এন্নিও মোররিকোনে, শোনাতেন ছুটন্ত ঘোড়ার খুরের সুর
বাংলা সিনেমার এক টিপিক্যাল দৃশ্য দিয়ে শুরু করা যাক। ধরলাম, সিনেমার নায়ক জসিম। পাহাড়ের পাদতলে ঘোড়া ছুটিয়ে তিনি ছুটে যাচ্ছেন ভিলেন জাম্বুকে পাকড়াও করতে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে। এক ভুতুড়ে-রহস্যময় সুর। ড্রামের মৃদু তালে তালে ঠোঁটের শিস। ট্রাম্পেটের ঢেউ। কখনো সেই সুর মিলিয়ে যাচ্ছে হ্রেষায়, কখনো খুরের টগবগে (সুরকে যদি ভাষায় প্রকাশ করা যেত!)। ক্ষণে ক্ষণে গা শিউরে উঠছে দৃশ্য ও সুরের পরম্পরায়, ঘটনার উত্তেজনায়। কিন্তু তখন কি জানতাম, বাংলা সিনেমায় এমন জাদুকরি সুর নেওয়া হয়েছে ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’ থেকে!
কিংবদন্তি ইতালিয়ান কম্পোজার প্রয়াত এন্নিও মোররিকোনের এই ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর বিশ্ব সিনেমার জগতে অনন্য হয়ে থাকবে সব সময়। তেমনি ‘স্পেগেত্তি ওয়েস্টার্নের’ স্রষ্টা সার্জিও লিওনের ‘ডলার্স ট্রিলজি’। ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’র শেষ দৃশ্যে কবরস্থানে যখন ত্রিমুখী হয়ে বন্দুক হাতে ‘ম্যান উইথ নো নেম’ (ক্লিন্ট ইস্টউড), ‘টুকো’ (এলি ওয়ালাচ) ও ‘অ্যাঞ্জেল আইস’ (লি ফন ক্লিফ) দাঁড়ায়, তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজতে থাকে সেই বিখ্যাত সাসপেন্স-থ্রিলারমাখা সুর। সেই সুরের কথাই বলেছি মূলত শুরুতে। মোররিকোনের মিউজিক কেবল ঢালিউডে নয়; বলিউডের বহু চলচ্চিত্রেও হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে। ‘ডলার্স’ সিরিজসহ লিওনের আরও দুই মাস্টারপিস ছবি ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন ওয়েস্ট’ ও ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন আমেরিকা’র মিউজিকও কম্পোজ করেন মোররিকোনে।
চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না!
চলচ্চিত্রের শুরুর দিককার সময় কোনো সুর ছিল না। নির্বাক যুগ পেরিয়ে সিনেমা এখন এত দূর বিস্তৃত, যা এক শতকের মধ্যেই শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়া তো এখন সিনেমার কথা চিন্তাই করা যায় না! এখন দর্শক কেবল পর্দার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে থাকেন না; কানকেও কাজে লাগান সিনেমাবোধের জন্য। কাহিনিকে যদি আমার শরীর ধরি, তবে অভিনয় হচ্ছে সিনেমার প্রাণ। আর সংগীত যেন এই দুইয়ের সংযোগস্থল। কাহিনি ও অভিনয়কে আরও বেগবান করে তোলে সংগীত।
