চঞ্চল চৌধুরী কেন অন্যদের চেয়ে আলাদা?

অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর আজ জন্মদিন। সম্প্রতি বেশ কিছু ভিন্নধর্মী চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের আবিষ্ট করেছেন তিনি। জনসংস্কৃতির মধ্যেও একটা জায়গা তৈরি হয়েছে তাঁর। কেন এবং কীভাবে অন্যদের চেয়ে আলাদা হলেন এই অভিনয়শিল্পী, তাঁর জন্মদিনে সেই বিশ্লেষণ।

চঞ্চল চৌধুরীছবি: সংগৃহীত

নায়ক হওয়া যতটা সহজ, অভিনেতা হওয়া ততটা সহজ নয়। আমাদের প্রতিদিনের হাজারো অভিজ্ঞতাকে রুপালি পর্দায় জীবন্ত করে তোলা, তার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করার মতো সূক্ষ্ম কাজটাই একজন অভিনেতার ‘ম্যামথ টাস্ক’। পরিচিত আবেগ, অনুভূতি, ব্যক্তিত্ব, প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শরীরী ভাষাকেই আমরা শিল্পমাধ্যমে নিজের হাতের রেখার মতো খুঁজে ফিরি। দর্শকেরা তাই পর্দায় সব সময় এমন কাউকে চান, যিনি তাঁদের নিয়ে, তাঁদের মতো করে কিছু সুখ-দুঃখের গল্প বলবেন, হাসাবেন, কাঁদাবেন। অভিনয়শিল্পী হয়তো খুব নায়কোচিত কেউ হবেন না, বরং তিনি হয়ে উঠবেন খুব কাছের, ‘আ কমন ম্যান’। এই ‘কমন ম্যান’ আদলের জন্যই চঞ্চল চৌধুরী বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষের এত ভালোবাসা পেয়েছেন। সময়ের ব্যবধানে এই অভিনেতা হয়ে উঠেছেন সাধারণ থেকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী—সব ধরনের দর্শকের ভালো লাগা আর ভালোবাসার প্রতিরূপ। তাঁর সহজাত সাবলীল অভিনয়ে দর্শকেরা বুঝতেই পারেন না, একজন অভিনেতা কীভাবে একই সঙ্গে ‘হাওয়া’ সিনেমার চান মাঝির মতো খল চরিত্রে ঠা ঠা করে হাসতে পারেন, ভয়ের সঞ্চার করতে পারেন, আবার ওয়েব সিরিজ ‘কারাগার’–এ বসে যাওয়া গাঢ় লাল চোখ, চটে মোড়ানো পোশাকে শরীর ঢেকে শুধু ইশারায় করে যান মূক কয়েদির অভিনয়।

যেকোনো দর্শককে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কোন ধরনের চরিত্র তিনি পর্দায় দেখতে ভালোবাসেন, নিঃসন্দেহে চলে আসবে বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রের কথা। থিয়েটারের প্রাণপুরুষ স্তানিস্লাভস্কির মতে, যেকোনো পরিস্থিতিতে একটা চরিত্রের মতো ব্যবহার করতে অভিনেতার প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট অনুপ্রেরণার। অভিজ্ঞতার ঝুলি হাতড়ে এমন একটা কিছু ওই অভিনেতাকে খুঁজে বের করতে হবে, যা তাঁকে ওই পরিস্থিতিতে চরিত্রের আবেগ প্রকাশে সাহায্য করবে। ‘মেথড অ্যাক্টিং’–এর জাদুর কাঠিতে এভাবেই একেকটা চরিত্র বাস্তবানুগ হয়ে ওঠে। এই মেথড অ্যাক্টিংয়ে বাস্তবের সঙ্গে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ফারাক না রাখার জন্যই অভিনয়শিল্পীকে তৈরি করতে হয় বিশ্বাসযোগ্যতা। চঞ্চল চৌধুরী সেই বাস্তবের কোলঘেঁষা চরিত্রে প্রাণ দিতেই প্রথমে নিজের মনে তৈরি করে নেন চরিত্রটির ইমেজ। অর্থাৎ কোনো চরিত্রে অভিনয়ের আগে সেই চরিত্রের সাপেক্ষে তিনি একটি ‘মেক বিলিভ’ তৈরি করেন। চরিত্রটি বুঝতে চেষ্টা করেন। এ জন্যই বোধ হয় এক চঞ্চলই যখন ভয়ংকর চান মাঝি অথবা মূক কয়েদির চরিত্রে অভিনয় করেন, তখন আমাদের কাছে তা এমনই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে যে মনে হয়, এই অভিনেতা বুঝি দুই ভিন্ন মানুষ।

মনপুরা সিনেমায় এভাবেই পর্দায় এসেছিলেন চঞ্চল
ছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘ সময় ধরে মঞ্চে অভিনয় করেছেন চঞ্চল চৌধুরী। নাট্যদল আরণ্যকে শুরু হয়েছিল তাঁর অভিনয়জীবন। নিজের দীর্ঘ ক্যারিয়ারে ক্রমাগত নিজেকে ভাঙছেন চঞ্চল। একটা চরিত্র থেকে আরেকটা চরিত্রে রূপায়ণে যে পার্থক্য থাকে, যে চরিত্র লেখা হয়, অভিনয়ের মাধ্যমে তার আরেকটি বৈচিত্র্য দিতে তিনি সিদ্ধহস্ত। অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি চরিত্রে তিনি নতুন মাত্রা খোঁজার চেষ্টা করেন। তাঁর এই বহুমাত্রিক অভিনয়ের কারণেই হয়তো দর্শককে তিনি আকর্ষণ করতে পেরেছেন। জনসংস্কৃতির মধ্যে জায়গা করে নিতে পেরেছেন।

