহ এখনো বিরাজমান।

বইয়ের আরেকটি যে ব্যতিক্রমী দিক পাঠকদের অবাক করে দেয়, তা হলো এর পৃষ্ঠাসংখ্যার গণনা। বই শুরু হয়েছে ৯৬৮ পৃষ্ঠা থেকে এবং এর সমাপ্তি ১ পৃষ্ঠায় এসে। কোনো এক সাক্ষাৎকারে লেখিকাকে কেন তিনি তা করেছেন, এমন প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তোকারচুক বলেছিলেন, পূর্ব ইউরোপজুড়ে তালমুদের যে পাঠের দেখা মেলে সেখানেও পৃষ্ঠাসংখ্যার বিন্যাস ঠিক সেইভাবে দেখা যায়। ফলে তালমুদকে নিয়ে দেখা দেওয়া বিতর্কের ওপর ভিত্তি করে লেখা উপন্যাসে সেই একই স্টাইল তিনি বজায় রাখতে চেয়েছেন বলেই উল্টো দিক থেকে পৃষ্ঠার গণনা তিনি বেছে নেন।

উপন্যাস খুবই আকর্ষণীয় ও সুখপাঠ্য হলেও পূর্ব ও দক্ষিণ ইউরোপের মধ্যযুগের শেষ দিকের ইতিহাস এবং সেখানকার ইহুদি জনগোষ্ঠীর জীবনসংগ্রামের দিকগুলো যাঁদের জানা নেই, সে রকম পাঠকের কাছে দীর্ঘ সেই উপন্যাস বিরক্তিকর এবং ভারী হয়ে দেখা দিতে পারে। তবে এসব বিষয়ে সামান্য হলেও যাঁরা অবগত, ইয়াকোভ ফ্রাঙ্কের জীবনের মধ্য দিয়ে সেই সময়ের বর্ণনা মনে হয় তাঁদের সহজেই আকৃষ্ট করতে সক্ষম। ফলে বইয়ের আকার দেখে ভীত না হয়ে এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে পাঠক কেবল পরিতৃপ্তই হবেন না, সেই সঙ্গে জ্ঞানের নতুন দুয়ারও পাঠকের সামনে খুলে যাবে। সেখানেই হয়তো আছে সেই উপন্যাসের সার্থকতা।