কেন আমরা প্রত্যেকেই এখন পণ্য

পার্সোনাল বা ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডের এই জমানায় প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই এখন পণ্য। স্ব–মার্কার বাজারজাতকরণে ২৪ ঘণ্টা নিয়োজিত প্রত্যেক মানুষ। কেন আমরা প্রত্যেকেই এখন পণ্য? পণ্যায়িত দুনিয়ায় আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করছেন কোন সে জন?

২০১৬ সালের ২১ অক্টোবর নেটফ্লিক্সে প্রকাশিত হয় কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক সিরিজ ‘ব্ল্যাক মিরর’–এর তৃতীয় সিজন। প্রথম পর্বে দেখানো হয়েছিল ভবিষ্যতের এমন এক সমাজ, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের চোখের পেছনে ইমপ্ল্যান্ট বসানো রয়েছে, যা সংযুক্ত তাদের মুঠোফোনের সঙ্গে। এই সমাজে নাগরিক সুবিধা রেটিংয়ের ওপর নির্ভর করে। পাঁচ তারকা রেটিংয়ের অধিকারীদের আর্থসামাজিক অবস্থান সবচেয়ে ভালো। যেকোনো মানুষের দিকে তাকালেই আপনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার রেটিং দেখতে পাবেন এবং আপনিও ক্রমাগত যাচাইয়ের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে থাকবেন। ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে মনে হয়, কাল্পনিক সেই সমাজ আজ বাস্তব।

পার্সোনাল বা ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডের এই জমানায় প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই এখন পণ্য। স্ব–মার্কার বাজারজাতকরণে ২৪ ঘণ্টা নিয়োজিত প্রত্যেক মানুষ। আপনি একজন শিক্ষার্থী, সংগীতশিল্পী, খেলোয়াড়, অভিনয়শিল্পী, নভোচারী কিংবা গৃহিণী—যে–ই হোন না কেন, আত্মপ্রচারে আপনি নিমগ্ন। আপনি সারা দিনে যা যা করছেন—ফেসবুকে স্টোরি, রিলস বা স্ট্যাটাস আপডেটের মাধ্যমে দুনিয়াকে জানানোর তাড়না বোধ করবেন, ইনস্টাগ্রামে নানা ধরনের ছবি–ভিডিওর মাধ্যমে নিজের সামাজিক, ব্যক্তিগত ও আদর্শিক জীবন গড়বেন, লিঙ্কডইনে ক্যারিয়ারের অগ্রগতি লিপিবদ্ধ না করলে পিছিয়ে পড়ার ভয়ে কুঁকড়ে থাকবেন।

ফরাসি তাত্ত্বিক গায় ডিবর্ড
ছবি: সংগৃহীত

ফরাসি তাত্ত্বিক গায় ডিবর্ড এমন এক সমাজের কথা বলেছিলেন আরও আগেই। গত শতকের সত্তরের দশকেই তিনি বলেছিলেন, যে জীবন আগে যাপিত হতো, তা এখন কেবলই উপস্থাপিত। মানুষের পারস্পরিক ক্রিয়া–প্রতিক্রিয়া ইমেজ বা ছবি দ্বারা প্রতিস্থাপিত। ডিবর্ড বলছিলেন, একটি ভোগবাদী সমাজে সামাজিক জীবনযাপনের জন্য নয়, বরং পাওয়ার জন্য; এই যে আকর্ষণীয় প্রদর্শন (স্পেকটেকল) তা ছবি ব্যবহার করে বোঝায় মানুষের কী প্রয়োজন এবং কী অবশ্যই পেতে হবে। এর ফলস্বরূপ, সামাজিক জীবন আরও দূরে সরতে থাকে; এবং ‘পাওয়া’র স্থিতি থেকে সরে ক্রমেই ‘উপস্থাপন’–এর দিকে ধাবিত হয়; অর্থাৎ ছবির আবির্ভাবের দিকে।’ তার মানে প্রকৃত জীবনের থেকে বানিয়ে তোলা জীবনই ‘সত্যি’ হয়ে উঠতে থাকে।  

ধরুন, আপনি একজন সংগীতশিল্পী। টিকটকে গান পোস্ট করে ভাইরাল হয়েছেন আর সেই সুবাদে বড় কোনো লেবেলওয়ালা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিও বাগিয়ে নিয়েছেন। হঠাৎ দেখবেন, বছরের পর বছর আপনি নিজের শিল্পের মানোয়ন্নয়নে কোনো বিনিয়োগই করতে পারছেন না। দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা আপনি অবিরাম আত্মপ্রচারের ট্রেডমিলে দৌড়াচ্ছেন। আপনার গায়কির কোনো উন্নতি হচ্ছে না কিন্তু বাজারজাতকরণের কৌশল আপনি দারুণভাবে রপ্ত করে নিচ্ছেন।

 অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে দিচ্ছে আপনার অনলাইন জীবনের গতিপথ। সেই পথ ধরে আপনি এগিয়ে যাচ্ছেন এবং আপনার ভবিষ্যৎকে আকার দিচ্ছেন। আর ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে আপনার প্রকৃত জীবনের সমীকরণ। বিশেষ করে জেনারেশন জেড বা ‘জেন জি’, অর্থাৎ ১৯৯৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যাঁরা জন্মেছেন, তাঁদের জীবনভঙ্গি চূড়ান্তভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এই জেন জিদের মূল্যবোধের ধারণাই গড়ে উঠেছে অ্যালগরিদমের ওপর ভিত্তি করে।

মার্কিন লেখক ও প্রাবন্ধিক উইলিয়াম ডেরেসিউক্জ বলেন, শিল্পীরা এখন উদ্যোক্তাদের মতো চিন্তা করছেন। তিনি আরও বলেন, প্রত্যেক শিল্পীকেই এখন বহুমাত্রিক হতে হবে। যেকোনো ভালো ব্যবসার মতোই বহুমুখী উপযোগিতার কথা ভাবতে হবে। শিল্প এখন পরিচিত, ছকে বাঁধা, ব্যবহারোপযোগী এবং খুশি করতে উন্মুখ, অনেকটা বিনোদনের মতো।

‘দ্য গার্ডিয়ান’কে দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে কানাডীয় লেখক নাওমি ক্লেইন বলেন, ‘নব্য উদারনীতিবাদ (নিওলিবারালিজম) এমন দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে যে আত্মপণ্যায়নই এখন যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অর্জনের একমাত্র পথ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অবিরাম আত্মপ্রচারের সব হাতিয়ার আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে।’  

কিন্তু অবিরাম আত্মপ্রচারের ফল কী হচ্ছে। অনলাইনে অগণিত প্ল্যাটফর্মে আপনি বিনা মূল্যে নিজেকে তুলে ধরতে পারছেন। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত এসব প্ল্যাটফর্মে আপনি কোনো বিভেদ বা বিদ্বেষের শিকার হচ্ছেন না? আসলেই কি অনলাইন দুনিয়া শ্রেণি বৈষম্যহীন? তাহলে কেন আপনাকে কিছু ‘স্বীকৃত’ বা ‘গৎবাঁধা’ উপায়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে হচ্ছে? শুধু তাই নয়, আপনি নিজেকে অরক্ষিত অবস্থায় মেলে ধরছেন সব ধরনের মানুষের সামনে, বাড়ছে হেনস্তা ও নির্যাতনের ঝুঁকি।

‘ব্ল্যাক মিরর’–এর দৃশ্যে ব্রাইস ডালাস হাওয়ার্ড
ছবি: সংগৃহীত

অপার সম্ভাবনাময় এই দুনিয়ারও ঈশ্বর আছে। আর সেই ঈশ্বর হলো অ্যালগরিদম। অ্যালগরিদম নির্ধারণ করে দিচ্ছে আপনার অনলাইন জীবনের গতিপথ। সেই পথ ধরে আপনি এগিয়ে যাচ্ছেন এবং আপনার ভবিষ্যৎকে আকার দিচ্ছেন। আর ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে আপনার প্রকৃত জীবনের সমীকরণ। বিশেষ করে জেনারেশন জেড বা ‘জেন জি’, অর্থাৎ ১৯৯৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে যাঁরা জন্মেছেন, তাঁদের জীবনভঙ্গি চূড়ান্তভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এই জেন জিদের মূল্যবোধের ধারণাই গড়ে উঠেছে অ্যালগরিদমের ওপর ভিত্তি করে। যেহেতু এটা দেখেই তাঁরা বেড়ে উঠেছেন যে তাঁদের আর্থসামাজিক অবস্থান পুরোটাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপস্থাপনের ওপর নির্ভরশীল, তাই সে অনুযায়ী তাঁরা নিজেদের মূল্যবোধ বা আদর্শিক অবস্থান যেকোনো মুহূর্তে পাল্টে ফেলছেন।

লেখিকা ও ব্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজিস্ট রেচেল কে অ্যালবার্স—এ প্রবণতাকে বলছেন ‘অনলাইন বিজনেস ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স।’ অনলাইন ‘গুরু’রা আমাদের ক্রমাগত উপার্জনের পথ বাতলে দিচ্ছেন। ‘ফ্রি–ল্যান্সিং’ হয়ে উঠেছে ডিজিটাল যুগে সাফল্যের মূলমন্ত্র। তবে সে জন্য সামাজিক মাধ্যমে নিজের উপস্থিতির জানান দিতে হবে ক্রমাগত, ‘সেল্‌ফ মার্কেটিং’ বা আত্মবাজারজাতকরণ হয়ে দাঁড়াবে আপনার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। একটি সমাজ, যার প্রতি সদস্য একজন জীবন্ত কুটিরশিল্প হয়ে উঠতে পেরেছেন, সেটাই তো মুক্তবাজার অর্থনীতির যৌক্তিক পরিণতি।