শুধু ‘স্লিম’ মেয়েরাই কি সুন্দর

এক কনসার্টে গাইছেন টেইলর সুইফটফাইল ছবি: রয়টার্স
সদ্য সমাপ্ত কান চলচ্চিত্র উৎসবের লালগালিচা কি অস্কার উৎসব—সবখানেই ‘স্লিম’ অভিনেত্রীদের জয়জয়কার। ‘স্লিম’ নারীই যেন সৌন্দর্যের প্রতীক। সৌন্দর্যের এ ধারণা কেন গড়ে ওঠে আমাদের মনে?

আমার ১১ বছরের ছেলের সঙ্গে ছুটির দিনের আড্ডা চলছিল। আমরা একটি রেস্তোরাঁয় খেতে খেতে আলাপ করছিলাম। কথা প্রসঙ্গে ছেলে বলে উঠল, সুন্দর মেয়েরা ‘স্লিম’ হয়। আমি একটা ধাক্কা খেলাম। সে বলল, ‘টেইলর সুইফটকে দেখো নাই?’ আমি বললাম, ‘টেইলর সুইফট তোমার কাছে সুন্দর?’ সে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ! সবাই তো তা–ই বলে।’

আমি একমুহূর্তে ছোটবেলার কুঁকড়ে থাকার দিনগুলোতে ফিরে গেলাম। আমার দৈহিক গড়ন বরাবরই মোটার দিকে, পেটের কাছে একটু বাড়তি মেদ। এটা নিয়ে সংকোচের অন্ত ছিল না। পাতলা, ছিমছাম গড়নের মেয়েদের দিকে হিংসা নিয়ে তাকাতাম। তার ওপর শ্যামলা হওয়ায় বাঙালি পারিবারিক ও সামাজিক গণ্ডিতে যা যা শুনতে হয়, তার সবই শুনেছি। ১৯৯৪ সালে শ্যামা সুন্দরী সুস্মিতা সেন যখন বিশ্বসুন্দরীর খেতাব পেলেন, তখন প্রথম জানলাম, কালো মেয়েও সুন্দরী হতে পারে। তবে মোটা মেয়ে কখনোই সুন্দরী হতে পারে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল টনি মরিসনের ‘দ্য ব্লুয়েস্ট আই’। কৃষ্ণাঙ্গ পিকোলাকে বারবার সবাই মনে করিয়ে দেয়, সে দেখতে কত ‘কুৎসিত’। একটি শ্বেতাঙ্গ পাড়ায়, শ্বেতাঙ্গ পরিবারে আশ্রিতা পিকোলার মনে হয়, পৃথিবীর সুনীলতম চোখ পেলেই সে সুন্দরের স্বীকৃতি পাবে। ত্রিশ-চল্লিশের দশকের তীব্র বর্ণবিদ্বেষমূলক মার্কিন সমাজে বেড়ে ওঠা টনি মরিসন এ উপন্যাসে নিজের বালিকাবেলার বেদনার কথাই তুলে ধরতে চেয়েছেন বলে পরবর্তীকালে জানিয়েছেন। কৃষ্ণাঙ্গদের বিমানবিকীকরণ সামষ্টিক অবচেতনে কীভাবে গেঁধে গিয়েছিল, তা তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন একটি দৃশ্যেই—যখন পিকোলাকে দোকানি ক্যান্ডি দিতে গিয়ে সাবধানে দেয়, যাতে পিকালোর হাতের ছোঁয়া না লাগে। কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের ভেতরেও তীব্রভাবে জাগিয়ে তোলা হয়েছে আত্মঘৃণা, যা তাঁদের চামড়া, চুল ব্লিচ করে, অর্থাৎ অ্যাসিডে পুড়িয়ে ফরসা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিশ শতকের গোড়ার দশকগুলোয় ‘ব্রাউন পেপার ব্যাগ’ পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যেতেন কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা। অর্থাৎ বাদামি কাগজের থলের বিপরীতে যাচাই করা হতো ত্বকের রং কতটা হালকা।

এখন আপনার ‘রং ফরসা করার’ প্রসাধন ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’র (যা এখন নাম পাল্টে ‘ফেয়ার অ্যান্ড গ্লো’ হয়েছে) পুরোনো বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে না, যেখানে আপনার রং কতটা ফরসা, তা যাচাই করা হয় একটি শেডকার্ড দিয়ে?

কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা দুনিয়াতেই সৌন্দর্যের অভিধায় এখনো শ্বেতাঙ্গ অনুষঙ্গ প্রাধান্য পায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দৌরাত্ম্যের এ সময়ে যখন সব বয়সী মানুষ সব সময় নানা ধরনের ইমেজে নিমজ্জিত এবং নিয়মানুগ পুনরাবৃত্তির চক্রে আবদ্ধ, তখন আর তা এড়াতে পারার কোনো উপায়ও থাকে না। আর তাই কারদাশিয়ান পরিবারের অন্যতম জনপ্রিয় সদস্য কেন্ডেল জেনার যখন ইনস্টাগ্রামে নিজের ক্ষীণ কটি ও স্ফীত ওষ্ঠের ছবি প্রকাশ করেন, তখন বিশ্বজুড়ে কিশোরী ও তরুণীদের কাছে তা আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়।

‘ব্রাউন পেপার ব্যাগ’ পরীক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি। মিশ্র জাতের মানুষেরা একটু বেশি সম্মান পেতেন রং তুলনামূলক ফরসা হওয়ার কারণে।

গত শতকের ষাটের দশকে কৃষ্ণাঙ্গ অধিকারকর্মীরা শুরু করেন ‘ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল’ বা ‘কালোই সুন্দর’ আন্দোলন। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন কৃষ্ণাঙ্গ মননের গভীরে প্রোথিত আত্মঘৃণার বীজকে উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল, প্রকারান্তরে যা বর্ণবিদ্বেষের মহিরুহকে ডালপালা ছড়াতে সাহায্যই করেছে। কালো চামড়া, চুল, দৈহিক বৈশিষ্ট্য, পোশাক, বাচনভঙ্গি, আচরণ—সবকিছুই স্বতন্ত্র, অনন্য এবং সর্বোপরি সুন্দর। কালোরা সাদাদের মতো হতে চাইবে কেন? কেন শ্বেতাঙ্গ সৌন্দর্যের পরিভাষাকে ধারণ করবে? কেন শ্বেতাঙ্গের মানদণ্ডে নিজেকে মাপতে গিয়ে নিজের সত্তাকে পুরোপুরি মেরে ফেলবে, যেমনটা করেছে টনি মরিসনের পিকোলা।

কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা দুনিয়াতেই সৌন্দর্যের অভিধায় এখনো শ্বেতাঙ্গ অনুষঙ্গ প্রাধান্য পায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দৌরাত্ম্যের এ সময়ে যখন সব বয়সী মানুষ সব সময় নানা ধরনের ইমেজে নিমজ্জিত এবং নিয়মানুগ পুনরাবৃত্তির চক্রে আবদ্ধ, তখন আর তা এড়াতে পারার কোনো উপায়ও থাকে না। আর তাই কারদাশিয়ান পরিবারের অন্যতম জনপ্রিয় সদস্য কেন্ডেল জেনার যখন ইনস্টাগ্রামে নিজের ক্ষীণ কটি ও স্ফীত ওষ্ঠের ছবি প্রকাশ করেন, তখন বিশ্বজুড়ে কিশোরী ও তরুণীদের কাছে তা আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়।

নানা ধরনের বৈষম্যের বিষয়ে আমরা এখন অনেক সচেতন। বিশ্বজুড়ে সৌন্দর্যপণ্য বিক্রির ক্ষেত্রেও অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান আজকাল বৈচিত্র্যের দিকে নজর দেয়। এমনকি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতাগুলোও বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করছে। আগে ২৮ বছরের বেশি বয়সী নারীরা মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারতেন না। গত বছর এ নিয়মে পরিবর্তন আনা হয়। তুলে দেওয়া হয় বয়সসীমা। এ ছাড়া প্রতিযোগীদের যোগ্যতার মাপকাঠির অনেক বিধিনিষেধে আনা হয় পরিবর্তন, যার ধারাবাহিকতায় সন্তানের মা, বিবাহিত, বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে, স্থূলকায়—এমন নারীরাও বর্তমানে এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারছেন।

কিন্তু বৈচিত্র্যের এই উদ্‌যাপন কি আসলেই সার্বিক মনোভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে পেরেছে? কেন ১১ বছর বয়সী বালকের কাছে সুন্দর মানে ক্ষীণকায়া? কেন টেইলর সুইফটের মতো শ্বেতাঙ্গিকেই ‘সুন্দরী’ বিবেচনা করা হচ্ছে? আমাদের সামাজিক মনস্তত্ত্ব তথা সমাজ আমাদের এমন করেই শেখাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে বিশ্বজুড়ে নানা বয়সী নারীরা এখনো আত্মঘৃণার সেই খাঁচাতেই আটকে আছেন। ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমার মতো তাই গাইতে ইচ্ছে হয়, এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে?