নান্দীপাঠ
গণমানুষের পক্ষে পরিবর্তনের লক্ষ্যে স্বাধীনতা–উত্তর গ্রুপ থিয়েটার
বিশ্বনাটকের বহুবর্ণ ইতিহাস থেকে বাংলাদেশের মঞ্চের ধ্বনি ও আবেগ, গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের সংগ্রাম থেকে ধ্রুপদি নাটকের চিরন্তন আবেদন, আর সমকালীন নাটকের তাজা ভাষা ও ভঙ্গি; সব মিলিয়ে দীপু মাহমুদ খুলে দেবেন নাট্যজগতের বহুস্তরীয় দরজা। নিয়মিত নাট্যপাঠ ও বিশ্লেষণে প্রতিটি নান্দীপাঠ হবে নাটকের মঞ্চের সামনে বসা এক নিবিষ্ট দর্শকের চোখ ও মনের ভ্রমণ।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যাঁরা নাট্যচর্চা শুরু করেছিলেন তাঁরা বললেন, শিল্পের জন্য শিল্প নয়। তাঁরা বলতে চাইলেন, শিল্প হবে উদ্দেশ্যমুখী। শিল্প বাঁধনছাড়া স্বতঃস্ফূর্ত, স্বতঃপ্রণোদিত নয়। যেকোনো শিল্পে একটি উপযোগিতা থাকতে হবে। তাঁরা বললেন, শিল্প হোক জীবনযুদ্ধের হাতিয়ার। নাটক হোক রাজনীতিমুক্ত (Let us depoliticise theatre), এই স্লোগানের প্রবক্তা ফরাসি অ্যাবসার্ড নাটকের নাট্যকার ইউজিন আয়োনেস্কো। এই মতের সঙ্গে মিল রেখে থিয়েটার চর্চাকারীরা বললেন, শিল্পের জন্য শিল্প।
গত শতকের থিয়েটারের প্রধানতম বিকাশ হলো রাজনীতিকে ঘিরে এর ব্যাপক সম্প্রসারণ। বিশ শতকে নাটকের বিষয়ে, প্রযোজনা ভঙ্গিমায়, মঞ্চের নকশায় ও নাট্য নির্মাণশৈলীতে বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়। জনগণের থিয়েটারের ভাবনা নানাভাবে, নানা চিন্তায় আবর্তিত-বিবর্তিত হতে থাকে। সব ভাবনার শুরু, থিয়েটারকে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
কেউ কেউ এ সময় খুব স্পষ্ট করে বলেছেন, একটা রাজনৈতিক দর্শনকে সামনে রেখেই নাট্যকর্ম পরিচালিত হবে আর সে দর্শন হবে মার্ক্সবাদ। সেই বিশ্বাস থেকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতে ছড়াতে থাকে অ্যাজিটপ্রপ (agitprop) নাট্যভাবনা। গণজাগরণ বা অ্যাজিটেশন এবং প্রপাগান্ডা বা প্রচার শব্দ দুটি মিলে জন্ম নেয় অ্যাজিটপ্রপ নাট্যধারা। এই নাট্যভাবনার উদ্দেশ্য ছিল শ্রেণিবিন্যাস, শ্রেণিসংঘর্ষ, শ্রেণিসংগ্রামের কথা তুলে ধরা এবং শ্রমিকশ্রেণিকে সংগঠিত করা। যদিও মার্ক্সবাদীদের ভাবনা শুধু অ্যাজিটপ্রপ ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, সে ক্ষেত্রে বলা যায় অ্যাজিটপ্রপ ছিল মূলত রাজনৈতিক নাট্যভাবনার একটি প্রথম ও বিশেষ ধাপ। আমরা এখানে রাজ্যশাসন–সম্পর্কিত নীতিকেই রাজনীতি হিসেবে দেখছি। যেমনটা বলেছে বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান—রাষ্ট্র শাসন বা পরিচালনার নীতি।
