জন্ম বিক্রমপুরে হলেও রাবেয়া খাতুনের শৈশব কৈশোর কেটেছে পুরোনো ঢাকার গলিতে, পাতলা খান লেনে। যে বাসায় থাকতেন, তার পুবদিকে ছিল বড় একটা খোলা জানালা, যেখানে ঠাঁই পেত অনেকখানি আকাশ। সেই জানালা দিয়ে আকাশের পানে চেয়ে খালি গলায় গান গাইতেন বাবা মৌলভী মোহাম্মদ মুল্লুক চাঁদ। শিল্পী না, শখের বসেই গাইতেন রজনীকান্ত, অতুল প্রসাদ, ডিএল রায়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রামপ্রসাদী—সব গান। মাঝে মধ্যে বাড়িতে বসত সৌখিন গানের মজলিস। কাঁথা সেলাইয়ের সময় হলুদগোলা বাটিতে সুতো ডুবিয়ে জমিনে নকশার ছাপ তুলে সুঁচ হাঁটাতে হাঁটাতে মা গুনগুন করে গাইতেন ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ কিংবা অন্য কোনো গান। গাইতে গাইতে গল্প শোনাতেন ক্ষুদিরামের বা অন্যকিছুর। ভাই থাকতেন মুসলিম হলে। শনিবার বাড়ি ফিরে যৌথ পরিবারের সবাইকে নিয়ে বসত গল্প শোনার আসর। শেক্সপিয়র, তলস্তয়, রবিঠাকুর, শরৎচন্দ্র, শরদিন্দু সবার হাজিরা হতো। আর বড়বোন নূরজাহান হাত পা নেড়ে নেড়ে বলতেন রূপকথার গল্প। শুনতে শুনতে মনে হতো বাঘ, রাক্ষস, খোক্কস সবাই যেন এসে হাজির হয়েছে। কাকা পড়তেন ডাক্তারি, ছবি আঁকতেন সুন্দর। রং তুলিতে ফুটিয়ে তুলতেন অনেক কিছু, গল্পের মতো। কিশোর রাবেয়া খাতুনেরও ইচ্ছে করত এরকম গল্প বলতে, যে গল্প সবাই শুনবে, মুগ্ধ হবে। কিন্তু রাবেয়া খাতুন কি তখন থেকেই লেখক হতে চেয়েছিলেন?
না, তিনি চেয়েছিলেন গান গাইবেন। সংগীতের ব্যাপারে ছিল তাঁর অসীম দুর্বলতা। কিন্তু পুরোনো ঢাকার মুসলমান মহল্লায় গেরস্তের ঘরে মেয়েদের হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়ার সাহস তেমন ছিল না। শিক্ষক রেখে সংগীতচর্চা তো অসম্ভব। তবু গান গাইতে যখন খুব ইচ্ছে হতো, খালি গলায় গুনগুনিয়ে গাইতেন। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলেই কেবল হারমোনিয়ামে গলা সাধার সুযোগ।
কিশোর রাবেয়া খাতুনেরও ইচ্ছে করত এরকম গল্প বলতে, যে গল্প সবাই শুনবে, মুগ্ধ হবে। কিন্তু রাবেয়া খাতুন কি তখন থেকেই লেখক হতে চেয়েছিলেন? না, তিনি চেয়েছিলেন গান গাইবেন। সংগীতের ব্যাপারে ছিল তাঁর অসীম দুর্বলতা। কিন্তু পুরোনো ঢাকার মুসলমান মহল্লায় গেরস্তের ঘরে মেয়েদের হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়ার সাহস তেমন ছিল না।
তবে গান যে কণ্ঠ হতে মিলিয়ে যায়নি, তার প্রমাণ পাওয়া যাবে বেশ কিছু বছর পরে, যখন ঢাকার এক সাহিত্য সভায় সবার অনুরোধে রাবেয়া খাতুন গেয়ে উঠবেন রবীন্দ্রনাথের গান ‘ওরে নূতন যুগের ভোরে দিস নে সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার করে’। আর তা শুনে সদ্য কলকাতা ফেরত সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দিনও ফিরে তাকাতে বাধ্য হবেন ঢাকাই সাহিত্যের আকাশে অচিরেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠার অপেক্ষায় থাকা তরুণী লেখক রাবেয়া খাতুনের দিকে।
এর মধ্যেই কত কিছু ঘটে যাচ্ছিল পৃথিবীতে আর চারপাশে! শহরে বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ আর দাঙ্গা ফেলছে গভীরতম দাগ। সেখান থেকে পালিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে গেলে মধুমতীর তীরে তাঁতীদের গ্রাম, অভাবের বোঝা নিয়ে আর অনাহারে ধুঁকে খটর খটর তাঁত বুনছে জোলা সম্প্রদায়। আর অন্যদিকে বাল্যসখী সহেরে বানু, ডাক নাম যার সাহানী—তার বিয়ে হয়ে গেল মাত্র এগারো বছরে! দু গাল ভরে পান খেতে খেতে মা খালাদের আড্ডার সঙ্গী হয়ে গেল সাহানী, আর দু বছর যেতে না যেতেই সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হলো সখীর!
