ট্রেনে কাটা পড়ে নিঃশব্দে মারা গেলেন যে লেখক

ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছেন লেখক–অনুবাদক–সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুর রশীদ। কোথাও কোনো টুঁ শব্দ হয়নি। কেউ জানতেও পারেননি। কথাশিল্পী শহীদুল জহিরের লেখা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাঁর এই অভিন্নহৃদয় বন্ধুটির চেষ্টার অন্ত ছিল না।

মোহাম্মদ আবদুর রশীদ
ছবি: সংগৃহীত

কোনো কোনো পথ অনেক ব্যস্ত, সারাক্ষণ পথচারী চলছেই। কোনো কোনো পথ একটু কম ব্যস্ত, কম কম মানুষ সেই পথে চলাচল করে। কোনো কোনো পথ বড় নির্জন, কখন যে কে সেই নির্জনতা ভেঙে হেঁটে যায়, তা হয়তো জানাই হয় না আমাদের। কোনো কোনো মানুষ ব্যস্ত পথটির মতো, কেউ কেউ তার চেয়ে কম ব্যস্ত। কেউ কেউ নির্জন পথ, পথের মতো, তাঁদেরই কেউ যদি চলে যান চিরদিনের জন্যও, তবু খুব একটা শব্দ হয় না। যেটুকু দেখেছি, সে রকমই একজন মোহাম্মদ আবদুর রশীদ। যেন বা নিজেকে কিছুটা আড়ালে রেখে চলতে পারাই ছিল ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদের জীবনের গতিপ্রকৃতি! এই আড়ালপ্রিয়তা দোষের কিছু নয়।

কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তিনি উত্তরায় নিজের বাসার কাছে ট্রেনে কাটা পড়বেন, এমন কি কারও ভাবনায় ছিল? ২ ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্মদিন ছিল। আবদুর রশীদের কাটা টুকরো লাশ জোড়া লাগিয়ে ঢাকা থেকে পাবনায় নিয়ে গিয়ে সমাহিত করা হয়েছে।

ট্রেনে কাটা পড়ে নিঃশব্দে মারা গেলেন লেখক-অনুবাদক-সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুর রশীদ। সাহিত্য সমাজের কেউ যেন জানতেই পারল না।

মোহাম্মদ আবদুর রশীদের সঙ্গে শাহরোজা নাহরিন ও টোকন ঠাকুর।
ছবি: সংগৃহীত

মোহাম্মদ আবদুর রশীদ ছিলেন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। ১৯৯৬ সালে তিনি অধ্যাপকের পদ অর্জন করেন এবং বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে জনাব রশীদ বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক পদে যোগদান করেন এবং পরবর্তী সময়ে ডিন পদে কাজ করেন। তাঁর লেখা গ্রন্থ ও অনুবাদ গ্রন্থসমূহ হলো, ‘দ্য প্রাইস অব ইনইকুয়ালিটি’, ‘অসমতার খেসারত’, ‘বৈপ্লবিক রাশিয়া’, স্যামুয়েল দি হানটিংটনের দুটি বই, জোসেফ ই, স্টিগলিজের দুটি বই, নোয়াম চমস্কির তিনটি বই, নেলসন ম্যান্ডেলার একটি বই, ফরিদ জাকারিয়ার একটি বই, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত পাকিস্তান সরকারের তদন্ত কমিটির বাছাইকৃত অধ্যায়সমূহ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভারতের বিএসএফের তৎকালীন মহাপরিচালক রুস্তুমজির স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থসহ মৌলানা ওয়াহিদ উদ্দিন খানের ইসলাম ধর্মবিষয়ক দুটি গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন।

