বাংলার সংস্কৃতিতে ফোরাতের ধারা
১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দ সিলেটে বসবাসকারী ব্রিটিশ প্রশাসক রবার্ট লিন্ডসে রচিত টুয়েলভ ইয়ারস অব মাই লাইফ ইন সিলেট গ্রন্থে বাংলাদেশের মহররম উদ্যাপনের ঐতিহ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক সচেতনতার একটি সম্পর্কসূত্র আবিষ্কার করা যায়, যা নিয়ে নতুন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে।
ইসলামি চান্দ্রবর্ষপঞ্জির হিসাবে মহররমের চাঁদ উদিত হলেই হিজরি নববর্ষের সূচনা হয়। কিন্তু এ দেশে প্রচলিত অন্যান্য নববর্ষ উদ্যাপনের মতো হিজরি নববর্ষকেন্দ্রিক বৃহত্তর কোনো আনুষ্ঠানিক আয়োজন তেমন দেখা যায় না। ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ করেছি, শোকাবহ মহররম স্মরণে আমার মা আমেনা খাতুন প্রতিবছর মহররমের চাঁদ উঠলেই পরদিন থেকে টানা ১০ দিন রোজা রাখেন। পাশাপাশি অনেকটা নিয়ম করে ভোরে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত এবং কখনো দুপুরে, কখনো সন্ধ্যার পরে মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ–সিন্ধু পাঠ করেন। শুধু তা–ই নয়, প্রতিবছর মহররম এলে কারবালার প্রান্তরে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেনের সঙ্গে এজিদ বাহিনীর যুদ্ধের স্মরণে আমাদের গ্রামে লাঠিখেলার আয়োজন দেখে আসছি। এখনো মহররম বা আশুরা উপলক্ষে আমাদের ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া অঞ্চল থেকে লাঠিখেলার ঐতিহ্য সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়নি।
মহররমকেন্দ্রিক সাহিত্যিক-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান শ্রদ্ধার সঙ্গে বিষাদ–সিন্ধু ঘরে সংরক্ষণ ও পাঠ করতেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের গ্রাম-গ্রামান্তরে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির অন্দরমহলে ঢুকে দেখেছি, শুধু মহররম আর ‘বিষাদ–সিন্ধু’ একসূত্রে গাঁথা নয়, এটি এ দেশের ইসলামকেন্দ্রিক ঐতিহ্যগত সংস্কৃতির প্রাণস্পন্দন হয়ে আছে। বিশেষ করে নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন গ্রামে বিকশিত ‘বিষাদ-জারি’র আসরজুড়ে বিষাদ–সিন্ধু পরিণত হয়েছে মৌখিক রীতির অনন্য এক সৃষ্টিশীল ঐতিহ্যে। এই ঐতিহ্যের আদ্যোপান্ত বর্ণিত হয়েছে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্য: জারিগানের আসরে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ আত্তীকরণ ও পরিবেশন-পদ্ধতি শীর্ষক গ্রন্থে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, বাংলায় মহররমকেন্দ্রিক সাহিত্যিক বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আধুনিক কালের নয়, চার শতাধিক বছরের প্রাচীন।
ঐতিহাসিক উৎস থেকে জানা যায়, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাতি এবং হজরত আলী ও মা ফাতেমার বড় ছেলে ইমাম হাসানের মৃত্যুর পরপরই ইমাম হোসেন কারবালা প্রান্তরে শহীদ হন। তাঁদের উভয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর কালক্রমে পারস্য, আরব দেশ, ইরাক, লেবানন, সিরিয়ায় এমনকি বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে অনেক কিংবদন্তির জন্ম হয়। পারস্য, ইরাক, সিরিয়া ও আরবের বিশেষ করে শিয়া-মুসলিম কবিরা এজিদের সঙ্গে ইমাম হাসান-হোসেনের সংঘর্ষের কাহিনি নিয়ে কবিতা রচনা করেন। কবি