এইসব ভয়াবহ জীবন দেখতে দেখতে মাত্র বারো তেরো বছরের বালিকা রাবেয়া আবিষ্কার করল তার যাবতীয় পাঠ্যপুস্তক আর পড়ালেখার খাতার আড়ালে ঠাঁই করে নিয়েছে ভিন্ন এক খাতা। সেই খাতায় চরিত্রগুলো জীবন্ত হয়ে উঠছে ক্রমশ। ব্যাস, নেশায় পরিণত হয়ে গেল লেখা। পড়ালেখা উঠল গোল্লায়। মায়ের চোখ এড়িয়ে গোপনে গোপনে। আর কিছু জানে না সে বালিকা, শুধু জানে জীবিত মানুষকে যেমন শেষ পর্যন্ত যমের কাছে যেতে হয়, তেমনি অমোঘ আকর্ষণে গোপনে তাকে ফিরতে হবে কলমের কাছে।
প্রথম লেখাই উপন্যাস, ‘নিরাশ্রয়া’। নিজেই প্রচ্ছদ এঁকে হ্যান্ডমেড বই, একমাত্র পাঠক ছোটবোন সুফিয়া। তারপর একটু সাহস করে গল্প লিখে পত্রিকার ঠিকানায় পাঠালে তা ছাপাও হয়ে গেল! প্রথম ছাপা হলো যে গল্প, তার নাম ‘প্রশ্ন’, গল্পের বিষয় নারী নির্যাতন! তাও নিজের নামে না, ছাপা হলো ‘তাজেদা বানু’ ছদ্মনামে। রাবেয়া খাতুন নামটা নিজেরই পছন্দ ছিল না, খুব সাধারণ নাম মনে হতো। তাই নিজেই বানিয়ে নিয়েছিলেন লেখকনাম। যদিও তাজেদা বানু আর কন্টিনিউ করেনি, রাবেয়া খাতুন নামেই পরবর্তী সময়ে খ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি।
গল্পগুলো একে একে ছাপা হতেই লাগল বিভিন্ন পত্রিকায়। তা দেখে বড়বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে চিঠি এল পিতার সমীপে, ‘আপনার পরিবারের একটি কন্যার হস্তাক্ষর বাইরের পরপুরুষেরা দেখিতেছে। উভয় খানদানের জন্য ইহা অত্যন্ত অসম্মান এবং লজ্জার ব্যাপার। বিষয়টির প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাইতেছে...।’ শুরু হলো সামাজিক চাপ।
গল্পগুলো একে একে ছাপা হতেই লাগল বিভিন্ন পত্রিকায়। তা দেখে বড়বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে চিঠি এল পিতার সমীপে, ‘আপনার পরিবারের একটি কন্যার হস্তাক্ষর বাইরের পরপুরুষেরা দেখিতেছে। উভয় খানদানের জন্য ইহা অত্যন্ত অসম্মান এবং লজ্জার ব্যাপার। বিষয়টির প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাইতেছে...।’ শুরু হলো সামাজিক চাপ।
কিন্তু বালিকা যে বুঝে গেছে, যেকোনোভাবেই হোক, তাকে ফিরতে হবে কলমের কাছেই। তাই আর পিছু ফিরে তাকানো হলো না। একের পর এক লিখে চললেন মধুমতি তীরের জোলাদের নিয়ে ‘মধুমতি’, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে ‘বায়ান্ন গলির এক গলি’, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ‘ফেরারী সূর্য’ সহ প্রায় অর্ধশতাধিক উপন্যাস! সঙ্গে শ চারেক ছোটগল্প! এর পাশাপাশি স্মৃতিকথা, ভ্রমণ ও শিশুসাহিত্যও কম নয়। জীবনের ষাট বছরেরও বেশি সময় ব্যয় করেছেন সমৃদ্ধ সাহিত্য চর্চাতেই। কবি শামসুর রাহমান বলেছিলেন—‘এই লেখিকা বাজার মাত করার জন্য শস্তা গল্প লিখে বেঁচে থাকার মতো কেউ নন। তিনি সত্যিকারের উঁচুস্তরের সাহিত্য রচনা করার উদ্দেশ্য নিয়েই হাতে কলম নিয়েছেন।’
বাংলা সাহিত্যের এই দুই দিকপাল নারী লেখকের জন্মদিন আবার পাশাপাশি—রাবেয়া খাতুনের ২৭ ডিসেম্বর আর রিজিয়া রহমানের ২৮ ডিসেম্বর। দুজনকেই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
