রুচির দুর্ভিক্ষ নাকি সংস্কৃতির: মামুনুর রশীদ বনাম হিরো আলম

হিরো আলম
ছবি: প্রথম আলো

‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ না বলে ‘সংস্কৃতির দুর্ভিক্ষ’ বললে বরং ভালো করতেন নাট্যকার মামুনুর রশীদ। ‘রুচি’ ব্যাপারটা ব্যক্তিগত এবং ‘সংস্কৃতি’ বিষয়টি কেবল ব্যক্তিগত নয়। তবে ‘রুচি’ যত অনায়াসে আমরা ব্যবহার করি, ‘সংস্কৃতি’ ততটা করি না। মামুনুর রশীদও তা–ই করেছেন হয়তো।

হিরো আলমের নাম মামুনুর রশীদ যেভাবে ব্যবহার করেছেন, তা হিরো আলমের জন্য কিছুটা অবমাননাকর তো বটেই। তবে আমাদের তথাকথিত ‘শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান’ মানুষদের অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে মামুনুর রশীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, তা এই বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্বের জন্যও কম অবমাননাকর নয়। অবশ্য এটা ওই মানুষদের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক অবদমনেরও বহিঃপ্রকাশ।

এ ক্ষেত্রে হিরো আলম বরং সংযম ও রুচির পরিচয় দিয়েছেন এই বলে, ‘রুচিতে বাধলে হিরো আলমকে মেরে ফেলেন, মামুনুর রশীদকে হিরো আলম’ (সমকালের ২৮ মার্চ ২০২৩ সংখ্যার শিরোনাম)। হিরো আলম তাঁর আক্ষেপ, অভিযোগ ও অভিমানের কথা বলেছেন, কিন্তু একটাও কটু কথা নয়, মামুনুর রশীদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেছেন পুরোপুরি। মামুনুর রশীদ জানেন, হিরো আলমকে তাঁর রুচির জন্য মেরে ফেলা যায় না কিংবা তাঁকে দমন করেও সংস্কৃতি রক্ষা হয় না। সংস্কৃতি একটা চলমান ব্যাপার এবং এই ব্যাপারের মধ্যে হিরো আলমের খুব বড় জায়গাও নেই। তিনি আমাদের সময়ের একটা সিরিয়াস ইয়ার্কি।

হিরো আলম আমাদের জনরুচির পণ্য। তিনি জনবিনোদনের উপাদান। দীর্ঘ জীবন জনরুচির টিভি নাটকে কাজ করেছেন মামুনুর রশীদ। জনরুচি উন্নত করার সংগ্রামও করেছেন তিনি। আবার জনরুচি বা জনসংস্কৃতির উপাদান হিসেবে ব্যবহৃতও হয়েছেন।

তিনিও ব্যাপারটা ভালো করেই জানেন। হিরো আলম আমাদের সময়ে বিনোদনের বিবেচনায় স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানের চেয়ে বেশি কিছু। প্রাচীন রোমে হিংস্র পশু কিংবা হিংস্রতম কোনো অপরাধীর সঙ্গে দাস, প্রান্তিক কিংবা অন্যায় সাজাপ্রাপ্ত কোনো গ্ল্যাডিয়েটরকে লড়তে লড়তে মরতে দেখে মানুষ যে আনন্দ পেত, হিরো আলম আমাদের এখনকার মানুষের কাছে সেই আনন্দের মতো। ওই গ্ল্যাডিয়েটরের প্রতি যে সহানুভূতি ও করুণা থাকত দর্শকদের, আজকের হিরো আলমের প্রতিও তাঁদের আছে সেই সহানুভূতি ও করুণা। হিরো আলমের যাঁরা দর্শক ও পক্ষাবলম্বী শিক্ষিত রুচির মানুষ, তাঁরা কিন্তু মুক্ত মাধ্যমের এই দুনিয়ায় হিরো আলমের ভূমিকায় নামবেন না; কারণ, তা তাঁদের রুচিতে বাধবে। তবে তাঁরা হিরো আলমের ক্যারিকেচার উপভোগ করবেন।

হিরো আলম আমাদের সময়ে বিনোদনের বিবেচনায় স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ানের চেয়ে বেশি কিছু। প্রাচীন রোমে হিংস্র পশু কিংবা হিংস্রতম কোনো অপরাধীর সঙ্গে দাস, প্রান্তিক কিংবা অন্যায় সাজাপ্রাপ্ত কোনো গ্ল্যাডিয়েটরকে লড়তে লড়তে মরতে দেখে মানুষ যে আনন্দ পেত, হিরো আলম আমাদের এখনকার মানুষের কাছে সেই আনন্দের মতো। ওই গ্ল্যাডিয়েটরের প্রতি যে সহানুভূতি ও করুণা থাকত দর্শকদের, আজকের হিরো আলমের প্রতিও তাঁদের আছে সেই সহানুভূতি ও করুণা। হিরো আলমের যাঁরা দর্শক ও পক্ষাবলম্বী শিক্ষিত রুচির মানুষ, তাঁরা কিন্তু মুক্ত মাধ্যমের এই দুনিয়ায় হিরো আলমের ভূমিকায় নামবেন না; কারণ, তা তাঁদের রুচিতে বাধবে। তবে তাঁরা হিরো আলমের ক্যারিকেচার উপভোগ করবেন।

আমাদের দেশেও একটা দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটেই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে মামুনুর রশীদদের উত্থান হয়েছিল। ১৯৬০–এর দশকে তাঁরা যখন নাটক লিখছেন বা থিয়েটার করছেন, তখন তাঁদের আর বয়স কতই-বা। সে সময় একধরনের সাংস্কৃতিক শূন্যতা দেখা দিয়েছিল এবং সেই শূন্যতার মধ্যেই জেগে ওঠা মুখগুলোর একজন মামুনুর রশীদ। হিরো আলম ও রুচির দুর্ভিক্ষ ইস্যুতে মনে পড়ছে, তাই জিজ্ঞেস করি, যে ধরনের সাংস্কৃতিক শূন্যতার মধ্যে মামুনুর রশীদদের মামুনুর রশীদ হয়ে ওঠা, এখনকার পরিস্থিতিতেও তেমন কোনো কিংবা ভিন্ন কোনো সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে কি না? হয়ে থাকলে তা কোথা থেকে কীভাবে তৈরি হয়েছে এবং সেই শূন্যতা পূরণ করার উপায় কী?

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন
প্রতিকৃতি: আরাফাত করিম

১৯৪৩ সালে এই দেশে যে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, যা ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত। তারও আগে ১৭৭০ সালে (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, যা বাংলা সনের হিসেবে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে সুপিরিচিত। এই দুই দুর্ভিক্ষই ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে মারাই গিয়েছিল এক কোটির মতো মানুষ। তাহলে বেঁচে থেকেও মানবিক ও মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিল কত মানুষ? ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ স্থায়ী হয়েছিল দশকের বেশি। মারা গিয়েছিল ৩০ লাখের মতো মানুষ। এ ক্ষেত্রেও মানবিক ও মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিল কত মানুষ? যদিও দুই দুর্ভিক্ষকেই প্রাকৃতিক সংকট, সমস্যা ও বিপর্যয় বলে চালিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা ছিল ব্রিটিশ আমলজুড়ে, কিন্তু দুর্ভিক্ষগুলো ছিল মনুষ্যসৃষ্ট। দুই দুর্ভিক্ষের জন্যই ব্রিটিশ শাসনকে দায়ী করা হয়। তার মানে মোদ্দাকথাটা হলো, দুর্ভিক্ষের জন্য সরকারের দায় ছিল। আমাদের এই সময়ে সংস্কৃতির এই দুর্ভিক্ষের ঘটনার দায় তবে কার ওপর বর্তায়? তা ছাড়া দুর্ভিক্ষের কারণে সংস্কৃতিতে যে প্রভাব থাকে, তাই-বা কীভাবে কাজ করে?

মামুনুর রশীদ তাঁর বক্তব্যে (প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০২৩–এর শিরোনাম ‘রুচির দুর্ভিক্ষে হিরো আলমের উত্থান: মামুনুর রশীদ’) শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলেছিলেন, দেশে একটা রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। আমরা সেই রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি।’ পঞ্চাশের যে মন্বন্তরের কথা বলছিলাম, সেই মন্বন্তরের প্রজন্ম শিল্পাচার্য জয়নুল। তাঁর ছবিতে এই মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষ যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, তা আর কারও চিত্রকলায় নেই। তিনি যে ‘রুচির দুর্ভিক্ষের’ কথা বলেছিলেন, সেটিও কিন্তু আসলে ‘সংস্কৃতির দুর্ভিক্ষ’ বোঝাতেই বলা।

মামুনুর রশীদ
ছবি : সংগৃহীত

বিখ্যাত মার্কিন লেখক ওয়াল্টার মোজলে (কিছুটা রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির) ২০০৬ সালের ২৩ অক্টোবর একটি কলাম লিখেছেন ‘দ্য নেশন’ পত্রিকায় ‘কালচারাল ফ্যামেন: অ্যা সাইকেল’ শিরোনামে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘মানুষ যখন জীর্ণশীর্ণ হতে হতে মারা যায়, সেই দুর্ভিক্ষ সবচেয়ে ভয়ংকর। কিন্তু অন্য ধরনের দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও আছে: মানুষের আত্মার দুর্ভিক্ষ। সংবেদনের এই বিরান শূন্যতা, এই আধ্যাত্মিক দুর্ভিক্ষ আজ আমাদের দেশের লোকদের মধ্যে এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশের মানুষের মধ্যে পুরোদমে চলছে। আশাহীনতা, শূন্যতা এবং বিবেক ও বোধহীন উন্মাদনা (সিনিসিজম—শিল্প, নান্দনিকতা, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রতি ঘৃণা) আমাদের অনেকের হৃদয়ে বাসা বেঁধে নিয়েছে। আমরা ধনসম্পদে পরিবেষ্টিত এবং মানব ইতিহাসের মধ্যে অতুলনীয় সম্ভাবনায় আশীর্বাদপুষ্ট হয়েও ধীরে ধীরে জীর্ণশীর্ণ হয়ে যাচ্ছি।’

যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতির দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি আরও বলছেন, ‘পুরো পরিবার এবং গ্রামের পর গ্রামের ধীরে ধীরে মুত্যু হতে থাকার চেয়ে ভয়ংকর কিছু দুর্দশা এখানে আছে, যে পরিস্থিতিতে একে অপরের চোখের দিকে তাকালে পুরো সংস্কৃতিই দেখতে পায় যে মৃত্যু ধেয়ে আসছে।’

ওয়াল্টার মোজলের এই বক্তব্য এখানে এ কারণে ব্যবহার করলাম যে তাঁদের অবস্থাই যদি এমন টালমাটাল হয়, তবে আমাদের অবস্থা কী, তা সহজেই বোঝা যাবে। বোঝা যাবে সংস্কৃতির বিশ্ব পরিস্থিতিটাও।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছবিতে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’

আমরা জানি, সংস্কৃতি, সমাজ, দেশ, কাল, অর্থনীতি, রাজনীতিও বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটেই তৈরি হয়। দুর্ভিক্ষ কিছু সংস্কৃতি রেখে যায়। বাংলার দুর্ভিক্ষও কিছু সংস্কৃতি রেখে গেছে। পরবর্তী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও সেই সংস্কৃতিকে কোথাও কোথাও জিইয়ে থাকতে দিয়েছে কিংবা নিকেশ করতে পারেনি। যে কারণে আমাদের সংস্কৃতিতে এই ধরনের গল্পও আমরা দেখি যে এক প্রতিবেশী আরেক প্রতিবেশীকে তৃপ্তি ও গর্বের সঙ্গে বলছে, ‘ভাই, কালকে কাঁঠাল খেয়েছি, একটা কোষের পুরোটাই খেলাম।’ আরেক প্রতিবেশী (যে নাকি খুদ-কুঁড়ার জাউ খেয়ে কোনোভাবে বেঁচে থাকে) তা শুনে হাসছে মিটিমিটি। দুর্ভিক্ষ কী সংস্কৃতি উৎপাদন করে দিয়ে গেছে, তা কি পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মানুষের এই গল্পে আমরা দেখতে পাচ্ছি?

সমাজ, দেশ, কাল, অর্থনীতি, রাজনীতি ও বিশ্ব পরিস্থিতির প্রভাবে যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, সেই সংস্কৃতির এই গোটা ব্যাপারের মধ্যে ব্যক্তির আর্থিক ও আত্মিক বিকাশ তথা ব্যক্তির ব্যক্তিগত অবস্থানের ওপর নির্ভর করেই তৈরি হয় তাঁর ব্যক্তিগত রুচি। আমরা এ–ও জানি যে রুচি মিলে মিলেই গড়ে ওঠে সংস্কৃতি আর সংস্কৃতি থেকেই বেরিয়ে আসে ব্যক্তিগত রুচি।

হিরো আলমের ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ আমাদের যে মান সংস্কৃতির বিবেচনায়, যে মান সংস্কৃতি তৈরি করতে ভূমিকা রেখেছেন মামুনুর রশীদরা, সেটি মামুনুর রশীদদের হাত থেকে বেহাত হয়ে কোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির মদদদার হয়ে উঠেছে কি না এবং একটি সংস্কৃতি-অভিজাত শ্রেণির ডান্ডায় পরিণত হয়েছে কি না, সেদিকে আমাদের নজরদারি কই? কিংবা সেদিকে আদৌ নজর দেওয়ার দরকার আছে কি না? বিশ্ব জনরুচি বা জনসংস্কৃতি নিয়ে দুনিয়ার পুঁজিকাঠামো যে হইহুল্লোড়ে মেতেছে, যেভাবে টাকা কামিয়ে নেওয়ার মচ্ছবে মেতেছে, তা থেকে নিদান লাভের কোনো উপায় কি মামুনুর রশীদের আছে? মামুনুর রশীদ তো দূরের কথা, কোনো একটি দেশ বা রাষ্ট্রেরই কি আছে সেই সামর্থ্য ও সক্ষমতা?