স্বাধীনতার পরপরই গণমানুষের পক্ষে কথা বলার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল গ্রুপ থিয়েটারগুলোর মধ্যে। তবে সেই নাটকে কোনো সামাজিক বিশ্লেষণ দেখা যায়নি। রাজনৈতিক ভাবনা বাদ দিয়ে, রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নাটককে জনগণের বিষয় করে তুলতে চাওয়া হয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেই সময়ে ক্ষমতাসীন সরকার বারবার দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে বলেছিল, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ার কর্মসূচি নিয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম হয়েছে। শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের যে অঙ্গীকার সেদিনের জনগণের মধ্যে ছিল, তা থেকে কোনোভাবেই মুক্ত ছিলেন না নাট্যকর্মীরা। তবে এ কথাও সত্য যে সত্যিকার অর্থে শোষণমুক্তির রাজনীতি কী, সে সম্পর্কে তাঁরা বড় একটা সচেতন ছিলেন, এমনটিও মনে হয় না। স্বাধীনতার পর নানা রকম রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে বাংলাদেশের নাট্যধারায় নতুন এক ভাবনার উন্মেষ ঘটে। এই ভাবনায় সম্পৃক্ত ছিলেন রাজনৈতিক দল–বহির্ভূত, সমাজ বিশৃঙ্খলায় বিক্ষুব্ধ, নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার তাড়নায় উদ্গ্রীব একদল তরুণ। যাঁরা মঞ্চের আগের সব রীতিনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, নতুন নাট্যধারা গড়ে তোলার কথা বলেন, নতুন বিষয় নিয়ে নাটককে জনগণের বিষয় করে তুলতে চান। যাঁরা চেয়েছিলেন নতুন করে কিছু করতে। নিজেরাই তাঁরা নাটক লিখেছেন, নিজেরাই তা মঞ্চস্থ করেছেন, কোনো সুনির্দিষ্ট চিন্তা বা মতবাদ ছাড়াই। আর সে পথ ধরেই জন্ম নেয় বাংলাদেশের গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন।
স্বাধীনতার পরপরই গণমানুষের পক্ষে কথা বলার প্রবণতা লক্ষ করা গিয়েছিল গ্রুপ থিয়েটারগুলোর মধ্যে। তবে সেই নাটকে কোনো সামাজিক বিশ্লেষণ দেখা যায়নি। রাজনৈতিক ভাবনা বাদ দিয়ে, রাজনীতি থেকে যোজন যোজন দূরে দাঁড়িয়ে থেকে নাটককে জনগণের বিষয় করে তুলতে চাওয়া হয়েছিল। নতুন এই নাট্যধারার প্রবক্তারা সবাই ছিলেন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। মার্ক্সবাদীদের মতে, মধ্যবিত্ত মানেই পাতিবুর্জোয়ার অংশ। পাতিবুর্জোয়া ভাবনার মধ্যে থাকে ভাববাদী ঝোঁক। যার ফলে নানা বিভ্রান্তির জন্ম হয়। পাতিবুর্জোয়ার মানসিকতায় ভাববাদী চিন্তার প্রভাব যে কত রকম নতুন নতুন চেহারা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে, সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বাধীনতা–পরবর্তী নাট্যচর্চার মধ্যে, মধ্যবিত্তের দোদুল্যমানতা নানাভাবে ধরা পড়ে। তখনকার নাটকগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সামাজিক অঙ্গীকারের প্রশ্নে লক্ষ্যহীনভাবেই বাংলাদেশের নাট্যচর্চা শুরু হয়েছিল। সামাজিক অঙ্গীকারবদ্ধ নাটক বলতে আমরা এমন নাটকের কথা বলছি, যা সামাজিক দ্বন্দ্বগুলোকে তুলে ধরে এবং জনগণকে জড় অবস্থা বা জড়িমার বিরুদ্ধে ভাবতে শেখায়।
