শহীদুল জহিরের আদি ঢাকা অথবা ঘোড়ার ডিমের শিল্পায়ন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির জন্মেছিলেন ১৯৫৩ সালে, ঢাকায়। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, পুরান ঢাকার ভূতের গলি, নারিন্দায়। তবে বাবার চাকরির সুবাদে আজ চাঁদপুর, তো কাল ময়মনসিংহ, কদিন বাদে সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম করে কেটেছে তাঁর শৈশব। এত ঝক্কির পরও ১৯৫৭-৬৩ পর্যন্ত ছেলেবেলার টানা একটা সময় কেটেছে তাঁর পুরান ঢাকার ভূতের গলি, দক্ষিণ মৈশুণ্ডী কিংবা পদ্মনিধি, জোড়পুল লেনের অলিগলিতে, বন্ধুদের সঙ্গে হল্লা করে। সেখানে তিনি মহল্লার কেতা রপ্ত করে লাভ করেছেন আদি ঢাকার নাগরিক পরম্পরা। ’৬৮-’৭০–এ ঢাকা কলেজ এবং স্বাধীনতার পর ’৭২–’৭৫ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর ’৭৮ থেকে আমৃত্যু ঢাকায় (চাকরিজীবন) থেকে তিনি নাগরিক জীবনকে মননে ধারণ করেছেন। তবে তিনি আদি ঢাকার মানুষ হলেও ঢাকাইয়া কুট্টি ছিলেন না।

বরং তাঁর পিতার জন্মভিটা সিরাজগঞ্জ ছিল বলে মহল্লার বন্ধুরা তাঁকে ‘পাবনাইয়া’ বলে টিজ করত।

শহীদুল জহির লিখেছেন অল্প, কিন্তু তা দীর্ঘদিন ধরে লিখেছেন। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’ (১৯৮৫) নিয়ে কওয়া–বলা হয় কম, কিন্তু লেখা বাহুল্য, বইটি শুধু কোনো মেধাবী তরুণের ‘হাত মকশো’র ছিল না। তাতে স্পষ্ট ছিল পরিণতির ছাপ আর তাঁর গদ্যভঙ্গি মনোযোগের দাবি নিয়ে হাজির ছিল। ঢাকার প্রান্তিক ও নিম্নবর্গের ঠেলাওয়ালা, ছুটা বুয়া, রিকশাওয়ালা, কুলি, সুইপার প্রমুখের যে গল্প লেখক ফাঁদেন, তাতে শ্রেণিদ্বন্দ্ব ও প্রতিবাদ জারি থাকলেও তাতে মহল্লাবাসীর তৎপরতা চোখে পড়ে না। নগর–সংস্কৃতির জোরালো অবয়ব ও প্রাণবহুল ঢাকার গল্প মেলে ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ এবং ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থে। এ দুই গ্রন্থের ‘ডুমুরখেকো মানুষ’, ‘এই সময়’, ‘কাঁটা’, ‘চতুর্থ মাত্রা’, ‘কোথায় পাব তারে’, ‘মহল্লায় বান্দর আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা’, ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’, ‘প্রথম বয়ান’, ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পে বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী ৪০০ বছর বয়েসী শহরের ভূগোল, জনসংস্কৃতি ও মানুষের যৌথতার বয়ান হাজির থাকে।

