মানুষ জন্মগতভাবে সংগীতময়, বিশেষ করে নারী। শামসুর রাহমানের মায়ের মতো যে নারীকে কখনো গান গাইতে দেখা যায়নি, তিনিও। যখন কাঁদেন, বিশেষ সুর ও ছন্দ অবলম্বন করেন। কান পাতলে এমন কান্নাকে মনে হয় হৃদয়ভাঙা বিষণ্ন সংগীত। এ ধরনের কান্নাকে আমরা বলি বিলাপ। রংপুর অঞ্চলে বলা হয় অরুণা-করুণা।
অরুণা-করুণা কেবল ব্যক্তিগত আবেগের প্রকাশ নয়, বরং এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচরণ, যা সংগীত নৃতত্ত্বের আলোকে পাঠযোগ্য। কেননা অরুণা-করুণা সুরেলা, পুনরাবৃত্তিমূলক, ঘটনাবহুল গল্পকথনের মতো এবং সংক্রামক। তাতে থাকে হারিয়ে যাওয়া, মরে যাওয়া বা দূরে সরে যাওয়া প্রিয়জনের স্মৃতি—তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া ইতিহাস, বর্তমানের হাহাকার এবং প্রিয়জন-বিচ্ছেদে জীবনের সম্ভাব্য সব শূন্যতার গল্প।
নারীর ভেতর লুকিয়ে থাকা অভিজ্ঞতা, ভাষা, সুর ও সংকেতময় অনুধাবন বিলাপের মাধ্যমে সমাজে কেবল উন্মুক্তই হয় না, প্রতিষ্ঠিতও হয়। পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিবারে ও সমাজে অবদমিত জীবনযাপনই গ্রামীণ নারীর নিয়তি যেন। এই পটভূমিতেই বিলাপই হয়ে ওঠে বঞ্চিত, অবদমিত গ্রামীণ নারীর ঐতিহ্যগত ভাষাভঙ্গি, যার ভেতর দিয়ে তার ক্ষতিগ্রস্ত সম্পর্ক, অনিশ্চয়তা ও হারানো স্বপ্ন ব্যক্ত হয়; প্রকাশিত হয় ব্যক্তিগত, যৌথ ও সামাজিক বৃত্তান্ত। যেন বুকে পাথরের মতো জমে থাকা কষ্ট বিলাপে পরিণত হয়ে প্রকৃতপক্ষে নারীকে ভারমুক্ত করে।
বিলাপকে নারীর দুর্বলতা হিসেবে ব্যাখ্যা করার একপ্রকার চেষ্টাও সমাজে আছে। প্রবাদের মতো বলা হয়ে থাকে, ‘পুরুষের কাঁদতে নাই’। এই ধারণা পুরুষের আকুলিবিকুলিকে ঠাট্টার চোখে দেখে, আর নারীর জন্য শোক প্রকাশের উদ্দেশ্যে কথা বলার ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়। যেন শোক প্রকাশ নারীর দায়িত্বও—খাবার রাঁধা, ঘর সামলানো, সন্তান আগলে রাখার মতোই।
পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিলাপই হয়ে ওঠে বঞ্চিত, অবদমিত গ্রামীণ নারীর ঐতিহ্যগত ভাষাভঙ্গি, যার ভেতর দিয়ে তার ক্ষতিগ্রস্ত সম্পর্ক, অনিশ্চয়তা ও হারানো স্বপ্ন ব্যক্ত হয়; প্রকাশিত হয় ব্যক্তিগত, যৌথ ও সামাজিক বৃত্তান্ত। যেন বুকে পাথরের মতো জমে থাকা কষ্ট বিলাপে পরিণত হয়ে প্রকৃতপক্ষে নারীকে ভারমুক্ত করে।
বৈষম্যপ্রবণ সমাজ নারীর ভাব প্রকাশ সীমিত করতে সর্বদাই উদ্যত। এ কারণেই সংগীত নৃতাত্ত্বিকদের মতে, নারী তার অন্তর্জগৎ উন্মোচন করে শোকসংগীতের ভাষায়। এই অভিব্যক্তির প্রতিও কটাক্ষ ও নিষেধাজ্ঞা বিরল নয়। তবে নৃসংগীত এমন এক সাংস্কৃতিক আচরণ, যার ওপর নিষেধের ক্ষমতা কাজ করে না। বাংলাদেশের গ্রামীণ নারীর এই মিউজিক্যাল আচরণের কাঠামো সর্বজনীন। এতে এমন এক ‘লেমেন্টেশন টোন’ থাকে, যা নিচু, মাঝারি ও উচ্চ স্বরের স্তরে ওঠানামা করে। কখনো থেমে