এস এম সুলতান কেন জাতিস্মর

১০ আগস্ট ছিল কিংবদন্তি চিত্রকর এস এম সুলতানের জন্মশতবর্ষ। কেন তিনি আঁকলেন পেশিবহুল পুরুষ আর হৃষ্টপুষ্ট লাবণ্যময় মেয়েদের ছবি, এ লেখায় থাকল তার তত্ত্ব–তালাশ।

শুধু রংতুলি নয়, বাঁশি হাতেও দারুণ পারঙ্গম ছিলেন এস এম সুলতান। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম, ডিসেম্বর ১৯৭৯

চিত্রশিল্পীর প্রথাসিদ্ধ পথে না গিয়ে এস এম সুলতান—সংক্ষেপে সুলতান—নিজের অভিলাষ অনুযায়ী অগ্রসর হয়েছেন স্বতন্ত্র হয়ে। এই যাত্রায় যতি ছিল না অন্তিমের আগে, কিন্তু বিরতি ছিল মাঝেমধ্যেই—কখনো ইচ্ছায়, কখনোবা অনিচ্ছায়। জীবনের প্রথম পর্বে ক্রমাগত এ শিল্পীর ঠিকানা বদলেছে, থেকেছেন স্থান থেকে স্থানান্তরে, দেশে ও বিদেশে। শৈশব থেকে উত্তর-যৌবনাবধি তাঁর জীবন ছিল যাযাবরের। থিতু মানুষের আটপৌরে জীবনযাপনের পরিবর্তে পরিব্রাজকের মতো ভ্রমণ ছিল তাঁর নিয়তিনির্ধারিত, কেননা তাঁর ধমনির রক্তে ছিল, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ‘আতাভিজম’, বাংলায় ‘পূর্বপুরুষের স্বভাবের প্রতিধ্বনি’। স্বভাবে, জীবনাচরণে পুর্বপুরুষের একজন হয়ে, তাঁদের মতো তাঁকে যেতে হয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে নিজের ঠিকানা খুঁজে পেতে। অনেক লোকালয়ে আশ্রয় পেয়েছেন, কিন্তু মনে হয় শান্তি পাননি, পাননি স্বস্তি; যে কারণে আবার বেরিয়ে পড়তে হয়েছে নিজের প্রকৃত ঠিকানার খোঁজে।

শেষ পর্যন্ত সেই ঠিকানা সুলতান পেয়েছিলেন, যেখানে তাঁর শিকড় প্রোথিত। তাঁর নিজের জীবনের বৃত্তের ভেতরই ছিল ঠিকানাটি, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তাঁর আত্মজীবনের পরিচয় অনুসন্ধানের যাত্রা। নাড়ির সম্পর্ক যে নড়াইল শহরের উপান্তে, চিত্রা নদীতীরে, সেখানেই নিজেকে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন পূর্বপুরুষের আদিম জীবনযাপনের সরলতায়; শ্যামল প্রকৃতির স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায়। কবি শামসুর রাহমান এই জনপদ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেখানে প্রকৃতি আপন মহিমায় অভিষিক্ত...পুরুষ আর নারীর ধড়-মূর্তি বৈভবে আর প্রাঞ্জলতায় নিবিড় কৃষিনির্ভর সভ্যতার এক ঐকান্তিক রূপ।’ (দৈনিক স্বাধীনতা, ১৯৯৪)।

দুই

আশৈশব ছবি এঁকেছেন সুলতান। জন্মসূত্রে পাওয়া শিল্পপ্রতিভার দরুন ছবি আঁকাই ছিল তাঁর নিয়তি, যেমন পূর্বনির্ধারিত ছিল যাযাবর জীবন। তিনি নিজের তাগিদেই এঁকেছেন, খ্যাতি বা অর্থবিত্তের জন্য নয়। এঁকেছেন দেশ-বিদেশের মানুষের অসংখ্য প্রতিকৃতি, বিভিন্ন মাধ্যমে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি। কিন্তু ছবি আঁকায় সিদ্ধহস্ত হলেও সুলতান যেন নিজের পরিচিতি গড়ে তুলতে পারছিলেন না। ষাট দশক পর্যন্ত তাঁর ছবি ভিন্ন পরিচয়ে বিশিষ্ট হয়ে চিহ্নিত হতে পারেনি। তবে জন্মস্থান নড়াইল শহরের উপকণ্ঠে নদীতীরের গ্রামীণ পরিবেশে ফিরে আসার পর সেখানকার প্রকৃতি আর সহজ–সরল মানুষ এ চিত্রকরকে শুধু নতুন বিষয় নয়, নতুন আঙ্গিকেরও সন্ধান দিল। বিশাল ক্যানভাসে তিনি তৈরি করলেন কিষাণ-কিষাণির ছবি, যাঁদের শরীর অতিমানব-মানবীর মতো প্রকাণ্ড, শক্তিমান। তিনি বললেন, এই অতিস্বাস্থ্যের মানুষেরাই আবহমান বাংলার কৃষাণ-কৃষাণী। এই তাঁদের চিরায়ত পরিচয়। বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর লিখেছেন, ‘সুলতানের এটি হচ্ছে প্রয়াস ফিরে যাওয়ার; এবং একটি জনসমষ্টিকে একটি প্রতীকের মধ্য দিয়ে একটি অভিজ্ঞতার সঙ্গে পুনর্বার যুক্ত করার, যে যুক্ততা এই জনসমষ্টিকে ভাষা খুঁজতে সাহায্য করবে, যাতে করে তারা ফের নিজস্ব ইতিহাস আত্মসাৎ করতে পারে।’ (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৯৯৫)।