তবে ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পটি আলাদা জায়গা করে নেয় মহল্লাবাসীর আড়ম্বরপূর্ণ তুমুল জীবনকে ভিন্নমাত্রা দেবার কারণে। এই গল্পে (বা গল্পের বাইরেও) ঢাকার মহল্লাবাসীর দিনযাপনে মেলে যূথবদ্ধ জীবনের ছাঁচ। আর কে না জানে, মানুষের যোগাযোগ ও সম্পর্কের শুরুর সূত্রই এই যৌথতা। তাদের সেয়ানা স্বভাবে মিশে থাকে হানাহানি ও রাহাজানি, গালি ও গলাবাজি, যেন অপরের প্রতি তাদের আজন্ম রোষ। কিন্তু বিপদে ও আনন্দে, পার্বণ কি বিশেষ দিনে তারাই আবার প্রয়োজনে কাঁধ দেয় নানা টুকিটাকি কাজে। সকালে শাণিত কথায় অন্যকে ঘায়েল করে কিন্তু বিকেলের ম্লান আলোতে তারাই একত্রে তরমুজ সাবাড় করতে করতে বিক্রেতাকে বলে, ‘মিয়ারা, মাছির দিনে তরমুজ লয়া আহো কেলা!’ মায়া ও রোষ তাদের ভেতরকার সম্পর্কের খিলান। আচরণে দরাজ বাসিন্দাদের দল বেঁধে রেস্তোরাঁ ও সিনেমায় যাওয়া নৈমিত্তিক রুটিনের অংশ। আবার মহল্লায় বিস্কুট কারখানা চালু হলে তার ঘ্রাণে যখন সুরভিত মহল্লার অলিগলি, তখন কেউ কেউ কারখানার উদ্বোধনী মিলাদে পাওয়া ঠোঙার জিলাপি রোঁয়াকে বসে ঠ্যাং ঝুলিয়ে খায়। তারা বিক্ষিপ্ত, কিন্তু বিচ্ছিন্ন নয়, বরং এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ। আর সেই বন্ধনের সুতাটার নাম ‘মহল্লার লোক’। এমন সব ইমেজ ঢাকাকে এক প্রাণবন্ত শহরে পরিণত করে। এই ঢাকা জেগে থাকে প্রত্যুষ থেকে মধ্যরাত অব্দি, বিয়ে থেকে জানাজাতক। বিপরীতে ’৬০–এর দশক থেকে বাড়তে থাকা নতুন ঢাকায় দেখি দোরে খিল আঁটা সংস্কৃতির চল। হাইরাইজ বাড়িতে মহল্লার প্রায় সমান বাসিন্দা গিজগিজ করে কিন্তু তারা থাকে পরস্পর আজীবন-অচেনা। সেখানে নেই যূথবদ্ধ হবার যৌথ পাটাতন, যার প্রভাবে বিকশিত সমাজ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। নতুন ঢাকার জীবনের প্রতি লেখকের কোনো আগ্রহ নাই এবং তার লেখায় এই জীবনের নজিরও নাই। শহীদুলের ছোটগল্প ও উপন্যাসে ঢাকার যে বয়ান ডালপালা মেলে, হাজির হয় তার অনবদ্য সুষমা নিয়ে, তা আদি ঢাকার সংস্কৃতির দৃশ্যমান সিলসিলা।

শহীদুলের লেখায় দেখি একটা স্পষ্ট বাঁক, অন্য রকম স্বাদ, স্পর্শ, গন্ধ। দক্ষিণ মৈশুণ্ডী, ভূতের গলি, পদ্মনিধি লেন, নারিন্দা, দয়াগঞ্জের মানুষেরা কি জানত, কী আশ্চর্য মমতায় অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে তাদের জীবনের গল্প আমাদের শোনাচ্ছেন একজন লেখক?

তবু শহীদুলের লেখায় দেখি একটা স্পষ্ট বাঁক, অন্য রকম স্বাদ, স্পর্শ, গন্ধ। দক্ষিণ মৈশুণ্ডী, ভূতের গলি, পদ্মনিধি লেন, নারিন্দা, দয়াগঞ্জের মানুষেরা কি জানত, কী আশ্চর্য মমতায় অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে তাদের জীবনের গল্প আমাদের শোনাচ্ছেন একজন লেখক। ওই একই মহল্লার আবদুল করিম, চান মিয়া, মামুনুল হাই বা ফখরুল আলম লেদুর গল্প আমাদের শোনাচ্ছেন তিনি। কিন্তু আমাদের শুনবার ক্লান্তি নেই। যেমন গার্সিয়া মার্কেস ঘুরেফিরে আমাদের শুনিয়েছেন ইরিন্দিরা বা মাকান্ডো গ্রামের গল্প। শহীদুলের মহল্লার একটা যৌথ চরিত্র আছে। সবগুলো মানুষ মিলে একটা মানুষ যেন তারা, যৌথভাবে চিন্তা করে, ‘আমরা মহল্লায়, সেদিন রাতে আমাদের দিবসের কর্ম শেষে ক্লান্ত অবসরে আব্দুল করিমের ময়মনসিংহ যাওয়ার সর্বশেষ খবর শুনি এবং বলি, পোলাটা হালায় ভোদাই।’

