মানুষের নৃশংসতা নিয়ে কী বলেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ

আজ নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুদিন। ২০১১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আধুনিক দুনিয়ার মানুষের নৃশংসতা নিয়ে প্রথম আলোতে ‘মাইন্ড গেম’ নামে একটি মনোহর লেখা লিখেছিলেন তিনি। লেখাটি পরে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের বই ‘বসন্ত বিলাপ’–এ সংকলিত হয়েছে। এই লেখায় নৃশংসতার আড়ালে উঁকি দিয়েছিল হুমায়য়ূনের মৃত্যুবিষয়ক চিন্তাও। আজ তাঁর ১১তম মৃত্যুদিনে লেখাটি আবার প্রকাশিত হলো।

হুমায়ূন আহমেদছবি: প্রথম আলো

মাইন্ড গেম

তাত্ত্বিক পদার্থবিদেরা (Theoretical physics) ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার চেয়ে মনে মনে অর্থাৎ কল্পনায় পরীক্ষা করতে পছন্দ করেন। এই পরীক্ষাগুলোকে বলে  Thought experiment (থট এক্সপেরিমেন্ট)। শ্রোডিঙ্গারের বিড়াল হলো চিন্তা পরীক্ষার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ।

আমরা আমজনতারা চিন্তা পরীক্ষা করতে পারি না। তবে  Mind game (মাইন্ড গেম) বা চিন্তা খেলা খেলতে পারি। এই খেলা আমার বিশেষ পছন্দের। খেলার নমুনা দিচ্ছি। একটি আট বছরের বালকের সঙ্গে এই খেলা খেলছি। বালকটির নাম ধরা যাক, শুভ্র।

আমার এবং তার মধ্যে কথোপকথন—

আমি:  শুভ্র! কেমন আছো?  

শুভ্র: ভালো আছি।

আমি: তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? মাকে নাকি বাবাকে?  

শুভ্র: দুজনকেই সমান সমান। (৯৯% শিশু এই জবাব দেবে)।

আমি: ভালো করে চিন্তা করে বলো—সমান সমান?  

শুভ্র: হুঁ।

হুমায়ূন আহমেদ (১৩ নভেম্বর ১৯৪৮—১৯ জুলাই ২০১২)
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

আমি: আচ্ছা বেশ, এখন কল্পনা করো তুমি তোমার মাকে এবং বাবাকে নিয়ে নৌকায় করে যাচ্ছো [মাইন্ড গেম শুরু হয়ে গেল]

শুভ্র: কল্পনা করছি।

আমি: নৌকায় শুধু তুমি আর তোমার বাবা-মা? মাঝিও নেই।  

শুভ্র: আচ্ছা।

আমি: এই তিনজনের মধ্যে শুধু তুমি সাঁতার জানো। বাকি দুজন সাঁতার জানে না। ok?

শুভ্র: জি, ok.

আমি: তুমি এতই ভালো সাঁতার জানো যে নৌকা ডুবে গেলে বাবা-মা দুজনের একজনকে বাঁচাতে পারবে। বুঝেছ?

শুভ্র: বুঝেছি।আমি: এখন মনে করো নৌকা ডুবে গেল। তোমার বাবা-মা দুজনই ডুবে যাচ্ছেন। এখন বলো তুমি কাকে বাঁচাবে? বাবাকে না মাকে? [মাইন্ড গেম শুরু হলো]

শুভ্র: দুজনকেই বাঁচাব।

আমার এই মাইন্ড গেমের ফলাফল বলি। ১০০ ভাগ শিশুই বলেছে, তারা মাকে বাঁচাবে। হঠাৎ হঠাৎ এক-আধজন পাওয়া যায়, যারা বাবাকে বাঁচাতে চায়। ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলনের ছোট মেয়ে (লেখা) তাদের একজন। আমি তাকে বললাম, বাবাকে বাঁচাতে চাও কেন? সে বলল, বাবা লেখক তো, এই জন্যে বাবাকে বাঁচাব।

আমি: তোমাকে আগেই বলা হয়েছে তুমি শুধু একজনকে বাঁচাতে পারবে।
বেশির ভাগ শিশু এই পর্যায়ে হতভম্ব হয়ে পড়ে। বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে থাকে। কারও কারও চোখে পানি এসে যায়।

মনের ওপর চাপ তৈরির এই কঠিন খেলা এখন আমি আর খেলি না। কারণটা বলি—
এক বালিকা মাইন্ড গেমের এই পর্যায়ে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, ‘আমি মাকে বাঁচাব আর আল্লাহ বাবাকে বাঁচাবে।’

তখনই ঠিক করেছি, এই নিষ্ঠুর খেলা শিশুদের সঙ্গে খেলব না।

আমার এই মাইন্ড গেমের ফলাফল বলি। ১০০ ভাগ শিশুই বলেছে, তারা মাকে বাঁচাবে। হঠাৎ হঠাৎ এক-আধজন পাওয়া যায়, যারা বাবাকে বাঁচাতে চায়। ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলনের ছোট মেয়ে (লেখা) তাদের একজন। আমি তাকে বললাম, বাবাকে বাঁচাতে চাও কেন?

