রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্য সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর কবি অজিত দত্ত ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘তাঁর কাব্যের জগৎ ছিল তাঁর একান্তই নিজস্ব। যে কাব্যলোক সাধারণ কাব্যপাঠকের পরিচিত, তার সঙ্গে মেলাতে গেলে জীবনানন্দের কবিতা অদ্ভুত, দুর্বোধ্য ও সঙ্গতিহীন মনে হওয়া কিছু আশ্চর্য নয়। তাঁর মন যেন চলেছিল প্রচলিত ভাব–ভাবনা ও চিন্তার পথ এড়িয়ে অন্য পথে, তাঁর উপমাগুলো যেন অন্য রকম, তাঁর ছবিগুলো যেন অন্যভাবে আঁকা।...সেই হিসেবে তাঁকে “কবিদের কবি” বললে অন্যায় বলা হবে না।’ কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁকে উল্লেখ করেছেন ‘কবিতার জাদুকর’ হিসেবে।
বাংলা কবিতার চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটিয়ে জীবনানন্দ কবিতায় আধুনিকতার সূচনা করেছেন। যদিও কবির মৃত্যুর আগে তাঁর প্রতিভার মূল্যায়ন সেভাবে হয়নি, কেবল বুদ্ধদেব বসু ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য তাঁকে নিয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। কবির মৃত্যুর পর ‘কবিতা’ পত্রিকা জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যা প্রকাশ করে। বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য ছাড়া অমলেন্দু বসু, অজিত দত্ত, অশোক মিত্র, অরুণকুমার সরকার, নরেশ গুহ, অশোকবিজয় রাহাও কবিকে নিয়ে সেখানে প্রবন্ধ রচনা করেন। এর বাইরে চিঠিপত্রের মাধ্যমে কবির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা দু-একজন পাঠকের কথাও উল্লেখ করতে হবে, যাঁদের চিঠি লিখে জীবনানন্দ আনন্দ পেতেন।
তাঁর মন যেন চলেছিল প্রচলিত ভাব–ভাবনা ও চিন্তার পথ এড়িয়ে অন্য পথে, তাঁর উপমাগুলো যেন অন্য রকম, তাঁর ছবিগুলো যেন অন্যভাবে আঁকা।...সেই হিসেবে তাঁকে ‘কবিদের কবি’ বললে অন্যায় বলা হবে না।অজিত দত্ত
জীবনানন্দের কবিতায় প্রকৃতি, গ্রামবাংলা, সময় ও মানুষের অস্তিত্বের গভীর প্রশ্নগুলো অনন্যভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। যে ভাষা, ছন্দ ও চিত্রকল্প তিনি ব্যবহার করেছেন, তাঁর আগে বাংলা কবিতায় এর অস্তিত্ব ছিল না। এভাবে তিনি বাংলা কবিতাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কণ্ঠ নিচু। ধ্যান ও নিমগ্নতাকে জীবনানন্দ দাশ নিছক সাহিত্যচর্চার উপাদান বিবেচনা করেননি, তাঁর জীবনচর্যার মধ্যে বিষয়গুলো ঢুকে পড়েছিল।
জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। যদিও এই তাৎপর্যময় কথাটি ‘স্থূল হাতে ব্যবহৃত হয়ে, ব্যবহৃত হয়ে, ব্যবহৃত—ব্যবহৃত হয়ে’ হয়তো ক্লিশে হয়ে গেছে, কিন্তু এর আবেদন পুরোনো হয়েছে বলে মনে হয় না। ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’—জীবনানন্দ কল্পিত এই ‘কেউ কেউ’ ভিন্ন জাতের মানুষ। তাঁর মতে, এই বিশেষ জাতের মানুষদের রয়েছে নিজস্ব চিন্তা ও স্বতন্ত্র সত্তা, এরা আগের ও বর্তমান শতাব্দীর আলোর মিথস্ক্রিয়ায় হৃদয়ের কল্পনা এবং কল্পনার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কাব্যচর্চা করে।
গটফ্রিড বেন বলেছিলেন, ‘শ্রেষ্ঠ কবির কাছে সবসুদ্ধ পাঁচটি শুদ্ধ কবিতা আমরা আশা করব।’ কথাটিকে আশ্রয় করে অলোকরঞ্জন বলেন, ‘তাহলে, তার নিরিখে অনায়াসই বলা সম্ভব, অন্তত উত্তীর্ণ পঞ্চাশটি কবিতায় জীবনানন্দ তাঁর আরব্ধ শিল্পযোগ উৎকীর্ণ করে রেখে গিয়েছেন। এই পঞ্চাশটি কবিতা, রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তাকে পার হয়েও, বাংলা যাঁদের মাতৃভাষা, তাঁদের হৃদয়ে চিরদিনের জন্য মুদ্রিত হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, যাঁকে “নির্জনতম কবি” বলে গণ্য করা হয়েছিল, তিনিই আসলে বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তম কবি।’
স্বভাবগতভাবে কবি ছিলেন অনেকটা ভিন্ন প্রকৃতির। বুদ্ধদেব বসুর মতে, ‘আসলে জীবনানন্দর স্বভাবে একটি দুরতিক্রম্য দূরত্ব ছিল—যে অতিলৌকিক আবহাওয়া তাঁর কবিতার, তা–ই যেন মানুষটিকেও ঘিরে থাকত সব সময়—তার ব্যবধান অতিক্রম করতে ব্যক্তিগত জীবনে আমি পারিনি, সমসাময়িক অন্য কোনো সাহিত্যিকও না।’
জীবনানন্দ দ্বারা প্রভাবিত কবির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া কবির তালিকায় প্রথমেই নাম করা যাবে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও বিনয় মজুমদারের। কিন্তু জীবনানন্দ নিজে কার উত্তরসূরি?
