চলচ্চিত্র
কালজয়ী রাজনৈতিক চলচ্চিত্র দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স
৫ জুলাই আলজেরিয়ার স্বাধীনতা দিবস—একটি জাতির বহু ত্যাগ ও সংগ্রামের ফসলের দিন। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির এই দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুধু আফ্রিকান ইতিহাসেই নয়, বিশ্ব রাজনীতির পটপরিবর্তনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই মুক্তিযুদ্ধের এক জ্বলন্ত চিত্র ফুটে উঠেছে ইতালীয় চলচ্চিত্র পরিচালক গিলো পন্টিকর্ভো নির্মিত কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘দ্য ব্যাটল অফ আলজিয়ার্স’ (The Battle of Algiers, 1966)–এ।
সাম্রাজ্যবাদ যে পুঁজিবাদ বিকাশের উচ্চতম পর্যায় সেটা বহু দিন আগেই ঘোষণা করেছেন মহামতী ভি আই লেনিন। সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্টের কারণে পীড়ন বৃদ্ধি পায়, তাই নিপীড়িত জাতি অর্জন করতে চায় গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতা। লেনিন মনে করেন, নিপীড়ক জাতি থেকে স্বাধীন রাজনৈতিক বিচ্ছেদের অধিকার হলো জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারেরই অপর নাম। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে বিচ্ছেদ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের ঘটনা গত শতাব্দীর ১৯৩০ সালের দশক থেকে হু-হু করে বেড়েছে। ১৯০১-১৯১০ সাল পর্যন্ত যেখানে জাতিরাষ্ট্রের সংখ্যা ছিল ৪৮টি, সেখানে ১৯৫০ সালের দশকে এ সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১০৮-এ। এরপর ২০০৬ সালে জাতিরাষ্ট্রের সংখ্যা গিয়ে ঠেকে ১৯২-তে। বলা বাহুল্য নয়, বাংলাদেশও আছে এরই মধ্যে।
এই যে শয়েশয়ে জাতিরাষ্ট্র গঠনের ইতিহাস, সেটার পেছনে রয়েছে বঞ্চনা ও শোষণের হাত থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষাই যুগ যুগ ধরে, ধরা পড়েছে বিভিন্ন সাহিত্য ও শিল্পকর্মে, চলচ্চিত্রে। তেমনি একটি চলচ্চিত্রের নাম ‘দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’। একে বলা হয় আধুনিক রাজনৈতিক সিনেমার পথিকৃৎ। আলজেরিয়া ও ইতালির যৌথ প্রযোজিত এই ছবি মুক্তি পায় ১৯৬৫ সালে। পরিচালক গিলো পন্টিকর্ভো এই ছবিতে ফরাসি উপনিবেশ থেকে আলজেরিয়ানদের রাজনৈতিক মুক্তি, মুক্তির জন্য লড়াই এবং বিপরীতে তাদের দমন করতে ফরাসি শাসকদের আপ্রাণ ও নিষ্ঠুর চেষ্টার আখ্যান তুলে ধরেছেন। বিদেশি শাসন ও নিপীড়ন থেকে আলজেরিয়া মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬২ সালে। এর আগের কয়েক বছর আলজেরিয়ানদের জান বাজি রেখে স্বাধীনতা লাভের যে চরম আকাঙ্ক্ষা গিলো এই ছবিতে দেখিয়েছেন এবং যেভাবে দেখিয়েছেন এক কথায় তা অসাধারণ। ১৯৫৪ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ফরাসি ঔপনিবেশিক শোষণ ও পীড়নের ঐতিহাসিক ঘটনাকে অনেকটা সংবাদ উপস্থাপনের মতো করে দর্শকের সামনে হাজির করেন গিলো। তবে নিউজরিল ব্যবহার হয়নি কোথাও, তারপরও ছবির কোনো কোনো জায়গা প্রামাণ্যচিত্রের মতো মনে হয়েছে, কারণ ইতালির পরিচালক গিলো এই ছবিতে ব্যবহার করেন টেলিফোটো লেন্স।