চলচ্চিত্রে সংগীতের প্রথম ব্যবহার ঘটে ১৮৯৫ সালের ডিসেম্বরে, লুমিয়ের ব্রাদার্সের হাত ধরে। অগুস্ত লুমিয়ের আর লুই লুমিয়ের—এই দুজনের কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবে চলচ্চিত্রশিল্প। এই দুই ভাই তখন প্যারিসে তাঁদের সিনেমার একটি প্রদর্শনী করেন। সেখানে ছবির সঙ্গে সঙ্গে বাজতে থাকে লাইভ পিয়ানো। যেন লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয় বোঝাতে চেয়েছিলেন যে সিনেমা শুধু দেখার নয়, শোনারও বস্তু। শুরুর দিকের চলচ্চিত্রে মূলত লাইভ সংগীত ব্যবহার করা হতো। সেটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে এসেছে আজকের অবস্থানে। এখন তো সংগীতায়োজনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহযোগিতা নেওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে উঠছে। তবে প্রথম পূর্ণাঙ্গভাবে চলচ্চিত্রে সুরারোপের কৃতিত্ব দিতে হবে ফরাসি কম্পোজার কামিল সেঁত-সাঁসকে। ১৯০৮ সালে ‘লা-সাসিনা দু দ্যুক দ্য গিজ’ বা (দ্য অ্যাসাসিনেশন অব দ্য ডিউক গা গিজ) নামে মাত্র ১৫ মিনিটের ফরাসি চলচ্চিত্রের সুর রচনা করেন তিনি। এরপর চলচ্চিত্রে ধীরে ধীরে ‘সিঙ্ক্রোনাইজড সাউন্ড’ (চিত্রের সঙ্গে সমন্বিত শব্দ বা সুর) জনপ্রিয় হতে থাকে। ১৯৩০ দশকের দিকে সংগীত সিনেমার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এ সময় শুধু প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে পরিচালক, অভিনয়ের কলাকুশলী, ক্যামেরাম্যান নয়; চুক্তিবদ্ধ হতে থাকেন সুরকার, মিউজিক এডিটর, বাদনদার ও সংগীত পরিচালকও।
কিংবদন্তি ইতালিয়ান কম্পোজার প্রয়াত এন্নিও মোররিকোনের এই ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর বিশ্ব সিনেমার জগতে অনন্য হয়ে থাকবে সব সময়। ফিল্মের জন্য চার শতাধিক স্কোর করেছেন মোররিকোনে। ছিলেন নিজের সময়ের সেরা মিউজিশিয়ান।
তারও ৩০ বছর পর ফিল্মজগতে স্কোর লিখে বিখ্যাত হতে শুরু করেন মোররিকোনে। ষাটের দশকে সার্জিও লিওনের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনি উপহার দিয়েছেন অনেক কালজয়ী সিনেমা। যাঁরা সার্জিও লিয়নের স্পেগেত্তি সিরিজের ভক্ত, তারা জানেন ছুটন্ত ঘোড়া কিংবা বন্দুকবাজির রোমাঞ্চকর মুহূর্তটাকে কীভাবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে ভাসিয়ে দিতেন মোররিকোনে। ২০২০ সালের ৬ জুলাই, ৯১ বছর বয়সে মারা যান তিনি। হলিউডের অনেক আইকনিক স্কোর করে কিংবদন্তিতুল্য হয়ে আছেন মোররিকোনে। আজও বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী মিউজিশিয়ান হিসেবে গণ্য করা হয় তাঁকে। মোররিকোনের জন্ম ১৯২৮ সালের ১০ নভেম্বর, রোমে। সে সময় ইতালিতে ছিল ফ্যাসিস্ট শাসন। আর কী আশ্চর্য! ফিল্মে মোররিকোনের মিউজিক কম্পোজের শুরু হয় ১৯৬১ সালে মুক্তি পাওয়া লুসিয়ানো সালচের ‘দ্য ফ্যাসিস্ট’ দিয়ে।