১৯৫২ সালে একদিন সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বাড়িতে ভূমেন্দ্র গুহ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও জীবনানন্দ দাশ একসঙ্গে আলাপ করছিলেন। সঞ্জয় ভট্টাচার্য যেন কিছুটা উত্তেজিত, তাঁর প্রশ্ন, জীবনানন্দ কি স্বতন্ত্র কবিতা লিখছেন? জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে শেলি-কিটস-হুইটম্যান থেকে আরম্ভ করে ইয়েটস-রিলকে-এলিয়ট পেরিয়ে ডিলান টমাস পর্যন্ত কবিদের কবিতার আত্মীয়তা রয়েছে বলে তিনি অভিমত দেন। জীবনানন্দ দাশ স্বভাবসুলভ মৃদুস্বরে বলে ওঠেন, ‘একজন সচেতন কবিকে এতজন অগ্রজ বা সমসাময়িক কবি একই সঙ্গে প্রভাবান্বিত করতে পারেন?’ জীবনানন্দের উত্তর শুনে সঞ্জয় ভট্টাচার্য রেগে গেলেন। বললেন, ‘আপনি এঁদের বংশপরম্পরার।’
প্রভাব নয়, বংশপরম্পরা। আত্মীয়তার বিষয়টায় জীবনানন্দ আর গেলেন-ই না! তিনি অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।
জীবনানন্দ দাশ পাশ্চাত্য কবিতা আর দেশীয় সংস্কৃতিকে সার্থকভাবে বাংলা কবিতায় আত্মীকরণ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই জীবনানন্দের মতো সৃষ্টিশীল ও প্রভাবশালী কবি কারও অনুকারক হতে পারেন না বরং পরবর্তীকালে অনেক কবি তাঁকে অনুসরণ করে কাব্যচর্চা করেছেন। তাঁর কবিতার দ্বারা প্রভাবিত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমার মনে হয় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছেন আমাদের বয়সী কবিরা জীবনানন্দের দ্বারা। প্রভাবিত হয়েছেন, আবার প্রভাব কাটিয়েও উঠেছেন, তাঁর মতো লেখা তো সম্ভব নয়। কোথাও কোথাও তিনি থেকে গেছেন। আমার নিজের কথাই বলি—আমার পদ্যের মধ্যে অনেক সময়, জীবনানন্দ রয়ে গেছেন।’
আসলে জীবনানন্দর স্বভাবে একটি দুরতিক্রম্য দূরত্ব ছিল—যে অতিলৌকিক আবহাওয়া তাঁর কবিতার, তা–ই যেন মানুষটিকেও ঘিরে থাকত সব সময়—তার ব্যবধান অতিক্রম করতে ব্যক্তিগত জীবনে আমি পারিনি, সমসাময়িক অন্য কোনো সাহিত্যিকও না।বুদ্ধদেব বসু
কবিদের কবি জীবনানন্দ কি জনপ্রিয় কবি ছিলেন? কথাটির সত্যতা নিরূপণে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত জীবনানন্দের প্রিয় কবি গটফ্রিড বেনের একটি উক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। বেন বলেছিলেন, ‘শ্রেষ্ঠ কবির কাছে সবসুদ্ধ পাঁচটি শুদ্ধ কবিতা আমরা আশা করব।’ কথাটিকে আশ্রয় করে অলোকরঞ্জন বলেন, ‘তাহলে, তার নিরিখে অনায়াসই বলা সম্ভব, অন্তত উত্তীর্ণ পঞ্চাশটি কবিতায় জীবনানন্দ তাঁর আরব্ধ শিল্পযোগ উৎকীর্ণ করে রেখে গিয়েছেন। এই পঞ্চাশটি কবিতা, রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তাকে পার হয়েও, বাংলা যাঁদের মাতৃভাষা, তাঁদের হৃদয়ে চিরদিনের জন্য মুদ্রিত হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, যাঁকে “নির্জনতম কবি” বলে গণ্য করা হয়েছিল, তিনিই আসলে বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তম কবি।’
