মাঝে মাঝে মনে হয়, কবিতায় মিলিত অক্ষরপুঞ্জের কোনো অর্থ নেই; অক্ষর দিয়ে মিলিত শব্দপ্রবাহ যতই প্রেমের, যতই রহস্য-রোমাঞ্চের অভিজ্ঞতা দিক, শব্দবিবাহের দাম্পত্য মধু যতই আলোড়িত করুক, শব্দপরকীয়ার নিষিদ্ধ সুখ যতই ভাসিয়ে দিক। তাহলে কোন অভিঘাতে কবি লিখে ফেলেন এই সব নিঃশব্দ চলিষ্ণু ধ্বনিশব্দবাক্যচরণধারা, যা স্থির থেকেও থাকে কলরবমুখর, নিয়ে যায় দূরত্বে। দূরগামী এই সব পুঞ্জের এত ক্ষমতা কেন! আবেগবিদ্ধ করে কে কবির দ্বারা লিখিয়ে নেয় এই সব চরণ! কে কবিকে সংযত করে প্রবাহিত শৃঙ্খলে! কে কবিকে সংহত করে গতি বিনির্মাণে! কে কবিকে নিবিষ্ট করে শব্দের পরিমিত ব্যবহারে! কে যে করে তা জানার উপায় নেই। কিন্তু ‘করে যে’ তা তো অবধারিত। তাই পেছনের সত্তার খোঁজে না গিয়ে প্রাপ্ত অস্তিত্বের ভেতরে বহমান নিষ্ঠুর রহস্যের দিকে যাই। সেখানে দেখি অনেক কিছু।
দুই
সেই যে প্রারম্ভিক যৌবনে হাতে উঠে এসেছিল কোনো এক কবির ভয়ার্ত নিঃসঙ্গতা, উঠে এসেছিল বিজন বিষণ্নতা, উঠে এসেছিল চিত্রার্পিত হাহাকার। আজও কোনো পতনাকাঙ্ক্ষা ছাড়াই বেজে চলেছে সেই সুর। মাঝে মাঝে সংশয়ী হয়ে উঠেছি। তবু কৈ ও মেঘের প্রেমের মতো আমার পতনগুলো প্রার্থনা হয়ে উঠেছে। কোন সে কবি! যার জন্য মিথ্যা হয়ে গেল পতনশীল রহস্যের অস্তিত্ব! নিজের ভেতরে বিরাজিত নিঃসঙ্গতা আবিষ্কৃত হলো! করল বিষণ্ন! ভরিয়ে দিল হাহাকারে! তাঁর শিল্পভাষ্যের সংক্রাম এভাবে আবিষ্কার করল আমাকে।
মনে পড়ে, কবিতায় যখন উন্মেষ ঘটছে, জীবন হয়ে উঠছে উন্মুলাকাঙ্ক্ষায় উন্মুখ, হয়ে উঠছে ব্যগ্র, ব্যাকুল, তেজি, বুঝে না বুঝে ভুলভ্রান্তির হোচটে টলটলায়মান, তখন লাল লাল চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ একজন হাতে তুলে দিয়েছিল আবুল হাসান সমগ্র। যেন হাতে তুলে দিয়েছিল তুমুল আকাশ। যেন হাতে তুলে দিয়েছিল নিঃসঙ্গ প্রান্তরে হু হু করে বয়ে যাওয়া হাহাকার। ঠিক তখনই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল নিঃসঙ্গতার যেমন মৃত্যু নেই, তেমনি মৃত্যু নেই রহস্যের। বিজন প্রান্তরে তখনই দেখা হয়ে যায় বিষণ্নতার সাথে। দেখা হয়ে যায় চিত্রার্পিত হাহাকারের সঙ্গে। তখন কেবলই ‘রাজা যায় রাজা আসে’। তখন কেবলই ‘যে তুমি হরণ করো’। তখন কেবলই ‘পৃথক পালঙ্ক।’
নীল পাখিটিই তখন আবুল হাসান। আমাদের নাগরিক চেতনা, স্বদেশচিন্তা, ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় আর প্রেমের যুগপৎ রসায়নে ব্যক্ত বিপর্যস্ত উপকূল। ব্যাপ্ত জনপদের হাহাকার।
