হুমায়ূনের জগৎ কি এখনো আছে?

কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের ছিল এক আশ্চর্য লেখালেখির ভুবন। গত শতকের সত্তর দশক থেকে চলতি শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের বিস্তৃত বাংলাদেশই ছিল তাঁর লেখালেখির জগৎ। হুমায়ূন নির্মিত সেই জগতের কী অবস্থা এখন? এই পরিবর্তিত সমাজে সেই জগৎ কি এখনো আছে?

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮-১৯ জুলাই ২০১২)
ছবি: প্রথম আলো

গল্প-উপন্যাসের আখ্যান এবং চরিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রত্যেক লেখক একটি জগৎ তৈরি করেন। সেই জগতের বাসিন্দাদের নিয়ে তিনি আপনমনে খেলেন বিরাট শিশুর মতো। যেমন লাতিন আমেরিকার লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস খেলেছেন মাকন্দ গ্রামের বাসিন্দাদের নিয়ে, খেলেছেন আর্কাদিও বুয়েন্দিয়াকে নিয়ে। রুশ সাহিত্যিক লিও তলস্তয় তো তাঁর সাহিত্যিক জীবনের পুরোটাই খরচ করছেন জীবন কী, এর সার্থকতা কোথায়—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে। আমাদের শহীদুল জহিরের লেখার জগৎজুড়ে ছিল পুরান ঢাকার অলিগলি, বানর ও বাসিন্দারা, শহিদুল জহির যাদের বলেছেন ‘হালার পুতেরা’! হাসান আজিজুল হকের জগৎজুড়ে ছিল দেশভাগের হাহাকার। তেমনি হুমায়ূন আহমেদেরও ছিল এক আশ্চর্য লেখালেখির ভুবন। সেই ভুবন কেমন? কারা সেই ভুবনের বাসিন্দা? সেই জগৎ কি এখনো আছে?

মেঝেতে ল্যাটা মেরে বসে সামনে টুলের ওপর কাগজ রেখে হাতের লেখায় তিরিশ বছরের বেশি সময় ধরে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর লেখালেখির জগৎ নির্মাণ করেছেন।

তাঁর সেই জগতের বাসিন্দা হয়েছে মাজেদা খালা, বাদল, বৈষয়িক খালু সাহেব, বেহিসেবি হিমু, অসম্ভব রূপবতী রূপা, মিসির আলী, নীলগঞ্জ হাইস্কুলের মাস্টার, পাড়ার মাস্তান বাকের, মোহনীয় মুনা, চিররোগী মামি, পঙ্গু হামিদ, অরু, তরুসহ আরও অনেকে।

মোটা দাগে বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধপরবর্তী সংকট, গ্রামের কৃষিজীবন, বহু আগের জমিদারবাড়ি, সামন্ত প্রথা, মধ্যবিত্তের ঘরকন্না, চায়ের দোকানের আড্ডা, হাওয়া মে উড়তা যায়ে…হিন্দি গান—সব মিলিয়ে গত শতকের সত্তর দশক থেকে চলতি শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের বিস্তৃত বাংলাদেশই ছিল হুমায়ূন আহমেদের লেখার জগৎ। হুমায়ূন নির্মিত সেই জগতের কী অবস্থা এখন?

প্রথমেই পঙ্গু হামিদের কথা মনে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ছিল রাজাকার। তার আগে সে ধান কাটার কাজ করতে সিলেটের হাওর অঞ্চলে গিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাড়ি, নৌকা সব বন্ধ হয়ে যায়। সে আটকা পড়ে সেখানে। একসময় ধান কাটার কাজ শেষ হয়ে যায়। তার হাতের পয়সাকড়ি ফুরিয়ে আসে। কী করবে সে এখন? মুক্তিতে যাওয়া যায়, কিন্তু মুক্তিতে টাকাপয়সা নেই। রাজাকারে গেলে ৭০ টাকা বেতন। লুটপাটের ভাগও আছে। এ ছাড়া অন্যান্য সুবিধা তো আছেই।