যেন সবাই মিলে ভাবছেন, সবাই মিলে বলছেন। পুরান ঢাকার সঙ্গে যাঁর পরিচয় আছে, তিনি জানেন সেখানে এই যৌথতার ব্যাপারটি কতটা সত্য। ইউরোপ আমাদের জানিয়েছে নগর হচ্ছে একাকিত্ব, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য আর ব্যক্তিসর্বস্বতার চরাচর। পুরান ঢাকা তা ভুল প্রমাণ করে।

‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পটি ছোট কাগজ ‘মাটি’তে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয়ে, ’৯৮ সালে ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হলে পাঠকেরা এক বিস্ময়কর নিরীক্ষা লক্ষ করেন। গল্পটি পরিচ্ছেদহীন এবং কমা, কোলন, সেমিকোলন ছাড়া পূর্ণ যতিচিহ্নহীন। ফলে প্রায় সাত হাজার শব্দের গল্পটি জমাট ঘোরের পাঠ-অভিজ্ঞতা তৈরি করে। (যদিও এমন নিরীক্ষা এটিই প্রথম ছিল নয়। ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় কমল কুমার মজুমদারের ‘সুহাসিনী পমেটম’ উপন্যাসটি ২৫০ পৃষ্ঠায় লিখিত হলেও তাতে কোনো দাঁড়ি নেই।)

কিন্তু দেখা যায়, ওই বইটিতে গল্পের শেষে একটি দাঁড়ি রয়েছে। ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পটি একটি অনুচ্ছেদে লেখা। প্রায় ২০ পৃষ্ঠার একটি গল্পতে কোথাও কোনো পূর্ণ যতি নেই। শুধু কমা আর সেমিকোলন দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। গল্পটি শেষ হয়েছে একটি কমা দিয়ে। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ওই মহল্লার জীবনের ভিসিয়াস সাইকেলটাকে ধরবার জন্য এমনটি করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ বইটিতে এই গল্প ছাপাবার সময় কিছুতেই ছাপাখানার মানুষদের ব্যাপারটা বোঝাতে পারছিলেন না। তিনি যতবার গল্পের শেষে দাঁড়ি কেটে কমা করেন, প্রুফরিডার আবার সেটি দাঁড়ি করেন। বলেন, কমা দিয়ে লেখা শেষ হয় নাকি। আপনি ব্যাকরণ মানবেন না? নিষেধ সত্ত্বেও তাঁরা দাড়ি দিয়ে এই লেখাটা ছেপেছেন। শহীদুল একটি কমার বেদনায় মর্মাহত, ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।

এই ক্ষোভ থেকেই লেখক ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থে গল্পটি পুনরায় ছাপান, নিম্নোক্ত অনুক্রমণিকা জুড়ে দিয়ে—‘কেবলমাত্র একটি শুদ্ধ পাঠ নিশ্চিত করার জন্য গল্পটি পুনঃ মুদ্রণ করা হলো।’

লেখকের মৌলিক ২৭টি গল্পের মধ্যে এই বিশেষ গল্পের আরও বিশেষত্বের তত্ত্বতালাশ করা যাক।

অর্থনীতির তত্ত্বানুযায়ী, নগর ও শিল্প একে অন্যে জড়াজড়ি করে থাকে। লেখক লেদ মেশিন অধ্যুষিত ছোট জনপদে তরমুজের জুস তৈরির কারখানা স্থাপনের কাহিনি ডালপালাসহ বলেন। এর সঙ্গে তিনি ইমেজের পর ইমেজ হাজির করে পাঠককে রোলার কোস্টার রাইডের অভিজ্ঞতা দেন।