সত্তরের দশকের নাটকে শ্রেণির প্রশ্নটি দেখা যায় অনুপস্থিত, তখন নাটকে রাজনীতির সম্পৃক্ততায়ও ছিল নাট্যদলগুলোর অনীহা। চুয়াত্তর সালে থিয়েটার পত্রিকায় নাটক সম্পর্কে ঢাকা ও চট্টগ্রামের তখনকার প্রথম সারির পাঁচটি দলের মনোভাব প্রকাশ করা হয়েছিল। দল পাঁচটি হলো—ঢাকার নাগরিক, থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, বহুবচন এবং চট্টগ্রামের থিয়েটার ’৭৩। নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের বক্তব্য ছিল, নাটক প্রযোজনায় আমরা বিচিত্রতায় বিশ্বাসী। যেকোনো ভাষায় অথবা যেকোনো নাট্যকারের রচনা হোক না কেন—ভালো নাটক দেশ-কালের ঊর্ধ্বে, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় আবদ্ধ নয়। বিশেষ কোনো মতবাদ বা দর্শনে আমরা বিশ্বাসী নই বলে বিশেষ ধরনের নাটকে আমাদের আগ্রহ শূন্য। আমাদের লক্ষ্য—দেশি বা বিদেশি ভালো নাটক।
থিয়েটারের বক্তব্য ছিল, যে ধরনের নাটকে সমসাময়িক জীবন আছে, জীবনের আধুনিক বিশ্লেষণ আছে কিন্তু মধ্যযুগীয় দার্শনিক তত্ত্বের উৎপাত নেই, আমরা সে ধরনের নাটক প্রযোজনায় আগ্রহী। কেননা আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের চারপাশের আবহ সব সময়ই নাটকীয় উপাদানে সমৃদ্ধ এবং এদের বাদ দিয়ে যত্রতত্র নাটকের অনুসন্ধান করা অযথা সময় ও শক্তির অপচয়। ঢাকা থিয়েটারের বক্তব্য ছিল, আমরা জীবনঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য নাটক করি, আমরা নিজস্ব সৃজনশীলতাকে সর্বাগ্রাধিকার দিই। কারণ, শুধু নাটক নয়, আমরা যে উদ্দেশ্যে নাটক করছি সে উদ্দেশ্য মাত্র আমাদের লেখকরাই অনুধাবন করতে পারেন।
বহুবচন ও চট্টগ্রামের থিয়েটার ’৭৩-এর বক্তব্য ছিল প্রায় একই রকম। মঞ্চের প্রচলিত ধারণার পরিবর্তন ঘটিয়ে, সেই সঙ্গে আধুনিক বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সাম্প্রতিক নাট্য আন্দোলনের ধারাকে দেশীয় রীতির মিশ্রণে নতুন কোনো রূপ দেওয়া যায় কি না, সে ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোতেই তাদের উৎসাহ।
সেই সময়ের নাট্যভাবনার মধ্যে কোথাও সমাজ পরিববর্তন বা শ্রেণিসংগ্রামের কথাটি দেখা যায় না। সমাজের প্রতি নাট্যদলের ভূমিকার কোনো জোরালো বক্তব্যও তখনকার নাট্যভাবনায় পাওয়া যায় না। নাগরিকের মূল স্লোগান ছিল, দর্শনীর বিনিময়ে নাটক দেখার অভ্যাস করুন। ঢাকা থিয়েটার বলছিল, নাটকের মাধ্যমে আমরা সৎ সমাজের বক্তব্য রাখব, বাংলাদেশের লেখা নাটক করব। থিয়েটারের স্লোগান ছিল, ভালো নাটক প্রযোজনা করা, নাট্য পত্রিকা প্রকাশ করা, নিয়মিত নাটক করা। চট্টগ্রামের অরিন্দমের বক্তব্য ছিল, নাটক আমাদের শিল্প, শিল্পই আমাদের ঈশ্বর।