‘দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ আধুনিক রাজনৈতিক সিনেমার পথিকৃত হিসেবে খ্যাতি পাওয়ার পেছনে একটি কারণ হলো, গিলো ইতালির কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধের একজন কমান্ডার ছিলেন। ব্যক্তিজীবনের রাজনৈতিক দর্শন, পাশাপাশি কাহিনীচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র, এই দুরকম শৈলী ব্যবহার করে গিলো যে উচ্চতায় ছবিটিকে নিয়ে গেছেন তা সত্যিই ঈর্ষণীয়। সমষ্টির মুক্তির স্বপ্নকে তিনি ব্যক্তি পর্যায়ে নামিয়ে আনেন, আবার ব্যক্তির স্বাধীন হওয়ার প্রবল রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে মিলিয়ে দেন পুরো জাতির সঙ্গে। এই ছবির চিত্রনাট্যকারও ছিলেন কমিউনিস্ট, নাম ফ্রাঙ্কো সোলিনাস। সোলিনাস নিজেও রাজনৈতিক সিনেমার পরিচালক ছিলেন। তিনি গিলোর ‘বার্ন!’ ছবিরও চিত্রনাট্যকার।
ষাটের দশকে ইতালিতে প্রচুর রাজনৈতিক ছবি নির্মিত হয়েছে। সেসময় নির্মাতাদের অনেকেই মনে করতেন বিপ্লবী ছবির জন্য প্রয়োজন বিপ্লবী আঙ্গিক। তারা মনে করতেন কাহিনী আশ্রিত চলচ্চিত্র দিয়ে সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব নয়। কিন্তু গিলো সেসবে আস্থা রাখেননি, তিনি বিশ্বাস করতেন, যে ছবি বিশাল জনগোষ্ঠীর বোধগম্য হবে, সেটাই বিপ্লবের পক্ষে সচেতনতা তৈরিতে হবে সহায়ক। নিজের বিশ্বাসের প্রমাণ দিলেন ‘দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ নির্মাণ করে। ছবির প্রথমেই দেখা যায়, এক আরবকে নির্যাতন করছে ফরাসি সেনাকর্মকর্তারা। তার তথ্য অনুযায়ী কসবাহ নামের এক এলাকায় তল্লাশি অভিযানে যায় সেনাবাহিনী। সেখানকার এক ভবনে শিশু ও নারীসহ কয়েকজন পুরুষ লুকিয়ে আছে। তাদের মধ্যে রয়েছে আলজেরিয়ার মুক্তি আন্দোলনের প্রথম সারির নেতাকর্মী। ওমর আলি তাদেরই একজন। ভবনের ভেতর গোপন কুঠুরির মধ্যে লুকিয়ে আছে তারা। কিন্তু এই তথ্য অত্যাচারের মুখে সেনাবাহিনীকে বলে দেয় সেই আরব বন্দী। বিপ্লবীরা জানে, ধরা পড়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। জীবনের অন্তিম সেই মুহূর্তে আলির মনে পড়ে কীভাবে সে যুক্ত হয়েছিল মুক্তির আন্দোলনে। কিন্তু মজার বিষয় হলো আলিকে দিয়ে কাহিনীর ভেতর প্রবেশ করলেও একবারও মনে হয়নি আলি এই ছবির নায়ক বা প্রধান চরিত্র। বরং গিলোর সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে আলি দর্শককে নিয়ে যায় হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষের কাছে। যেখানে ব্যক্তি নয়, সমষ্টিই নায়ক। কি শিশু, কি নারী, সকলেই যেন মুখিয়ে আছে ফরাসি উপনিবেশকে উৎখাত করতে।
চোরাগুপ্তা হামলার মাধ্যমে যখন একের পর এক ফরাসি পুলিশ মারতে লাগল মুক্তিকামী আলজেরিয়ানরা, তখন পুলিশও উল্টো ব্যবস্থা নিল। রাতের অন্ধকারে আলজেরিয়ানদের কলোনিতে বোমা পেতে রেখে আসে তারা। ফলে মারা যায় নিরীহ অনেক আরব। প্রতিশোধ নিতে পাল্টা হামলা চালানো হয় এয়ার ফ্রান্সের অফিসে, ফরাসিদের ডান্স ক্লাবে আর খাবারের দোকানে। সবকটি হামলার বোমা বহন করে নারীরা। ছবির এই অংশে দেখা যায় ফরাসি খাবারের দোকানে যে নারী বোমা বহন করে নিয়ে যায়, দোকানের ভেতরে চারদিকে তাকায় সে। দেখে এক ফুটফুটে শিশুও রয়েছে সেখানে। বোমাটি বিস্ফোরণের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিচালক তিনবার ঘুরেফিরে সেই নিষ্পাপ ফরাসি শিশুর মুখ ক্লোজশটে দেখান। এই দৃশ্যসজ্জার দুরকম মানে থাকতে পারে। এক হতে পারে পরিচালক ফরাসিদের বলতে চাইছেন, দেখো তোমাদের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বলি হচ্ছে এই নিষ্পাপ শিশু। দ্বিতীয় মানে হতে পারে, পরিচালক বলতে চাইছেন যুক্তিসংগত দাবি দাওয়া ও সংঘর্ষ কোমলমতি শিশুকেও রেহাই দেয় না। বোধহয় এমন দৃশ্যসজ্জার কারণেই গিলোকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। অনেক সমালোচক এমনকি অতি-বাম বুদ্ধিজীবীরাও বলেছিলেন এই ছবিতে গিলো এমন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছেন যে বিপ্লবীদের প্রতি পরিচালকের সহানুভূতি যথেষ্ট স্পষ্ট হয়নি। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত, এই সমালোচকেরা বোধহয় সবকটি দিক ভেবে দেখেননি।
