সাহিত্য প্রসঙ্গে বিশ শতকের দুই ভাবুকের নানা সিদ্ধান্ত

আর্নল্ড টয়েনবি ও দাইসাকু ইকেদা। গ্রাফিকস: প্রথম আলো

আর্নল্ড টয়েনবি ও দাইসাকু ইকেদা বিশ শতকের দুজন বিশিষ্ট মনীষী, চিন্তাবিদ ও ভাবুক। ভৌগোলিক পরিচয়ের দিক থেকে টয়েনবি পশ্চিমের দুনিয়ার আর ইকেদা পূর্ব এশিয়ার। টয়েনবির মূল পরিচয় ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক এবং ইকেদা বৌদ্ধ চিন্তাবিদ, শান্তিপ্রবক্তা ও লেখক। পরিচয়গত নানাবিধ পার্থক্য সত্ত্বেও দুজনের চিন্তা, কর্ম ও জীবনদর্শনের মিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়।

টয়েনবি ও ইকেদা দুজনেই ছিলেন জ্ঞানপিপাসু, ইতিহাসসচেতন, মানবতাবাদী, যুদ্ধবিরোধী ও বিশ্বমৈত্রীর দূত। নিজেদের লব্ধজ্ঞান ও মনীষার মাধ্যমে তাঁরা জীবনভর মানবিক মূল্যবোধ, অহিংসা, সহনশীলতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের উদ্বোধন ঘটিয়ে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন। বিগত শতকের শেষার্ধে এই দুই মনীষীর মধ্যকার বৈঠক ও সংলাপ ছিল জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতের সবচেয়ে বড় ঘটনা। টয়েনবির আমন্ত্রণে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সালে দুজনের মধ্যে একাধিক দীর্ঘ বৈঠক ও আলাপচারিতা হয় লন্ডনে টয়েনবির বাসভবনে। এতে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল সভ্যতার উত্থান-পতন, বিশ্বযুদ্ধ ও শান্তিসংকট, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন, মানবতার ভবিষ্যৎ, পূর্ব ও পশ্চিমের দর্শনের মেলবন্ধন; ধর্ম, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ; শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মানবপ্রগতি প্রভৃতি। আলাপচারিতায় দুজনের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও যে ঐকমত্য দেখা যায়, তা ছিল বিস্ময়কর।

তখন পর্যন্ত সারা দুনিয়ায় চলমান রয়েছে পশ্চিমের নেতৃত্ব। আলাপচারিতায় টয়েনবি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ভবিষ্যৎ পৃথিবীর নেতৃত্বের ব্যাপারে। ইঙ্গিতটা ছিল এমন—পূর্ব এশিয়া অচিরেই পশ্চিমের কাছ থেকে নেতৃত্ব গ্রহণ করবে। এমন প্রত্যাশার কারণও তিনি তুলে ধরেছিলেন। অন্যদিকে ইকেদার সঙ্গে টয়েনবি সহমত পোষণ করেছিলেন যে নতুন শতাব্দীতে মানবজাতি রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে ঐকমত্যে পৌঁছাবে। অবশ্য ভবিষ্যৎ পৃথিবী নিয়ে টয়েনবির তুলনায় ইকেদা বেশি আশাবাদী ছিলেন। তিনি ধারণা করতেন, মানবজাতির মধ্যে এই পরিবর্তন আসবে নিজেদের সম্মিলিত উদ্যোগে ও স্বেচ্ছায়। আর এই পরিবর্তন হবে সমতার ভিত্তিতে, কারও ওপরে জোরজবরদস্তি ছাড়াই। টয়েনবিও এমন পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেননি, তবে তাঁর কথা ছিল এই পরিবর্তনের জন্য মানবজাতিকে উচ্চ মূল্যও দিতে হবে। দুই চিন্তাবিদের এমন ভাবনা ও ফারাকের পেছনের কারণকে তাঁদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন ইতিহাসবিদেরা। একইভাবে সাহিত্য ও শিল্প বিষয়েও টয়েনবি ও ইকেদার স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ও ঐকমত্য দেখা গেছে আলাপচারিতায়, যা পরবর্তীকালে লেখক, শিল্পী ও চিন্তাবিদদের বেশ প্রভাবিত করেছিল।