সে বলল, বাবা লেখক তো, এই জন্যে বাবাকে বাঁচাব।
তোমার বাবা লেখক না হলে মাকে বাঁচাতে?
অবশ্যই।

হুমায়ূন আহমেদ
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

মিলনকন্যার কথাবার্তায় আমি খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করলাম। লেখক হওয়ার কারণে আমার শিশুপুত্র হয়তো বা আমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে। বাস্তবে দেখা গেল সেই গুড়ে বালি না, একেবারে কঙ্কর।

পুত্র নিষাদের সব খেলাধুলা আমার সঙ্গে। আমি তার ‘টম অ্যান্ড জেরি’ কাটু‌র্ন দেখার সাথি। ছবি আঁকার সাথি। সে যখন ঘরের দেয়ালে ছবি আঁকে, তখন তার মা তাকে কঠিন শাসন করে। শুধু আমি বলি, ছবি সুন্দর হয়েছে। বিশেষ করে রাক্ষসের ছবিটা তো অসাধারণ!

এত কিছুর পরেও নিষাদের মাথায় তার মা ছাড়া কিছু নেই।
প্লেনে করে দেশের বাইরে যাচ্ছি। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া। বিমান খুব বাম্প করছে। আতঙ্কিত নিষাদ বলল, বাবা, তুমি মাকে বাঁচাও।
আমি বললাম, তোমাকে বা নিনিতকে বাঁচাতে হবে না?
সে বলল, আগে মাকে বাঁচাও।

লস অ্যাঞ্জেলেস, ইউনিভার্সেল স্টুডিওতে গিয়েছি। ওদের একটা রাইড নিয়েছি। এই রাইডে থ্রিডির কিছু কাজ আছে। যাত্রার একপর্যায়ে প্রকাণ্ড এক গরিলার দেখা পাওয়া যাবে। থ্রিডির কল্যাণে গরিলাকে মনে হবে জীবন্ত।

যাত্রা শুরু হলো। একপর্যায়ে সত্যি সত্যি ভয়ংকর এক গরিলার (কিং কং) দেখা পাওয়া গেল। ভালোমতোই জানি, পুরো বিষয়টা থ্রিডি ক্যামেরার কারসাজি। তার পরও আমাদের নিজের কলিজা শুকিয়ে গেল। নিষাদ ক্রমাগত চেঁচাতে লাগল—বাবা! আমার মাকে বাঁচাও। বাবা! আমার মাকে বাঁচাও।

পৃথিবীর সব শিশু তাদের মাকে বাঁচাতে চায়। মায়ের পায়ের নিচে বেহেশত—এই (হাদিস?) কথা সব সময় বলা হয়ে থাকে। তার পরও মা কী করে শিশুসন্তানকে হত্যা করেন?

কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা হুমায়ূন আহমেদের সেই ‘কালারফুল’ প্রতিকৃতি, যা বসন্ত বিলাপ বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছিল

পত্রিকায় পড়লাম, এক মা তাঁর দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে পড়েছেন। এই মহিলা নিজে ঝাঁপ দিতে চাইলে ঝাঁপ দেবেন। অবোধ সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে কেন?

স্বামীর সঙ্গে রাগ করে স্বামীকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এক মা সন্তান হত্যা করলেন। এই মা কেমন মা?

আমেরিকার এক তরুণী মা তাঁর নয় মাস বয়সী সন্তানকে মাইক্রোওয়েভ চুলায় ঢুকিয়ে চুলা চালু করে হত্যা করলেন। হত্যাকাণ্ডে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। কী ভয়ংকর!

বিড়ালকে নিজের সন্তান হত্যা করে খেয়ে ফেলতে আমি দেখেছি। বাঘও নাকি এ রকম করে।

আমরা কি বিড়াল এবং বাঘের ওপর উঠতে পারিনি? এখনো পশু হয়ে আছি?

প্রথম আলো, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১

হুমায়ূন আহমেদের ‘বসন্ত বিলাপ’ বইটি সংগ্রহ করতে অর্ডার করুন prothoma.com