আনন্দের এ বার্তা সব ছেলের কাছে পৌঁছে দাও

রংপুরের এক তরুণ মুক্তিযুদ্ধের সময় হয়ে উঠলেন অকুতোভয় যোদ্ধা। ঢাকা থেকে অনেক দূরে বসে বিজয়ের আনন্দ কীভাবে উদ্‌যাপন করেছিলেন তিনি?

স্বাধীনতা হওয়ার আনন্দে মানুষের উল্লাস, ১৯৭১ছবি: সংগৃহীত

দুপুরের পর সুবেদার খালেক আসেন তাঁর সেই পরিচিত ভঙ্গি নিয়ে। কয়েকজন সৈনিক তাঁর সাথে।

বাঙ্কারে শুয়ে ছিলাম আমরা। বলতে গেলে একটা বন্ধ্যা সময় যাচ্ছে। জেনারেল রাও ফরমান আলীকে চূড়ান্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে আত্মসমর্পণের জন্য। কিন্তু তাঁর তরফ থেকে কোনো রকম সাড়া-শব্দ নেই। এদিকে ফ্রন্টও চুপচাপ। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর তরফ থেকে কোনো আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেই। শুধু খবর আসে, ভাতগা দখল হয়ে গেছে। শুধু তা–ই নয়, ভাতগা ব্রিজের পাশ দিয়ে নদীর ওপর পন্টুন ব্রিজ তৈরি করে মিত্রবাহিনী ট্যাঙ্ক নিয়ে এগিয়ে গেছে দশমাইলের দিকে। মুক্তিবাহিনীর একটা অংশ আছে তাদের পদাতিক দলের সাথে। আমাদের বাবলু, মতিয়ার আর একরামুলরা তো রয়েছেই।

সুবেদারকে বলি, যাবেন কোথায় দাদু?

: ইয়ানো, চলেন একটু লঙ্গরখানা থন ঘুইরা আসি। সময় কাটতাছে না বুঝছননি?

: ঠিক আছে চলেন। বলে পিন্টুকে সাথে করে রওয়ানা দিই। ওয়াকি–টকি সেটটা ব্যাটারির অভাবে অচল ছিল কদিন। গতকাল থেকে নতুন ব্যাটারি পেয়ে সচল হয়েছে সেটা। পিন্টুকে বলি, ওয়াকি–টকি সেটটা সাথে নিতে। কেননা, কখন কোন নির্দেশ আসে, বলা তো যায় না।

মাহবুব আলম

২০/২৫ মিনিট হাঁটার পর আমাদের লঙ্গরখানায় পৌঁছানো যায়। বেশ বড় একটা পরিত্যক্ত ধানকলের ভেতর স্থাপন করা হয়েছে লঙ্গরখানাটি। এই লঙ্গরখানা থেকে প্রতিদিন আমাদের খাবার তৈরি হয়েছে, অমানুষিক পরিশ্রম করেছে লঙ্গরখানার প্রত্যেক সদস্য এ কাজে। নানা প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতিতে, বিপদের ভয়াবহ ঝুঁকি মাথায় নিয়েও। সনাতনী উপায়ে বাঁশের ভাঁড়ে করে এখান থেকে খাবার পৌঁছানো হয়েছে ফ্রন্টের প্রতিটা বাঙ্কারে–ট্রেঞ্চের পোস্টে। এ কাজ করতে গিয়ে অনেককে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছে। আমাদের সম্মুখযুদ্ধে আসার প্রথম দিন চৈতনপাড়ায় চারজন খাদ্যবাহী মানুষকে একেবারে চোখের সামনে বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে দেখেছি। এর বাইরে কতজন যে হতাহত হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই।

লঙ্গরখানার মানুষজন ব্যস্ত রাতের খাবার তৈরি করার কাজে। এখানকার কমান্ডার নায়েব সুবেদার এগিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানান। দৌড়ঝাঁপ করে বসার আয়োজন করে লোকজন। এভাবে লঙ্গরখানা দেখতে আসায় খুশি হয়েছে সবাই খুব। নায়েব সুবেদার চা-নাশতা দিয়ে আপ্যায়ন করেন। তারপর তাঁর কিছু কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন সুবেদার খালেকের সাথে। যুদ্ধ এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়েও কথা হয়। শেষে আমরা উঠি। ফিরে চলি আমাদের অবস্থানের দিকে।