১৯৭৪ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে এস এম সুলতানের প্রথম একক প্রদর্শনী দেখে দর্শক-সমালোচক স্তম্ভিত, বিস্মিত এবং সংশয়ে দোদুল্যমান। কিন্তু অচিরেই অনেকের মধ্যে এই উপলব্ধি হলো যে তাঁরা এক অনন্যসাধারণ শিল্পীর শিল্পকর্মের মুখোমুখি, যা দেখার অভিজ্ঞতা শুধু নান্দনিক নয়, ইতিহাস পাঠের চেয়ে রোমাঞ্চকর। পেশিবহুল পুরুষ আর হৃষ্টপুষ্ট লাবণ্যময় মেয়েদের দেখিয়ে সুলতান যেভাবে তাঁর ছবিতে দর্শককে বাংলার গৌরবময় অতীত ঐতিহ্যের কথা বললেন, তার জন্য আলোড়িত, বিমোহিত হতে হলো তাঁদের।

কিন্তু কীভাবে তিনি এলেন এই নতুন আঙ্গিকের ছবি আঁকায়, কোথায় পেলেন এ ধারণা? তাঁর এর আগের কোনো ছবিতে নেই এর সামান্যতম আভাস–ইঙ্গিতও। তা হলে কী রূপে সম্ভব হলো অভূতপূর্ব এই শৈলীর ছবি আঁকা?

বিশালাকার মানুষের এসব ছবি আঁকার একটা ব্যাখ্যা এমন হতে পারে যে সুলতান হয়তো জাতিস্মর হয়ে জন্মেছিলেন। জাতিস্মর হয়ে জন্ম নেওয়ার অর্থই হলো, পূর্বজীবনের সব পরিচিত অনুষঙ্গ দেখে শনাক্ত করা এবং তাদের নিখুঁত বর্ণনা দেওয়া। কিংবদন্তির জাতিস্মর যাঁরা, তাঁদের বর্ণনায় নিজের পূর্বজন্মের স্মৃতি ফিরে আসে বর্তমানে। সেই মাফিক জাতিস্মররূপে সুলতান চলে গিয়েছেন পেছনে, পূর্বপুরুষের জীবনে। সমকালের বাস্তবে তাঁদের জীবনের অনুষঙ্গগুলো না থাকলেও তিনি আস্থার সঙ্গে ছবির ভাষায় বলেছেন, একদা এ–ই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের বিশুদ্ধ আনন্দময় জীবন, এমন ছিল তাঁদের আদিম বলিষ্ঠ অবয়ব আর তরঙ্গায়িত পেশিবহুল হস্ত-পদযুগল।

সুদূর অতীতে গিয়ে পূর্বপুরুষের জীবনচিত্র অবলোকন করে এর মধ্যে নিজের জীবন খুঁজে পেয়ে নমিত উল্লাসে সুলতান বলতে চেয়েছেন, এমন ছিল আমাদের জীবনযাপনের চিত্র। অকুতোভয়, সাহসী মানুষ ছিলাম আমরা, আমাদের পুর্বপুরুষেরা। আমি নিশ্চিতভাবে এ কথা জানি বলেই সে সময়ের গৌরবের সব দিনকে রেখা আর রঙে দেখিয়েছি ছবিতে। পূর্বপুরুষদের পুনরুজ্জীবিত করেছি কাগজে, ক্যানভাসে। আর এভাবেই খুঁজে পেয়েছি আমার—আমাদের সামষ্টিক পরিচয়।