‘রাজনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞান কোষ’ শীর্ষক তাঁর একটি মৌলিক গ্রন্থ দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি যথাক্রমে ‘যুদ্ধাপরাধী জামায়াত’ ও ‘জঙ্গি প্রসঙ্গ’ শীর্ষক ছয় খণ্ড সম্পাদনা করেছেন। শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের ওপর তাঁর সম্পাদিত একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহিরের ক্লাসমেট ছিলেন মোহাম্মদ আবদুর রশীদ। শহীদের জীবনে রশীদ এক দরদি বন্ধু ছিলেন। এ যুগে মেলে না এমন। শহীদুল জহির আকস্মিক প্রয়াত হলেন ২০০৮ সালে। জনাব জহির সরকারের আমলা ছিলেন বটে, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে অকৃতদার ছিলেন। চূড়ান্ত একা থেকে মরে যাওয়া লেখক শহীদুল জহির। ‘শহীদুল জহির স্মারকগ্রন্থ’ সম্পাদনা থেকে শুরু করে ‘শহীদুল জহির রচনাসমগ্র’ ও শহীদুল জহিরের উপন্যাস, গল্প, অগ্রন্থিত ও প্রকাশিত লেখাসমূহ সংগ্রহ ও সম্পাদনা করেছেন মোহাম্মদ আবদুর রশীদ।

আবদুর রশীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুলগেরিয়ার হায়ার ইকোনমিক ইনস্টিটিউট থেকে যথাক্রমে রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর পড়ালেখা ও গবেষণা করেছিলেন। দেশ–বিদেশের অসংখ্য একাডেমিক জার্নালে তাঁর বেশ কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

আবদুর রশীদ মাসখানেক আগেই মারা গেছেন ট্রেনে কাটা পড়ে—এই তথ্য আমার জানা ছিল না। পাঠক সমাবেশের প্রকাশক সাহিদুল ইসলাম বিজু কথায় কথায় জানালেন। শুনে হতবাক হলাম। এক মাস আগে রশীদ ভাই কবরে চলে গেছেন? জানিই না!

মোহাম্মদ আবদুর রশীদ অনূদিত দুটি বই

পূর্বাচলে রশীদ ভাইয়ের একটা আবাসিক জমির প্লট ছিল। সেই প্লটে তিনি এখনো বাড়ি নির্মাণ শেষ করেননি, প্লটের ভেতর পেঁপেগাছসহ অনেক ধরনের গাছ লাগিয়েছিলেন। সেসব গাছের সামনে দাঁড়িয়ে তোলা ছবি তিনি ফেসবুকে আপলোড করতেন। ফেসবুক মেসেঞ্জারে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাওয়া নিজের কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত পাঠাতেন। খুব যে ভালো লাগত রশীদ ভাইয়ের গায়কী বা কণ্ঠ, তা নয়। তবু প্রিয়জন ভেবেই পাঠাতেন।

বাংলা ভাষার খুব বড় লেখক শহীদুল জহিরের তিনি যেমন বন্ধু ছিলেন, শহীদুল জহির মারা গেলে তাঁর সব লেখালেখির ট্রাঙ্ক খুলে মালামাল বের করার দায়িত্বে ছিলেন জনাব রশীদ। অনেকটা জীবনানন্দের ট্রাঙ্ক খুলে মালামাল বের করা বা সম্পাদনার দায়িত্ব যেমন ছিল কবি ভূমেন্দ্র গুহর ওপর, একইভাবে শহীদুল জহির মারা গেলে তাঁর লেখাপত্রও রশীদ ভাইয়ের গ্রন্থনা ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে।

একদিন রশীদ ভাই নারিন্দায় এসেছিলেন, শহীদুল জহিরের মনোজগতের ‘কাঁটা’র চিত্রায়ন দেখতে। সারা দিন ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আমার ‘কাঁটা’ সিনেমাটি নিয়ে তিনি খুব আশাবাদী ছিলেন। ‘কাঁটা’র নির্মাতা হিসেবে রশীদ ভাইয়ের কাছে আমার ঋণ রয়ে গেছে। দুর্ভাগ্য, ‘কাঁটা’ মুক্তি পাবে অচিরেই, কিন্তু রশীদ ভাই আর থাকলেন না। ছবিটি তিনি দেখে যেতে পারলেন না।

খুব হাহাকার লাগে, এমন মানুষ কীভাবে ট্রেনে কাটা পড়েন? অনেকবার দেখা হয়েছে পাঠক সমাবেশে, আড্ডা হয়েছে।

