যে কারণে আবুল হাসনাতকে আমাদের মনে পড়ে

আজ ১ নভেম্বর কবি ও সম্পাদক আবুল হাসনাতের প্রয়াণবার্ষিকী। কেন সম্পাদক হিসেবে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছিলেন তিনি?

আবুল হাসনাত
ছবি: সংগৃহীত

কল্পনা ও রহস্য তোমার ধমনিতে লেগে আছে

আর আমি দেখি আমার করোটিতে খেলা করে

প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের ভাষা।

একটি অক্ষর নামতে থাকে মায়ায়

দুটি অক্ষর নিয়ে রচিত হয় ভয়

তুমি এলে কল্পনায়

তুমি গেলে যন্ত্রণায়

ভয় নিয়ে কথা বলি প্রেয়সীর সঙ্গে

ভয় নিয়ে মধ্যরাতে মুখর থাকি

ভয় নিয়ে সন্ধেবেলা কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলি

(-‘অক্ষর’: মাহমুদ আল জামান, ২৪ জানুয়ারি ২০১৯)

এমন একসময়, ভয় আমাদের করোটিতে খেলা করে। আমাদের কল্পনা আর রহস্যের ভেতর ভয় মুখর থাকে। এমনকি অক্ষরও ভয়ে কুঁকড়ে আছে। এমন সংবেদনশীল কবিতাটি মাহমুদ আল জামানের। মানে আবুল হাসনাতের! নানা ভয় আর মৃত্যু এখন আমাদের সঙ্গী। তবে কিছু মৃত্যু আছে খুব হালকা। হালকা এ কারণে, পূর্ণ বয়স যাপন করে ইহজগত গত হওয়া। আবার কোনো শোক, কোনো সভা, কোনো সমবেদনার অক্ষরে পূর্ণ করা সত্যি কঠিন! কবি, লেখক ও সম্পাদক আবুল হাসনাতের অকালে চলে যাওয়া ছিল ঠিক একই রকমের ভারী ব্যাপার। ৭৫ বছরে তিনি গত হন। কর্মক্ষম অবস্থায় তাঁকে অকালে বিদায় জানাতে হয়েছিল আমাদের। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য একজন সংবেদনশীল, নির্বিবাদী, নিরহংকারী, নিভৃতচারী ও অজাতশত্রু লেখক ব্যক্তিত্বকে হারাতে হয়েছিল।

ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন, বামপন্থী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আবুল হাসনাতের অবদান অতুলনীয়। কারণ, ষাটের দশকে বেড়ে ওঠা সচেতন তরুণেরা টের পাচ্ছিলেন, অনির্বচনীয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভেতর জন্ম নিচ্ছিল একটি নতুন রাষ্ট্রের রাজধানী। সেই নতুন স্বাধীন দেশের স্বপ্ন তাদের রাজপথের লড়াই আর বুদ্ধিবৃত্তিক-সাংস্কৃতিক লড়াই একই সুতায় গেঁথে দিয়েছিল। তিনি ছিলেন সেই স্বপ্নের একজন সার্থক সতীর্থ। তাঁর স্বপ্নের পাঠাতন ছিল দেশ–মাটি–মাতৃকা আর গণমানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা সফল হয়েছে, আবার কোনো ক্ষেত্রে সেটা সফল হয়নি। তবে আবুল হাসনাতদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো ষাটের দশকের উত্তাল ছাত্র আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল। এর শেষ ফলাফল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। সে প্রসঙ্গ ভিন্ন! আমাদের প্রসঙ্গ আবুল হাসনাতের সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব।