জসীমউদ্দীন তাঁর জারীগান গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইমাম হোসেনের বিয়োগান্ত ঘটনা নিয়ে ইরাকের বাগদাদে মইজুদ্দৌলার রাজত্বকালে (হিজরি ৩৫২ সনের হিসাবে ৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে) মহররম মাসের দশম তারিখে প্রথম শোক প্রকাশ করা হয়। সে সময় দলে দলে বহু লোক কারবালার প্রান্তরে গিয়ে শোক প্রকাশ করেন। অন্যদিকে কারবালার শোকাবহ ইতিহাস নিয়ে কবিতা রচনার সূচনা হয় পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে। বাংলায় মর্সীয়া সাহিত্য গ্রন্থের প্রণেতা গোলাম সাকলায়েনের দেওয়া তথ্যমতে, পারস্যদেশীয় কবি মুল্লা মুহ্তশম্ কাশানি, মুকবিলসহ বেশ কয়েকজন বিষয়টি নিয়ে প্রথম পর্যায়ে কবিতা রচনা করেন। তাঁদের মধ্যে কবি মুকবিলের কবিতায় কারবালার রোমহর্ষ ঘটনার প্রত্যেক অংশের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়। কারবালার ঘটনার শুরু থেকে ইমাম হোসেনের পরিবারের বন্দী হওয়া এবং তাদের মুক্তিলাভের পর মদিনায় আসা পর্যন্ত সব ঘটনা তিনি এমন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কবিতায় বর্ণনা করেছেন যে তাকে কবিতা না বলে কবিতার মাধ্যমে কারবালার ঘটনার একটি যথার্থ ইতিহাস বলা যায়। কবি মুকবিলের মৃত্যুর পর ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইরানি কবি মির্জা হাবিব (ক্বানি) ইমাম হোসেনের শাহাদাতবৃত্তান্ত নিয়ে হৃদয়স্পর্শী ভাষায় কবিতা রচনা করেন। অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে উর্দু সাহিত্যে কবি মীর বাবর আলী আনিস, মির্জা সালামত আলী দবির প্রমুখ হাসান-হোসেনের মৃত্যুকাহিনি নিয়ে শোককাব্য বা মর্সিয়া রচনা করেন। এমনকি আরবি সাহিত্যেও ফারাজাদক বা হাম্মান বিন গালিবের মতো কবি এই বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করেন। গবেষকদের ধারণা, মীর মশাররফ হোসেন বিষাদ-সিন্ধু রচনায় এসব বই অনুসরণ করেছিলেন।
বাংলা ভাষায় কারবালার করুণ ইতিহাসকেন্দ্রিক এক বিশাল সাহিত্যভান্ডার গড়ে উঠেছে সেই মধ্যযুগ থেকে। কারবালার মর্মান্তিক ঘটনার ওপর রচিত সবচেয়ে প্রাচীন পুঁথিগ্রন্থ হলো চট্টগ্রামের লোকপ্রিয় কবি মুহম্মদ খানের ‘মোক্তাল হোসেন’ বা ‘মকতুল হুসৈন’ (১৬৪৫-৪৬)। মুহম্মদ এনামুল হক ও সুকুমার সেনের মতে, ষোড়শ শতকে পুঁথিসাহিত্যের ধারায় শেখ ফয়জুল্লাহ ‘জয়নবের চৌতিশা’ রচনা করেন। এতে কারবালার করুণ কাহিনির সঙ্গে জড়িত ইমাম হোসেনের আত্মীয় বিবি জয়নবের বিলাপ বর্ণিত হয়েছে। এই কাব্যের প্রথম কয়েক পৃষ্ঠায় লিখিত বিষয়বস্তুর সঙ্গে কবি মুহম্মদ খানের ‘মোক্তাল হোসেন’ (মকতুল হুসৈন) কাব্যের অংশবিশেষের কিছু সামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। জয়নবের চৌতিশা কারবালা যুদ্ধসম্পর্কিত বড় কাব্য নয়; বিরাট কারবালা কাহিনির একটি অতি ক্ষুদ্র ঘটনা অবলম্বনে বিশেষ আঙ্গিকে রচিত কাব্য। এ ছাড়া ষোড়শ শতাব্দীর আরেকজন কবি দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত জঙ্গনামা নামে একটি খণ্ডিত পুঁথির সন্ধান পাওয়া গেছে। আসলে এসব কাব্যের আদর্শে পরবর্তীকালে বাংলা ভাষায় কারবালাবিষয়ক অসংখ্য পুঁথি রচিত হতে থাকে। এর মধ্যে ফকীর (বা শাহ) গরীবুল্লাহর জঙ্গনামা, হায়াৎ মাহমুদের জারী জঙ্গনামা মুনশী জনাব আলীর শহীদে কারবালা, শেখ মুহম্মদ মুনশীর শহীদে কারবালা, জাফর রচিত ‘শহীদ-ই-কারবালা’ ও সখিনা বিলাপ, রাধাচরণ গোপের ওফাৎনামা ও ইমামের কেচ্ছা, হামিদ রচিত সংগ্রাম হুসন, মুহম্মদ ইসহাক উদ্দীনের দাস্তান শহীদে কারবালা, কাযী আমীনুল হকের জঙ্গে কারবালা, ওয়াহিদ আলীর জঙ্গনামা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শেষোক্ত কাব্যটি সিলেটি নাগরী লিপিতে রচিত।