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নাট্য আন্দোলনের শুরুতে দেশের রাজনীতি ও সামাজিক অবস্থা বরং নাটকে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর দেশে দেখা গিয়েছিল চরম অরাজকতা। মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল নানা দুর্ভোগ। বাহাত্তর-তিয়াত্তর সালের দৈনিক পত্রিকা সেই সব খবর প্রকাশ করেছে। দৈনিক পত্রিকাগুলোর সে সময়কার নিত্যদিনের সংবাদ ছিল, ঢাকায় দিনদুপুরে সশস্ত্র রাহাজানি বেড়েই চলেছে। গ্রামবাংলায় আগ্নেয়াস্ত্র–সজ্জিত দুর্বৃত্তদের অমানুষিক অত্যাচারে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে এবং গ্রামবাংলার বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের অমানুষিক কাণ্ডকীর্তন সাধারণ মানুষের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তখন সত্যিকার অর্থেই লুটতরাজ, গুপ্তহত্যা ও ধর্ষণ খুবই বেড়ে গিয়েছিল। জনস্বাস্থ্যের প্রতি সরকারের ঔদাসীন্যে ওষুধ, খাদ্য ও পণ্যদ্রব্যে ভেজালের রাজত্ব চলছিল। দেশে আইনশৃঙ্খলা আদৌ আছে কি না, তাই নিয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অস্বাভাবিকতার দরুন ঢাকার লোকসংখ্যা তখন দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
কিছু মানুষের ভালো লাগা বা শখ থেকে সেটা শুরু হলেও, পরে তা আর শখের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজনৈতিক ঘটনাবলির নানা অস্থিরতার ভেতর নাটক একটি সামাজিক আন্দোলন হয়ে দেখা দিল। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের কাছে স্বাধীনতা লাভের অর্থ ছিল, স্বাধীনতা-পূর্বের চেয়ে সচ্ছল জীবন এবং সুখ ও সমৃদ্ধি।
স্বাধীনতা–পরবর্তী রাজনৈতিক-সামাজিক ঘূর্ণাবর্তের কালেই গ্রুপ থিয়েটার নাট্যচর্চার আরম্ভ। কিছু মানুষের ভালো লাগা বা শখ থেকে সেটা শুরু হলেও, পরে তা আর শখের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। রাজনৈতিক ঘটনাবলির নানা অস্থিরতার ভেতর নাটক একটি সামাজিক আন্দোলন হয়ে দেখা দিল। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের কাছে স্বাধীনতা লাভের অর্থ ছিল, স্বাধীনতা-পূর্বের চেয়ে সচ্ছল জীবন এবং সুখ ও সমৃদ্ধি। স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো রকম অনিশ্চয়তা চায়নি তারা, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে চায়নি। সামাজিক-রাজনৈতিক দিক থেকে বিশৃঙ্খলা, সরকারের স্বৈরাচারী মনোভাব, বুদ্ধিজীবী ও নেতৃত্বের দোদুল্যমান অবস্থা, চারদিকে নৈরাজ্য, খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, যুদ্ধোত্তর সময়ের স্বাভাবিক পরিণতি হলেও যারা ৯ মাস যুদ্ধে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছে, তারা এই অবস্থা মেনে নিতে পারেনি। তারা কিছু করতে চাইল। তাদের এই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মাধ্যম হিসেবে তারা বেছে নিল নাটককে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ–উত্তরকালে যখন নাগরিক জীবন বিধ্বস্ত, বিধ্বস্ত