আজ এত দিনে ঝরে ঝরে গেছে কত কত রোদ! রোদ থেকে সরে গেছে না-দেখা আলোর রং। পথে পথে পা ফেলে জীবন চলে গেছে ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রান্তরে। কিন্তু বড় বিস্ময় হয়ে আজও বজে সেই সুর। এখনো পুরোনো হলো না তাঁর কুহেলি মাঠ। এখনো চোখ বন্ধ করলেই দেখা যায় তাঁর কল্পিত প্রান্তরের দেবদূত। আবার দিকে দিকে ঝরে ঝরে যাচ্ছে প্রিয়তম পাতাগুলি—
‘প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে, কেউ মনেও রাখবে না,
আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম
কেন আমি মানুষ না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্যাসী
হয়েছি বিজন ব্যথা, হয়েছি আগুন।’
এই যে বিচ্ছিন্নতাবোধ, এই যে সমাচ্ছন্ন নিঃসঙ্গতা, এই যে ব্যর্থতাবোধ থেকে উঠে আসা কথিত আত্মবিমুগ্ধতা—এগুলো যেন বরাবর কাতর করে চলেছে। ব্যক্তির ভেতরে আবির্ভাব ঘটিয়েছে অন্য ব্যক্তির। যে ব্যক্তির আর্ত অন্তর্লোকে আলো ফেলতে চেয়েছে, চেয়েছে নিঃসঙ্গতাকে শিল্প করতে। চেয়েছে যার কাছে, সে আবুল হাসান, ‘সে এক পাথর’। কিন্তু সেখানে কেবলই ‘লাবণ্য ধরে’। উজ্জ্বলতা ধরে মায়াবী করুণ। বহুবার ভেবেছি। এটা কি সেই পাথর, ‘পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কান্নাভেজা চোখ’ নিয়ে দাঁড়ানো প্রথম যৌবনের ভোর, নাকি স্বল্প বৃষ্টিতে ভেজা বিকেলের চোখ!
ইট–পাথরের এই নগরে থাকতে হয় বহুতল ভবনে। জানালার ওপাশে বিস্ময়কর সব দালান। একটুখানি খোলা আকাশ। প্রতি ভোরবেলা যখন শিশাস্নিগ্ধ বাতাস ঢুকে পড়ে আধুনিক আততায়ীর মতো, ঘুম ও ঘামের ঘনত্বে তখন আমাদের ভোর হয় না। অজান্তে বন্ধ করে ফেলি আমরা কাচের জানালা। পৃথিবী আলোকিত হয়। আলো এসে আঘাত করে। কিন্তু নাগরিক ক্লান্তিকে পরাস্ত করতে পারে না ওই আলো। একসময় কাচের জানালায় ঠকঠক ঠক। আচমকা ঘুম থেকে জেগে দেখি, মাথার কাছেই এক কালো কাক ঠোঁট দিয়ে জানালার কাচে ঠোকর দিচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে জানালা খুলতেই পাখিটি চলে যায়, একটু দূরে, আপাত চঞ্চলতায়। আমরা দেখি কোথায় যেন এক আলোছায়ার খেলা। কাক উড়ে গিয়ে অন্য কিছুতে বসে। তারপর আস্তে আস্তে চলে যায় দূরে। তার অপস্রিয়মাণ দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে মনে হতে থাকে পাখিটির রং আসলে নীল, কালো নয়। মনে হয়, জীবনের যাপিত গরল পান করে করে সে হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয় আর্দ্র।