এ গল্পের জমিন আদি ঢাকা, যেখানে লেখকের নাড়ি পোঁতা। ২০ শতকের ’৬০, ’৭০ ও ’৮০’–এর দশকের সময়ের বিভিন্ন তলে ঘটনা ও চরিত্রেরা যাতায়াত করেন। গল্পের কথক বহুবচনের আমরা অর্থাৎ মহল্লাবাসীর বয়ানে গল্পটির পর্ব ও পরত খুলতে থাকে। এখানেও হয়তো, এবং, ফলে, পুনরায়, অথবা, কিংবা—ইত্যাদি শব্দে লেখক দ্বিধা তৈরি করে একাধিক পথ খোলা রাখেন। গল্পে তরমুজ বস্তুর চেয়ে অতিরিক্ত রূপ ধারণ করে মহল্লাবাসীর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে এবং তরমুজ শব্দটি ১৫৯ বার ব্যবহত হয়। এভাবে বস্তুর বারবার ফিরে এসে গল্পকে প্রভাবিত করা শহীদুলের গল্পে প্রথম নয়। তাঁর ‘কোথায় পাব তারে’-তে ডালপুরি, ‘কাঁটা’-য় কুয়া, ‘ডুমুরখেকো মানুষ’-এ ডুমুর, ‘এই সময়’-এ ফুল, লতাপাতা, ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’-এ কাক, ‘ধুলোর দিনে ফেরা’য় ময়না ও গোলাপ, ‘চতুর্থ মাত্রা’য় ঘড়ি ও কাচের গ্লাস, ‘প্রথম বয়ান’-এ চম্পা ফুল, ‘ডলু নদীর হাওয়া’য় চিনি ও বিষের শরবত, ‘কার্তিকের হীম ও জ্যোৎস্না’য় স্যান্ডেল ফিরে ফিরে আসে এবং ঘটনাকে মুচড়ে দিয়ে ঘটনার মোড় ঘোরায়।

আপাত এটা সরলরৈখিক গল্প নয়, পাঠে তা দুর্বোধ্য মনে হতে পারে। যেন ঘটনা এখানে দুরন্ত কিশোরের ঘুড়ির নাটাইয়ে জট পাকানো বিষ গেরো লেগে যাওয়া একতাল সুতার দলা। কিন্তু তলিয়ে দেখলে এবং সুতার গেরোর সন্ধান করে তা খুলে দেখলে গল্পের দারুণ এক পাঠ গোচর হয়।

’৬০–এর দশকে বুড়িগঙ্গাকেন্দ্রিক আদি ঢাকার অর্থনীতির বড় বুনিয়াদ ছিল লেদ মেশিনসমেত ছোট ছোট শিল্প। আর অর্থনীতির তত্ত্বানুযায়ী, নগর ও শিল্প একে অন্যে জড়াজড়ি করে থাকে। লেখক লেদ মেশিন অধ্যুষিত ছোট জনপদে তরমুজের জুস তৈরির কারখানা স্থাপনের কাহিনি ডালপালাসহ বলেন। এর সঙ্গে তিনি ইমেজের পর ইমেজ হাজির করে পাঠককে রোলার কোস্টার রাইডের অভিজ্ঞতা দেন। গল্পপাঠ এমন এক জার্নি হয়ে ওঠে, যার মাঝপথে নেমে পড়া দুঃসাধ্য।