যাহোক, আলজেরিয়ার ফরাসি-পল্লীতে স্থানীয় নারী পুরুষ নির্বিশেষের এমন হামলায় দিশেহারা ফরাসিরা বাধ্য হয় সেনাবাহিনীর বিশেষ দলকে তলব করতে। তাদের দলপতি ম্যাথিউ ফিলিপ নামের এক সেনানায়ক। আন্দোলন দমন করার নতুন ফন্দি আটে সে। এরই মাঝে আলজেরিয়ার মুক্তিকামী সংগঠন এফএলএন সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। সাধারণ আলজেরিয়ানরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দেয় তাতে। কিন্তু ঘর থেকে জোর করে তাদের বের করে আনে সেনাবাহিনী, কাজে পাঠায় তাদের। নিজেদের দখলদারিত্বকে পোক্ত করতে ম্যাথিউ ও তার সেনাদল যে জুলুম-নির্যাতন চালায়, তাতে আলির মতো অনেক মুক্তিকামী আলজেরিয়ানই জীবন দেয়, কিন্তু শেষ হাসিটা হাসে আত্মত্যাগী বিপ্লবীরাই। আলজেরিয়ার মানুষ ফ্রান্সকে মাতৃভূমি হিসেবে অস্বীকার করে। জীবনের বিনিময়ে তারা অর্জন করে নেয় স্বাধীনতা। আলজেরিয়ার এই মুক্তি সংগ্রামের প্রতি ফরাসি শাসকদের ঔপনিবেশিক মনোভাবের বিরোধিতা করেন সাধারণ অনেক ফরাসি নাগরিক। ছবিতে সাংবাদিকরা যখন ফরাসি সেনানায়ক ম্যাথিউর সাক্ষাৎকার নিতে আসে তখন প্রসঙ্গক্রমে উঠে আসে ফরাসি দার্শনিক জঁ পল সার্ত্রের নাম। সেনানায়ক ম্যাথিউ বলে, সে সার্ত্রকে শত্রু ভাবারও যোগ্য মনে করে না।
‘দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। ইতিহাসের খাতিরে বলতে হয় যেহেতু বাংলাদেশেও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, তাই এদেশেও মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র হয়েছে। আফসোস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে নাচগান, ধর্ষণদৃশ্য এমনভাবে ব্যবহার হয়েছে, যার সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয়ের কোনো মিল নেই। ন্যূনতম শ্রদ্ধা না দেখিয়ে, মুনাফা অর্জনের জন্য, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের মতো বিষয়কেও কলঙ্কিত করেছে এদেশের চলচ্চিত্র পরিচালকরা।
অবশ্য ‘দ্য ব্যাটল অব আলজিয়ার্স’ মুক্তির পাঁচ বছর পর, ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তি পায় জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’, যেটিকে অনায়াসে ভালো চলচ্চিত্র বলা যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শোষণের রূপটিকে এ ছবিতে আনা হয় রূপকের আকারে। মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে রায়হান বয়ান করেন চাবির গোছা দিয়ে। কিন্তু পরের বছর আর রূপক নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর চালানো গণহত্যার জবাব দিতে সরাসরিই কথা বলতে হলো জহির রায়হানকে। তিনি বানালেন ‘স্টপ জেনোসাইড’।