নীল পাখিটিই তখন আবুল হাসান। আমাদের নাগরিক চেতনা, স্বদেশচিন্তা, ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় আর প্রেমের যুগপৎ রসায়নে ব্যক্ত বিপর্যস্ত উপকূল। ব্যাপ্ত জনপদের হাহাকার। এই সব ছেনেছুনে আর্দ্র হয়ে হয়ে, সংদেনশীল অন্তর্লোকে আর্ত হতে হতে, বহির্বিশ্বকে পাঠ করে করে হয়ে উঠেছে অন্য বর্ণের বিভা। যেখানে নিজেকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যেতে হয়। কিন্তু দেখাতে হয় সহিষ্ণু সদ্ভাব। তাই তো এত দিনে জানা হয়ে যায়—
‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ নেবে না।
আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে
আমার মৃত্যুর আগে বোলে যেতে চাই
সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন
কী লাভ যুদ্ধ করে? শত্রুতায় কী লাভ বলুন’
কারণ, তত দিনে আরও জানা হয়ে যায় মানুষ আসলে একা। নাগরিক কোলাহলটা আসলে মুখোশ। এই মুখোশের ভেতরে আছে আরেক মুখোশ। এত সব মুখোশে মুখোশে মুখগুলো একদম অচেনা। তখন নিজের সঙ্গে নিজেরই রচিত হয়ে যায় বিচ্ছিন্নতা। ফলে সেখানে এসে বাসা বাঁধে মৃত্যুভাবনা। ফলে সেখানে এসে ভর করে ক্লান্তি। ফলে সেখানে এসে গেঁথে যায় হতাশা। এসবের আবর্তনে আবর্তনে কবি হয়ে যান বিপর্যস্ত—
‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা
দৃশ্যের বিপরীত সে পারে না একাত্ম হতে
এই পৃথিবীর সাথে কোনোদিন’
যদিও দৃশ্যের ভেতরে অনেক আবেগ, যেখানে মা আছে, বাবা আছে, বোন আছে! কিন্তু কী আশ্চর্য! তাঁর মা যেন আমাদের মা, তাঁর মা যেন বাংলার সব দামাল ছেলের মা। তাঁর মা যেন আমাদেরই বঙ্গদেশ। তাঁর মা যেন আমাদেরই জন্মভূমি। তাঁর বোন যেন আমাদের বোন, তাঁর বোন যেন বাংলার সব ডানপিটে ভাইয়ের অহংকার।
‘আমি কতবার ভাসিয়ে দিয়েছি শুভ সময়ের খালে আমার স্থলপদ্ম
কতবার সূর্যময় সরোবর আর পাতা ফেলা বনানীকে ভেবেছি আমার বোন।’
তাঁর প্রেমিকা যেন বাংলার সব আউলাঝাউলা, আবেগপ্রবণ, বোহেমিয়ান প্রেমিকের রহস্যময়ী বান্ধব। অসম্ভব আবেগে থরো থরো আত্মপরিচয়ের কুহেলি মাঠ!
ওই কুহেলি মাঠেই রচিত হতে থাকে জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার বীজতলা, যেখান থেকে জন্ম নিতে থাকে বারবার বোর্হেসের পতনশীল ঈশ্বরের হন্তারক। ওই হন্তারক আমাদের নিয়ে যায় আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার কাছে। সেখানে হারানো আর প্রাপ্তির দৃশ্য। সেখানে কল্পনা আর প্রতিস্থাপনের সান্ত্বনা—
‘লক্ষ্মী বউটিকে
আমি আর কোথাও দেখি না
হাঁটি হাঁটি শিশুটাকে
কোথাও দেখি না
কতগুলো রাজহাঁস দেখি
নরম শরীর ভরা রাজহাঁস দেখি
কতগুলো মুখস্থ মানুষ দেখি
বউটিকে কোথাও দেখি না
তবে বউটি কি রাজহাঁস?
তবে শিশুটি আজ
সবুজ ঘাসের সূর্য, সবুজ আকাশ!
কেবল উৎসব দেখি
স্বাধীনতা দেখি
তবে কি আমার ভাই আজ
স্বাধীনতা, পতাকা?
তবে কি আমার কোন তিমিরের বেদিতে উৎসব?’