থেমে দীর্ঘশ্বাস মেশানো কথামালা থাকে—যেমন থাকে কবিগানে, কিংবা পালায়। নারীর বিলাপ আসলে তার অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যম। কিশোরী মেয়ের অকালমৃত্যুর ঘটনায় মা যখন বিলাপে বলেন, তোর বিয়ের গয়না বানাইছিলাম গো মা/ তোর বাপের চোখের পানি শুকায়া গেইছে গো মা/ কিছু না কয়া গেলু ক্যানে রে মা…, তখন এক স্পর্শকাতর শোকনাট্য তৈরি হয়। ফলে শোকগ্রস্ত নারীকে সান্ত্বনা দিতে আসা সবাই চোখের পানিতে ভাসে। বিলাপ বা অরুণা-করুণা তখন আর একক নারীর আচরণ নয়, হয়ে ওঠে এমন এক সংবেদনার সংগীত, যাতে সহমর্মীরা অংশগ্রহণ করে। এমনকি এ-ও দেখা যায় যে শোকস্তব্ধ নারীকে কাঁদতে বলা হয়—কান্দেক বুবু, কান্দেন, বুকে খিল ধরাইস নে, দম বন্ধ হয়া যাইবে! তাহলে সমস্ত বেদনার ভার বহন করার শক্তি অর্জন করতেই কি নারীকে বিলাপ করতে হয়? আর তারা শোকগ্রস্ত নারীকে নানা প্রশ্ন করে, কী হইছিল? কখন ঘটল? তখন তোমরা কই আছিলেন? এভাবে আসলে সান্ত্বনা দিতে আসা মানুষেরাও তার গল্পগুলো শুনতে চায়। এটা এমন এক সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে শোকবিহ্বল নারী স্বাভাবিক জীবনধারায় ফিরে আসেন। বিলাপরত নারী, প্রথমত, ব্যক্তিগত শোকের কথা আত্মীয়-প্রতিবেশীদের জানিয়ে দেন, হয়তো তাদের পাশে পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, যার জন্য কষ্ট পাচ্ছেন তাকে ঘিরে থাকা সব স্মৃতি সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেন। এভাবে বিলাপের মাধ্যমে যূথবদ্ধ সমাজের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে তৈরি হওয়া হার্দিক সম্পর্ক শক্তিশালী করে তোলেন।
গবেষকেরা দেখিয়েছেন, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সংগীতধারায় জেন্ডার ভূমিকার প্রভাব অত্যন্ত গভীর। বিলাপের মধ্য নারীর আবেগগত মর্যাদা সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে, পরিবার ও সমাজে নারীর ভূমিকা সামনে আসে। সবচেয়ে বড় কথা, শোকগ্রস্ত নারী ও পুরো সমাজের জন্য বিলাপ একধরনের শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে।
সংগীত নৃবিজ্ঞানী জন ব্ল্যাকিং বলেছিলেন, সংগীত হলো ‘মানুষের সংগঠিত ভাষা।’ সেই অর্থে নারীর বিলাপ কেবল আবেগ নয়, বরং একধরনের সংগঠিত ও উদ্দেশ্যমূলক অভিব্যক্তি, যা সবার কাছে বোধগম্য, যদিও প্রচলিত অর্থে বিলাপকে ‘সংগীত’ বলা হয় না। শোকগ্রস্ত, বিক্ষত, বেদনাহত নারীর স্বভাব হিসেবেই সমাজের মানুষ বিলাপকে বিবেচনা করে। কিন্তু যখন, হায় রে, আমার ভাইকে কই নিলা গো আল্লাহ, বারবার টানা সুরে বলা হয়, তখন আর তা কেবল কথা হয়ে থাকে না, রূপ নেয় আবেগঘন সংগীতে, আক্রান্ত করে উপস্থিত প্রত্যেককে।
শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে শোক প্রকাশের নানা সংগীতধারা দেখা যায়, যা একধরনের আবেগময় সামষ্টিক পরিসর তৈরি করে। আবেগের চরম মুহূর্তগুলোকে তীব্রতর করে তোলাই শুধু নয়, এর মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত দুঃখ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিয়ে ব্যক্তি যেন সমষ্টির অংশমাত্র হয়ে ওঠেন। অ্যালান লোম্যাক্স তাঁর ক্যান্টোমেট্রিক্স (cantometrics) তত্ত্বে বলেছেন, কণ্ঠস্বরের ধরন আর আবেগের তীব্রতার সঙ্গে সমাজকাঠামোর যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে, বিলাপের মধ্য দিয়ে তার সাংস্কৃতিক প্রকাশ ঘটে।
কিন্তু গ্রামীণ সমাজে প্রথাগতভাবে নারীরাই কেন বিলাপ করেন! নৃসংগীত বিজ্ঞানী ডেবোরা উং (Deborah Wong) ও লুইস মেইন্টজেসের (Louise Meintjes) মতো গবেষকেরা দেখিয়েছেন, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সংগীতধারায় জেন্ডার ভূমিকার প্রভাব অত্যন্ত গভীর। বিলাপের মধ্য নারীর আবেগগত মর্যাদা সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে, পরিবার ও সমাজে নারীর ভূমিকা সামনে আসে। সবচেয়ে বড় কথা, শোকগ্রস্ত নারী ও পুরো সমাজের জন্য বিলাপ একধরনের শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যেহেতু নারীর কথা বলা সামাজিক অনুশাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তাই বিলাপের মধ্য দিয়ে নারীরা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রকে নিজেদের করে নেন—নিজের অনুভব ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তুলে ধরেন পারিবারিক ইতিহাস, সম্পর্কের মাত্রা, এমনকি বিশ্বাস—ধর্মীয় কিংবা সামাজিক। এভাবে গ্রামীণ নারীর বিলাপে ব্যক্তিগত শোক ও সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গি একাকার হয়ে যায়।
দীর্ঘস্থায়ী বিলাপে অনেক সময় শোকাহত নারী নিজের কণ্ঠ বা শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন। তা এতটাই সংক্রামক হয়ে ওঠে যে পুরো জনগোষ্ঠীই আবেগে ভেসে যায়। এ অবস্থা আধ্যাত্মিক অর্থেও তাৎপর্যপূর্ণ। গিলবার্ট রুজের মতো গবেষকেরা দেখিয়েছেন, শোকজনিত আর্তনাদ ধীরে ধীরে রূপ নিতে পারে এক সংগঠিত, সমবেত আচারে। ভারতসহ পৃথিবীর অনেক স্থানেই বিলাপ করার পেশাদার সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে নারীর বিলাপের সামাজিক-অর্থনৈতিক রাজনীতির দিকটা উপেক্ষা করা যায় না। মহাশ্বেতা দেবীর ‘রুদালী’ উপন্যাসের কথা নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে, যেখানে শনিচরী নামের দরিদ্র নারী বিলাপকে শ্রম হিসেবে বিক্রি করে।
আসলে নারীর বিলাপ নিছক কান্না নয়। এটি একই সঙ্গে আবেগ, ইতিহাস, সামাজিক আচরণ ও অবদমনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ। বিচ্ছেদ ও বেদনা থেকে জন্ম নেওয়া এই সুরময় অভিব্যক্তি নারীকে দেয় অন্তর্গত আবেগ প্রকাশের পরিসর, বেদনার প্রশমন ঘটিয়ে স্বাভাবিক জীবনধারায় পুনরেকীভূত হওয়ার শক্তি।