সুলতান তাঁর বিশাল সব ক্যানভাসে সাহসী, বলিষ্ঠ আদিম মানুষের জীবনের চারণকবি হয়ে যেন এ–ও বলতে চেয়েছেন, এই যদি হয় আমাদের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য, তাহলে বর্তমানের হীন-দীন অবস্থা আর শীর্ণ শরীরের মানুষ সত্য বা চিরন্তন হতে পারে না। তারা হয় অলীক, মায়া অথবা ক্ষণস্থায়ী, অপস্রিয়মাণ।

কোনো জাতি যখন স্মৃতিভ্রষ্ট হয়, মনে হয় তখন এভাবেই আবির্ভাব ঘটে জাতিস্মরের। আর তাঁদের বলে যেতে হয় কিংবদন্তির ভাষ্য, যে কিংবদন্তি নিকট অথবা সুদূর অতীতের।

কেন অতীতের আদিম মানুষের প্রতিকৃতি এঁকেছেন সুলতান, ওপরে তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া হলো। এখন দেখা যাক, কীভাবে এবং কোন উপায়ে এই চিত্রকর কিংবদন্তির কথা বলেছেন ক্যানভাসের রং–রেখায়।

বিশাল ক্যানভাসে তিনি তৈরি করলেন কিষাণ-কিষাণির ছবি, যাঁদের শরীর অতিমানব-মানবীর মতো প্রকাণ্ড, শক্তিমান।

তিন

সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ যৌথভাবে বাস করেছে প্রকৃতির সান্নিধ্যে—ফলমূল সংগ্রহ করে এবং মাটিতে গবাদিপশু দিয়ে কর্ষণ করে ফসল ফলিয়ে। সে জন্য পূর্বপুরুষের জীবনের কথা বলতে গিয়ে সুলতান যে জীবনকে তাঁর নিজের বলে মনে করেছেন, সেই গ্রামীণ কৃষিসভ্যতা বারবার উঠে এসেছে তাঁর ছবিতে। পৃথিবীর ছোট–বড় বিভিন্ন শহরে তিনি বাস করেছেন দীর্ঘদিন। কিন্তু তাঁর অসংখ্য ছবির মধ্যে এমন একটিও নেই, যার পটভূমি নগর এবং বিষয় নাগরিক জীবন। প্রকৃতিসংলগ্ন গ্রামীণ জীবনকেই উপজীব্য করে ছবি এঁকে তিনি যেন ফিরতে চেয়েছেন নিজের পূর্বজন্মের জীবনে, যে জীবন তাঁর পূর্বপুরুষেরও।

কেবল বিষয়ের অনুষঙ্গে গৌরবময় অতীতের কথা বলা নয়, বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত মানুষের ভঙ্গি আর আচরণেও দেখা যায় কিংবদন্তি, এমনকি মিথের সাহায্যে অতীতের পুনরুজ্জীবন। যেমন ‘আদি মানবের বৃক্ষরোপণ’ ছবিতে সুলতান ব্যবহার করেছেন মির্চা এলিয়াদ কথিত ‘ক্রিয়েশন মিথ’ (মিথস, ড্রিমস অ্যান্ড মিস্ট্রিজ, ১৯৬৮)। বিশাল ক্যানভাসে অনেক ছবিতে তিনি এঁকেছেন জমিতে হাল কর্ষণরত কৃষককে, যেখানে দেখা যায় জেমস ফ্রেজারের ‘ফার্টিলিটি মিথ’। (দ্য গোল্ডেন বাউ, ১৯০০)। আবার তাঁর ছবিতে যখন দেখা মেলে জমি বা চরভূমি নিজেদের অধিকারে রাখার জন্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হাতে ছুটছেন মানুষ, সেখানে মূর্ত হয়ে ওঠে লরেন্স কুপের ‘হিরোইক মিথ’। (মিথ, ১৯৫০)। ট্র্যাজিক মিথের (রিচার্ড ভাগনারের রিং সাইকেল অপেরায় সিগফ্রিডের মৃত্যু, ১৮৭৬) ব্যবহার দেখা যায় শত্রুর হাতে নিহত নর-নারী এবং শিশুদের মৃতদেহ পড়ে আছে ফসলের ক্ষেতে—এসব ক্যানভাসে।