আর্নল্ড টয়েনবি ও দাইসাকু ইকেদা বিশ শতকের দুজন বিশিষ্ট মনীষী, চিন্তাবিদ ও ভাবুক। ভৌগোলিক পরিচয়ের দিক থেকে টয়েনবি পশ্চিমের দুনিয়ার আর ইকেদা পূর্ব এশিয়ার। টয়েনবির মূল পরিচয় ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক এবং ইকেদা বৌদ্ধ চিন্তাবিদ, শান্তিপ্রবক্তা ও লেখক।

আলাপচারিতায় মানবজীবনে সাহিত্যের প্রভাব প্রসঙ্গ তুলেছিলেন ইকেদা। সাহিত্যের ভূমিকা নিয়ে ইকেদা বেশ প্রভাবিত ছিলেন জাঁ পল সার্ত্র দ্বারা। সার্ত্রের জিজ্ঞাস্য প্রসঙ্গেই তাঁর আলোচনার সূত্রপাত যে ভুখা-নাঙ্গা মানুষের জন্য সাহিত্যের দায় কী? ইকেদা দেখেছেন সাহিত্যশিল্পে সামাজিক দায় স্বীকার করে কিছু লেখক সৃষ্টিশীল কাজে নিযুক্ত, অনেকে আবার এই ধরনের দায়কে উপক্ষো করে শুধু শিল্পসৃষ্টিতে মশগুল রয়েছেন। তাঁদের ধারণা, শিল্পসৃষ্টি ছাড়া সাহিত্যের দ্বিতীয় কোনো দায় নেই। টয়েনবি ইকেদার প্রসঙ্গকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে সাহিত্যসৃষ্টির সঙ্গে বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতিতুলনা করেন। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক গবেষণাই-বা ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য কী মঙ্গল বয়ে আনে? টয়েনবির নিজের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন জোটানো যদি গবেষণার প্রধান লক্ষ্য হয় আর সে লক্ষ্য অর্জনে যদি গবেষণাকর্মের ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে বৈজ্ঞানিক গবেষণাও নিরন্ন মানুষের দাবি মেটাতে ব্যর্থ হয়—আদতে কোনো কাজে লাগে না। টয়েনবির কথা তাই সীমিত উদ্দেশ্যে কর্মে আত্মনিয়োগ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পথে পঙ্গুত্ব বই নয়। তাই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তখনই সম্ভব হয়ে ওঠে, যখন মননশীল কৌতূহল মেটানোর জন্য গবেষণাকর্মটি হাতে নেওয়া হয়। পৃথিবীর প্রায় সব আবিষ্কার সাধিত হয়েছে উপযোগ কিংবা উদ্দেশ্য ছাড়াই—অবশ্য পরে তা মানবকল্যাণে ব্যবহৃত হয়েছে। বিজ্ঞানের এই আপাতবিরোধী সত্যকে সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য বলে টয়েনবির দাবি।

প্রসঙ্গক্রমে টয়েনবি টেনে এনেছেন লিও তলস্তয়কে। উনিশ শতকের খ্যাতিমান এই রুশ কথাসাহিত্যিকের প্রভাব ছিল দুনিয়াব্যাপী। বিশেষ করে তাঁর সাহিত্যকর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন পৃথিবীর ধনী ও ক্ষমতাশালীদের একটা বড় অংশ। যাঁরা মনুষ্যত্বের দায় কাঁধে নিয়ে নিরন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ানোসহ নানা সামাজিক সংস্কারে এগিয়ে এসেছিলেন। টয়েনবি দেখিয়েছেন, তলস্তয়ের সৃষ্টির দুটি পর্যায়ের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের রচনা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও শিল্পসৃষ্টির তাগিদে; আর দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনা ছিল সামাজিক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে রচিত। প্রথম পর্যায়ের রচনাগুলোর শিল্পমান যেমন উঁচুস্তরের ছিল, সামাজিক দিক থেকেও ছিল আধিপত্যবিস্তারী। সেই তুলনায় সামাজিক দায়িত্ব নিয়ে কিংবা সমাজসংস্কারের উদ্দেশ্যে লেখা দ্বিতীয় পর্যায়ের রচনায় যেমন সাহিত্যমূল্য শিথিল ছিল, তেমনি সামাজিক উপযোগ মেটাতেও ততটা প্রভাববিস্তারী ছিল না। প্রথম পর্যায়ের রচনার এমন প্রভাবের জন্য টয়েনবি শিল্পগুণকেই কৃতিত্ব দিয়েছেন।

তবে টয়েনবি এটাও উল্লেখ করতে ভোলেননি যে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট সরকার যে তলস্তয়কে গ্রহণ করেছিল, তিনি সাহিত্যশিল্প নিয়ে মতাদর্শ পরিবর্তনকারী দ্বিতীয় পর্যায়ের তলস্তয়। শিল্পসাহিত্যের ব্যাপারে কমিউনিস্টদের মতাদর্শ হচ্ছে এর সামাজিক উপযোগ। অবশ্য ‘সামাজিক কল্যাণ’ ধরনের উপযোগ তলস্তয়ের মতাদর্শের চেয়েও সংকীর্ণ বলে উল্লেখ করেন টয়েনবি। কারণ, কমউনিস্টদের সামাজিক কল্যাণের অর্থ হচ্ছে সাম্যবাদী আদর্শ এবং কমিউনিস্ট সরকারের প্রসার। তাই টয়েনবির পর্যবেক্ষণে এমন সাহিত্যের ফলাফল হচ্ছে শিল্পসৃষ্টি ও সামাজিক প্রভাবের দারুণ অবনতি। তাই কমিউনিস্ট আদর্শে লিখিত তৎকালীন সাহিত্যকে তিনি নিষ্প্রভ ও অকার্যকর বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে কমিউনিস্ট সরকার শিল্পসৃষ্টির অভিপ্রায়ে রচিত তৎকালীন সাহিত্যকে শুধু নিরুৎসাহিত করত না, বরং পার্টির নীতিবহির্ভূত সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকদের নির্যাতন করতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। সোভিয়েত সরকারের শিল্পসাহিত্য-সংক্রান্ত নীতির ব্যাপারে টয়েনবির পর্যবেক্ষণের সঙ্গে ইকেদা সহমত পোষণ করে ঔপন্যাসিক আলেকজান্ডার সোলঝেনিৎসিনের প্রসঙ্গটি টেনে আনেন। রচনা নিষিদ্ধসহ জেল-জুলুম, রাজনৈতিক দমনপীড়ন; এমনকি দেশ থেকে বহিষ্কার পর্যন্ত সোলঝেনিৎসিনকে সইতে হয়েছিল। ইকেদা সোলঝেনিৎসিনের এই পরিণতিকে শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ওপর সরকারি নীতির বলপ্রয়োগের পরাকাষ্ঠা বলে অভিমত দেন।

বিগত শতকের শেষার্ধে এই দুই মনীষীর মধ্যকার বৈঠক ও সংলাপ ছিল জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতের সবচেয়ে বড় ঘটনা। টয়েনবির আমন্ত্রণে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সালে দুজনের মধ্যে একাধিক দীর্ঘ বৈঠক ও আলাপচারিতা হয় লন্ডনে টয়েনবির বাসভবনে। আলাপচারিতায় দুজনের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও যে ঐকমত্য দেখা যায়, তা ছিল বিস্ময়কর।

এ প্রসঙ্গে টয়েনবির আরও মত যে বিপ্লব-পূর্ব সাম্রাজ্যবাদী জার সরকারও সাহিত্যিকদের স্বাধীনতা পছন্দ করত না; বরং লেখকদের স্বাধীনতায় সরকারপক্ষ আতঙ্কিত থাকত। তারপরও জার সরকার লেখকদের উৎপীড়নের নীতি গ্রহণ করেনি, কারণ তারা জানত এতে হিতে বিপরীত হবে। অন্যদিকে লেখকদের সৃজনী প্রেরণার প্রকাশস্বরূপ রচিত সাহিত্যের প্রভাবকে টয়েনবি ‘রাশিয়ার সাহিত্য-ইতিহাসের শিক্ষা’ বলে গণ্য করেছেন। বিষয়টাকে আপাতবিরোধী স্বীকার করে সৃজনী প্রেরণাকে মানুষের অধ্যাত্মজীবনের উৎসজাত বলে দাবি তাঁর।