রংপুরের কবি হায়াৎ মাহমুদ ১৭২৩ সালে রচিত জারী জঙ্গনামা কাব্যে আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘পড়িনু শুনিনু ভাই আরবি ফারসি।/ ইমামের কথা শুনি দুঃখ মনে বাসি॥/ যতেক শুনিনু মুঞি পুস্তক বয়াতে।/ কথো আছে কথো নাহি কিতাবের মতে॥/ নাহি জানে আদ্যকথা নাহি পায় তত্ত্ব।/ পচাল পাড়িয়া মিথ্যা ফিরয়ে সতত॥/ তাহা শুনি মনে মোর দ্বিধা সর্বক্ষণ।/ রচিনু পুস্তক তবে জানিতে কারণ॥’ বাংলা লোককাব্য বা মর্সিয়া সাহিত্যের ধারায় মুহম্মদ খানের ‘মকতুল হুসৈন’ কাব্যের পরে হায়াৎ মাহমুদের জারী জঙ্গনামা পূর্ণ কাব্য । এ কাব্যের একটি বৈশিষ্ট্য হলো প্রতি পর্বের শুরুতে একেকটি করে ধুয়া সংযুক্ত রয়েছে। এ ধরনের ধুয়া এখনো লোকায়ত পর্বে মহররমের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে জারি-মর্সিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
পুরান ঢাকার বিখ্যাত ইমামবাড়া তথা হোসেনি দালানকেন্দ্রিক মহররম উদ্যাপনের প্রায় চার শ বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের আড়ালে থেকে গেছে এ দেশের বৃহত্তর কৃত্যমূলক সংস্কৃতির গভীর ও ব্যঞ্জনাময় পরিচয়। বিশেষ করে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলায় গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠা পাঞ্জাতনের মুকামকেন্দ্রিক ১০ দিনব্যাপী মহররম উদ্যাপনের প্রান্তিক ও প্রাণবন্ত ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করলে বহু ধরনের লৌকিক সাধনা, জ্ঞান, শিল্পচর্চার পাশাপাশি মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক সম্পর্কসূত্র আবিষ্কার করা সম্ভব। অন্যদিকে মানিকগঞ্জের গড়পাড়া, কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মহররম পালন বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি প্রত্যক্ষ করা যায়।
সবশেষে একটি বিষয় উল্লেখ করা সমীচীন। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, বাংলাদেশে মহররম পালনের এই সংস্কৃতি শুধু কৃত্য হয়ে থাকেনি, একসময় তা বিদ্রোহেও পরিণত হয়েছিল। ১৭৭৮ সালে সিলেটে মহররম পালনের ঐতিহ্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে রূপলাভ করেছিল।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে মহররম পালনের সঙ্গে পীর-ফকিরদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিশেষ করে সিলেট, কিশোরগঞ্জ, মানিকগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলের মহররম পালনে পীর-ফকির ও তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রত্যক্ষ করা যায়। তবে ১৭৭৮ সালে সিলেটে বসবাসকারী ব্রিটিশ প্রশাসক রবার্ট লিন্ডসে রচিত টুয়েলভ ইয়ারস অব মাই লাইফ ইন সিলেট (আবদুল হামিদ মানিক ভাষান্তরিত সিলেটে আমার বারো বছর) গ্রন্থে বাংলাদেশের মহররম পালনের ঐতিহ্যের সঙ্গে রাজনৈতিক সচেতনতার একটি সম্পর্কসূত্র আবিষ্কার করা যায়, যা নিয়ে নতুন আঙ্গিকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে কেউ এ বিষয়ে গবেষণায় তৎপর হবেন।