বাংলা লোকগল্পে কেন অনুপস্থিত ইংরেজ শাসক

বাংলা লোকগল্পে গল্পবলিয়ে নারীদের যেমন সুনির্দিষ্টভাবে কোনো নাম নেই, তেমনি ঔপনিবেশিক আমলে সংকলিত হলেও এতে অনুপস্থিত ইংরেজ শাসকেরা। কেন এমন ঘটল? লাল বিহারী দে সংকলিত বাংলা লোকগল্পের প্রথম সংকলনসহ অন্য বইপত্র ঘেঁটে এ প্রশ্নের সুলুক সন্ধান।

১৯১২ সালে লাল বিহারী দের সংগৃহীত লোকগল্পের সংকলন ফোক–টেলস অব বেঙ্গল–এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী ওয়ারউইক গবলের আঁকা ছবি

সন্ধ্যাবেলা টিমটিমে কুপিবাতি জ্বলছে। আকাশে তখন তারার মেলা। এর মধ্যে কেউ একজন গল্প বলছেন। ডালিম কুমারের গল্প, সুয়োরানি-দুয়োরানির গল্প, ব্রহ্মদৈত্যের গল্প, অথবা ফকির চাঁদের গল্প। 

কিন্তু যিনি গল্প বলছেন, তাঁকে কি আমরা চিনি? হয়তো কারও ঠাকুমা হবেন। সাদা শাড়ি পরে, একহাত ঘোমটা টেনে তিনি সাত ভাই চম্পার গল্প বলছেন। অথবা শম্ভূর মা? ছোট মাছের চচ্চড়ি আর বিন্নি চালের ভাত রেঁধে-বেড়ে-খাইয়ে সারা দিন তিনি হতদরিদ্র স্ত্রী হিসেবেই থাকেন। আর সন্ধ্যাবেলা কেবল কুপিবাতির আলোতেই তিনি গল্পের রানি। তিনি শাঁখচুন্নির কণ্ঠ নকল করে হেসে উঠলে গা ছমছম করে। পুকুরে ডুব দিয়ে আর উঠতে না পারা হিরণ্য কুমারীর করুণ পরিণতির কথা তাঁর মুখে শুনতে শুনতে হুহু করে ওঠে শ্রোতাদের বুক। কেউ কেউ হয়তো আঁচলে চোখও মোছেন। 

যুগে যুগে দূর গ্রামের ঠাকুমা-ঠাকুরঝি-মা-বউ-ঝিদেরই আমরা ‘গল্পবলিয়ে’ হিসেবে জেনেছি। কেননা, সেই আঠারো শতক থেকে যাঁরা বাংলায় লোকগল্প সংগ্রহ ও সংকলিত করেছেন, তাঁরা আমাদের তেমনটিই বলেছিলেন। এই যেমন রেভারেন্ড লাল বিহারী দের কথাই ধরা যাক। বাংলার লোকগল্পের তিনিই প্রথম সংগ্রাহক। তিনি বলছেন ‘শম্ভূর মা’ নামের এক গ্রাম্য নারীর কথা, যিনি গোবিন্দ নামের এক বালককে গল্প শোনাচ্ছেন। আর সেই সব গল্প ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ করছেন লাল বিহারী দে। দক্ষিণারঞ্জন মিত্রও তাঁর লোকগল্পের সংগ্রহের নামকরণ করেছিলেন ঠাকুমার ঝুলি (১৯০৯) ও ঠানদিদির থলে (১৯০৯)। ঠাকুমার ঝুলিতে ‘গ্রন্থকারের নিবেদন’ অংশে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে দক্ষিণারঞ্জন লিখেছেন, ‘মা আমার অফুরান রূপকথা বলিতেন। ...এমন গৃহিণী ছিলেন না যিনি রূপকথা জানিতেন না, না জানিলে যেন লজ্জার কথা ছিল। কিন্ত এত শিগগিরই সেই সোনা-রুপার কাঠি কে কাড়িয়া নিল? আজ মনে হয়, আর ঘরের শিশু তেমন করিয়া জাগে না, তেমন করিয়া ঘুম পড়ে না!’

