‘আমরা হয়তো শেষ জেনারেশন’—এই কথার মধ্য দিয়ে আমরা যা ঘটাচ্ছি

দিন কয়েক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা ফেসবুকে ট্রেন্ডিং হলো ‘আমরাই প্রথম জেনারেশন’ বা ‘শেষ জেনারেশন’ ধরনের কথা। যেকোনো সামাজিক–সাংস্কৃতিক ইস্যুতে কেন কথাটি জুড়ে দিলাম আমরা? আর এই কথার মধ্য দিয়ে কী ঘটাতে চাইলাম সবাই?

ফেসবুকের বিভিন্ন স্ট্যাটাস ও কনটেন্ট অবলম্বনে কোলাজ

‘আমরাই হয়তো শেষ জেনারেশন, যাদের “মা” ভালো রান্না জানে।’

‘আমরাই হয়তো প্রথম জেনারেশন, যাদের বউ পিঠা বানাতে জানে না।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস, স্টোরি ও মিমে এখন ট্রেন্ডিং হলো এ ধরনের কথাবার্তা। দিন কয়েক আগেই ফেসবুকে এই ‘শেষ জেনারেশন’ নিয়ে কত কীই না ঘটল। যেকোনো সামাজিক–সাংস্কৃতিক ইস্যুতেই এখন জুড়ে দেওয়া হচ্ছে ‘প্রথম জেনারেশন’ বা ‘শেষ জেনারেশন’ হিসেবে একটি নির্দিষ্ট প্রজন্ম বা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অনুভূতি।

ফরাসি তাত্ত্বিক মিশেল ফুকোর মতে, ক্ষমতা ও জ্ঞান নিবিড়ভাবে যুক্ত। দুইয়ে মিলে তৈরি হয় নিয়ন্ত্রণের একটি কাঠামো। আর যেকোনো ক্ষমতাকাঠামোকে সুঠাম রাখতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে সহিংসতা। এ কথা বলতেই এ প্রশ্নও উঠবে যে সহিংসতা বলতে আপনি বা আমি কী বুঝি?

ঐতিহ্যগতভাবে সহিংসতার সংজ্ঞায় এক বা একাধিক আক্রমণকারী ও এক বা একাধিক আক্রান্ত ব্যক্তি থাকেন। তবে এই আক্রমণের ধরন দৃশ্যমান ও উদ্দেশ্যমূলক। তবে আরও একধরনের সহিংসতা রয়েছে, যা স্পর্শগ্রাহ্য বা সচেতনভাবে না–ও ঘটতে পারে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সক্রিয় অংশগ্রহণও এ ক্ষেত্রে না–ও দৃশ্যমান হতে পারে। এই ধরনের সহিংসতা জ্ঞানমূলক এবং দীর্ঘকাল ধরে ধীরে ধীরে এর বিস্তার ঘটে। যার ফলে প্রথাগত সহিংসতা হিসেবে তা বিবেচ্য হয় না। এ ধরনের সহিংসতাকে বলা হয় ‘এপিস্টেমিক ভায়োলেন্স’ বা জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতা।