চৈত্র–বৈশাখে মৌসুম শুরু হলে বিক্রেতারা তরমুজ এনে ঢিবি করে রাখলে তার টানে সবাই ভিড় করে। তাদের মধ্যে সেই ধাঁধাময় প্রশ্ন ঘুরপাক খায়—মাছির দিনে তরমুজ হয়, না তরমুজের দিনে মাছি। কারও কারও পেটে তরমুজের বিচি চলে গেলে পেট মোচড়ায়, শুয়ে থেকে তারা ভাবনার অবকাশ পেয়ে স্থানীয় দার্শনিক বনে যায়। তাদের ভেতর ঘোর বিশ্বাস জন্মে, তরমুজ হচ্ছে ডিমের মতন, পচে যেতে পারে কিন্তু ভেজাল হতে পারে না। কিন্তু তারা পরে জানতে পারে, স্যাকারিন ও রং দিয়ে তরমুজে ভেজাল দেওয়া হয়। সেই নিদানে তারা তরমুজওয়ালার শরণ নেয়। তাদের মনে হয়, বিক্রেতারা খুব চালাক। কারণ, তারা তরমুজ না খেয়ে টাকা জমায়। কেউ তাকে এ প্রশ্নও করে, তরমুজ কি গাছের ডিম? সপ্রতিভ বিক্রেতা চটজলদি জবাব দেয়, যেহেতু এতে তা দিলে তরমুজ জন্মে না, ঘোড়ার বাচ্চা জন্মে, তাই এটি আদতে একটা ঘোড়ার ডিম। কিন্তু তাদের জীবনে সংকট বেড়ে যায় তরমুজের দাম তিন গুণ বেড়ে গেলে। তারা মহল্লার নেতাকে বলে, ‘কিছু করেন আমাগো লাইগা, তরমুজের দাম বাইড়া গেল, দশ টাকার তরমুজ এখন তিরিশ ট্যাকা দাম, আমরা বাঁচি কেমনে’, তখন সে আমাদের বলে যে লেদ মেশিনের কাঁচামালের দাম বেড়ে গেছে, কর বসানো হয়েছে, তা ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম, যেমন চাল, ডাল, তরমুজের দাম বেড়েছে, কাজেই তারা কী করতে পারে, তার কথা শুনে আমরা বুঝতে পারি, কেমন করে তরমুজের দাম বাড়ে বলেই তরমুজের দাম বাড়ে, তরমুজ কেমন করে নিজের দাম নিজে বাড়িয়ে নেয় একটি চক্রের ভেতর দিয়ে এবং এই চক্রের ভেতর আমরা দক্ষিণ মৈশুণ্ডীর অবস্থান আবিষ্কার করি, আমরা তরমুজের দাম কমানোর কোনো পথ খুঁজে পাই না, তিরিশ টাকা থেকে নেমে তা পঁচিশ টাকায় স্থায়ী হয়।

কিন্তু চড়া দাম সত্ত্বেও তারা তা খাওয়া ছাড়তে পারে না। তাদের মনে হয়, তরমুজ খাওয়া উপকারী ও লাভজনক। এটা দেহ মন ঠান্ডা রাখে, আবার জীবনের একটা উদ্দেশ্য এনে দেয়। না হলে শূন্যতার ভেতর মানুষ পথ হারায়। মহল্লার ব্যবসায়ী হাজি আব্দুর রশিদ মৃত্যুশয্যায় অন্তিম খায়েশ হিসেবে তরমুজ খেতে চাইলে মৌসুম না থাকায় অধরা ইচ্ছা নিয়ে মারা যান। সেই খেদ থেকে ছেলেরা এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হিসেবে তরমুজের জুসের ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। এভাবে মহল্লার প্রভাবের ছড়ি হাত বদলে ছেলেদের হাতে আসে এবং মহল্লাবাসীর তরমুজকেন্দ্রিক ঘটনা শেষ হয়। এসব ঘটনা বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে খাড়া ওপরে ছোটে। এই উল্লম্ফনকে একশব্দে জাদুবাস্তবতা দিয়ে দাগিয়ে দেওয়া যায়। তরমুজ কেনা ও খাওয়ার সঙ্গে আরও জড়িয়ে থাকে মানুষের আনকনশাসে জেগে থাকা বাসনা বা ডিজায়ার। ক্যাপিটালিজমের অবিশ্বাস্য আধিপত্যের দুনিয়ায় সব বাসনার লক্ষ্য পণ্য ও ভোগ। ব্যাপক প্রচারে ভোগ মৌলিক অধিকারের কাতারে শামিল হতে চায়। ফলে তাদের ঘুমে ও জাগরণে, আড্ডায় ও নিবিড় আদরে তরমুজ মন-মগজে জারি থেকে ক্রমাগত হাতুড়িপেটা করে। তরমুজ এখানে পণ্য ও বস্তুর প্রতীকই শুধু নয়। বরং তা মনোজগতের একটা কোণ দখল নিয়ে তাদের চালিত করে।