গল্প বলিয়ে হিসেবে তাই বেশি ‘পরিচিতি’ পেলেন নারীরাই। পরিচিতি না বলে বোধহয় কল্পিতই বলা উচিত। কারণ, যে গ্রামীণ নারীদের মুখে গল্প শুনে শুনে সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ করা হয়েছিল, তাঁদের নাম আর প্রকাশিত হলো কই? তাঁরা তো সেই ‘অমুকের মা’ আর ‘তমুকের ঠাকুমা’ হয়ে বইয়ের পাতাতেই রয়ে গেলেন। লাল বিহারী দের মতো কয়েকজন হয়তো তাঁদের খানিকটা বর্ণনা দিয়েছেন। বলেছেন, দূরগ্রামের এক বাঙালি খ্রিষ্টানকন্যা তাঁকে কিছু গল্প শুনিয়েছিলেন। কিন্তু কে এই কন্যা? কী তাঁর নাম? শম্ভূর মা–ই বা কে ছিলেন? অথবা আদতেই ছিলেন কি না? এসব প্রশ্নের উত্তর আর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। 

রেভারেন্ড লাল বিহারী দে
ছবি: সংগৃহীত

সে যাহোক, লাল বিহারী দের সংকলিত ফোক– টেলস অব বেঙ্গল (১৮৮৩) পড়তে গিয়েই এত কথা মনে হলো। বইটি বাংলা লোকগল্পের প্রথম সংকলন। তবে এর চতুর্থ পাতায় আছে এক অদ্ভুত চমক। লাল বিহারী দে লিখছেন, ‘এ বই লিখতে যেয়ে বাংলার গ্রামে-গ্রামে আমি বহু লোকের কাছ থেকে বহু গল্প শুনেছি। অনেক গল্পই আমি এই সংকলন থেকে বাদ দিয়েছি। কারণ, সেসব গল্পে ভুল আর মিথ্যে তথ্যের পরিমাণই বেশি। ছোটবেলায় আমি যেসব গল্প শুনে বড় হয়েছি, সেসবের সাথে এই “ভুল গল্পগুলোর” কোনো মিল নেই। আমি আশা করছি, বাংলার গ্রামগুলোতে মুখে-মুখে যে লোকগল্পগুলো আবহমানকাল ধরে বলা হচ্ছে, তার “খাঁটি” স্বরূপ আমি এই বইতে সংকলিত করতে পেরেছি।’

বাংলার লোকগল্পের প্রথম সংগ্রাহক হিসেবে লাল বিহারী দের অবদান অনস্বীকার্য। তবু এই লেখাটুকু পড়ে চমকে উঠি। ‘ভুল’, ‘মিথ্যে’ বা ‘খাঁটি’র বিচার তিনি ঠিক কিসের ভিত্তিতে করলেন? কেনই–বা করলেন? সে বিচারে তাঁর নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাপ আছে কতটুকু? 

বিহারীবাবু গল্প সংগ্রহ করেছেন আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তত দিনে বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বয়স এক শ বছরেরও বেশি। আর যদি ফরাসি, পর্তুগিজ, ডেনিশদের শোষণরূপী বাণিজ্যের কথাও ধরা যায়, তবে ভারতের সঙ্গে ঔপনিবেশিক বেনিয়াদের পরিচয় ঘটেছে লোকগল্প সংগ্রহের আরও প্রায় দুই শ বছর আগে। অথচ তাঁর সংগৃহীত গল্পগুলোতে কোনো সাহেব নেই, বেনিয়া নেই, ছোটলাট নেই, এমনকি সিপাহিও নেই। সেখানে রাজা আছেন, রাজার দুই বা সাতজন রানি আছেন। গরিব ব্রাহ্মণকে ‘ইজারাবিহীন জমি’ দেওয়ার কথা আছে, সাতঘড়া মোহরের কথাও আছে। এ যেন নবাবি বা সুলতানি আমলের লোকগল্প! তাই যদি হবে, তবে গল্পে নবাব বা সুলতানরা তো থাকবেন? কিন্তু না! গল্পের চরিত্ররা তো রাজা-রানি,শাঁখচুন্নি, ব্রহ্মদৈত্য—যাদের ছবিতে আর চরিত্রের বর্ণনায় সনাতন পুরাণের ছাপ স্পষ্ট। রানিদের বন্ধ্যত্ব দূরকারী শিকড়বাকড় দিতে আবির্ভূত ‘ফকির’ ছাড়া তেমন কোনো মুসলমান চরিত্র লাল বিহারী দে সংগৃহীত গল্পে পাওয়া যায় না। ইসলামিক পুরাকথার তেমন কোনো উপাদানও—যেমন জিন—এ গল্পগুলোতে নেই। 

