হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ার আগেই তাঁর নাম জানা হয়ে গিয়েছিল টিভিতে ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকের কারণে। নাটকের রাতে পাশের বাসার চাচিরাও চলে আসতেন। কত রকম আলাপ এর চরিত্রগুলোকে ঘিরে। এখনকার মতন তো না যে হাজার হাজার স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের কোটি কোটি কনটেন্ট। কিছু দেখতে বসলে ব্রাউজ করতে করতেই হয়রান হতে হয়।
একটা একান্নবর্তী মধ্যবিত্ত পরিবারকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে নাটকটা। মধ্যবিত্তদের নিয়ে আগেও নাটক হয়েছে অনেক, তবুও এই নাটকটা অন্য রকম লাগত। আমি ক্লাস ফোরে পড়ি তখন। অত কিছু বুঝতাম না, তারপরও ছাদের ঘরের ম্যাজিশিয়ান আনিস ভাই যখন শাহানাকে ম্যাজিক দেখাতে দেখাতে রুমালের ভেতর থেকে বের করে আনতেন আস্ত একটা গোলাপ ফুল, তাজ্জব হয়ে যেতাম! আবুল খায়ের বহুদিন পর্যন্ত আমাদের কাছে ছিলেন ‘সুখি নীলগঞ্জ’। বোহেমিয়ান আর একটু পাগলা মতন ছোট ভাই রফিকের প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলাম প্রায়। কিছু কিছু দৃশ্য এখনো স্পষ্ট—সারা দিনের সব কাজ শেষে খাবার টেবিলে একা বসে ছোট ছোট চুমুকে চা খাচ্ছেন ডলি জহুর; হোমিওপ্যাথি বিষয়ে প্রবল স্পর্শকাতর বাবা ঝগড়া করছেন আবুল খায়েরের সঙ্গে, এসব দৃশ্যে বড়রা হেসে অস্থির। আবার এত বড় একটা পরিবার সামলাতে গিয়ে হিমশিম বড় ভাই বুলবুল আহমেদ যখন অসহায়ভাবে একটা টেবিলের কোণ আঁকড়ে ডুকরে উঠতেন, ‘বড় কষ্ট’! দেখতাম, বড়দের অনেকের চোখ ছলছল করছে। এভাবে নাটকের চরিত্রগুলো আমাদের নিজেদের লোক হয়ে উঠত। যেদিন টুনি মারা গেল, আমাদের স্কুলে বাংলা ক্লাসে সবাই টুনির মৃত্যু নিয়ে কথা বলছিলাম, মনে আছে।
জীবনানন্দ দাশের মতন আমিও বিশ্বাস করি ‘কেউ কেউ কবি’। তাঁরা দুনিয়ায় আসেন তাঁদের কবিসত্তা নিয়ে। হুমায়ূন আহমেদ আমার কাছে সে রকম একজন। তিনি দোষ-গুণ মিলিয়ে স্বাভাবিক একজন মানুষ ছিলেন, যিনি প্রবল কৌতূহল এবং অপার ভালোবাসা নিয়ে তাঁর চারপাশ অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন।
হুমায়ূন আহমেদের যে উপন্যাস আমি প্রথম পড়েছি, তার নাম শঙ্খনীল কারাগার। তত দিনে ক্লাস ফাইভে পড়ি। বহুক্ষণ ধরে বইটার নাম নিয়ে ভাবলাম। ভেতরে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের একটা বাক্য ছিল, কোনো একজন কবির লেখা থেকে নামটা তিনি নিয়েছেন। ‘শঙ্খনীল কারাগার’ বলতে যে পৃথিবীকে বোঝানো হয়েছে, অনেক ভাবনাচিন্তার পর এই আবিষ্কার করতে পেরে আর্কিমিডিসের চেয়েও বেশি খুশি হয়েছিলাম!