সেই হামিদই দেশ স্বাধীনের পর এক জোড়া বুটজুতা, খাকি শার্ট আর প্যান্ট নিয়ে গ্রামে ফিরে আসে এবং মিনমিনে গলায় বলে, সে মুক্তিতে নাম লিখিয়েছিল। গ্রামবাসী তার কথা বিশ্বাস করে এবং যথেষ্ট সম্মান দিতে শুরু করে। এরপর পঙ্গু হামিদ একজন মুক্তিযোদ্ধার সব সুযোগ–সুবিধা ভোগ করে বাকি জীবন পার করে দেয়।

এই হামিদ কি এখন আমাদের সমাজে নেই? আলবত আছে এবং সংখ্যায় বেশুমারই আছে। অনেককেই দেখি ক্ষমতার হাওয়াবদলের সঙ্গে সঙ্গে দল বদল করতে। বহু বছর যে মানুষকে বিএনপির রাজনীতি করতে দেখতাম, তাকে হঠাৎ দেখি ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বাদ্য বাজিয়ে কিংবা তিন মণ দুধ দিয়ে গোসল করে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে।

কমে যাচ্ছে হলুদ হিমু-নীল রূপাদের সংখ্যাও। কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে প্রতিনিয়ত নোটিফিকেশনের হাতছানি, লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের মোহ উপেক্ষা করে হিমুর মতো যুক্তিহীন বৈরাগ্য ধারণ করা একপ্রকার অসম্ভব সাধনাই বটে। ফলে আজকের সমাজে রূপার মতো কেউ নীল শাড়ি পরে ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে, তার দীঘল চুলের আড়াল দিয়ে ডুবে যাবে শেষ বিকেলের মায়াবি ‍সূর্য—এমন আশা করাটাই বাতুলতা। বড়জোর মেসেঞ্জারে নীল শাড়ি পরা রূপার ছবি আশা করা যেতে পারে।

‘আলাউদ্দীনের ফাঁসি’ গল্পটা মনে আছে আপনাদের? গল্পের আলাউদ্দীন একজন শিশু অপহরণকারী। গল্পে দেখা যায়, একটি শিশুকে হত্যার অভিযোগে আদালতে তার বিরুদ্ধে শুনানি চলছে। তারপর একসময় মামলা খারিজ হয়ে যায়। নানা কূটবুদ্ধি চালিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রমাণ বানিয়ে বেকসুর খালাস পায় আলাউদ্দীন। তারপর বিচারকের বাড়িতে এসে সে নিজেই সত্যটা বলে, সে–ই আসলে শিশুটিকে খুন করেছিল। গল্প এখানে শেষ হয়ে যায়। এই গল্পে ভালোর দেখা নেই, সত্যের কোনো জয় নেই, মিথ্যা শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হয়েই রয়।

এখনো সূর্য ওঠে। এপ্রিল মাসের গনগনে রোদে পুড়ে যায় ঢাকা শহর। মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রমাণের জোরে ঝকঝকে দাঁত বের করে আদালত থেকে বেরিয়ে আসে কোনো কোনো আলাউদ্দীন! আমরা দেখি তো, হুমায়ূনের জগতের আলাউদ্দীনদের নব নব রূপ।

আমরা দেখি ‘শঙ্খনীল কারাগার’–এর খোকা ও রাবেয়া দুই ভাই-বোনসহ আরও অনেকেই শুধু দুঃখ চাপা দিয়ে রাখে। একটু চোখ-কান খোলা রাখলে আমরা এখনো দেখতে পাব, আমাদের চারপাশেই কতশত খোকা-রাবেয়া নিজের ভেতর দুঃখ চেপে রেখেছে। হয়তো দুঃখের ধরন পাল্টেছে। পাল্টেছে সামাজিক প্রেক্ষাপট। তাই আমরা আর লজিং মাস্টারদের দেখি না। কিন্তু মাস্টার কাকার মতো চরিত্রদের সমাজজুড়ে ঠিকই দেখি। তবে মাস্টার কাকাকে ফালি ফালি করে কাটা মন্টুরা সমাজ থেকে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।