মূল্যবোধ, প্রত্যেক মানুষ ভুগছে এক নৈতিক দ্বন্দ্বে, প্রায় অনিবার্যভাবেই নেমে পড়েছে অধঃপতনের খাদে, সরকারপক্ষ যখন সর্বশক্তি দিয়ে বিরুদ্ধ পক্ষকে দমন করতে উদ্যত, সাধারণ মানুষ যখন তার সামনে অসহায়, কোথাও ন্যায়বিচার নেই, নাটক তখন মধ্যবিত্তের সান্ত্বনা ও সাহস হিসেবে তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। শোষণ–বঞ্চনার বিরুদ্ধে সে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত বা যুদ্ধ–পরবর্তী অবক্ষয়-হত্যা-রাহাজানি-ধর্ষণ—এসবের বিরুদ্ধে সরাসরি লড়ার শক্তি বা অবস্থা তখন ছিল না, তাই তাদের প্রতিবাদ ঘোষিত হলো নাটকের মধ্য দিয়ে। যতটা প্রতিবাদ, তার চেয়ে বেশি ক্ষোভ প্রকাশ। রামেন্দু মজুমদার লিখলেন, ‘আমাদের তরুণ তার ক্ষোভ, হতাশা, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পাদপ্রদীপের সামনে এসে দাঁড়াল অত্যন্ত দৃপ্ত পদভারে।’ নাটকের সংলাপ হয়ে উঠল স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ।
সেলিম আল দীনের ‘সর্প বিষয়ক গল্প’ ও ‘সঙবাদ কার্টুন’ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর তিন বছর আগে লেখা ‘সর্প বিষয়ক গল্পে’ রাজনৈতিক চিন্তার সাক্ষাৎ মেলে। একজন স্বৈরাচারী নেতার পতন এবং সেই পতন যে সামরিক বাহিনীর হাতে ঘটতে পারে, এই রাজনৈতিক সচেতনতা নাটকে ধরা পড়েছে।
এ ক্ষেত্রে সেলিম আল দীনের ‘সর্প বিষয়ক গল্প’ ও ‘সঙবাদ কার্টুন’ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। ‘সর্প বিষয়ক গল্প’ মঞ্চস্থ হয় ১৯৭২ সালে। নাটকের আখ্যানটি রচিত হয়েছিল খুবই জাঁদরেল একজন স্বৈরশাসকের পতনকে কেন্দ্র করে। স্বৈরশাসকের পতন ও মৃত্যু ঘটেছে সামরিক বাহিনীর দ্বারা। শাসকের হঠাৎ এই পতন ও মৃত্যুতে পুরো শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। কোনো পূর্বসংকেত ছাড়াই ঘটেছে ঘটনাটা। সবাই বিস্মিত, যে শাসক এত ক্ষমতার অধিকারী এবং এত জনপ্রিয়, কীভাবে তার এত দ্রুত পতন ঘটল। শুধু পতনই নয়, তার জানাজা পড়ার মতো লোক পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। লোকটা যখন মিছিলে যেত, পেছনে হাজার হাজার মানুষ থাকত। অথচ জানাজা পড়তে গিয়েছিল মাত্র ছয়জন। কেউ শোকসভা পর্যন্ত করেনি। জীবিত অবস্থায় লোকটাকে অনেকেই সমীহ করত, তার সভা-সমিতি মিছিলেও প্রচুর লোক হতো। প্রথম দিকে অনেকেই খুশিমনে ঘরে নেতার ছবিও টাঙিয়েছিল। লোকটা তখন কিছু সত্য কথাও বলত। তবে তার শাসনের শেষ দিকের লুটপাট অনেকেরই ভালো লাগত না। নাটকে দেখা যায়, স্বৈরশাসকের মৃত্যুর পর শহরে আর কোনো মিছিল–মিটিং নেই। নেতা মারা গেছে, অতএব মিছিলও বন্ধ। সন্ধ্যার পর লুটতরাজের ভয়ও কমে গেছে। লোকটাকে যে মিছামিছি খুন করা হয়েছে, তা–ও নয়। শেষ দিকে শহরের লোকজন খেপে উঠেছিল। লোকটাকে ঘুমের মধ্যে মেরে ফেলাতে অনেকের খারাপও লেগেছিল। নেতা মারা