জীবনানন্দ চিঠি লিখতেন। তাঁর পাঠানো চিঠি এবং পোস্ট না করা চিঠির কিছু খসড়া পরে উদ্ধার করা হয়। একবার একটি খসড়া চিঠিতে তিনি হুমায়ুন কবিরকে, যিনি সে সময় ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের সচিব ছিলেন, লিখেছিলেন, ‘আমি বিশিষ্ট বাঙালিদের মধ্যে পড়ি না; আমার বিশ্বাস, জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কিছু—যা শেষ বিচারে কোনো একটা জিনিসের মতন জিনিস, কিন্তু ভাগ্য এমনই যে তার খাদ্য জুটছে না। কিন্তু আশা করি, ভবিষ্যতে খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে। আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।’ তিনি যা আশঙ্কা করেছেন, তা-ই। জীবদ্দশায় নিজের সাফল্যের তেমন কিছুই দেখে যেতে পারেননি। কবির মৃত্যুর এক বছর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাসে তাঁর রচনাসমূহ পাঠ্যসূচির বিষয় হয়। কবির মৃত্যুর এক বছর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ ক্লাসে তাঁর রচনাসমূহ পাঠ্যসূচীর বিষয় হয়, এবং তার আগেই যাদবপুর এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠসূচিতে প্রবেশ করে।
জীবনানন্দের কবিতায় বারবার মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা এবং মানুষের অস্তিত্বের সংকট উঠে এসেছে। তিনি মানুষের অন্তর্গত অনুভূতি এবং অস্তিত্বের গভীর দিকগুলো নানাভাবে উপস্থাপন করেছেন।
আমার বিশ্বাস, জীবিত মহত্তর বাঙালিদের প্রশ্রয় পাওয়ার মতনও কেউ নই আমি। কিন্তু আমি সেই মানুষ, যে প্রচুর প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্রতিটি দ্রব্যকে সোনা বানিয়ে তুলতে চায় অথবা মহৎ কিছু—যা শেষ বিচারে কোনো একটা জিনিসের মতন জিনিস, কিন্তু ভাগ্য এমনই যে তার খাদ্য জুটছে না। কিন্তু আশা করি, ভবিষ্যতে খাঁটি মূল্যের যথার্থ ও উপযুক্ত বিচার হবে। আমার ভয় হয়, সেই ভালো দিন দেখতে আমি বেঁচে থাকব না।হুমায়ুন কবিরকে লেখা চিঠিতে জীবনানন্দ দাশ
জীবনানন্দের কবিতা একাধিক আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা যায়। কবিতাগুলোর প্রতীক, রূপক ও চিত্রকল্প এতটাই গভীর ও অর্থবহ যে তা সাধারণ পাঠকের পাশাপাশি কবি ও সাহিত্যবোদ্ধাদের কাছেও বেশি আবেদনমূলক। তাঁর কবিতায় রয়েছে সুর। বুদ্ধদেব বসুর মতে এটাই জীবনানন্দের কবিতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। ‘সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়’, বুদ্ধদেব বসু বলেন, তাঁর কবিতা নিয়ে বসলেই তাঁর এই লাইনটি মনে পড়ে। একটি সুর জলের মতো হাওয়ার মতো ঘুরে ঘুরে অনেক দূর থেকে কানে এসে লাগছে।
বস্তুত জীবনানন্দ দাশের কবিতার জাদু, গভীরতা ও নান্দনিকতাই তাঁকে ‘কবিদের কবি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর কবিতা শুধু পাঠের জন্য নয় বরং অনুভব এবং বিশ্লেণের জন্যও। তিনি এমন এক কবি, যিনি বাংলা কবিতাকে শুধু সমৃদ্ধ করেননি, বরং তাকে নিয়ে গেছেন এক নতুন মাত্রায়। এ জন্যই তিনি আজও কবি ও বোদ্ধাদের কাছে চিরকালীন এবং প্রাসঙ্গিক। এখনো বাংলা কবিতা নিয়ে নিরলস চর্চায় রত নবীন কবিরা জীবনানন্দকে নিয়ে মেতে আছেন। এখনো নতুন কোনো কবি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করার আগে এই অগ্রজ কবির কবিতার বই উল্টেপাল্টে দেখেন। তাই তাঁকে ‘কবিদের কবি’ বলা অত্যুক্তি নয়।