কমে যাচ্ছে হলুদ হিমু-নীল রূপাদের সংখ্যাও। কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই যুগে প্রতিনিয়ত নোটিফিকেশনের হাতছানি, লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের মোহ উপেক্ষা করে হিমুর মতো যুক্তিহীন বৈরাগ্য ধারণ করা একপ্রকার অসম্ভব সাধনাই বটে। ফলে আজকের সমাজে রূপার মতো কেউ নীল শাড়ি পরে ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে, তার দীঘল চুলের আড়াল দিয়ে ডুবে যাবে শেষ বিকেলের মায়াবি ‍সূর্য-এমন আশা করাটাই বাতুলতা। বড়জোর মেসেঞ্জারে নীল শাড়ি পরা রূপার ছবি আশা করা যেতে পারে।

হুমায়ূনের লেখালেখির জগৎজুড়ে বাংলাদেশের সমাজের এক সামগ্রিক হতাশাও রয়েছে। কী সেই হতাশা? প্রথমত, দেশ স্বাধীনের পর বাইরের শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা না থাকায় স্বাধীন বাংলাদেশে ‘ব্যক্তিক নেতৃত্ব’ ধারণাটি প্রয়োজনীয়তা হারায়। দ্বিতীয়ত, যে বিরাট প্রত্যাশা নিয়ে গোটা জাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির সংযোগ না ঘটায় সবারই স্বপ্নভঙ্গ হয় এবং সেই স্বপ্নভঙ্গের যাতনা থেকে সবাই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠ। সমাজের এই সামগ্রিক হতাশাই হুমায়ূন উপন্যাসের সূতিকাগার। তাই আমরা তাঁর লেখালেখির বিরাট জগতে বড় কোনো নায়ক দেখি না।

তবে ছোট ছোট, মৃদু মৃদু যেসব নায়ককে দেখি, তাদেরও সামগ্রিক মূল্য কম নয়। হুমায়ূনের ‘ফেরা’ উপন্যাসে ফিরে তাকানো যাক। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র আমিন ডাক্তার। তিনি এগারো বছর পর সোহাগী গ্রামে ফিরে গিয়ে একটি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানানোর জন্য গ্রামের চৌধুরীবাড়ির খেতের সামনে বসে পড়েন। কারণ, এগারো বছর আগে চৌধুরীবাড়ির পেছনে এক সুন্দরী বধূর লাশ পাওয়া গিয়েছিল।

এখনো তো সমাজে খুন হয়, হত্যা হয়, ধর্ষণ হয়, চুরি হয়, ডাকাতি হয়। কিন্তু আমিন ডাক্তারের মতো কেউ কি প্রতিবাদ করতে বসে পড়ে? পড়ে না। তনু-ত্বকী–সাগর-রুনিরা বিস্মৃতির আড়ালে নিভৃতে কাঁদে। তাদের জন্য আর কোনো প্রতিবাদ হয় না। হুমায়ূনের জগতের সেই আমিন ডাক্তাররা সমাজ থেকে উধাও হয়ে গেছে।

আমরা হুমায়ূনের লেখালেখির জগতে এক ‍সুন্দর মনের মসজিদের ইমাম দেখি, দার্শনিক কথা বলা কাজের মানুষ দেখি, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সঠিক সংখ্যা বের করতে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে দেখি এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাকে, হিমু নামের এক বোহেমিয়ান ‍যুবককে দেখি গুম আর ক্রসফায়ার নামের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে, পাড়ার মাস্তান ছেলেটার বুকের গভীরে দেখি ঘুঘু পাখির পালকের মতো কোমল প্রেম…।

হুমায়ূনের সেই জগৎ, সেই জগতের ‍মৃদু মানুষেরা এখনো কি আছে আমাদের সমাজে? সবাই নেই। কেউ কেউ তো আছে নিশ্চয়ই। কেউ কেউ নিশ্চয়ই ফিনিক ফোটা জোছনায় আজও গৃহত্যাগী হয় জ্যোৎস্নানার ফুল ধরতে। কেউ কেউ চরাচর ভেসে যাওয়া বৃষ্টির দিনে টিনের চালে সেতারের সুরে মুগ্ধ হয়। কেউ কেউ ছুটির নিমন্ত্রণে বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল নিয়ে দেখা করতে যায় প্রিয় মানুষটির সঙ্গে। যায় তো!