শহীদুল জহিরের ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পটি ক্রমাগত গদ্যের বিবরণে বলার কারণে তা আরব্য রজনীর হাজার রাতের গল্প বলা শেহেরজাদীর ঝুলিতে থাকা অনিঃশেষ গল্পের আশ্চর্য ভান্ডারের কথা মনে করিয়ে দেয়। আবার অন্যভাবে দেখলে, আদি ঢাকার এ গল্প যেন মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা শত টুকরো আয়না। যেখানে টুকরোরা অবিন্যস্ত জড়ো হয়ে আছে, আর একেক টুকরোয় একেকটা ছবি, আর সে ছবিতে খণ্ড খণ্ড গল্প। আবার সমগ্র ভাঙা আয়না একসঙ্গে দেখলে ধরা দেয় একটা জনপদের মেলানো জীবন।

এই গল্পে কোনো গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ নেই। লেখক ছোট ছোট বাক্যে নানা গল্প এক টুকরো বা তিন টুকরো একেকবার বলে ন্যারেটিভ এগিয়ে নিয়ে যান। তার মধ্যে আবদুল গফুরের পরিবারের কাহিনি অন্যতম প্রধান ন্যারেটিভ হয়ে দাঁড়ায়। আবার গল্প শুরুর তৃতীয় পৃষ্ঠায় তিনি এর সম্ভাব্য পরিণতির ইশারা দিয়ে রাখেন, ‘এবং আমরা তখন মহল্লার একমাত্র কবি, একমাত্র প্রেমিক, একমাত্র ঘর পলাতক নারী এবং একমাত্র আত্মহত্যার ঘটনার কথা স্মরণ করতে পারি।’

লেখকের নির্দেশিত পথরেখা ধরে এগোলে কলেজপড়ুয়া মহল্লার কবি আজিজুল হককে পাই। কাঁধ বেয়ে নেমে আসা ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো অবয়বে তাকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের উত্তরসূরি কল্পনা করে মহল্লাবাসী টিপ্পনী কাটে—কবি কবি ভাব। একটা সাধারণ কবিতার আশায় তাদের দিন ও রজনী কাটে। কিন্তু দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যে কবিতাটি তাদের হাতে আসে, তার মাথা-মুণ্ডু বা বিন্দু-বিসর্গ তারা বুঝতে পারে না। কবিতাটি ছিল এমন—

‘তিনটি বিন্দু ছিল সামনে
ডানে-বাঁয়ে এবং
মাঝখানে
অথবা
একটি রেখা ছিল
ডান থেকে বাঁয়ে কিংবা
বাম থেকে ডানে
অথবা একটি বাক্য ছিল রেখার মতো
কারণ, তখন অর্থ ছিল না
কারণ, তখন বাক্য রেখা ছিল
এবং রেখা বিন্দু ছিল, অথবা
তখন অর্থ ছিল
রেখা তখন বাক্য ছিল
এবং বাক্য জীবন ছিল
কারণ, তখন স্বপ্ন ছিল
বাক্য তখন কথা ছিল
কিন্তু তখন স্বপ্ন ছিল না
আমরা জাগরণের পীড়নের ভিতর নিদ্রিত ছিলাম
আমাদের নিদ্রার ভেতর ভালোবাসার অঙ্কুর ছিল না
কারণ, তখন বাক্য রেখা ছিল
মাটিতে
পানিতে
এবং আকাশে
কারণ তখন অর্থ ছিল না
এবং তোমার কথা
অন্য কথা ছিল’

গল্পের কবি আজিজুল হককে অসিলা করে লেখকের কবিসত্তার প্রকাশ দেখতে পাই। তবে লেখকের অন্যান্য লেখায় কবিতার প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায় না। যদিও এটা তার শেষ কবিতা হলেও প্রথম নয়। রচনাসমগ্রতে দেখি ছাত্রাবস্থায় তিনি মাও সে–তুংয়ের চারটি কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। শিরোনামহীন আরেকটি কবিতা লিখেছিলেন ডায়েরিতে, সেটা তিনি কোথাও ছাপতে দেননি।