ইকেদারও ওই একই কথা যে শিল্পীকেও বিজ্ঞানীর মতো আধ্যাত্মিকভাবে স্বাধীন হতে হয়। সামাজিক দায় লেখকের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে বরং তাঁর রচনা সাহিত্য পদবাচ্য না–ও হতে পারে। সেদিক থেকে সৃজনশীল প্রতিভাজাত স্বতঃস্ফূর্তভাবে রচিত সাহিত্য ভুখা-নাঙ্গা মানুষের জন্য কাজের কাজ করতে পারে। প্রসঙ্গত, ইকেদা রাজনৈতিক শাসনের সঙ্গে সাহিত্যশিল্পের বিচার-বিশ্লেষণের অবতারণা করে মার্ক্সবাদী কিংবা খ্রিষ্টবাদী সাহিত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে দেখান যে বিপ্লবোত্তর অর্ধশতকেও ফিওদর দস্তয়েভস্কির রচনার সমান উঁচু মানের সাহিত্য রাশিয়ায় রচিত হয়নি।

১৯৭৩ সালের লন্ডন বৈঠকে দাইসাকো ইকেদা (বামে) ও আর্নল্ড টয়েনবি
ছবি: সংগৃহীত

লেখকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করার পেছনে টয়েনবি অন্য কারণও দেখিয়েছেন। প্রথম যে কারণ তা হলো ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক মতাদর্শকে অন্ধভাবে জিইয়ে রাখা; আর দ্বিতীয়টি, নৈতিকতার খড়্গকে শাণিত রাখা। ধর্মীয় কারণে সাহিত্যের ওপর যে ‘সেন্সর’ জারি থাকে, তাতে সাহিত্যশিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়ে বলে টয়েনবির দাবি; আর নীতিগতভাবে এর বিপক্ষে তাঁর অবস্থান। মতাদর্শগত সেন্সরের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ কিংবা যাজকীয় কর্তৃপক্ষ সহজেই চিন্তা ও অনুভূতি প্রকাশে সেন্সর আরোপ করতে পারে। নৈতিক মান রক্ষার জন্য যে সেন্সর, তা লেখকদের জন্য আরও কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, কোন বিষয়টি নৈতিক আর কোনটি তা নয়, তাতে সবার মতামত সমান না–ও হতে পারে। সেন্সরের ব্যাপারে টয়েনবির শেষ কথা, সাহিত্যশিল্পে বাধানিষেধ সব সময়ে হিতে বিপরীত কাজ করে। তাই এসব তুলে দেওয়া উচিত।

ইকেদাও সাহিত্যকে সমাজের দর্পণ উল্লেখ করে সমকালীন সাহিত্যের প্রবণতার প্রসঙ্গ টানেন। বিশ শতকের বহুবিধ মূল্যবোধের যুগচিত্তের প্রতিফলন হিসেবে সাহিত্যে যে অশ্লীলতার প্রকাশ—একে তিনি পরিবর্তনশীল দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষ দিক হিসেবে উল্লেখ করেন। ইকেদার ধারণা, এ ধরনের সাহিত্যবস্তুর আকর্ষণ ক্ষণস্থায়ী, সময়ান্তরে তা উবে যেতে বাধ্য। তবে ‘অশ্লীল সাহিত্য’ যাতে তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে না পারে, সে বিষয়ে সবার সজাগ দৃষ্টি রাখার কথাও বলেন। সাহিত্যশিল্পে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা সুরক্ষায় সেন্সরের ব্যাপারে কঠোর মনোভাবের বিপরীতে টয়েনবির মতো ইকেদারও কথা হলো, লেখকের বাক্‌স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা অনুচিত। অভিজ্ঞতা থেকে ইকেদা দেখেছেন সেন্সর একবার চালু হয়ে গেলে তা একসময় সর্ব ক্ষেত্রে বিস্তারমান হতেই থাকে।

