পরীমনি যেভাবে ‘পুরুষ দৃষ্টি’র সীমা ভাঙলেন

পরীমনি
ছবি: কবির হোসেন
সম্প্রতি তারকা দম্পতি পরীমনি ও শরীফুল রাজের দাম্পত্য সংকট গোপনীয়তার গণ্ডি পার করে জনপরিসরে চলে এসেছে। সাক্ষাৎকারে পরীমনি নিজেই বলেছেন, ‘আমার সবকিছু পাবলিককে দিয়ে দিলাম।’ এভাবেই কি ‘পুরুষ দৃষ্টি’র সীমা ভাঙলেন এই নায়িকা?

আকাশের তারাকে আমরা ছুঁতে পারি না, কিন্তু নিজেকে ঢেকে রাখার অধিকার তার নেই। প্রদর্শনীর জন্য সে সদা উপস্থিত। বিনোদন জগতের তারাদের হালও অনেকটা তাই। তাঁদের গোপন ও প্রকাশের সীমারেখা বড়ই অস্পষ্ট এবং ক্রমাগত নির্মাণাধীন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই প্রবাল্যে মেটা–দুনিয়ায় আমাদের সবার জীবনই কি অনেকটা সে রকম নয়?

যাঁরা তারকা, তাঁরা রিল ও ‘রিয়েল লাইফ’ বা পর্দা ও বাস্তবের জীবনকে অনেক সময়ই গুলিয়ে ফেলেন—এটা হলো পুরোনো ও প্রতিষ্ঠিত বয়ান। কিন্তু এখন আমাদের যে বাস্তব, তা অনেক অনেক পর্দার সমষ্টি, যেসব পর্দা প্রতিনিয়তই নানা ধরনের বয়ানের প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। আর এই প্রতিফলন ও বিচ্ছুরণ ঘটছে নানান দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গিতেও। হালফিল সময়ে আমাদের জীবন তাই একটি ক্রমাগত পরিবর্তনশীল ‘মেকানিজম’, অনেক সময়ই যার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না; এমনকি নিয়ন্ত্রণ থাকছে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ারও সুযোগ থাকছে না!

ক্যাফে লাইভে পরীমনি
প্রথম আলো

সম্প্রতি তারকা দম্পতি পরীমনি ও শরীফুল রাজের দাম্পত্য সংকট গোপনীয়তার গণ্ডি পার করে জনপরিসরে চলে এসেছে। সাক্ষাৎকারে পরীমনি নিজেই বলেছেন, ‘আমার সবকিছু পাবলিককে দিয়ে দিলাম।’

পরিবার বা সংসারকে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে আদি হেজেমনিক প্রতিষ্ঠান—স্বামী ও স্ত্রী যে প্রতিষ্ঠানের মূল ভিত। একটি কার্যকর সমাজব্যবস্থা অটুট রাখতে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানকে অটুট রাখা জরুরি। তাই পরিবারে ফাটল বা ভাঙন মেরামতে সমাজের মুরব্বিদের এগিয়ে আসার বিষয়টির ঐতিহ্য রয়েছে এই অঞ্চলে। এখনো গ্রামাঞ্চলে বা শহরতলিতে এই প্রথা বিদ্যমান। কিন্তু সজ্ঞানে বা অবচেতনে আমরা যখন মেটা–দুনিয়ার নাগরিকত্ব কবুল করে নিয়েছি, তখন সেখানকার মুরব্বি কে?

মেটা–দুনিয়ার মুরব্বি হলো ‘পাবলিক’, বাংলায় যাদের আমজনতা বলা যেতে পারে। আর তাই কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নয়, এই দুই তারকা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিজেদের বয়ান দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলেন। শুধু তা–ই নয়, সামাজিক মাধ্যমে এসে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করে নিজ নিজ জায়গা থেকে তাঁদের বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার চেষ্টাও করলেন। তবে এখানে পর্দায় তাঁদের ক্রমাগত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হলো এবং থাকতে হলো সবার দৃষ্টিসীমায়।

লারা মালভি
ছবি: সংগৃহীত

কারণ, পুঁজিবাদী সমাজে কোনো তারকার পক্ষে নিজের জীবনকে খুব ব্যক্তিগত করে রাখা বেশ কঠিন, তিনি চাইলেও পারবেন না। আর এই মেটা–দুনিয়ায় তা তো এখন আরও বেশি দুঃসাধ্য। সব সময় ‘পাবলিক’–এর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেন তারকারা; জনতারূপী ‘পাবলিক’ জানতে চায় তাদের সর্বশেষ আপডেট। এ কারণেই কি রাজ–পরীকে তাঁদের দাম্পত্যের বিষয়–আশয় এবং পরস্পরের প্রতি নিজেদের অভিযোগ–অনুযোগ নিয়ে ‘পাবলিকের আদালত’–এ হাজির হতে হলো? ‘পাবলিক’কে ‘মুরব্বি’ মানতে হলো?