হয়তো তিনি যে অঞ্চল থেকে গল্পগুলো সংগ্রহ করেছিলেন, সে অঞ্চল ছিল সনাতন ধর্মালম্বী অধ্যুষিত। সেখানে জিনের চেয়ে ব্রহ্মদৈত্যই হয়তো লোকমুখে বেশি প্রচলিত ছিল। তবে আঠারো শতকে বাংলায় এমন কোনো গ্রাম কি ছিল, যেখানে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রতিনিধি নেই, ফরাসি বেনিয়া নেই অথবা ওলন্দাজ বাহিনীর উৎপাত নেই? তাহলে ভিক্টোরিয়ান আমলে প্রকাশিত ফোক–টেলস অব বেঙ্গল কী করে ঔপনিবেশিকতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে গল্পের পর গল্প বলে গেল? নাকি লাল বিহারী দের ‘ভুল’, ‘মিথ্যে’ অভিযোগের কবলে পড়ে ঔপনিবেশিকতার গল্পগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ রয়ে গেল? উত্তরটি পেতে লাল বিহারীর ব্যক্তিগত মতাদর্শও বোঝা প্রয়োজন।

১৯১২ সালে লাল বিহারী দের সংগৃহীত লোকগল্পের সংকলন ফোক–টেলস অব বেঙ্গল–এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী ওয়ারউইক গবলের আঁকা ছবি

লাল বিহারী দে বর্ধমানের সনাতন ধর্মালম্বী এক বণিক পরিবারে জন্মেছিলেন ১৮২৪ সালে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার জোরালো প্রভাবের মধ্যে থাকা সেকালে বাংলায় খানিকটা ইংরেজি শিক্ষার জোরে অনেক দূর এগিয়ে যাচ্ছিলেন অনেকেই। সেই ভাবনা থেকেই খ্রিষ্টান ধর্মযাজক আলেকজান্ডার ডাফ পরিচালিত জেনারেল অ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশনে লাল বিহারীকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন তাঁর বাবা। তিনি সত্যিই ইংরেজিতে সুশিক্ষিত হলেন। সেই সঙ্গে উনিশ বছর বয়সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দীক্ষিত হলেন খ্রিষ্টধর্মে। 

কয়েক বছর পর ধর্মযাজক হন তিনি। স্কটল্যান্ডের অবৈতনিক চার্চের ধর্মপ্রচারক হিসেবে কাজ করেন বর্ধমান জেলায়। পরবর্তীকালে হুগলি কলেজে বহু বছর অধ্যাপনাও করেন। ফোক–টেলস অব বেঙ্গল–এর ভূমিকায় লাল বিহারী বলছেন, ব্রিটিশ সৈন্য, সিভিল অফিসার ও বিখ্যাত লোকসাহিত্যিক রিচার্ড কর্নাক টেম্পলের কথায় তিনি বাংলার লোকগল্প সংগ্রহ করেন ১৮৭০-১৮৮০ সালের দশকে।

এই টেম্পল সাহেবও প্রায় একই সময়ে পাঞ্জাবে লোকগল্প সংগ্রহের কাজ করছিলেন। টেম্পলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় উদ্যোগ থেকে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রতিনিধিদের সঙ্গে লাল বিহারী দের সুসম্পর্কের কথা স্পষ্ট হয়। তবে তিনি কিন্তু জনবিরোধী বা বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী ছিলেন না; বরং বর্ধমান ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জনপদে তিনি প্রজাদের পক্ষ নিয়ে জমিদারদের বিরোধিতা করেছেন। সমসাময়িক লেখক বঙ্কিমচন্দ্র রায় ও দীনবন্ধু মিত্রের মতো তিনিও দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে লিখেছেন। ১৮৮৫ সালে কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার্থে যে আইন পাস হয়, তাতেও লাল বিহারী দে এবং তাঁর সমসাময়িক লেখক ও সমাজ সংস্কারকদের ব্যাপক প্রভাব ছিল।