‘মৃত্যু আমাকে নেবে, জাতিসংঘ নেবে না।/ আমি তাই নিরপেক্ষ মানুষের কাছে, কবিদের সুধী সমাবেশে/ আমার মৃত্যুর আগে বোলে যেতে চাই/ সুধীবৃন্দ ক্ষান্ত হোন, গোলাপ ফুলের মতো শান্ত হোন/ কী লাভ যুদ্ধ করে? শত্রুতায় কী লাভ বলুন’
তিন
বিজন আয়নার পরাপাঠ্যে শুধু স্বপ্নিল উচ্ছ্বাস নিয়েই শেষ হয়ে যায় না আবুল হাসানের কবিতা। সেখানে ভিড় করে শত শত প্রশ্ন। উত্তরগুলো খুঁজতে খুঁজতে পার হয়ে যায় কবিতার শেষ চরণও। শেষ চরণের পরে যে মহাশূন্যতা থাকে, সেখানেও পাঠককে যেতে হয় ভাবনার ভেলায় চড়ে। এই ঘোর তাঁকে করে তোলে পবিত্র মাতাল। কিন্তু জীবন তো কোনো এক পবিত্র মাতালের স্বীকারোক্তি নয়। তাহলে কবি আবুল হাসান কেন প্রথমে নিজেকে, তারপর তাঁরই প্রতিবিম্বিত রূপ কবিতাকে এবং তাঁর কবিতার পাঠককে সেই পবিত্র বিহ্বলময় হাহাকারের দিকে নিয়ে যান? যান, কারণ যে ক্ষরণে তিনি বিপর্যস্ত, তা শুধু একার নয়। শুধু তিনি পবিত্র মাতালের মতো তা জারিত করেন কবিতায়। তা প্রকরণে ও উপস্থাপনায় এমন সংযোগী যে পাঠক অবলীলায় একাত্ম হয়ে যান। কিন্তু এই একাত্ম হয়ে যাওয়াটা বিষয় ও প্রকরণের এক যৌথ মনীষার লব্ধি ফলাফলে।
কী তাঁর বিষয়? বলার অপেক্ষা রাখে না যে তাঁর কবিতার একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে বিচ্ছিন্নতাবোধ, আবেগপ্রবণ আচ্ছন্নতা, রয়েছে কাতরতা, যা কিছু হতে পারত তাঁর অনুপস্থিতিজনিত হাহাকার। কবিতায় স্পষ্টীকরণ নিয়ে বোদ্ধা মহলে নানারকম বিতর্ক শোনা যায়। স্পষ্টীকরণ ও অস্পষ্টীকরণের মাঝামাঝি থেকে যে কবিতাগুলো লেখা হয়েছে, বিশ্ব কবিতার ইতিহাসে সেগুলোই জনপ্রিয় হয়েছে, হয়েছে অমর। এই প্রবণতা কবিতায় আধুনিকত্বের উপাদান আবিষ্কারের এবং কবিতায় শিল্পসত্তার গভীরতা শনাক্তের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আবুল হাসানের কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে এই দুয়ের মাঝামাঝি একটা প্রকরণ উপলব্ধ হয়। এটা করতে গিয়ে তিনি প্রচলিত অলংকার হিসেবে শুধুই চিত্রকল্প বা দৃশ্যকল্প নির্মাণ করতে চাননি। তিনি বাংলা কবিতায় সংযোজন করেছেন নতুন এক অলংকার-ধারণার। যেটাকে বলা যেতে পারে—চিত্রাল্পনা। তাতে চিত্রকল্পের জটিল খেই হারানোর ঝুঁকি থেকে মুক্তি পেয়ে তাঁর কবিতা হয়েছে চিত্রাল্পনাময়। এটা বাংলা কবিতায় নতুনতর সংযোজন বলে মনে হয়। এই সংযোজনের মাহাত্ম্যে তাঁর কবিতার অন্দরমহল যেমন জটিলতর হয়নি, হয়নি দুর্বোধ্য, হয়নি অবোধ্য, কিংবা অপ্রবেশ্য। আবার সরল-তরল হয়ে ক্ষুণ্ন করেনি এর শিল্পমূল্যকে।
তাঁর বিবিধ ভাবনার ভেতরে ব্যক্তির দুঃখও তাঁকে স্পর্শ করে। খুব স্বল্পায়ু জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে তাঁর কবিতায় সমষ্টির দুঃখ ও মর্মবেদনার হাহাকার থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি।
তাঁর কাব্যের জগৎ বড়ই রহস্যময়। তা চিত্রাল্পনাময় হয়ে উপস্থাপিত হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের পাঠকের সমক্ষে। তাঁর বিবিধ ভাবনার ভেতরে ব্যক্তির দুঃখও তাঁকে স্পর্শ করে। খুব স্বল্পায়ু জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে তাঁর কবিতায় সমষ্টির দুঃখ ও মর্মবেদনার হাহাকার থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয়নি। ‘কালো কৃষকের গান’ কবিতাটিই তো তাঁকে অমর করার জন্য যথেষ্ট, তা–ই নয় কি?