হাসনাত ভাই মৃদুভাষী ছিলেন ঠিক, প্রয়োজন হলে তিনি যথাযথই কথা বলতেন। আরেকটি ঘটনার কথা না বললেই নয়! এক-এগারোর পর আমরা শহীদ নূর হোসেন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও গবেষণা করতে গিয়ে হাসনাত ভাইয়ের শরণাপন্ন হয়েছিলাম একবার। বন্ধু চলচ্চিত্র পরিচালক, নাট্যকার মঈনুল শাওন আর আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি ‘কালি ও কলম’ অফিসে। আমরা জানতে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে আশির দশকের সংবাদপত্রের হালহকিকত। আমার ধারণা ছিল, হাসনাত ভাই কথা বলেন খুবই কম! কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আমাদের মনে যে মৃদুভাষীর ভাবমূর্তি ছিল, সেটা মিইয়ে যায় প্রায় তিন ঘণ্টার আলাপে। সেদিন হাসনাত ভাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অনেক তথ্য-উপাত্তের সন্ধান দিয়েছিলেন। আর আমরা নোট করছিলাম। তিনি বলেছিলেন, শহীদ নূর হোসেনের পরিবারের সঙ্গে সখ্যভাব বেশি সাংবাদিক ও লেখক মতিউর রহমানের, আমরা যেন মতি ভাইয়ের কাছে যাই।

আবুল হাসনাত দুইভাবে আমাদের সামনে হাজির আছেন। প্রথমত সাহিত্যিক হিসেবে, দ্বিতীয়ত সম্পাদক হিসেবে। দুটো নামে তিনি লিখেছেন—আবুল হাসনাত স্বনামে, আবার মাহমুদ আল জামান নামে। পারিবারিক রাজনৈতিক পরিসরের জন্য আমাদের পরিচিত ছিলেন দুজন ব্যক্তিত্ব। তাদের একজন সাপ্তাহিক ‘একতা’ ও ‘মুক্তির দিগন্ত’ পত্রিকার সম্পাদক মতিউর রহমান, অন্যজন ‘গণসাহিত্য’ ও ‘সংবাদ’-এর সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত। খুব ছোটবেলায়, বেড়ে ওঠার বয়সে সম্পাদিত ‘গণসাহিত্য’ পত্রিকার দু–এক কপি বাসায় থাকার সুবাদে নাড়াচাড়া করার সুযোগ হয়েছিল। আর ‘সংবাদ’, ‘একতা’ ও ‘মুক্তির দিগন্ত’ নিয়মিত রাখা হতো আমাদের বাসায়। এসব পত্রিকার পাশাপাশি রুশ-চীনা সাহিত্যের বড় সংগ্রাহক ছিলেন আমার বড় চাচা, সন্দ্বীপের নামজাদা মুক্তিযোদ্ধা সফি উল্লাহ। ফলে পত্রিকাগুলো আমাদের সাহিত্যরুচি, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তায় প্রভাব ফেলেছে বিস্তর।

আজকের একবিংশ শতাব্দীতে আমরা সম্পাদনার ভালো-মন্দ নিয়ে নানা কিছুর সমালোচনা করতে পারি। কিন্তু বাংলাদেশে শিল্প-সাহিত্যের সমালোচনা চিন্তার পরিসর যাঁরা সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম আবুল হাসনাত। মানে আমাদের হাসনাত ভাই। দুজন কিংবদন্তি সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত ও সন্তোষ গুপ্তের পরে আবুল হাসনাতের যুগ শুরু। আড়াই দশকের বেশি সময় তিনি ‘সংবাদ সাময়িকী’ সম্পাদনা করেন।

তৎকালীন সরকারশাসিত দৈনিক ‘বাংলা’ পত্রিকার বাইরে ‘সংবাদ’ই ছিল আপামর পাঠকশ্রেণির কাছে বিকল্প সাহিত্য–সংস্কৃতির বৃহত্তর পরিসর। বেশ আগে ঘরোয়া আড্ডায় হাসনাত ভাইয়ের একুশ বছরের সহকর্মী চিত্রশিল্পী বীরেন সোমের কাছে শুনেছিলাম, ‘তিনি [হাসনাত ভাই] ছিলেন এতই তীক্ষ্ণ, আদর্শিক দৃঢ়চেতা মানুষ, শিল্পের জন্য কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করেননি।’