নড়াইলে থাকার সময় সুলতান কিছু ড্রয়িং করেছিলেন। এখানে তিনি বর্তমানের মানবজাতি নয়, প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের ছবি এঁকেছেন। এতে তাঁদের দেখানো হয়েছে ক্রো ম্যাগনন শাখার ন্যুব্জদেহীরূপে। আদতে তাঁদের ছবি তিনি আঁকলেন কীভাবে? এর ব্যাখ্যা হতে পারে এই যে পূর্বজন্মে তিনি তাঁদের কথা শুনেছেন লোকমুখে। আর সেই জনশ্রুতির ফলে তিনি সমকালের জাতিস্মর হয়ে নন, বরং উত্তরসূরি হিসেবে পূর্বপুরুষদের ছবি এঁকেছেন। যে পন্থায় তিনি প্রাগৈতিহাসিক যুগের পূর্বপুরুষদের ছবি এঁকেছেন, তাঁকে বলা যায়, টি এস এলিয়ট কথিত ‘লিটারারি মিথ’ বা ‘মিথিক মেথড’। জেমস জয়েসের ইউলিসিস প্রকাশের পর এলিয়ট বলেছিলেন, এখন থেকে কাহিনি বর্ণনা ন্যারেটিভ মেথডে না হয়ে হবে মিথিক মেথডে। অর্থাৎ বর্ণনার ভেতরে ভেতরে মিথ থাকবে, যেমন ছিল তাঁর দ্য ওয়েস্টল্যান্ড কাব্যগ্রন্থে।

এলিয়ট কথিত মিথিক মেথড পুরোপুরি মিথনির্ভর নয়, মাঝেমধ্যে ইলিউশন বা সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হলেই এই শর্ত পূরণ হয়। এ সূত্র অনেক দিন ধরেই সাহিত্যে, বিশেষত কবিতায় অনুসৃত হয়ে আসছে। চিত্রকলায় এর আংশিক বা বিচ্ছিন্ন ব্যবহার দেখা যায় না। যেমন যাঁরা প্রাচ্যকলাধর্মী ছবি তৈরি করেছেন, তাঁরা কেবল মোটিফেই নয়, সম্পূর্ণ কম্পোজিশনেই প্রাচ্যকলা বা ওরিয়েন্টাল আর্টের চরিত্র বজায় রেখেছেন। তবে সাহিত্যের সঙ্গে ভিজ্যুয়াল আর্টের এখানে পার্থক্য রয়েছে। এর কারণ সাহিত্যের বর্ণনায় ইলিউশনের সাহায্য নিয়ে ভাষা ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়া যায়। কিন্তু প্লাস্টিক আর্টে ন্যারেশন বা বর্ণনা এভাবে ভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে মিশ্রিত হলে দর্শকের উপলব্ধিতে তা ধরা পড়া কঠিন, অনেক ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেখানে যে মোটিফ মূল ফর্মের সম্পূরক হিসেবে থাকে, সেগুলো মূলত সমধর্মী, অন্তত দর্শকের পক্ষে সমগ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত করার উপযোগী। এ কারণে চিত্রকলায় বিভিন্ন মিথের ব্যবহার এককভাবে হতে হয়, খণ্ডে খণ্ডে বিচ্ছিন্নভাবে নয়। তাই সুলতানের মতো শিল্পী যখন মিথনির্ভর ছবি আঁকেন, তখন তাঁকে আগাগোড়াই সেই মিথের প্রতিভাসে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়। এলিয়ট কথিত মিথিক মেথড সাহিত্যে যেমন, চিত্রকলায় তা হওয়ার উপায় নেই। দুটির ভাষা ভিন্ন।

সুলতানের ছবির কম্পোজিশন ও ফর্মের বিভিন্ন অনুষঙ্গ দেখে ব্যাখ্যা করা যায়, কীভাবে ছবির বিষয় এবং তার অন্তর্গত ফিগার বিভিন্ন মিথের ইঙ্গিত দিয়ে জানাচ্ছে যে তিনি সাধারণ শিল্পী হয়ে নন, জাতিস্মরের ভূমিকা ও দায়িত্ব নিয়ে নিজের অপ্রচলিত ধারার ছবিগুলো সৃষ্টি করেছেন।