বিকেল সাড়ে চারটা তখন। আমরা বীরগঞ্জ পেছনে রেখে আমাদের আস্তানার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। হঠাৎ করে ওয়াকি–টকি সেটে ভেসে আসে ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের গলা, টু ফোর ওয়ান। টু ফোর ওয়ান। ক্যান ইউ হিয়ার মি? ওভার।

জবাব দেই, ওয়ান ফোর টু। ওয়ান ফোর টু। লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার। ওভার।

: কংগ্র্যাচুলেশনস, মাহবুব! বিরাট সুখবর। আজ বিকেলে ঢাকা রেসকোর্সে পাকিস্তানি বাহিনী সারেন্ডার করেছে। ওভার

: কংগ্র্যাচুলেশন্স, স্যার। বিরাট সুখবর। যুদ্ধ তাহলে শেষ। স্বাধীনতা এল তাহলে। ওভার।

: ইয়েস বয়েজ। আনন্দের এ বার্তা সবগুলো বাঙ্কারে-ট্রেঞ্চে—সব ছেলের কাছে পৌঁছে দাও। কিন্তু সংযত থাকবে সবাই। আজকে আনন্দ করবে না। সামনে অনেক কাজ। ওভার।

: ওকে স্যার। আপনার কাছ থেকে পাওয়া বিজয়ের প্রথম বার্তা সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। ওভার।

: আমাদের সম্মুখে সৈয়দপুর রণাঙ্গনের পাকিস্তানি সেনারা ভাতগা নদীর ওপারে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। তারা আজ সারেন্ডার করতে পারে। সারেন্ডারের বিধি অনুযায়ী তাদের সারেন্ডার করাতে হবে। ফ্রন্টের কেউ ঘুমাবে না, হইচই করবে না, সারারাত জেগে থাকবে। আজ রাতে হয়তো আমাদের শেষ কষ্ট। আগামীতে আনন্দ। বুঝতে পারছ! ওভার।

: ইয়েস স্যার। নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানা হবে। আমাদের সবার তরফ থেকে ফিল্ড কমান্ডার হিসেবে আপনাকে এবং এবং সাব-সেক্টর কমান্ডার সদরুদ্দিন সাহেবকে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন। ওভার।

: ধন্যবাদ। ওভার।

: ওভার।

কথোপকথন শেষে সুবেদার খালেক জড়িয়ে ধরলেন। হাউহাউ করে কেঁদে ফেললেন আনন্দের আতিশয্যে। পাশে দাঁড়ানো আমার কোম্পানির সেকেন্ড ইন কমান্ড পিন্টু। জাপটে ধরে সে আমাকে। তারপর ছেড়ে দিয়ে দুপাক ঘুরে নাচার ভঙ্গিতে হাত ওপরে তুলে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘স্বাধীনতা স্বাধীনতা, মুক্তি মুক্তি, সারেন্ডার, সারেন্ডার;’ এবং সবশেষে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল সেই চিরায়ত স্লোগান, ‘জয় বাংলা...।’

শীতের সন্ধ্যা তখন নেমে এসেছে। চারদিকে কুয়াশার চাদর। সুবেদার খালেক তার সহকর্মী সেনাসদস্যদের নিয়ে চলে গেলেন তাঁর বি কোম্পানির অবস্থানে। প্রতিটি বাঙ্কারে-ট্রেঞ্চে জানানো হলো এই আনন্দ–সংবাদ। পাকিস্তানি সেনারা সারেন্ডার করলে কী কী পদ্ধতি নিতে হবে, তা সবাইকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। ছেলেরা ছাড়তে চায় না। উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে। সবার চোখে–মুখে আবেগ-উচ্ছ্বাস আর আনন্দের জোয়ার। কেউ বাধা মানে না। কাউকে থামানো যায় না। সমস্ত ফ্রন্টে আনন্দ-উল্লাস আর ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উত্তাল তরঙ্গের মতো জেগে ওঠে।

...

মাহবুব আলম রংপুরের এক তরুণ। মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ নিয়ে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন ৬ নম্বর সেক্টরের ভজনপুর সাব-সেক্টরে। গেরিলাযোদ্ধা হিসেবে শুরু করে শেষ পর্যন্ত সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ও অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর বই গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে [সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯২] থেকে নির্বাচিত অংশ।