প্রথম বাক্যটাই নিয়ে গেল আরেক দুনিয়ায়—
‘বাস থেকে নেমেই হকচকিয়ে গেলাম। বৃষ্টিতে ভেসে গেছে সব। রাস্তায় পানির ধারাস্রোত। লোকজন চলাচল করছে না, লাইটপোস্টের বাতি নিভে আছে।’
ছোট ছোট বাক্য বয়ে আনল বৃষ্টি মেশানো মফস্সলের রাত। নয়টার মধ্যেই চায়ের দোকান বন্ধ। বৃষ্টির কারণেই পারিপার্শ্বিক রহস্যে ঘেরা। ১০ বছরের মন্টু অপেক্ষা করছে বড় ভাইয়ের জন্য। এতক্ষণে মায়ের ভয়ে বাড়ি যেতে পারছিল না, তাকে নাকি বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার সময় মা বলেছেন, ভিক্ষা করে খেতে। মন্টু আর খোকার জগতে ঢুকে গেলাম আমিও। ওদের সঙ্গেই প্রায় জনমানবশূন্য অন্ধকার রাস্তায় হেঁটে ঘরে ফিরলাম। সেই প্রথমবারের পড়ায় বইটা তেমন করে না বুঝলেও তাদের পৃথিবীটা খুব নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। কী রহস্যময়ী আর দুঃখী মনে হয়েছিল ওদের মাকে! ছাপোষা বোকাসোকা বাবার জন্য মন খারাপ হয়েছিল, সেই সঙ্গে আবিদ হোসেনের একাকিত্বও কিছুটা অনুভব করেছিলাম।
এখানে মধ্যবিত্ত পরিবারের বয়ান হলেও খোকার মা শিরিনের চরিত্র নিয়ে এসেছিল অন্য আঙ্গিক। এই পরিবারে তিনি ছিলেন বেমানান। তার বিত্তশীল অতীতের ছিঁটেফোঁটা খোকা ও তার ভাইবোন টের পেত মামা ও খালাকে দেখে, যাঁদের মনে হতো অন্য জগতের মানুষ। শিরিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন আবিদ হোসেনকে। কয়েক বছর পরে সে বিয়ে ভেঙে গেছে, তত দিনে জন্ম হয়েছে রাবেয়ার। খোকার বাবা তাঁর দ্বিতীয় স্বামী, একসময় আশ্রিত ছিলেন শিরিনদের বাড়িতে। এতগুলো সন্তানের পরেও কখনো সহজ হতে পারেননি স্ত্রীর কাছে, তাঁদের মধ্যে থেকে গেছে শ্রেণিবৈষম্য।
হুমায়ূন আহমেদের বৃহন্নলা আমার খুব পছন্দের লেখার একটি। এই গল্পে বোঝা যায় হুমায়ূন আহমেদের পরিবেশ তৈরির ক্ষমতা। এতবার পড়া উপন্যাস, তবু প্রতিবারই পড়ার সময় গা ছমছম করতে থাকে। মানুষের তৈরি করা ভৌতিক আবহ ভেদ করে যখন তার কেন্দ্রে বসা মানুষটির স্বরূপ বেরিয়ে আসে, তখন আতঙ্ক আরও গাঢ় হয়।
হুমায়ূন আহমেদের বৃহন্নলা আমার খুব পছন্দের লেখার একটি। এই গল্পে বোঝা যায় হুমায়ূন আহমেদের পরিবেশ তৈরির ক্ষমতা। এতবার পড়া উপন্যাস, তবু প্রতিবারই পড়ার সময় গা ছমছম করতে থাকে। মানুষের তৈরি করা ভৌতিক আবহ ভেদ করে যখন তার কেন্দ্রে বসা মানুষটির স্বরূপ বেরিয়ে আসে, তখন আতঙ্ক আরও গাঢ় হয়। এই গল্পের মাধ্যমেই মিসির আলীর সঙ্গে আমার পরিচয়। সম্ভবত মিসির আলীকে নিয়ে এটিই