টয়েনবি মনে করেন, কোনো কর্তৃপক্ষের নৈতিক অধিকার নেই অপরাপর ধর্ম, দর্শন বা মতাদর্শকে দমন করার। দমন–পীড়নের পরিবেশে ভিন্নমতাবলম্বী ধর্ম কিংবা সাহিত্যশিল্প বড় রকমের হুমকির মধ্যে পড়ে; এমনকি তাতে রক্ষণশীল সাহিত্যশিল্পও ক্ষীয়মাণ হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং লেখক ও শিল্পীদের পক্ষে উচিত হয় সেন্সর থেকে আত্মরক্ষামূলক নীতি অবলম্বন করা। কারণ, সেন্সরের খড়্গের ভয় শিল্পীর স্বাধীনতা ও স্বতঃস্ফূর্ততাকে নষ্ট করে দেয়। অবশ্য টয়েনবি এটাও বলেন যে সভ্যতার ইতিহাসে দেখা গেছে স্বৈরাচারব্যবস্থার যুগেও অনেক মহৎ সাহিত্যশিল্পের সৃষ্টি হয়েছে; বিশেষ করে খ্রিষ্টান ও ইসলামি দুনিয়ায়।

নৈতিক মান রক্ষার জন্য যে সেন্সর, তা লেখকদের জন্য আরও কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, কোন বিষয়টি নৈতিক আর কোনটি তা নয়, তাতে সবার মতামত সমান না–ও হতে পারে। সেন্সরের ব্যাপারে টয়েনবির শেষ কথা, সাহিত্যশিল্পে বাধানিষেধ সব সময়ে হিতে বিপরীত কাজ করে। তাই এসব তুলে দেওয়া উচিত।

টয়েনবি লেখক বা শিল্পীর স্বাধীনতার ব্যাপারে আরেকটা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। তাঁর মতে, যতক্ষণ পর্যন্ত লেখক বা শিল্পী শৃঙ্খলের ব্যাপারে ভাবিত হন না, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি আধ্যাত্মিকভাবে মুক্ত। প্রসঙ্গক্রমে দান্তে আলিগিয়েরির কথা উল্লেখ করেছেন টয়েনবি। প্রচলিত মতাদর্শের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন বলে দান্তের মনেও হয়নি তিনি একজন বিরুদ্ধবাদী আর তিনি বসবাস করছেন খ্রিষ্টবাদের দমনপীড়নমূলক পরিবেশে। অথচ টয়েনবি প্রত্যক্ষ করেছেন দান্তের সমকালে অনেক লেখক-শিল্পী বিরুদ্ধবাদী হিসেবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন। যদিও এঁদের গির্জাচিত্র, ভাস্কর্য, খোদাই মূর্তি, খ্রিষ্টগীতি প্রভৃতির সঙ্গে দান্তের চেতনাগত ফারাক তেমন ছিল না। খ্রিষ্টীয় নিপীড়নবাদী পরিবেশে অবস্থান করেও দান্তে আধ্যাত্মিকভাবে স্বাধীন সত্তার কবি—অভিমত টয়েনবির। তাই তাঁর পক্ষে ডিভাইন কমেডির মতো মহৎ কাব্যরচনা সম্ভব হয়েছিল।

উনিশ শতকের রুশ সাহিত্যের ব্যাপারে টয়েনবির বক্তব্য—জারের শাসনে লেখকেরা ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন বলে তখনকার সাহিত্যেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। অন্যদিকে কমিউনিস্ট যুগের সাম্যবাদী আদর্শের রুশ লেখকদের সঙ্গে দান্তের তুলনাকে অসমীচীন বলে মনে করেন তিনি। কমিউনিস্ট লেখকেরা দমন–পীড়নের ভয়ে ভীত ছিলেন না, তাঁরা স্বাধীনভাবেই নিজেদের মতাদর্শ-অনুযায়ী সাহিত্যরচনা করতে পারতেন। যদিও মার্ক্সীয়-লেনিনীয় শাসনামলে আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার জন্য ভিন্নমতাবলম্বীদের কঠোর নিপীড়নের শিকার হতে হতো। এ প্রসঙ্গে টয়েনবি কমিউনিস্ট দুনিয়ার বাইরেও এমন আশঙ্কা করেছেন যে রাষ্ট্রব্যবস্থা আগ্রাসী হয়ে উঠলে সবখানেই লেখকদের সমান পরিণতি হতে পারে।