প্রশ্নগুলোর উত্তর আসলে কঠিন। সহজ কথায় এটুকু বলা যায়, এগুলো হলো সমাজের মধ্যে পুঁজিবাদের দানবীয় বিকাশের ফল। আর পুঁজিবাদী সমাজে যদি পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার আধিক্য থাকে তাহলে কী ঘটে, তা–ও আমরা এই দুই তারকার সাম্প্রতিক ঘটনাবলি অবলোকন করলে বুঝতে পারব।  

পুরুষ দেখবে আর নারীকে দেখা হবে—এটাকেই স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে বা করতে চায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এই দৃষ্টির দায়রায় নারী কেবল দেহ নয়, তাঁর নিজের ইমেজ বা উপস্থাপনের ওপরও তাঁর কোনো কর্তৃত্ব নেই। কিছু বেঁধে দেওয়া উপস্থাপনের বাইরে তাই নারীর যাওয়ার সুযোগ কম। যেমন নারী নিজের যৌন আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটাবেন না, গোপনীয়তার গণ্ডি অতিক্রম করবেন না, সংসার অটুট রাখার পূর্ণ দায়িত্ব নেবেন, সন্তান প্রতিপালনের পূর্ণ দায়িত্ব নেবেন, সঙ্গীর স্খলন মেনে নেবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা সহজাতভাবেই পুরুষতান্ত্রিক। পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিনোদন, যা পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শেই গড়ে উঠেছে। বিনোদনের জগতে বিষমকামী পুরুষের দর্শনতুষ্টির মূল খোরাকই হলো নারীর উপস্থিতি। নারীকে দেখা ও উপস্থাপনের এই তরিকা প্রথম ব্যবহার করেন ব্রিটিশ সমালোচক জন বার্জার। ইউরোপীয় চিত্রশিল্পে নারী—এই বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনি হাজির করেন ‘দ্য গেজ’ বা দৃষ্টির তত্ত্ব, যা বিশ্লেষণ করে পরোক্ষ বস্তু হিসেবে নারীর উপস্থাপন। তাঁর পর্যালোচনায় উঠে আসে ইউরোপীয় শিল্পে নারীকে দেখাই হচ্ছে নগ্ন ভোগ্যবস্তু হিসেবে।
 
যদিও ‘দ্য গেজ’ বা দৃষ্টির শক্তির কথা প্রথম উল্লেখ করেন অস্তিত্ববাদের অন্যতম প্রবক্তা জ্য পঁল সার্ত্রে। তিনি বলেন, ব্যক্তির দৃষ্টি ক্ষমতাকাঠামোর গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। কাকে, কখন, কীভাবে দেখা হচ্ছে; তাঁর অগোচরে দেখা হচ্ছে কি না—এমন অনেক বিষয়ের ওপর টিকে থাকে ক্ষমতার ভারসাম্য।

পরীমনি
ছবি: সংগৃহীত

তাহলে দেখা যাচ্ছে, পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারী সব সময়ই দৃষ্টির অধীন। কীভাবে? ‘ভিজ্যুয়াল প্লেজার অ্যান্ড ন্যারেটিভ সিনেমা’ বইয়ে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ব্রিটিশ সমালোচক লরা মালভি। তিনি বলেছেন, ‘মেল গেজ’ হলো  পুরুষের দৃষ্টির কথা। নারীদেহ অনবরত পুরুষ দৃষ্টি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই নিয়ন্ত্রণ ব্যক্তি হিসেবে নারীর এজেন্সি বা কর্তৃত্ব কেড়ে নেয়। তাঁকে পরিণত করে একটি বস্তুতে, যার কোনো অবস্থান নেওয়ার ক্ষমতা নেই। এই ব্যবস্থায় নারীর কেবলই পণ্যায়ন ঘটে।

পুরুষ দেখবে আর নারীকে দেখা হবে—এটাকেই স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে বা করতে চায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। এই দৃষ্টির দায়রায় নারী কেবল দেহ নয়, তাঁর নিজের ইমেজ বা উপস্থাপনের ওপরও তাঁর কোনো কর্তৃত্ব নেই। কিছু বেঁধে দেওয়া উপস্থাপনের বাইরে তাই নারীর যাওয়ার সুযোগ কম। যেমন নারী নিজের যৌন আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটাবেন না, গোপনীয়তার গণ্ডি অতিক্রম করবেন না, সংসার অটুট রাখার পূর্ণ দায়িত্ব নেবেন, সন্তান প্রতিপালনের পূর্ণ দায়িত্ব নেবেন, সঙ্গীর স্খলন মেনে নেবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

‘পুরুষ দৃষ্টি’র আওতাধীন পরীমনিও সংসার টিকিয়ে রাখতে যা যা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার বিবরণ দেন। লাইভ সাক্ষাৎকারে তিনি বারবার বলেন, তাঁর চলনে–বলতে কোনো বিচ্যুতি কখনো ঘটেনি। সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়, এমন কোনো কিছু তিনি করেননি। তবে একই সঙ্গে তিনি জোর গলায় ‘সন্তানের মা’–এর তকমাকে অগ্রাহ্য করেন, জীবনসঙ্গী হিসেবে প্রাপ্য সম্মান দাবি করেন, সন্তান প্রতিপালনে অংশীদারত্ব দাবি করেন।

পরীমনি ও শরিফুল রাজ
ছবি: প্রথম আলো

একটি অসম সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখতে অস্বীকৃতি জানানো ‘পুরুষ দৃষ্টি’কে চ্যালেঞ্জ করা হয় বটে! পরীমনি ও শরীফুল রাজের দাম্পত্য সম্পর্কের লেনদেন এবং সত্য–মিথ্যার হিসাব আমাদের অজানা। তবে মেটা–দুনিয়ার পরতে পরতে প্রতিনিয়তই যখন নতুন বয়ানের নির্মাণ এবং অগুনতি দৃষ্টির কর্তৃত্বের লড়াই, সেখানে পরীমনির পুরুষের পৃথিবীতে নারীর নির্মাণ ভাঙার এই প্রয়াসের গ্রহণযোগ্যতার বিচার না করলেও চলে।