যাওয়ার পর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখুন। সারা শহরে কারফিউ এবং আর্মি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও মিছিল–মিটিংয়ের কোনো নামগন্ধ নেই। শুধু শহরের মধ্যে এখানে–ওখানে প্রায়ই একটা সাপ দেখা যাচ্ছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর তিন বছর আগে লেখা ‘সর্প বিষয়ক গল্পে’ রাজনৈতিক চিন্তার সাক্ষাৎ মেলে। একজন স্বৈরাচারী নেতার পতন এবং সেই পতন যে সামরিক বাহিনীর হাতে ঘটতে পারে, এই রাজনৈতিক সচেতনতা নাটকে ধরা পড়েছে। সাপের বিষয়টি প্রতীকী। সাপ এখানে বিপদের প্রতীক। সেলিম আল দীনের অন্য একটি নাটক ‘সঙবাদ কার্টুন’-এ আমরা সে সময়কার সমাজ-রাজনীতিকে প্রত্যক্ষ করি। নাটকটি মঞ্চস্থ হয় ১৯৭৩ সালে। নাটকটি সমসাময়িক রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু সামাজিক চিত্র তুলে ধরে যথেষ্ট সাহসের সঙ্গে। ‘সঙবাদ কার্টুন’ নাটকটি সরাসরি সরকারের সমালোচনা করে এবং নাটকে সরকার ও প্রশাসনের দুর্নীতিকে চিত্রিত করে। স্পষ্টবাদিতার কারণে নাটকটির সঙ্গে রাজনৈতিক অ্যাজিটপ্রপের তুলনা করা চলে।
সে সময়কার রাজনৈতিক অস্থিরতাকে অনেকেই তাঁদের নাটকে স্থান দিয়েছেন। তবে সেটা সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টি থেকে রাজনৈতিক ঘটনাবলিকে বিশ্লেষণ করার জন্য নয়। শুধু অস্থির সময়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য। বাংলাদেশের শুরুর নাট্যচিন্তায় রাজনৈতিক ঘটনাবলি নয়, সে সময়কার অস্থির সময়ই বেশি প্রাধান্য লাভ করে। মমতাজউদ্দীন আহমদও সে রকম দুটি নাটক লিখলেন, ‘হরিণ চিতা চিল’ ও ‘ফলাফল নিম্নচাপ’। এর পাশাপাশি এসেছে সেলিম আল দীনের লেখা নাটক ‘এক্সপ্লোসিভ ও মূল সমস্যা’। সেখানে বাহাত্তরের কালোবাজারি আর ভেজালকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যের ওপর তিয়াত্তরে তেল সংকটজনিত আন্তর্জাতিক মন্দার যে বিরূপ প্রভাব এ দেশের মানুষের ওপর পড়েছিল সেই পরিপ্রেক্ষিতে রশীদ হায়দার লিখলেন, ‘তৈল সংকট’। সেই সময়কে ছুঁয়ে যাওয়া আরেকটি নাটক শেখ আকরাম আলীর ‘লাশ ’৭৪’। চুয়াত্তরে দেশের বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ হতে থাকে আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘সুবচন নির্বাসনে’।
বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত মঞ্চায়িত নাটকগুলোর বেশির ভাগই ছিল বিমূর্ত ভঙ্গিতে রচিত। যদিও সে সময়কার বেশির ভাগ নাটকই প্রকাশিত নয় এবং লিখিত পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায় না। যেসব নাটক পাওয়া যায় এবং নাটক–সম্পর্কিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকার লেখালেখি থেকে বোঝা যায়, কিছুটা স্বেচ্ছাকৃত দুর্বোধ্যতা এবং বিমূর্ত নাট্যরীতিই স্বাধীনতা–পরবর্তী নাট্যকার ও নাট্যকর্মীরা পছন্দ করেছিলেন। স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে যুবমানসে যে হতাশার জন্ম দেয়, নাট্যকার ও নাট্যকর্মীদের ক্ষেত্রে তা–ই বিমূর্ত নাট্যভঙ্গি হিসেবে মঞ্চে উপস্থাপিত হয়।