টয়েনবি গ্রিক দার্শনিকদের মতো মনে করতেন জ্ঞানলাভের পূর্বশর্ত হচ্ছে যাতনাভোগ। সেভাবেই তিনি দান্তের জীবনবোধকে উপলব্ধি করেছেন। অবশ্য এটা ঠিক যে দান্তে খ্রিষ্টীয় দমনমূলক শাসনের আওতায় থেকেও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা ভোগ করেছেন। রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হতে হয়নি তাঁকে; তবে প্রেমের যন্ত্রণায় জর্জরিত দান্তেকে বাসস্থান থেকে উৎখাতও হতে হয়েছিল। এসব যাতনা দান্তেকে মহৎ করে তোলে বলে অভিমত টয়েনবির।

ইকেদাও মনে করেন খ্রিষ্টধর্মের কঠোরতার ভিতরেও দান্তে স্বাধীন ছিলেন আর এটা সম্ভব হয়েছিল নিজের অটুট বিশ্বাসের জন্যই। খ্রিষ্টীয় পাপবোধের উপলব্ধি ও বিশ্বাসের ভিত্তি দান্তের ব্যক্তিত্বকে গঠন করে আর সেটাকে তিনি সৃজনশীল কাজে ব্যবহার করেন। তাই বলে দান্তের পরিস্থিতির মতো সমান বাস্তবতায় সবাই মহৎ কিংবা সামাজিক দায়িত্বপূর্ণ সাহিত্য সৃজন করতে পারেন, এমন যুক্তিও খারিজ করে দেন ইকেদা। উনিশ শতকের রুশ লেখকদের কার্যক্রমের প্রসঙ্গ এনে ইকেদা জানান যে এঁদের সাহিত্যিক প্রকল্প ছিল সামাজিক উপযোগ সৃষ্টি। বাস্তবে এসবের অসারতা দেখে অনেকে বেছে নিয়েছিলেন নিহিলিস্টের পথ। সমকালেও এমন উদাহরণ প্রত্যক্ষ করে ইকেদার অভিমত ছিল অন্তর্মুখী সাহিত্যশিল্পের প্রতি আধুনিক আসক্তি লেখকদের মধ্যে নিহিলিস্ট-সুলভ হতাশার জন্ম দিয়েছে।

নিহিলিস্টদের সম্বন্ধে টয়েনবিরও কথা হচ্ছে এঁরা নৈরাশ্যবাদী মতবাদ দ্বারা পরিচালিত; আর ‘নিহিলিজম’ও বিকল্পের স্পষ্ট পথ ব্যতিরেকে জীবন ও জগৎকে অবজ্ঞা করে। তাই সাহিত্য ও শিল্পক্ষেত্রে এমন অভিব্যক্তির প্রতিফলন সমাজে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে বলে তা নিন্দনীয়। অন্যদিকে অন্তর্মুখীনতার ক্ষেত্রে টয়েনবি দুটি বিকল্প পথের সন্ধান পান। প্রথমটি, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া অর্থাৎ, বিচ্ছিন্নতাকামী হওয়া। দ্বিতীয়টি, আধ্যাত্মিক সত্য অনুসন্ধানে একটা সুস্থিতি—একে টয়েনবি ‘ঐক্যকামী’ বলে অভিহিত করেছেন। তাই ইকেদার কথার জবাবে তাঁর যেটি বলার তা হলো, অন্তর্মুখী সাহিত্য নেতিবাচক হবে কি না, তা নির্ভর করে অন্তর্মুখিতার স্বরূপ কেমন তার ওপর। অন্তর্মুখী সাহিত্য নেতিবাচক হলে একে টয়েনবি নিন্দনীয়,—আর তা প্রেরণার উৎস হলে তাকে তিনি স্বাগত জানান। তবে সাহিত্যশিল্পের ক্ষেত্রে মতাদর্শ প্রচারকে টয়েনবি একেবারে খারিজ করে দিয়েছেন। কারণ, নির্দিষ্ট মত প্রকাশ করা শিল্পের দায়িত্ব তো নয়ই, বরং তাঁর মতে আধ্যাত্মিক বা সামাজিক উদ্দেশ্যসাধনের লক্ষ্যে রচিত সাহিত্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আপন উদ্দেশ্যকেই ব্যর্থ করে দেয়। সাহিত্যসৃষ্টির ব্যাপারে জীবনের যথার্থ রূপায়ণ ছাড়াও সাহিত্যিকদের টয়েনবি অকপট ও সাহসী হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত।