‘দুঃখের এক ইঞ্চি জমিও আমি অনাবাদী রাখব না আর আমার ভেতর
সেখানে বুনবো আমি তিন সারি শুভ্র হাসি ধৃত পঞ্জ ইন্দ্রিয়ের
সাক্ষাৎ একগুচ্ছ নারী, তারা কুয়াশার মতো ফের এক পলক
তাকাবে এবং বলবে তুমি না অন্ধ কবি ছিলে
তবে কেন চক্ষুষ্মান এমন কৃষক আজ? বলি কি সংবাদ হে মর্মাহত রাজা
এখানে রূপশালী ধানের ধারণা আছে? এখানে মানুষেরা সমিতিতে মালা পেয়ে খুশি…’
মর্মযাতনার ভেতরেও কী আশার বাণী! দুঃখ-উপলব্ধির ভেতরেও কী আনন্দের রেণু! এসব কেবল আবুল হাসানেই মেলে।
আবুল হাসানের কবিতা এভাবেই উপস্থাপিত। তাঁর কবিতা এ রকম বহুরৈখিক বার্তা নিয়ে হাজির, যেন খণ্ড খণ্ড বারুদ। এসেছে জ্বালিয়ে দিতে সুস্থির দর্পণে দৃশ্যমান সমূহ মুখ! কে তুমি সফেদরূপগ্রাহী পাপী দণ্ডায়মান! আগুনে বাতাসে কুটিল তুমি দাঁড়িয়ে থাকো বাধা হয়ে! আমাকে দেখো—গোলাপের গোপন পাপড়ি ভেদ করে এসেছি—এখন মুখে মুখে ছাই রঙের বারুদ। আমিও ঢেলে দেব গোপন পাপড়ি, আর তার সুবাস।
কবি আবুল হাসান ওই গোপন পাপড়ি ঢেলে দেন। তখন তৃষ্ণার স্বীকারোক্তি নিয়ে তাঁর চিন্তাপাপড়িগুলো চলে যাচ্ছে লোকালয়ে। সুবাস বিলাচ্ছে। হাহাকার সৃষ্টি করছে। চেতনায় ধরিয়ে দিচ্ছে আগুন। আর তিনি ধীরে ধীরে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছেন। প্রস্তুতি রচিত হচ্ছে তাঁর লোকান্তরিত হওয়ার।
কবিতার সত্যগুলো হয়তোবা সত্যি সত্যি চাক্ষুষ নয়। চাক্ষুষ নয় এই সব দৃশ্যকল্প-ভাষা। তাহলে কী এই সব? এই সবের মধ্যে যত সব কলরব তা উঠে এসেছে আবুল হাসানের অভিজ্ঞান থেকে। অভিজ্ঞানের ভেতরে যে অভিজ্ঞতা, তার ভেতরে নীল পরির অলীক নাচ, নীলাভ আলোর ভেতরে তার সামুদ্রিক সন্তরণ। চোখের ভেতরে এই সব প্রহেলিকা আদতে কোনো স্বপ্নবৈকল্যও নয়, নতুন রহস্যের নতুন মেঘ। এই মেঘ, এই পরি, এই সামুদ্রিক সন্তরণ ছেড়ে কবির কবিতা যাবে কোথায়! তাই তো কাজলাক্ষীর কাজল কালো চোখের ভেতরে মেঘের বেগুনি রং। তার ওপরে আকাশ। টলোমলো টলোমলো, ঝোড়ো ঝোড়ো, ভেজা ভেজা, উষ্ণ উষ্ণ, কপট কপট। এসবের ভেতরেই রচিত হয়ে যাচ্ছে তাঁর কবিতার পথ। তাই তো আজ আবুল হাসানের কবিতা তরুণ কবিরা অবশ্যপাঠ্য বলে মনে করেন।
কবি হয়তো নিজের ভেতরে নিজেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে? কতটা সহজে! কতটা সম্ভব এই অসম্ভাবনা! বাদাম পাহাড়ে তো কত ঘটনাই ঘটে। ঘটনা ও দুর্ঘটনা উভয়ই। এগুলো একে একে চোখের ভেতরে পাচার হয়ে যায়। সেখানে আবার বৃষ্টির ঢেউ। ঢেউ থেকে উঠে আসে তাঁর সব অভিজ্ঞান। মেঘের ভেতরে তখন অর্ফিয়ুসের বাঁশির হালকা সুর। সুরের ঝরনায় যখন বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় পড়ে, মনে হয় জলেশ্বরীর জলগণিতের প্রতিটি উপপাদ্য কবির সঙ্গে। কী প্রশান্তি! কত যন্ত্রণা মাথায় থাকে! মৃত্যুর মতোই সে অবধারিত, কবি আবুল হাসান যেমন অবধারিত; তাঁর কবিতা যেমন অবধারিত—একক ও অন্যতর, তেমন।