প্রথম উপন্যাস। মিসির আলীকে নিয়ে আরেকটি উপন্যাস খুব অবাক করেছিল আমাকে। নাম জ্বীন–কফিল। মিসির আলীর কাছে কেউ সমস্যা নিয়ে এলে তিনি এক ঘটনাই পরপর দুবার বর্ণনা করতে বলতেন। এখানে গল্পটা ছিল মানসিক ভারসাম্য হারানো এক নারীকে নিয়ে, আপাতদৃষ্টে যাকে প্রায় স্বাভাবিক মনে হয়। তার সন্তান মারা গেছে কুয়ায় পড়ে এবং স্বামী গ্রামের মসজিদের ইমাম। এই ইমাম সাহেব এসেছেন মিসির আলীর কাছে। যেদিন তাঁর সন্তান মারা গেছে, সেই একই দিন মসজিদে আগুন ধরেছিল এবং তাঁর স্ত্রী সেই আগুন নিভিয়ে ইমামের প্রাণ রক্ষা করেন। এই গল্পের বয়ানে মিসির আলীর মনে খটকা থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত খটকার কারণ জানা যায়। ইমাম তাঁর বর্ণনায় বলেছেন, আগুন লাগলে তাঁর চিৎকার শুনে স্ত্রী ছুটে এসেছে এক বালতি পানি নিয়ে। মিসির আলী বললেন, প্রথমেই চিৎকার শুনে স্ত্রী কীভাবে জানলেন আগুন লেগেছে? সাধারণত চিৎকারে মানুষ এমনি ছুটে আসে, তিনি কেন বালতি ভরা পানি নিয়ে এলেন। শার্লক হোমসের পরে এ রকম সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ আমি মিসির আলীকেই করতে দেখেছি।
ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য বা রাজনীতির বিষয়ে আমাদের মনসিক পরিপক্বতা বোঝা যায় কোনো কিছুর আনুষ্ঠানিকতা পার হয়ে মূল সত্যে পৌঁছানোর চেষ্টার মধ্যে। যেমন আমরা হিমু থেকে নিয়েছি কটকটে হলুদ পাঞ্জাবি, চাঁদনি রাতে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকার নাটকীয়তা। অথচ সে যে বাতাসের মতো নির্লিপ্ততায় তার পারিপার্শিক ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে তীব্র মায়ায় জড়িয়ে পড়ে বুঝতে পারি? হিমুর আছে যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আর অপ্রিয় প্রশ্ন করার সাহস। সে কারও ওপরেই নিজেকে চাপিয়ে দেয় না, যে কেউ একদম নিজের মতো করে হিমুর সঙ্গে মিশতে পারে, সে জানে ভালো-খারাপ, সত্য-মিথ্যা কোনো একরৈখিক বিষয় না; বরং এর মাঝে অনন্ত স্তর আছে। আপাত যা তুচ্ছ, হিমু তার দাম দিতে জানে। সে প্রতিমুহূর্তে আনন্দ নিয়ে বাঁচতে চায় এবং তা এতটাই তীব্র যে আশপাশের মানুষকেও স্পর্শ করে। যখন সে একজন পঙ্গু, অন্ধ ভিক্ষুকের গান শুনে বলে, ‘আপনার গানের গলা তো ভালো না’, ভিক্ষুকও জবাব দেয়, ‘আমি তো আর হেমন্ত না!’, এই কথোপকথন আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে এর বয়ানের কারণে। হিমুর সাথে তো এমন ঘটতেই পারে!