আশির দশকের বেশির ভাগ সময় ছিল সামরিক শাসকের শাসনকাল। এ সময় নাটকের বিষয়বস্তু হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে স্থান দেওয়া হয় এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের ঘৃণা করার ব্যাপারটিও এ সময়কালে নাটকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপিত হতে দেখা যায়।
পঁচাত্তর–পরবর্তী নাটকে ভিন্ন একটি অধ্যায় লক্ষ করা যায়। পঁচাত্তর–পরবর্তী সময়ে নাট্যকারদের মধ্যে যাঁরা সক্রিয় ছিলেন তাঁরা পুরোনো হতাশার ভঙ্গি বাদ দিয়ে ভিন্ন পথে এগোতে থাকলেন। তখন কিছুটা হলেও নাটকে উঠে আসতে থাকে শোষক-শোষিতের দ্বন্দ্ব। ১৯৭৫ থেকে ’৭৯ সাল পর্যন্ত ঢাকায় যে নাটকগুলো মঞ্চস্থ হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—‘চারদিকে যুদ্ধ’, ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘সেনাপতি’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসী’, ‘ওরা কদম আলী’, ‘ওরা আছে বলেই’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ ইত্যাদি। নাটকগুলোতে বিভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তুর দেখা মিললেও সে সময়কার রাজনৈতিক ঘটনাবলির কোনো চিহ্নমাত্র ছিল না। নাটকগুলোতে শোষক–শোষিতের প্রশ্ন থাকলেও কিংবা জীবনের আরও বৃহত্তর প্রেক্ষাপট ফুটে উঠলেও পঁচাত্তর–পরবর্তী সমকালীন রাজনীতির কোনো চেহারাই কোনো নাটকে ফুটে ওঠেনি। পঁচাত্তর–পরবর্তী নাটকের ধারায় যেটা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় তা হলো পঁচাত্তর–পূর্ববর্তী অ্যাবসার্ডধর্মী নাটকের জায়গায় স্বভাববাদ ও বাস্তববাদ নাট্যধারা ক্রমেই জায়গা করে নিতে থাকে। সেই সময়ে মঞ্চায়িত প্রায় নাটকই ছিল খুবই সহজ–সরল এবং বিষয়বস্তুও দর্শকদের বোধগম্য। নাটকগুলো ছিল উচ্চকিত অতিনাটকীয় আবেগে পূর্ণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে আবেগ পর্যবসিত হয়েছে শুধু সেন্টিমেন্টাল উচ্ছ্বাসে।
পরবর্তী দশক অর্থাৎ আশির দশকের বেশির ভাগ সময় ছিল সামরিক শাসকের শাসনকাল। সামরিক সরকার ক্ষমতা দখলের পরপরই সংসদ বাতিল এবং সংবিধান স্থগিত ঘোষণা করে। সামরিক আইন প্রশাসকের দপ্তর থেকে প্রচারিত ফরমানে সব ধরনের মিছিল, ধর্মঘট, জনসভা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়। এ সময়কালে নাট্যচর্চায় বেশ কিছু নতুন দিক লক্ষ করা যায়। একদিকে রাজনৈতিক লক্ষ্য সাধনের উপায় হিসেবে নাটককে বেছে নেওয়া, অন্যদিকে পেশাদারির প্রশ্ন তোলা। নাটকের বিষয়বস্তু হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকভাবে স্থান দেওয়া এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের ঘৃণা করার ব্যাপারটিও এ সময়কালে নাটকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপিত হতে দেখা যায়।