কেউ কেউ নির্জন পথ, পথের মতো, তাঁদেরই কেউ যদি চলে যান চিরদিনের জন্যও, তবু খুব একটা শব্দ হয় না। যেটুকু দেখেছি, সে রকমই একজন মোহাম্মদ আবদুর রশীদ। যেন বা নিজেকে কিছুটা আড়ালে রেখে চলতে পারাই ছিল ড. মোহাম্মদ আবদুর রশীদের জীবনের গতিপ্রকৃতি! এই আড়ালপ্রিয়তা দোষের কিছু নয়। কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তিনি উত্তরায় নিজের বাসার কাছে ট্রেনে কাটা পড়বেন, এমন কি কারও ভাবনায় ছিল?

২০১৯ সালে আমার বাসা ছিল রামপুরা মহানগর প্রজেক্টে। হঠাৎ একদিন ফোন করে রশীদ ভাই জানালেন, ‘রামাদা (ভি রামস্বামী) এখন ঢাকায়। আপনি কি একটু আসতে পারবেন?’

রামাদা ভারতীয় অবাঙালি, কেরালার লোক কিন্তু দীর্ঘদিন কলকাতায় বসবাস করছেন এবং যে কারণে রশীদ ভাই আমাকে ফোন করে আসতে বললেন, সেই কারণটি হলো রামাদা—ভি রামস্বামী শহীদুল জহিরের ইংরেজি অনুবাদক। রামাদার অনুবাদে ইংল্যান্ড থেকে এরই মধ্যে এক খণ্ড শহীদুল জহির প্রকাশিতও হয়ে গেছে পৃথিবীর ইংরেজি ফিকশন পড়া পাঠকদের জন্য। রামাদা, রশীদ ভাই, রামাদার অনুবাদকর্মের অ্যাসোসিয়েট শাহরোজা নাহরিন, বিজু...অনেক আড্ডা হলো একদিন, পাঠক সমাবেশে।

জানলাম, ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে রশীদ ভাইয়ের। এটা কি তাঁর আত্মহত্যা? না, তা কী করে হয়? তিনি অনেক স্বপ্নচারী ছিলেন। নইলে কি আর শহীদুল জহিরের গোলার ধান সম্পাদনায় নিজেকে ব্যাপৃত করতেন!

কিন্তু রশীদ ভাই একলা থাকতেন ঢাকায়, ছেলেমেয়েরা পশ্চিমে। বিজুর কথা শুনে যেটুকু বুঝলাম, অধ্যাপক আবদুর রশীদের ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু বা আত্মহত্যা বা হত্যা (!) নিয়ে একটা সন্দেহ ঘনীভূত থাকবে, ফিরে ফিরে আসবে আমাদের মনে, শুধু আবদুর রশীদ আর ফিরবেন না। রশীদ ভাই, ঋণ শোধরাবার সুযোগ দিলেন না! এমনকি আপনার সঙ্গে আর দেখাও হচ্ছে না? আহ, রশীদ ভাই, কী দিয়ে কী হয়ে গেল?

শহীদুল জহিরের অনুবাদক ভি রামস্বামীর সঙ্গে মোহাম্মদ আবদুর রশীদ।
ছবি: সংগৃহীত

ফেসবুক মেসেঞ্জারে চ্যাট হচ্ছিল রামাদার সঙ্গে। ভীষণ মনখারাপ রামাদার। কথায় কথায় বলে ফেললাম, ‘রশীদ ভাইকে স্মরণ করে একটা লেখা তো লিখতে পারি, রামাদা?’

রামাদা নিজেও উৎসাহী হলেন, বললেন, ‘তাহলে আমিও কিছু লিখে পাঠাই, আপনার লেখার সঙ্গে যুক্ত করে প্রকাশ পেতে পারে বাংলাদেশে।’ (তবে শহীদুল জহিরের অনুবাদক ভি রামস্বামী আবদুর রশীদকে নিয়ে যে লেখাটি লিখেছেন, সেটি আমরা আলাদাভাবে প্রকাশ করছি ‘যেমন ছিলেন আবদুর রশীদ’ নামে।)