রাবেয়া খাতুনের চার বছরের ছোট রিজিয়া রহমান। জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে ১৯৩৯ সালে। ছোটবেলায় সবাই ডাকত জোনাকী নামে। বেশ সাহিত্য-সংস্কৃতিমনষ্ক পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা রীতিমতো এস্রাজ আর বাঁশি বাজাতেন, গাইতেন রাগসংগীত। বাড়িতে ছিল অজস্র বই। কিন্তু রাবেয়া খাতুনের মতোই শৈশবেই জীবনে আসে বিভীষিকাময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আর দেশভাগের ভয়াবহতা। শেকড় ছেড়ে সপরিবারে চলে আসতে বাধ্য হন বাংলাদেশের ফরিদপুরে। থিতু হওয়ার আগেই বাবার মৃত্যুর পর চলে যেতে হয় মামাবাড়িতে, দোহারের শাইনপুকুরে, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে। সাহিত্য সংস্কৃতির বদলে জোটে ভীষণ রক্ষণশীল পরিবেশ, বোরখা ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ। এক পর্যায়ে স্কুলে যাওয়াই গেল বন্ধ হয়ে, প্রাইভেটে পাশ করতে হলো ম্যাট্রিক। অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে গেল, স্বামীর সঙ্গে এবারের ঠাঁই বেলুচিস্তান। সেখানকার কলেজে কিছুদিন পড়ালেখার সুযোগ পেলেও পরীক্ষার সুযোগ হলো না মাইগ্রেশন সার্টিফিকেট বিষয়ক জটিলতায়। ফলে আবার ঢাকায় ফেরত। এবার ইডেন কলেজ।
রিজিয়া রহমান ‘একাল চিরকাল’–এ তুলে আনেন সাঁওতালদের জীবন। পতিতা হতে বাধ্য হওয়া বীরাঙ্গনাদের জীবন নিয়ে লেখেন ‘রক্তের অক্ষর’, বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষ আর তাদের মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে লেখেন ‘শিলায় শিলায় আগুন’। আর রয়েছে তাঁর অন্যতম কীর্তি ‘বং থেকে বাংলা’। বাংলার হাজার বছরের মাটি আর মানুষেরা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে রিজিয়া রহমানের কলমে।
এইসব টানাপোড়েনের জীবনে রিজিয়া রহমানের একমাত্র স্বস্তি ছিল ‘লেখা’, কল্পনার চরিত্র সাজিয়ে নিজের একটা জগৎ তৈরি করা। কিন্তু একটা গল্পের বিরুদ্ধে উঠল অশ্লীলতার অভিযোগ। ছাপা হলো না রোকেয়া হলের ম্যাগাজিনে! তখন অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে—সম্পাদনা বোর্ডকে বলে তা ছাপানোর ব্যাবস্থা করতে হলো। এইসব নানাবিধ প্রতিকূলতা আর প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েও রাবেয়া খাতুনের মতোই রিজিয়াকেও তবু বারবার ফিরতে হয় কলমের কাছেই। বস্তির জীবন তুলে আনেন ‘ঘর ভাঙা ঘর’-এ, ‘একাল চিরকাল’–এ তুলে আনেন সাঁওতালদের জীবন। পতিতা হতে বাধ্য হওয়া বীরাঙ্গনাদের জীবন নিয়ে লেখেন ‘রক্তের অক্ষর’, বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামী মানুষ আর তাদের মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে লেখেন ‘শিলায় শিলায় আগুন’। একটা মেয়ের জীবনে তার চারপাশের সমাজ, পরিবার, নিঃসঙ্গতা, ক্ষুধা, ভয় এই সবকিছু যখন ভীতিকর হয়ে ওঠে; তখন ভয়ংকর হিংস্র বাঘকেও তার বন্ধু মনে হয়। সেই গল্প লিখেছেন ‘বাঘবন্দী’তে। আর রয়েছে তাঁর অন্যতম কীর্তি ‘বং থেকে বাংলা’। বাংলা সাহিত্যের এ এক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। বাংলার হাজার বছরের মাটি আর মানুষেরা বাঙ্ময় হয়ে ওঠে রিজিয়া রহমানের কলমে। যা তাঁকে অনন্য করে রেখেছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে।
বাংলা সাহিত্যের এই দুই দিকপাল নারী লেখকের জন্মদিন আবার পাশাপাশি—রাবেয়া খাতুনের ২৭ ডিসেম্বর আর রিজিয়া রহমানের ২৮ ডিসেম্বর। দুজনকেই জন্মদিনের শুভেচ্ছা।