কবি আজিজুল হক কাব্যচর্চায় কতটা সফল ছিলেন, তা জানা না গেলেও তাঁর জীবনে বিপর্যয় দেখতে পাই। ‘পাগলের গুষ্টি’ প্রমাণ করতে সে একদিন উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় নেমে এলে সবাই তাকে পাগলা গারদে রেখে আসে। কী কারণে কবি আজিজুল বিপর্যস্ত ও উন্মাদে পরিণত হন, তার কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের স্পষ্ট ব্যাখ্যা লেখক দেন না। তবে আবছা ইঙ্গিতে বোঝা যায়, শিক্ষক ননী বসাকের সুন্দরী কন্যা ঝর্ণা বসাকের সঙ্গে ব্যক্তিগত দুঃসম্পর্ক এর পরোক্ষ কারণ। সঙ্গে কবিতাটি মেলালে বিষয়টি দুইয়ে তিনে পাঁচ হয়। (বাস্তবে ঝর্ণা বসাক পরে মহল্লাছাড়া হয়ে শবনম নাম ধারণ করে সিনেমার নায়িকা হয় এবং ‘চান্দা তালাশ’সহ আরও অনেক সিনেমায় অভিনয় করে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।)

শহীদুলের গল্পে ফুল-পাখি, লতা-পাতা, তুমি-আমি মার্কা গৎবাঁধা প্রেম নাই। আজিজুলের ভাই আমিনুল ও পুতুলের প্রেম তার কাছাকাছি থাকলেও পরিণতি হয় করুণ। প্রেমের এ ঘটনায় লোকজ মিথের ব্যবহার দেখি। অসম ও অসম্ভব প্রেমের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে আমিনুলের মোহন বাঁশি। কিন্তু সে জানে না, বাঁশি শুনে প্রেমে পড়ে সাপরূপী নাগিনী। তার আরও অজানা থাকে, দেয়ালের ওপাশে বসে থাকা পুতুলের দেহ পঙ্গু। পয়লাবার দেয়াল পেরিয়ে সে তাকে ছুঁয়ে দিয়ে টের পায় যে সে কাঁদে এবং তার মনে হয় অশ্রু হচ্ছে গলে যাওয়া হৃদয়। আর ঈর্ষাতুর সাপ প্রেমকে ভাগ করতে জানে না বলে তাকে দংশন করে। পুতুল সাপে কাটা প্রেমিককে নিয়ে ভেলায় ভাসতে পারে না, তাই লখিন্দরের মতো তারও আর বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা থাকে না। এ পরিবারের স্কুলপড়ুয়া উচ্ছল কিশোরী শেফালী, মহল্লার অসংখ্য কিশোরের উৎসুক চোখ যার প্রতীক্ষায় থাকে। সে–ও একদিন কারও হাত ধরে পালিয়ে গেলে তার বাবা আবদুল গফুর লজ্জায় ও অপমানে কড়িবর্গার সঙ্গে ঝুলে পড়ে। এ নৈতিক পতনকে মহল্লাবাসী মানতে পারে না এবং তাদের মনে হয়, কাঁখের পিতলের কলসি পড়ে যাবার মতো তারা এ পতনের আওয়াজ শুনতে পায়।

এ গল্প এক পরিচ্ছেদে লেখা বলে বর্ণনার আতিশয্য ব্যাপক। তুলনায় সংলাপ কম, কিন্তু তা আলাদা করে নজর কাড়ে। নির্মাণের দিক থেকে এটি ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’র সঙ্গে কিছু মেলে। দুই ক্ষেত্রেই ঘোরময় বর্ণনার বিস্তার এবং তার ফাঁকে ছোট সংলাপ। বিষয়ের কারণে এ উপন্যাসের বর্ণনা সহিংসতাপূর্ণ ও জটিল। কিন্তু এ গল্পের বিবরণ অনেকটাই সরল। কখনো মনে হয়, ষাটের দশকের মহল্লার কোনো সংসারী যুবক আবার কখনো কোনো সরল কিশোর আমাদের সামনে গল্প বলে যাচ্ছে, যার এ জটিল পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা কম। একটা নমুনা দেখা যাক। সাপের কামড়ে আমিনুলের মৃত্যুর ঘটনার বিবরণ এ রকম, ‘এবং আমরা আমাদের হাতের দিকে তাকাই, উল্টেপাল্টে দেখি, আমরা বুঝতে পারি যে, হাত না থাকলে আমরা বাঁচতে পারতাম না, হাত দিয়ে শুধু যে কাজকর্ম করে বেঁচে থাকি তা–ই নয়, হাত রক্ষা করা সহজ, হাত নিরাপদ দূরত্বে ঝুলে থাকে, নিজের ভার নিজেকে বহন করতে হয় না, পা কে হয় এবং তাকে রক্ষা করা কঠিন, গর্তে পড়ে ভাঙে, কুকুর/ সাপে কামড় দেয়, পা থাকার কারণেই আমিনুল হক মারা পড়ে।’