চমকপ্রদ তথ্য হলো, ট্রেনে কাটা পড়ে মরার আগের দিনও রশীদ ভাই চ্যাট করেছেন রামাদার সঙ্গে। এত মূল্যবান গ্রন্থ তাঁর হাতে রচিত ও অনূদিত হয়েছে অথচ মোহাম্মদ আবদুর রশীদের নামটি সচরাচর পাঠক জানেনই না। এই দুর্ভাগ্য আমাদের সবার। জাতিগত দুর্ভাগা আমরা। রামাদা অর্থাৎ ভি রামস্বামীর সঙ্গে রশীদ ভাইয়ের সেই চ্যাট থেকেই টের পাওয়া যায়, জীবনের প্রতি আসক্তি কমেছিল তাঁর। হতাশা জমেছে। সেই চ্যাট থেকে একটি অংশ রামাদা আমাকে পাঠালেন, এখানে তুলে দিচ্ছি সেই অংশ। চ্যাটে রশীদ ভাইয়ের কথাটার পরই এ লেখায় যুক্ত বাকি অংশ ভি রামস্বামীর, যিনি শহীদুল জহিরের ইংরেজি অনুবাদক। বর্তমানে বাস করছেন কলকাতায়। খুবই আশ্চর্যের বিষয়, রামাদার সঙ্গে রশীদ ভাইয়ের ফেসবুক চ্যাটিং জানুয়ারির ৩১ তারিখে এবং পরদিন ১ ফেব্রুয়ারিতে তিনি ট্রেনে কাটা পড়লেন নিজের বাসার কাছাকাছি, উত্তরায়। রশীদ ভাইয়ের চ্যাট—

জানুয়ারি ৩০: ‘আমার শারীরিক অবস্থা আজকে খুবই খারাপ লাগছে। বিছানা থেকে উঠতেই পারছি না। আসতে চেষ্টা করব।’

জানুয়ারি ৩১: ‘শুভ সকাল। শারীরিক অবস্থা খারাপ থাকায় আমার পক্ষে আসা সম্ভব হয়নি, দুঃখিত। আপনি আমার জীবনের স্বপ্ন পূরণ করেছেন, আপনার কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ। ভালো থাকুন রামাদা।

আপনি সেই মানুষ যে আমার একটি বিরাট স্বপ্ন পূরণ করেছেন। আপনার কাজের দৌলতে শহীদুল জহির এখন বিশ্বসাহিত্যদরবারে স্থান পেয়েছে। আজকে পাঠক সমাবেশের মঙ্গল সমাবেশে আপনার উপস্থিত থাকার কথা আমি জানি। মনে হচ্ছে, সেখানে আসা সম্ভব হবে না। প্রিয় বন্ধু দুঃখিত, আমি অনুষ্ঠানে আসতে পারিনি। শরীরটা দিনের পর দিন খারাপ করছে। আপনার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। শহীদুল জহিরের বই অনুবাদ করে আপনি আমার জীবনের একটা বড় ইচ্ছা পূরণ করেছেন। আশা করি, তাঁর আরও কিছু গল্প-উপন্যাস অনুবাদ করে আপনি আমাদের এই বঙ্গের মানুষদের কৃতার্থ করবেন।... আশা করি অনুষ্ঠান ভালো হয়েছে। বেঁচে থাকলে আমাদের নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে।

আবারও বলছি বিরক্ত হবেন না, শহীদুল জহিরের কাজ হাতে নিয়ে আপনি আমাকে চির কৃতজ্ঞ করেছেন। আমার জীবনের স্বপ্ন আপনি পূরণ করেছেন। শহীদের আরও কিছু কাজ আপনি হাতে নেবেন কি না, সেটা আপনার আগ্রহের বিষয়। “মুখের দিকে দেখি” উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদ মুদ্রিত অবস্থায় আমি দেখে যেতে পারব কি না, জানি না। শহীদের আরও কিছু কাজ আপনি গ্রহণ করবেন কি না, সেটা আপনার বিবেক–বিবেচনা এবং মেধার ওপরই ছেড়ে দিলাম। আমার কিছুই বলার নেই।

বিনয়ের অবতার, আবদুর রশিদ’