‘অশ্লীল সাহিত্য’ যাতে তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করতে না পারে, সে বিষয়ে সবার সজাগ দৃষ্টি রাখার কথা বলেন ইকেদা। সেন্সরের ব্যাপারে কঠোর মনোভাবের বিপরীতে টয়েনবির মতো ইকেদারও কথা হলো, লেখকের বাক্‌স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা অনুচিত। অভিজ্ঞতা থেকে ইকেদা দেখেছেন সেন্সর একবার চালু হয়ে গেলে তা একসময় সর্ব ক্ষেত্রে বিস্তারমান হতেই থাকে।

ইকেদাও সাহিত্যের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে সমান মত পোষণ করেন। অর্থাৎ, সাহিত্যের উদ্দেশ্য নির্দিষ্ট হওয়া অনুচিত; তবে সাহিত্যের মর্মগত অভিপ্রায় যেন হয় প্রেরণা। আর তাঁর মতে, একজন সাহিত্যিক তখনই মহৎ বা সর্বজনীন সাহিত্য রচনা করতে পারেন, যখন তাঁর স্বাধীনতার মধ্যে মানুষের সত্যিকার যন্ত্রণা অভিব্যক্ত হয়। এমন সাহিত্যিক রূপায়ণ প্রতিকূল পরিবেশের কারণে কঠিন হলেও, সাহিত্যিককে সেই দায়িত্বটি পালন করতে হয়। সাহিত্যসৃষ্টির ব্যাপারে ইকেদার দায় হচ্ছে, তা যেন ভুখা-নাঙ্গা মানুষদের সুরক্ষার বর্ম হতে পারে।

‘শিল্পের জন্য শিল্প’—এমন মতকেও তাৎপর্যপূর্ণ অর্থে দেখতে চান টয়েনবি। কারণ, বৃত্তিগতভাবে বিশেষজ্ঞ শিল্পীর সৃষ্টি জীবনেরও জন্য বটে। অন্যদিকে অপরাপর মানুষের বদলে শুধু বিশেষজ্ঞের জন্য যাঁরা সাহিত্য-শিল্প রচনা করেন, টয়েনবি তাঁদের শিল্পকে ‘বন্ধ্যা’ বলে অভিহিত করেন। এ ধরনের শিল্পকে তিনি ‘বৃত্তিজীবীর শিল্প’ বলে অভিধা দিতে চান। সে অর্থেও একে টয়েনবি ‘ভ্রান্ত শিল্প’ বলে মত দেন। সাহিত্য-শিল্পে এমন চর্চাকে টয়েনবি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা বলে উল্লেখ করেন। সুস্পষ্টভাবে এ–ও বলেন যে মুষ্টিমেয়ের জন্য রচিত সাহিত্য, বিজ্ঞান ও শিল্প সামাজিক রুগ্ণতাকেই প্রকাশ করে।

আর্নল্ড টয়েনবি ও দাইসাকু ইকেদার শিল্প-সাহিত্যের সংলাপ সমাপ্ত হয় দুজনেরই সমান আশাবাদ ব্যক্ত করে। ইকেদা তাঁর চির আশাবাদী মন নিয়ে জানান, নিজ সময়ের মানুষের মনে সাহস জোগাবে এমন সাহিত্যের আশা নিয়ে তিনি বসে আছেন। তাই বলে নারকীয় ঘটনার মুখোমুখি মানবতার ছবিতে সুন্দরের অনুসন্ধানরত সাহিত্যকে তিনি ক্ষমা করতে নারাজ। এ ধরনের কপট সাহিত্যের বদলে ইকেদা পছন্দ করেন আন্তরিকতা, সহানুভূতি ও সদিচ্ছাপূর্ণ জীবনের অভিব্যক্তি নিয়ে রচিত সাহিত্যে মানুষের মর্যাদার অনুসন্ধান। টয়েনবিরও আশাবাদ: মানুষের সফলতা। মানুষকে জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে সফলতার সঙ্গে আর এ জন্য নৈরাশ্যকে পেছনে ফেলে সাহিত্যকে জীবনের যত অশুভ ও বিপত্তি অতিক্রম করে চলতে হবে। মানুষকে তার শেষ লড়াইটা চালিয়ে যেতেই হবে, যদিও মানুষ জানে না আদৌ সে জিতবে কি না।