আমার আরও মনে হয়, মিসির আলী ও হিমু হুমায়ূন আহমেদেরই দুই রকম সত্তা। এমনিতে একজন লেখক তো থেকেই যান তাঁর লেখার ভেতর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একজন লেখক তাঁর লেখার মাধ্যমে, তাঁর সম্পর্কে বিভিন্নজনের স্মৃতিচারণা, জীবনের ঘটনা ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেও একজন চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হন।
মিসির আলী আর হিমুর কথা উঠলেই শুনি লজিক আর অ্যান্টি-লজিক। এ রকম অবশ্য হুমায়ূন আহমেদ নিজেও লিখেছিলেন তাঁর কিছু বইয়ের ফ্ল্যাপে। আমি এদের মধ্যে মিল খুঁজে পাই বেশি। এরা দুজনই একা, আবার দুজনই খুব নৈর্ব্যক্তিক, নিরাসক্ত হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বারবারই মায়ায় জড়িয়ে পড়েন। যুক্তি ও যুক্তিহীনতার পথে ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত যে বিন্দুতে এসে মেলেন, তা ব্যাখ্যাতীত ও রহস্যময়।
আমার আরও মনে হয়, মিসির আলী ও হিমু হুমায়ূন আহমেদেরই দুই রকম সত্তা। এমনিতে একজন লেখক তো থেকেই যান তাঁর লেখার ভেতর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একজন লেখক তাঁর লেখার মাধ্যমে, তাঁর সম্পর্কে বিভিন্নজনের স্মৃতিচারণা, জীবনের ঘটনা ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেও একজন চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও তীব্র। তাঁর জীবনে চড়াই-উতরাই ও ঘটনার ঘনঘটা। তিনি নিজেও ছোট ছোট পরিসরে আত্মজৈবনিক লেখাগুলোতে নাটকীয়তা এনেছেন। তাঁর বিভিন্ন শিশুসুলভ অস্থিরতা, আবেগময় অভিব্যক্তি, অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে মানুষকে চমকে দেওয়ার চেষ্টার মধ্যে হিমুকে খুঁজে পাই। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, সরল কৌতূহল, ধারালো যুক্তি, সিগারেটে আসক্তি, ছোটখাটো অসুখবিসুখে কিছুটা পর্যুদস্ত এবং খিটখিটে মেজাজের মধ্যে মিসির আলী মিশে আছেন।
হুমায়ূনের চরিত্রগুলো একরৈখিক হয় না সাধারণত। তারা আমাদের আশপাশের যেকোনো মানুষের মতো সত্যি, তাদের ভেতর পরস্পরবিরোধী স্বভাব উপস্থিত। যেমন অয়োময় নাটকের ছোট মির্জা বা বদরুল। যে মানুষ ‘আমার মরণ চান্নি পসর রাইতে যেন হয়’ গাইতে গাইতে চোখের পানিতে ভাসেন, সেই একই মানুষ নির্বিকারভাবে কাউকে হত্যার আদেশ দেন। যে ছোট মির্জা পাখিদের কাণ্ডকারখানায় আপ্লুত হন, সেই একই মানুষ বজরাসমেত তাঁর বড় বউকে ডুবিয়ে মারার নির্দেশ দেন। এমন সব চরিত্রের যিনি স্রষ্টা, তাঁর নিজের মধ্যেও তাদের ছায়া থাকারই কথা।
জীবনানন্দ দাশের মতন আমিও বিশ্বাস করি ‘কেউ কেউ কবি’। তাঁরা দুনিয়ায় আসেন তাঁদের কবিসত্তা নিয়ে। হুমায়ূন আহমেদ আমার কাছে সে রকম একজন। তিনি দোষ-গুণ মিলিয়ে স্বাভাবিক একজন মানুষ ছিলেন, যিনি প্রবল কৌতূহল এবং অপার ভালোবাসা নিয়ে তাঁর চারপাশ অনুধাবনের চেষ্টা করেছেন। কখনো হাসি-ঠাট্টা, কখনো পাগলামির আড়ালে হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সমাজের অসংগতিগুলো তুলে ধরেছেন। তিনি অন্যের হেঁটে যাওয়া রাস্তার বদলে নিজের পথ নিজে তৈরি করতে চেয়েছেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা…’ এ রকম ঘোষণা দিয়ে না হলেও হুমায়ূন আহমেদ তাঁর মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে চাননি। সারা জীবন মনের রাস্তায় চলা সহজ কাজ নয়, নিজের জন্যও না, তাঁর সঙ্গে যাঁরা পথ চলেন, তাঁদের জন্যও না। তাই চলতি পথে অজস্র মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা যেমন পেয়েছেন, কাছের জনদের আঘাত করেছেন, নিজেও পেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদ আমার কাছে এমন একজন মানুষ, যিনি নিজের নিয়মে বেঁচেছেন, ভালোবেসেছেন, তিনি একই সাথে ছিলেন নির্লিপ্ত একজন মানুষ আবার প্রবল আবেগপ্রবণ, সরল, কৌতূহলী ও বিচক্ষণ। এ রকম একজন মানুষকে কোনো ক্যানভাসেই বন্দী করা যায় না; বরং বাতাসের মতন তিনি আমাদের ঘিরে থাকেন, ধরা দেন না।