ফিল্মের জন্য চার শতাধিক স্কোর করেছেন মোররিকোনে। জীবিত অবস্থায় ছিলেন নিজের সময়ের সেরা মিউজিশিয়ানদের সবার ওপরে। ফিল্মের জন্য সাউন্ডট্র্যাকের কাজ শুরুর আগে শহরের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস সংগীতাঙ্গন আকাদেমিয়া ন্যাশিওনাল দি সান্তা সিসিলিয়াতে শিখেছেন ট্রাম্পেট বাজানো ও সংগীত নির্দেশনা। দুই বছর পর পরিচালক সার্জিও লিয়নের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর। প্রস্তাব পান ‘আ ফিস্টফুল অব ডলার্স’-এর স্কোর লেখার। এখান থেকেই শুরু দুজনের সম্পর্ক। এরপর মোররিকোনে স্কোর করেন লিওনের ওয়েস্টার্ন জনরার ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন আমেরিকা’ ও ‘দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’তে। এ ছাড়া তিনি ব্রায়ান ডি পালমার গ্যাংস্টার ব্লকবাস্টার মুভি ‘দ্য আনটাচেবল’ এবং গুইসেপ্পে তোর্নাতোরের আর্টহাউস ক্ল্যাসিক ‘সিনেমা প্যারাদিসো’র স্কোর লেখেন।
কীভাবে চলচ্চিত্রের স্কোর লেখার কাজ শুরু করেছিলেন মোররিকোনে? এক সাক্ষাৎকারে সেই কথা তিনি বলেছিলেন এভাবে, ‘ছোটবেলায় শুরু করেছিলাম, যখন আসলেই আমি খুব ছোট ছিলাম। হয়তো, খুব ছোট্ট। যখন আমার বয়স ১০ বছর, আমার সব কম্পোজিশন ফেলে দিয়েছিলাম, তাই শুরুর কাজগুলোর কোনো চিহ্ন নেই। দুঃখজনক হলো, আমি সেসবের কোনোটির রেকর্ড রাখিনি। তখন জানতামও না যে টেপ-রেকর্ডার নামে কিছু আছে।’
বর্তমান সময়ের অন্যতম কম্পোজার হ্যান্স জিমার ও ফিল্মমেকার কুইন্তিন তারান্তিনোও মোররিকোনের প্রভাবের কথা স্বীকার করেছেন। তাঁর স্কোরের ভক্ত মেটালিকা, ডায়ার স্ট্রেইটস, রেডিওহেড, র্যামোনেসের মতো ব্যান্ডও।
মোররিকোনে কত ফিল্মমেকার-মিউজিশিয়ানকে প্রভাবিত করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। বর্তমান সময়ের অন্যতম কম্পোজার হ্যান্স জিমার ও ফিল্মমেকার কুইন্তিন তারান্তিনোও তাঁর প্রভাবের কথা স্বীকার করেছেন। তাঁর স্কোরের ভক্ত মেটালিকা, ডায়ার স্ট্রেইটস, রেডিওহেড, র্যামোনেসের মতো ব্যান্ডও। কী কারণে এমন তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন মোররিকোনে? কখনো তাঁর সুর মেলোডিয়াস, তো কখনো পপের হিপহপে ঠাঁসা। আছে জ্যাজ ও ফোকের সুরও। আবার সব একসঙ্গেই গুলিয়ে শরবতও বানিয়েছেন তিনি। তাই বলে ক্ল্যাসিক্যালকে বাদ দিয়ে গেছেন, এমন নয়। তবে তিনি নিজে প্রভাবিত ছিলেন আঁভা-গাঁদ শিল্পে।
পারতপক্ষে মোররিকোনের মিউজিককে কোনো জনরায় ফেলে বিচার না করাই ভালো। আসলে ছবির কাহিনি ও চরিত্রের প্রয়োজনে তাঁকে এমন অনেক স্কোর লিখতে হয়েছে যা কখনো মেলোডিয়াস, আবার কখনো জ্যাজ-রকের তীব্রতামাখা। তবে তার মধ্যে শতাধিক স্কোর পেয়েছে ক্ল্যাসিকের মর্যাদা। ওয়েস্টার্ন ফিল্মে তাঁর সমতুল্য সুন্দর স্কোরার নেই বললেই চলে। যেন ছুটে যাওয়া ঘোড়ার খুরের সুরও ধরতে পারতেন মোররিকোনে। অনেক কালজয়ী ফিল্মের কালজয়ী স্কোর তিনি লিখেছেন। তার তালিকা বেশ বড়। ইউটিউবে গিয়ে সার্চ করে নাহয় সেসব শুনে ফেলা যাক। আমি নিশ্চিত, প্রথমবার শুনতে বসেই আপনি মোররিকোনের মিউজিকের প্রেমে পড়বেন৷ তার আগে–পরে এমন সুরের জাদু যে আর কেউ দেখাতে পারেননি!