আশির দশকের নাট্যচর্চার একটি বিশেষ দিক হলো, নাট্যদলগুলো অনুধাবন করতে পারল, রাজনীতির সঙ্গে নাটকের কোনো বিরোধ নেই। কিছু দল জোরেশোরেই নাটককে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে ফেলার ঘোষণা দিল। সে জন্য আশির দশকে যে নাট্যদলগুলো জন্ম নিচ্ছিল তাদের প্রায় সবারই ঘোষণায় নাটকের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি ছিল।
পরবর্তী সময়ে নাটকের মধ্যে লোককথা, প্রচলিত কাহিনি বা মননশীল সাহিত্য নির্ভরতা দেখা যায়। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ অবলম্বনে লোক নাট্যদল তৈরি করে নাটক সোনাই মাধব। তবে একে ‘নাটক’ শব্দবন্ধে আবদ্ধ না করে বলা যেতে পারে ‘সোনাই মাধব’ হচ্ছে পদাবলি কীর্তন আর যাত্রাপালার সমন্বয়ে প্রসেনিয়ামে উপস্থাপিত লোকনাট্য।
মহাভারতের একলব্য চরিত্রকে উপজীব্য করে দেশ নাটক মঞ্চে আনে নাটক নিত্যপুরাণ। মহাভারতে একলব্য অতিসামান্য একজন। মহাকাব্যে নিতান্তই গল্পের প্রয়োজনে তার আগমন। নিত্যপুরাণে একলব্য বীর-নায়ক। সাধারণ মানুষ। বুকে সাহস আছে, বুদ্ধি আছে শতভাগ, আর আছে মনে জমাট প্রেম। তবু সে ভ্রষ্ট সমাজের কূটচালে বাঁধা পড়ে জটিল ধাঁধায়। তাকে পরাস্ত করে যুক্তি নয়, মিথ্যার আশ্রয়।
নাট্যকেন্দ্র প্রযোজনা করে নাটক তীর্থযাত্রী। হুমায়ুন কবিরের লেখা ‘তীর্থযাত্রী তিনজন তার্কিক’ গ্রন্থ এ নাটকের ভিত্তি। তীর্থযাত্রী নাটকে দেখা যায় তিনজন জ্ঞানের সন্ধানে যাত্রা করেছেন। তারা জানেন না কোথায় যাবেন। কেবল জানেন পথের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জ্ঞানের রূপ উদঘাটন করবেন। সত্য অবিষ্কারে তাঁরা প্রশ্ন করেন, তর্ক করেন, একমত হন।
এরিখ মারিয়া রেমার্ক-এর কালজয়ী উপন্যাসের ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ নাট্যরূপ আসে মঞ্চে। নাটকটি প্রযোজনা করেছে তাড়ুয়া। আরও আসে থিয়েটার প্রযোজনা পোহালে শর্বরী। হিন্দি ভাষার সাহিত্যিক সুরেন্দ্র বর্মার রচনা থেকে নাটকটি অনুবাদ করেছেন অংশুমান ভৌমিক। নির্দেশনা দিচ্ছেন রামেন্দু মজুমদার ও সংযুক্ত নির্দেশনায় আছেন ত্রপা মজুমদার।
চীনের আধুনিক সাহিত্যের জনক লু স্যুন একশ বছর আগে লিখেছেন সমাজ বাস্তবতার নগ্ন নিরেট সত্য নিয়ে অসাধারণ এক ছোটগল্প ‘দ্য ওয়াইজ, দ্য ফুল অ্যান্ড দ্য স্লেভ’। বাংলায় তার নাট্যরূপ দিয়েছেন অমল রায়। নাটকের নাম রেখেছেন ‘ক্রীতদাস কথা’।
এ সময়ে মঞ্চে নাটক সরাসরি রাজনীতির বক্তব্যধর্মী আবহ থেকে মানুষ মনে রাজনৈতিক মূল্যবোধ তৈরির দিকে এগিয়ে এসেছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, টানাপোড়েন, শোষণ, বেঁচে থাকার লড়াই-ই এখন নাটকের কথা।