যেকোনো জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতার গোড়ায় থাকে একটি বিষয়—‘আদারিং’ বা পৃথক্‌করণ। যেকোনো সামাজিক–সাংস্কৃতিক ব্যবস্থায় অধীনস্থদের ‘আমরা’ ও ‘অন্যরা’—এই দুই ভাগ বা ‘বাইনারি’তে ফেলে দেওয়া হয়। আর এই ‘আমি’ ও ‘অন্য’–এর নির্দিষ্ট জ্ঞানগত ভূমিকাও থাকে। কিন্তু এই ভূমিকার ফারাক বিস্তর। তো ফারাকটা কেমন করে ঘটে? ‘আমি’ ব্যক্তিটি নিজেকে ‘উত্তম’ মনে করেন। আর যাঁকে তিনি ‘অন্য’ জ্ঞান করেন, তাঁকে ভাবেন ততধিক বহির্ভূত ও ‘অধম’। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ঔপনিবেশিক আধিপত্য নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেন, জ্ঞান ও ক্ষমতা পরস্পরকে প্রভাবিত করে। এভাবে সমাজব্যবস্থার মধ্যে থাকা ‘অর্থ’ বা মানে, যাকে আমরা বলতে পারি মিনিং উৎপাদনের প্রক্রিয়া, তা নিয়ন্ত্রিত হয়। আর এই ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও ‘অর্থ (মিনিং)/জ্ঞান–ক্ষমতা পরস্পরচ্ছেদী’—এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়েই গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক এই পৃথক্‌করণের ধারণা নির্মাণ করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর কথা হলো, ঔপনিবেশিক শাসক ও শোষিতের মধ্যে এক অমোচনীয় রেখা টানা হয়। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনকে সেই ‘অন্য’ হিসেবে নির্মাণ করা হয়, যিনি সহজাতভাবে কম জ্ঞান ও বুদ্ধিসম্পন্ন। তাঁর কাছ থেকে জ্ঞানগত কর্তৃত্বই ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তাঁকে জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এতটাই নিকৃষ্ট হিসেবে দেখানো হয় যে ‘উৎকৃষ্ট’ ঔপনিবেশিক শাসকের আধিপত্য জায়েজ হয়ে যায়। স্পিভাক আরও বলেছেন, এই প্রক্রিয়ায় ঔপনিবেশিক শাসক নিজস্ব পৃথিবী নির্মাণ করেন আর পাল্টে দেন উপনিবেশিতের দুনিয়া।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থানে সামষ্টিক জ্ঞান উৎপাদনপ্রক্রিয়ার বিবর্তন বা ‘প্যারাডাইম শিফট’ হয়েছে। এখন সামাজিক মাধ্যমে জ্ঞান ও তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নির্মিত হয় ক্ষমতাসীনদের বয়ান। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না–ও হতে পারে, অবচেতনভাবেও ঘটতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা ভাইরাল হচ্ছে বা ট্রেন্ডিং হচ্ছে, জনধারণা গড়ে তুলতে তা ভূমিকা রাখছে। শুধু তা–ই নয়, জনধারণাকে তা এক খাতে প্রবাহিত করছে।

এই পৃথক্‌করণের আবার বেশ কিছু উপাদান রয়েছে, যেগুলোর অন্যতম হলো ‘স্টেরিওটাইপ’ বা ছাঁচে ফেলা এবং ‘প্রিজুডিস’ বা পূর্বধারণা। আমাদের সামষ্টিক জ্ঞানপ্রবাহে এই ‘স্টেরিওটাইপ’ ও ‘প্রিজুডিস’–এর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সম্পন্ন করা হয় যেকোনো পৃথক্‌করণ। যেমন ‘আমরাই হয়তো প্রথম জেনারেশন, যাদের বউ পিঠা বানাতে জানে না’—এই বক্তব্যের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক অবস্থানের নারীদের একটি ছকে ফেলে দেওয়া হলো। একই সঙ্গে একটি পূর্বধারণাকে দেওয়া হলো প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি এই ধারণাও প্রস্তাব করা হলো যে পুরুষেরা পিঠা বানানোর কোনো প্রক্রিয়ায় অংশ নেন না। অর্থাৎ তাঁদের লৈঙ্গিক ভূমিকা এখানে কর্তা তথা ‘আমি’ হিসেবে নির্ধারিত হলো। আর নারীকে স্থাপন করা হলো সেই ‘অন্য’ হিসেবে, যার জ্ঞান বা তথ্য উৎপাদনে কোনো ‘এজেন্সি’ বা কর্তৃত্ব নেই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উত্থানে সামষ্টিক জ্ঞান উৎপাদনপ্রক্রিয়ার বিবর্তন বা ‘প্যারাডাইম শিফট’ হয়েছে। এখন সামাজিক মাধ্যমে জ্ঞান ও তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নির্মিত হয় ক্ষমতাসীনদের বয়ান। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না–ও হতে পারে, অবচেতনভাবেও ঘটতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা ভাইরাল হচ্ছে বা ট্রেন্ডিং হচ্ছে, জনধারণা গড়ে তুলতে তা ভূমিকা রাখছে। শুধু তা–ই নয়, জনধারণাকে তা এক খাতে প্রবাহিত করছে। পক্ষে–বিপক্ষে বইছে মতামতের ঝড়। তবে মজার ব্যাপার হলো এই যে জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতার জোরে ক্ষমতাসীনরা সব মতের দখল নিয়ে নিচ্ছেন অগোচরেই। আর দৃশ্যমান না হওয়ায় সেই সহিংসতা আমরা মেনে নিচ্ছি বারবার। আমাদের চিন্তার উপনিবেশায়ন ঘটে চলেছে নিভৃতেই, ‘আমরাই হয়তো প্রথম জেনারেশন, যাদের বউ পিঠা বানাতে জানে না’—এই কথার মধ্যে দিয়েও!