মুক্তির চেতনাকে পুঁজি করে বানানো ‘ব্যাটল অব আলজিয়ার্সে’র চল্লিশ বছর আগে, ১৯২৫ সালে নির্মিত হয়েছিল আরেক মাস্টারপিস ছবি ‘ব্যাটলশিপ পটেমকিন’। আইজেনস্টাইনের এই ছবির কাহিনীতে, বক্তব্যে তো বটেই, এমনকি আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যেও ছিল দ্বান্দ্বিকতা। শোষক ও শোষিতের সম্পর্ককে আইজেনস্টাইন যেভাবে ফিল্মবন্দী করেছেন তাতে ছবিটি এখনো শ্রেষ্ঠকীর্তিগুলোর একটি হয়ে রয়েছে। নির্বাক ও সাদাকালোর এই যুগেই, ১৯২৭ সালে, আইজেনস্টাইন নির্মাণ করেন ‘অক্টোবর’। ১৯১৭ সালের সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নিয়ে জন রিড লিখেছেন ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’, সেটাকে ভিত্তি করেই আইজেনস্টাইন হাত দেন ‘অক্টোবর’ চলচ্চিত্রে।
এসব মুক্তি সংগ্রামের চলচ্চিত্রকে পাশে সরিয়ে রেখে পুঁজিবাদী দেশগুলোর বাজার দখলের যে লড়াই—দুটি বিশ্বযুদ্ধ, সেগুলোকে ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্রেও দেখব মানবতার পক্ষের কথা, শান্তির আকাঙ্ক্ষাকে এত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যার ফলে চলচ্চিত্রগুলো হয়ে গেছে কালোত্তীর্ণ। জঁ রেনোয়ার ‘লা গ্রান্ড ইলিউশন’, গিওর্গ পাবস্টের ‘ওয়েস্টফ্রন্ট’, রবার্তো বেনিনির ‘লাইফ ইজ বিউটিফুল’, ভিত্তোরিও ডি সিকার ‘টু উইমেন’, রোমান পোলানস্কির ‘দ্য পিয়ানিস্ট’ আরো কত কত ছবি। যুদ্ধকে আশ্রয় করে নির্মিত চলচ্চিত্র পশ্চিমা বিশ্বে এখন এমন এক জায়গায় গেছে যা দেখে বোঝার উপায় নেই যে কোনটা ‘সত্য’ আর কোনটা ‘নির্মিত সত্য’।
নির্মাণ প্রযুক্তি কখনো কখনো ছোট হয়ে যায় চলচ্চিত্রের বক্তব্য যখন অনেক বড় হয়। সেক্ষেত্রে নির্মাণ প্রযুক্তি নিম্নমানের হলেও কিছু এসে যায় না বলেই মনে করি। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য যে সুযোগ সুবিধা রয়েছে তা দিয়ে যথেষ্ট ভালো ছবি নির্মাণ করা সম্ভব। কোটি টাকা খরচ করে ‘মেহেরজান’, ‘গেরিলা’র মতো চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে আমাদের দেশে, কিন্তু ওসবের একটিকেও উল্লিখিত ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের সঙ্গে এক সারিতে রাখা যায় না। কোনোটায় মুক্তিযুদ্ধের ভুল ও অপমানজনক বয়ান হাজির করা হয়েছে, অন্যটিতে উপস্থাপন করা হয়েছে একঘেয়ে গল্প, যেন মুক্তিযুদ্ধ মানেই বন্দুক, গোলাগুলি, ধর্ষণ আর প্রতিশোধ। যুদ্ধের পেছনে যে দীর্ঘদিনের শোষণ ও অপমান থাকে, ঔপনিবেশিক শাসন বা সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিপরীতে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থাকে, একটা রাজনৈতিক বোঝাপড়া থাকে, সেসবের শৈল্পিক ও চলচ্চৈত্রিক ভাষান্তর দেখি না। কেবল মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বানানোর জন্য বানানো হচ্ছে, এতে পরিচালক হিসেবে একটা জাতে ওঠা যায়, বিশেষ সময়ে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়, সেজন্যই মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত চলচ্চিত্রই গড়পড়তায় একই কাহিনী বলে বোধ হয়। তবে এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বলতে হয় জহির রায়হানকেই। লাতিন আমেরিকার নির্মাতাদের মতো যে দক্ষতা তিনি অর্জন করেছিলেন, সেটার ফল আমরা খুব কমই ভোগ করতে পেরেছি। কাউকে অনুসরণ বা অনুকরণের দরকার নেই, নিজস্ব ভাষায়, স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে এবং গণমানুষের পক্ষের রাজনৈতিক দর্শনকে বুঝে ও ধারণ করে কেউ যদি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেন, তাহলে আশা করি বিশ্ব চলচ্চিত্র দেখে আমাদের এখন যে আফসোস হয়, সেটা আর থাকবে না।