গল্পে সংলাপ পূর্বাপর সম্পর্কহীন, প্রায় ক্ষেত্রে মনোলোগ। কিন্তু তার প্রয়োগ অত্যন্ত গভীর। বিক্রেতারা চাকু দিয়ে চৌকোণা তোলা তরমুজের টুকরো বের করে বলে—‘এক্কলে মাখখন।’ আর বাড়িতে তাদের স্ত্রীরা সেই কোণা বের করে অভিভূত হয়ে বলে, ‘মনে হয় য্যান বুকের ভিতর থিকা কইলজা টাইনা বাইর করলাম।’

গল্পে কালের উল্লেখ কম, কিছুটা অনির্দিষ্ট। ইতিহাসের নানা পর্ব কিংবা নানা চড়াই-উতরাইয়ের সঙ্গে লেখক গল্পের গাঁটছড়া বাঁধেন না, এর জমিন খোলা রাখতে চান। তবু গল্পের ফোকরে কিছু নোশন বা ইঙ্গিত থাকে, যেখানে কালপর্বকে মেলানো যায়। ঘরের ঝি-বউদের ব্লেন্ডারে তরমুজের জুস বানানো কিংবা মৌসুম শেষে ফ্রিজে তরমুজ খোঁজ করার প্রসঙ্গে অনুমান করা যায় তা আশির দশকের শেষ অথবা নব্বইয়ের শুরু। এ ছাড়া মহল্লাবাসীর রূপমহল ও নিশাত সিনেমা হলে দেখা ‘চান্দা’-(১৯৬২), ‘তালাশ’ (১৯৬৩), ‘বেহুলা’ (১৯৬৫), ‘এন্ড হোয়েন শি ওয়াজ গুড’ (১৯৬৭), ‘নাগিনীর প্রেম’ সিনেমার উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘চান্দা’ ও ‘তালাশ’ সিনেমার অভিনেত্রী ঝর্ণা বসাক ওরফে শবনমকে নিয়ে তাদের গর্বের পাশাপাশি থাকে না পাওয়া অথবা কাছের মানুষকে হারানোর চাপা সন্তাপ।

জীবনের কোনো কিছুই যেহেতু রাজনীতির বাইরে নয়, তাই এ গল্পেও রাজনীতির খেইল অন্তস্রোতে প্রবাহিত। নিঃসন্তান বিধবার দেড় কাঠা জমি হাজি আবদুর রশিদ গং-এর গ্রাসের চেষ্টা, এলাকার নেতা আলমগীর হোসেনের মোটর পার্টসসহ অন্যান্য জিনিসের দাম বাড়িয়ে তার পক্ষে সাফাই গাওয়া এবং কিস্তি টুপি পরা পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রীর ভাষণের উল্লেখ গল্পে রাজনৈতিক রসদের জোগান দেয়।

মহল্লার এই রংচঙে ভিসিয়াস সাইকেলটা বিরতিহীন চলতে থাকে। কিন্তু গল্প একসময় থামে। গল্পে যে ঝলমলিয়া নগরের আশ্চর্য আখ্যানের সন্ধান মেলে, তা হয়তো কোনো মহত্তর জীবনের কথা বলে না। মহৎ গল্প বলার চেষ্টাও নেই এখানে। এতে থাকে শুধু মাধুরী, অনেক বেশি না থাকার।

সূত্র:

১. থেমে গেল দক্ষিণ মৈশুণ্ডী আর ভূতের গলির গল্প, শাহাদুজ্জামান, শহীদুল জহির রচনাসমগ্র, পৃষ্ঠা- ৬৪১।
২. ঐ, পৃষ্ঠা- ৬৪৩৷
৩—৮. আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস, ঐ, পৃ- ২৭৮।