সুলতান যে একাডেমিক অর্থে বিভিন্ন মিথ সম্বন্ধে জেনে ছবি এঁকেছেন, তা নয়। কিন্তু যে স্বজ্ঞা তাঁকে এসব ছবি আঁকতে উদ্বুদ্ধ করেছে, তার মধ্যে নিশ্চয়ই ছিল মিথ-আশ্রিত ঐতিহ্যবোধের অনুষঙ্গ। নচেৎ তিনি এই প্রথাবিরোধী, অপ্রচলিত শৈলীর ছবি একের পর এক এঁকে যেতে পারতেন না। এখানে এ কথাও বলা দরকার, সুলতান যে জাতিস্মর হয়ে জন্মেছেন, এ–ও তাঁর জানা ছিল না নড়াইলের উপকণ্ঠে নিজ গ্রামে ফিরে আসার আগে। ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসা’র পরই তাঁর উপলব্ধি হলো, পূর্বজন্মের স্মৃতি রয়েছে আপন সত্তার গভীরে, অবচেতনে। আদতে পূর্বজীবনের ডাক শুনেই পুনর্জন্মের স্মৃতি মনে এল সুলতানের। ফলে তিনি এমন সব ছবি আঁকলেন, যা দেখে কবির মতোই দৃপ্ত কণ্ঠে বলা যায়, ‘আমি কিংবদন্তির কথা বলছি/আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।’

চার

জাতিস্মর হয়ে সুলতান যে কিংবদন্তির কথা বলেছেন, যে পূর্বপুরুষের ছবি এঁকেছেন, তা কি সত্যিই ছিল বাস্তবে, তাকে কি বলা যায় ঐতিহাসিক সত্য? গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছের যে সোনার বাংলা, তেমন দেশ, সেই কৃষিসভ্যতা, হয়তো কখনো বাস্তবে ছিল না—নেহাতই কল্পনা, অতিকথন, মিথ। কিন্তু মিথ হলেও তা একটি জাতির আদর্শ হয়ে বর্তমানের ক্ষুদ্রতাক্লিষ্ট এবং গ্লানিময় জীবনের বিকল্প হয়ে মানুষকে উৎসাহ জোগায়, সামনে অপেক্ষা করছে আনন্দময় জীবন—এমন বরাভয় জানায়। এখানে রলাঁ বার্থস স্মর্তব্য, তিনি বলেছেন, মিথ কোনো বস্তু বা ফর্ম নয়, মিথ একটি ভাষা, যার মাধ্যমে কোনো বক্তব্য ব্যক্ত করা হয়। আর এই বক্তব্য প্রকাশের ভাষা লিখিত হতে পারে অথবা হতে পারে প্রতিকৃতি (মিথোলজিস, ১৯৫৭)। এস এম সুলতান তাঁর ছবিতে যে অসম্ভব বাস্তবের আলেখ্য লিখেছেন, তাকে বলা যায় বর্তমানের দুঃসময়ের পটভূমিতে আশাবাদী আর আলোকিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী এক তূর্যবাদকের ঘোষণা। স্মৃতিনির্ভর অতীতের ছবি এঁকে তিনি সন্ত পুরুষের মতো অভয় দিয়ে বলেছেন, এই যদি হয় আমাদের অতীত জীবনের চালচিত্র, তাহলে ভবিষ্যৎ সুখী ও সমৃদ্ধ হবেই। এ শিল্পীর চরদখলের ছবি আমাদের এ–ও বলে যে প্রয়োজনে কাস্তে ফেলে হাতে তুলে নিতে হবে বল্লম, ঢাল-তলোয়ার, রুখে দাঁড়াতে হবে তাঁদের বিরুদ্ধে, যাঁরা কেড়ে নিতে চান অধিকার। এভাবেই শিল্পী এস এম সুলতানের অপ্রচলিত ধারার ছবি হয়ে গেছে জীবনসংগ্রামের মেনিফেস্টো, সুখী-সমৃদ্ধ জীবনের ইশতেহার।

এস এম সুলতান যখন যুবক
ছবি: সংগৃহীত

এস এম সুলতান, কিংবদন্তি চিত্রকর

পুরো নাম: শেখ মোহাম্মদ সুলতান

ডাকনাম: লাল মিয়া

জন্ম: ১০ আগস্ট ১৯২৩, নড়াইলের মাসিমদিয়া গ্রামের কৃষক পরিবারে।

চিত্রকলা শিক্ষা: চল্লিশের দশকে আর্ট স্কুলে ভর্তি হন; ১৯৪৩ সালে তৃতীয় বর্ষে উঠে আর্ট স্কুল ছেড়ে দেন; পরে বাংলার পেশিবহুল কিষাণ–কিষাণির ছবি এঁকে দেশে–বিদেশে অনন্য বিশিষ্টতা অর্জন করেছেন।

মৃত্যু: ১০ অক্টোবর ১৯৯৪, যশোরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে

উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম: প্রথম বৃক্ষরোপণ, গাঁতায় কৃষক, চর দখল, চিত্রা নদীর তীরে প্রভৃতি।