১৯১২ সালে প্রকাশিত লাল বিহারী দে সংগৃহীত লোকগল্পের সচিত্র সংকলন ফোক–টেলস অব বেঙ্গল–এর প্রচ্ছদ

কিন্তু এ কথাও সত্য যে লাল বিহারী দে ইংরেজ শাসনবিরোধী ছিলেন না। জমিদারি প্রথা, জোতদারদের শোষণ নিয়ে তিনি তীব্র সমালোচনা করলেও ব্রিটিশ রাজতন্ত্রকে ‘মঙ্গলজনক’ই মনে করতেন।

তাই স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, লোকগল্প সংগ্রহের সময় তাঁর এই ব্রিটিশ রাজতন্ত্রপ্রেমী মতাদর্শের প্রভাব কতটা ছিল? নাকি আমরাই ‘পোস্ট কলোনিয়াল ন্যারেটিভ’–এর জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে তাঁর সংকলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বসেছি?

সে রকম কিছু এ লেখার উদ্দেশ্য একেবারেই নয়। প্রশ্ন আমরা তুলছি বটে। তবে প্রশ্ন উত্থাপনের মধ্য দিয়ে আমরা শুধু বুঝতে চাইছি, যা ভুলে গিয়েছি, তা কেন ভুলে গেলাম? যা বাদ পড়ল, তা কেন বাদ পড়ল? নাকি ইচ্ছা করেই বাদ দেওয়া হলো? 

আর বুঝতে গিয়ে খুঁজে পাওয়া গেল এক ভিন্ন লোকগল্পের ধারা। ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার বার্ষিক জার্নাল ব্রিটিশ ইউনাইটেড সার্ভিস জার্নাল–এ (১৯৪৬) গভর্নর অফিসে কর্মরত এক ইংরেজ কর্মকর্তা পল বার্ড লিখেছেন, ১৮৮৪ সালের এক সন্ধ্যাবেলায় কলকাতাস্থ নিজ বাসভবনে ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূত দর্শনের গা ছমছমে অভিজ্ঞতা। সময়টা খেয়াল করুন, ১৮৮৪ সাল। অর্থাৎ ঠিক যে সময়ে লাল বিহারী দে ও টেম্পল সাহেবের মতো অনেকেই লোকগল্প সংগ্রহের কাজ করছেন। অথচ ইংরেজ শাসকদের উপস্থিতি সংগৃহীত এ গল্পগুলোর কোথাও নেই। ভাবছেন, পল বার্ডের অভিজ্ঞতা হয়তো ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা? 

তবে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তৎকালীন গভর্নরের স্ত্রী লেডি ব্রেড টেইলরের কাছে ফেরত যাই। আলিপুরের যে বাড়িতে তাঁরা ১৯৩০-৪০ সালে বাস করতেন, সেটি ছিল ওয়ারেন হেস্টিংসের পুরোনো বাসস্থান। সেই সময়ের দিনলিপিতে লেডি ব্রেড টেইলর লিখেছেন, ‘বাবুর্চি আমাকে বলেছে, এ বাড়িতে গত চৌদ্দ বছরে বহুবার তাঁকে (হেস্টিংসের ভূত) দেখা গিয়েছে। তিনি ইউনিফর্ম পরে আসতেন ঠিক সন্ধ্যাবেলায়। এ ছাড়া সন্ধ্যার পর ড্রাইভারও কিছুতেই গাড়ি রাখতে গ্যারেজে যেতে চাইত না। বলত সেখানে “শয়তান সাহেব”–এর ভূত আছে।’

যে গ্রামীণ নারীদের মুখে গল্প শুনে শুনে সংগ্রহ ও সংকলনের কাজ করা হয়েছিল, তাঁদের নাম আর প্রকাশিত হলো কই? তাঁরা তো সেই ‘অমুকের মা’ আর ‘তমুকের ঠাকুমা’ হয়ে বইয়ের পাতাতেই রয়ে গেলেন।
ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী ওয়ারউইক গবলের আঁকা ছবি

