পাঠককেও আপডেট হতে হয়

সা্হিত্যের আড্ডায় প্রায়ই নতুন ধরনের কবিতা লেখার কথা বলা হয়। কিন্তু পুরোপুরি নতুন বলে কি কিছু আছে? আর নতুনের পরিণতি তো শেষ পর্যন্ত পুরোনো হওয়া। অর্থাৎ বিশ্লেষণের বিষয়, যে কবিতাকে নতুন দাবি করা হচ্ছে, তা কত দিন নতুন থাকবে কিংবা এই নতুনের সঙ্গে পুরোনো কতখানি যুক্ত আছে? পুরোনো হয়ে গেলেই কি কবিতা গুরুত্বহীন? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বা জীবনানন্দ দাশের কবিতাও তো পুরোনো হয়েছে, কিন্তু আজকের পাঠক তো আগ্রহ নিয়ে পড়েন। আজও তো মনে পড়ে ভারতচন্দ্রের স্মরণীয় কিছু চরণ, ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়’ বা ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। আসলে কবির কাজ সমসাময়িক ভাষা ও শব্দভান্ডারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন, সমকালীন অভিজ্ঞতা আর চিরন্তন অনুভূতিকে সঙ্গী করে কবিতাকে আপডেটকরণ। এই আপডেটকরণকেই বলা হয় নতুন কিছু করা। এ ক্ষেত্রে চিন্তার গভীরতা আর অভিনবত্বই হয়তো একজন কবিকে অন্য কবি থেকে এগিয়ে রাখে!

অভিযোগ শোনা যায়, এ সময়ের কবিদের কবিতা পাঠকদের কোনোভাবেই আকৃষ্ট করতে পারছে না। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আজকের কবিতার পাঠকদের ৫০ শতাংশ লেখালেখিতে জড়িত (বিশেষত নবীন ও তরুণ), ৪০ শতাংশ কবির আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব এবং ১০ শতাংশ সাধারণ পাঠক।

এমন অভিযোগ ও পরিসংখ্যান সামনে রেখেই বলা যায়, ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় রোজই লিখিত ও পঠিত হচ্ছে অসংখ্য কবিতা, বেড়েছে কবিতার বই প্রকাশের সংখ্যাও। এর মধ্যে হয়তো থেকে যাচ্ছে উৎকৃষ্ট কোনো কোনো কবিতা। মার্কিন কবি ডব্লিউ এইচ মারউইনকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কবিতাকে কীভাবে জনপ্রিয় করা যায়? তিনি বলেছিলেন, শব্দ করে করে কবিতা পাঠের মাধ্যমে। একই রকমে প্রতিধ্বনি যেন পাওয়া যায় হোর্হে লুইস বোর্হেসের কথাতেও, সত্যিকারের ভালো কবিতা পড়তে হবে সশব্দে। ভালো কবিতা নীরবে পঠিত হতে চায় না। যদি নীরবে পড়ি, তবে তা কবিতা নয়। কবিতা উচ্চারণ দাবি করে। মনে রাখতে হবে, কবিতা প্রথমে মৌখিক শিল্প, তারপর লিখিত।

বোর্হেসের কথা আমাকে ভাবায়। লক্ষ করেছি, কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ-ছন্দ-বক্তব্য বা ধ্বনির শক্তি জোরে জোরে পাঠ করলে যেভাবে টের পাওয়া যায়, মনে মনে পাঠে সব সময় পাওয়া যায় না। ছাপাখানা আবিষ্কারের আগপর্যন্ত কবিতা তো ছিল শোনারই বিষয়। পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই তখন কবিতা ড্রাম বাজিয়ে পাঠ করা হতো। তবে কবিতা আর কেবল শ্রুতিনির্ভর নেই, দেখার বিষয়ও হয়ে গেছে। কবিতায় যে স্পেসের ব্যবহার, কবিতার যে বিভিন্ন রকমের আঙ্গিক, তা ছাপাখানারই অবদান। ছাপাখানা কবিতাকে দেখারও বিষয় করে তুলেছে, মনে মনে পাঠের বিষয় করে তুলেছে। কবিতা বিচিত্র নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অনেক দূর এগিয়েছে।

নতুন সময়ে লেখা উৎকৃষ্ট কবিতা উপলব্ধির জন্য পাঠককেও নিশ্চয় যথাযথ আপডেট হতে হবে, তা না হলে তিনি সমকালীন কাব্যরস উপলব্ধি থেকে বঞ্চিত থাকবেন। এর দায় কোনোভাবেই কবির নয়!