হাসনাত ভাইয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অনেক পরে। সাক্ষাৎ-পরিচয় হয় নব্বই দশকের শেষ মাথায়। সাপ্তাহিক ‘একতা’য় কাজ করার সুবাদে। কারণ ‘একতা’র পেস্টিং ও ছাপা হতো ‘সংবাদ’ প্রেসেই। এই সময় দু–চার বাক্য কুশল বিনিময় ছাড়া বিশেষ আলাপ হয়নি। আমি কখনো লেখা নিয়ে সরাসরি তাঁর কাছে যাইনি। একটা মজার ঘটনা বলি, নব্বই দশকের শুরুতে ছাত্রাবস্থায় আমি রূপকথার রাজা হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসনের লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ি। সে সময় এন্ডারসনকে নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখি। প্রবন্ধটি চট্টগ্রামের পরিচিত এক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদককে দিই। তিনি আমার প্রবন্ধ রেখে অন্য আরেকজনের এন্ডারসনকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ ছাপেন। তবে এন্ডারসনকে নিয়ে আমার লেখা ছাপা হওয়া প্রবন্ধের চেয়ে মন্দ ছিল না! খুব মন খারাপ হয়েছিল সে ঘটনায়। তার এক মাস পর ব্যক্তিগত পরিচয় ছাড়া ডাকযোগে হাসনাত ভাইকে সে প্রবন্ধটি পাঠাই। আনন্দের ব্যাপার, পরের সপ্তাহে ‘খেলাঘর’ পাতায় প্রবন্ধটি প্রধান রচনা আকারে ছাপা হয়। সেই ঘটনার পর চট্টগ্রামের ওই সম্পাদক আমাকে বিশেষ সমীহের চোখে দেখতেন!

‘কালি ও কলম’ পত্রিকায় যোগ দেওয়ার পর তিনি প্রায় ফোন করতেন। প্রায়ই লেখা চাইতেন। দুয়েকবার বলেও ছিলেন, আমি যাতে আমার বন্ধুদের বলি ‘কালি ও কলম’-এ লেখা পাঠাতে। একবার একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। হাসনাত ভাই ‘কালি ও কলম’-এর বিশেষ সংখ্যার জন্য কবিতা নিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক প্রসঙ্গ থাকায় তিনি কবিতাটি ছাপাতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন এবং নতুন অন্য কবিতা দিতে বলেছিলেন।

যেদিন সর্বশেষ পেস্টিং, সেদিন তিনি আমাকে তিনবার ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আপনি একগুচ্ছ লেখা দিন, পৃষ্ঠা খালি রেখেছি!’ সেদিন তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হইনি, আমি জ্বরে কাবু ছিলাম একলা ঘরে। আর বাসা থেকে পাঠানোর মতো ব্যবস্থা ছিল না আমার। সেদিন আমি ‘সর‍ি’ বলেছিলাম। কিন্তু কখনো বুঝতে পারিনি, তিনি আমার ওপর খানিক উষ্ণ ছিলেন কিছুদিন। হয়তো হাসনাত ভাই ক্ষমা করে দিয়েছিলেন আমার অপারগতার জন্য। কারণ, আমার অগ্রজ প্রজন্মের একজন সৎ, সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল সম্পাদক হাসনাত ভাই।

আবুল হাসনাত
ছবি: সংগৃহীত

হাসনাত ভাই মৃদুভাষী ছিলেন ঠিক, প্রয়োজন হলে তিনি যথাযথই কথা বলতেন। আরেকটি ঘটনার কথা না বললেই নয়! এক-এগারোর পর আমরা শহীদ নূর হোসেন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও গবেষণা করতে গিয়ে হাসনাত ভাইয়ের শরণাপন্ন হয়েছিলাম একবার। বন্ধু চলচ্চিত্র পরিচালক, নাট্যকার মঈনুল শাওন আর আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি ‘কালি ও কলম’ অফিসে। আমরা জানতে গিয়েছিলাম বাংলাদেশে আশির দশকের সংবাদপত্রের হালহকিকত। আমার ধারণা ছিল, হাসনাত ভাই কথা বলেন খুবই কম! কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আমাদের মনে যে মৃদুভাষীর ভাবমূর্তি ছিল, সেটা মিইয়ে যায় প্রায় তিন ঘণ্টার আলাপে। সেদিন হাসনাত ভাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অনেক তথ্য-উপাত্তের সন্ধান দিয়েছিলেন। আর আমরা নোট করছিলাম। তিনি বলেছিলেন, শহীদ নূর হোসেনের পরিবারের সঙ্গে সখ্যভাব বেশি সাংবাদিক ও লেখক মতিউর রহমানের, আমরা যেন মতি ভাইয়ের কাছে যাই। কবি শামসুর রাহমান ও মতিউর রহমানের যৌথগ্রন্থ ‘শহীদ নূর হোসেন’ যাতে জোগাড় করি। কবি শামসুর রাহমানের একটি বিখ্যাত কবিতা ওই যৌথগ্রন্থে সংকলিত হয়। সেই কবিতার শিরোনামে আমরা শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে নির্মীয়মাণ প্রামাণ্যচিত্রটির নাম রেখেছিলাম—‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। খেয়াল করলাম, কথা বলার সময় হাসনাত ভাইয়ের চোখ থেকে উজ্জ্বল ভাব ঠিকরে বেরোচ্ছে। স্বর স্মিত, কিন্তু দৃঢ়।