অভিনয়ে তিনি যেমন বৈচিত্র্যময় বা ‘কালারফুল’, বাস্তব জীবনে তার বিপরীত বলেই মনে হয়। হ্যাঁ, ব্যক্তিমানুষ হিসেবে চঞ্চল চৌধুরীর চালচলন বেশ সাদামাটাই। অভিনেতা–অভিনেত্রীদের নিয়ে অবিরত নানা রকম যেসব বিতর্ক চলে এবং যেসব গালগল্প চাউর হয়, চঞ্চল এসব থেকে দূরে। এটাই হয়তো তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছে।

আবার গল্প বিচারেও চঞ্চল খুব নিষ্ঠাবান। ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময়ে হয়তো এমন অনেক নাটক করেছেন, যা সাধারণ দর্শকের মনঃপূত হয়নি। কিন্তু ছোট পর্দা থেকে বড় পর্দায় যখনই তিনি এসেছেন, গল্প আর চরিত্রের প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন দারুণভাবে। ‘মনপুরা’ সিনেমার সোনাই, ‘মনের মানুষ’–এর কালুয়া বা ‘আয়নাবাজি’র আয়না—একটার থেকে আরেকটা ভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের মুনশিয়ানাই তাঁকে আলাদা করে দেয়।

‘হাওয়া’ সিনেমায় চান মাঝি চরিত্রে অন্য রূপে পাওয়া যায় চঞ্চলকে
ছবি: সংগৃহীত

আসলে চঞ্চল বুঝেশুনেই চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলো বাছাই করেন। এতে করে দিনে দিনে তাঁর প্রতি দর্শকের একটা আস্থা ও বিশ্বস্ততাও তৈরি হয়েছে। অভিনীত চরিত্রটি যত বড় বা যত ছোটই হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে তাঁর সর্বোচ্চ অভিনয়ের প্রতিফলন আমরা পর্দায় দেখতে পাই। আর বলা বাহুল্য, একের পর এক ব্যতিক্রমী চরিত্রে অভিনয় করেই চঞ্চল চৌধুরী এ প্রজন্মের দর্শকের হৃদয়ের কাছাকাছি এসেছেন।

সম্প্রতিককালে ওটিটির উত্থান ও জনপ্রিয়তার প্রেক্ষাপটে চঞ্চল চৌধুরীর নতুন নতুন অবতারকে আমরা প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করছি। কখনো তিনি কয়েদি নম্বর ১৪৫, কখনো বা ‘ঊনলৌকিক’–এর মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, আবার কখনো ঢাকা শহরের ত্রাস ব্ল্যাক রঞ্জু। সব চরিত্রেই যেন খাপে খাপ মিলে যাচ্ছেন তিনি। কীভাবে এটি ঘটছে?
ঘটছে এভাবে যে অভিনীত চরিত্রগুলোর সঙ্গে চঞ্চল বসবাস করছেন। ওটিটিতে যখন তিনি একটি চরিত্রে অভিনয় করছেন, তখন এর বাইরে অন্য কোনো অভিনয়ে সেভাবে তাঁকে দেখা যাচ্ছে না।

গেল বছরের ১৮ আগস্ট রাতে মুক্তি পায় ওয়েব সিরিজ ‘কারাগার–পার্ট ওয়ান। এখানে চঞ্চল চৌধুরীকে দেখা গেল নতুন রূপে

অভিনয়ে তিনি যেমন বৈচিত্র্যময় বা ‘কালারফুল’, বাস্তব জীবনে তার বিপরীত বলেই মনে হয়। হ্যাঁ, ব্যক্তিমানুষ হিসেবে চঞ্চল চৌধুরীর চালচলন বেশ সাদামাটাই। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে অবিরত নানা রকম যেসব বিতর্ক চলে এবং যেসব গালগল্প চাউর হয়, চঞ্চল এসব থেকে দূরে। এটাই হয়তো তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছে।

অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দর্শকের সঙ্গে তিনি বেশ সাবলীল। বলা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দর্শকের সঙ্গে তাঁর মিথস্ক্রিয়া ভালো। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে আমরা যখন তারকাদের ঘরোয়া পরিবেশের খবরও জানতে পারি, সেখানে চঞ্চল চৌধুরীর ছেলের বই সেলাই করে দেওয়ার মতো দৃশ্য অভিনয়ের বাইরে গিয়ে তাঁকে আমাদের আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে।

চঞ্চল চৌধুরীর কাজের জন্য এখন মুখিয়ে থাকেন অনেক দর্শক। কারণ, তাঁরা জানেন যে এই অভিনেতা তাঁদের নির্দিষ্ট কিছু চরিত্রের মধ্যে বন্দী না রেখে ক্রমাগত নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। পানি যেমন যে পাত্রে রাখা হয়, সেই পাত্রের আকার ধারণ করে, অভিনয়ে চঞ্চলও যেন তা–ই। ভিন্ন ভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে এবং নিজের সহজ–সাবলীল ব্যক্তিত্ব দিয়েই আমাদের তিনি মুগ্ধ করে চলেছেন। জন্মদিনে এ অভিনেতার প্রতি ভালোবাসা।