একই রকম সাহেবি ভূতের বর্ণনা পাওয়া যায় রাধারমণ দত্ত ও কালীপ্রসন্ন সিংহের সমসাময়িক দিনলিপিতেও। হেস্টিংস বা সাহেবি ভূতদের অস্তিত্ব প্রমাণ করা এ লেখার সাধ্যের বাইরে।

তবে ১৮৭০-১৮৯০ সালে কলকাতা ও তার আশপাশের এলাকায় এমন সাহেবি ভূতের বহু গল্প যে প্রচলিত ছিল তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় এমন বহু দেশি–বিদেশির লেখায়। 

তেমনটাই তো হওয়ার কথা। লোকগল্পের এক অবিচ্ছেদ্য উপাদান হলো সমসাময়িক আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট। আর ততদিনে এই ভিনদেশি সাহেব-সুবোর দল তো বাংলার তথা ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির এক বড় অংশ দখল করে নিয়েছেন। হেস্টিংসের ভূতের কথাই ধরা যাক। 

ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলায় ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রথম গভর্নর। তেরো বছর তিনি ‘সফল ভাবে’ (!) বাংলা শাসন ও শোষণ করলেন। পরে ১৭৮৭ সালে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে পদত্যাগ করেন। সংগত কারণেই বঙ্গবাসী ইংরেজ ও বাঙালিদের কাছে হেস্টিংস হয়ে গেলেন এক ‘হেরে যাওয়া বেচারা’। আর এজন্যই হয়তো হেস্টিংসের মৃত্যুর কয়েক বছর পর বাংলায় তাঁকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়ল ভূতের গল্প। সেসব গল্পে তাঁর আত্মা নিজেকে নিষ্পাপ প্রমাণ করার কাগজপত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে আলীপুরের পুরোনো বাসভবনে অথবা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে। লোকগাথা এভাবেই তো সত্য-মিথ্যা-কল্পনার বুননে জাল বিস্তার করে, বিস্তৃত হয় জনপদের অধিবাসীদের মুখে মুখে। তাই ঠিক সেই সময়ের গল্পে যদি এই ঔপনিবেশিক শাসকদের কথা সম্পূর্ণভাবে বাদ পড়ে যায়, তবে সেই বাদ পড়ার অভিপ্রায় নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। 

ঔপনিবেশিক আমলের ভারতবর্ষের বেশির ভাগ লোকগল্প সংগ্রাহকই ছিলেন ইংরেজ বা ইংরেজ সরকারের বেতনভুক্ত কর্মচারী। টেম্পল সাহেবের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এ ছাড়া পাঞ্জাব ও কাশ্মীরে লোকগল্প সংকলনের কাজ করেছিলেন ফ্লোরা আনা স্টিল নামের এক ইংরেজ নারী। আর লাল বিহারী দের মতো যে দু-চারজন দেশি ব্যক্তি এ কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁরাও ছিলেন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ভক্ত। তাই সে সময় সংগৃহীত লোকগল্পগুলো হয়ে গেল ঔপনিবেশিক ‘সেন্সরশিপ’–এর আওতায় সংগৃহীত লোকগল্প। সেই সেন্সরশিপের কতটা এই শিক্ষিত বাঙালি লাল বিহারীবাবুরা নিজেরা করেছেন, আর কতটা যে ব্রিটিশরাজের অবদান, আজকের দিনে তা বোঝা কঠিন। তবে ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যে সেন্সরশিপের করাত ঠিক কতটা সূক্ষ্ম আর ধারালো হয়, তার এক দুর্দান্ত উদাহরণ এই ফোক–টেলস অব বেঙ্গল


সূত্র: ফোক–টেলস অব বেঙ্গল (১৮৮৩), ব্রিটিশ ঘোস্টস অ্যান্ড অকাল্ট ইন্ডিয়া (২০০৪), ঠাকুমার ঝুলি (১৯০৭), কলোনিয়াল হিস্ট্রিস অ্যান্ড ন্যারেটিভ ইনফরমেন্টস: বায়োগ্রাফি অব অ্যান আরকাইভ (১৯৯৪), দ্য কলোনাইজার ফোকলোরিস্ট (১৯৯৭)