আমাদের হাসনাত ভাই মানে মাহমুদ আল জামান ছিলেন একাধারে কবি, শিশু সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও শিল্প সমালোচক। কবিতা তিনি বেশি লেখেননি, কিন্তু লিখেছেন আধুনিক কবিতা। প্রচ্ছন্নভাবে দেশ, মানুষের স্বাধীনতা, স্মৃতিময় মায়া আর মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। তাঁর শিল্প সমালোচনা ও শিল্পবিষয়ক বইয়ের সম্পাদনা আমাদের শিল্পকলার জগৎকে চেনার পথ বাতলে দিয়েছে। প্রকৃত অর্থে, তিনি শুধু সম্পাদক ছিলেন না, ছিলেন একজন সাহিত্য আর শিল্প–অন্তপ্রাণ। চিত্রকলা নিয়ে হাসনাত ভাইয়ের জানাশোনা ছিল অগাধ। শিল্প সংগ্রহও ঈর্শনীয়। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ—শিল্প কিংবা সাহিত্যের ক্ষেত্রে নির্লিপ্ত বাছাই গুণ। নিজের লেখার চেয়ে তিনি যে দেশের শিল্প-সাহিত্যের পাটাতন ও প্রজন্মের লেখকদের ভিত সৃষ্টি করেছিলেন, তা উজ্জ্বল হয়ে থাকবে অনেক দিন। বস্তুত তিনি সাহিত্যের বাহ্যিক নায়ক ছিলেন না, ছিলেন অন্তঃপুরের অনন্য কারিগর।

মনে পড়ছে, করোনা মহামারির অগণন মানুষের মৃত্যুর কথা। মহামারির শুরুর দিকে মারা যান চিলির কিংবদন্তি বিপ্লবী লেখক, কবি ও সাংবাদিক লুইস সেপুলভেদা। তাঁর মৃত্যু সে সময় বিশ্ব সাহিত্যকে স্তম্ভিত করেছিল। তেমনি আবুল হাসনাতের অকালপ্রয়াণ বাংলাদেশে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে অপার শূন্যতা তৈরি করেছিল। তবু বলব, মৃত্যু হচ্ছে মানুষের ইহজাগতিক স্থিতি থেকে নৈঃশব্দ্যে চলে যাওয়া। মানে ব্যক্তির দৃশ্যমান জগৎ ছেড়ে মানুষের আড়ালতম স্মৃতিতে পৌঁছে যাওয়া।

তবে যে দৃশ্য বা কথা একবার স্মৃতির কুঠুরিতে ডুব দেয়, তাকে ভোলা সবচে কঠিনতম কাজ। ভোলা অসম্ভবও বটে। আবুল হাসনাত নানাভাবে আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে চিন্তায় আর লড়াইয়ে ছায়াপাত করেছিলেন নির্মোহভাবে। কি রাজনৈতিক কর্মে, কি শিল্প-সাহিত্যে, কি সাংস্কৃতিক অচলায়তনে—তিনি ছিলেন সমাজের অগ্রগণ্য একজন পথিক। তাই তিনি আমাদের কাছে চির অম্লান। আমরা চিরঋণী কিংবদন্তি আবুল হাসনাতের কাছে।