পৃথিবীর পণ্ডিতদের মতে, আরবি ভাষার ‘আলিফ লায়লা’, বাংলায় ‘সহস্র এক আরব্য রজনী’ নামক আশ্চর্য উপন্যাসের কিস্সাগুলো প্রাচীনকালের। তবে সামগ্রিক রূপটি গড়ে উঠেছে মধ্যযুগের বারো থেকে ষোলো শতকের মধ্যে। সময়টা ছিল আবার সারা দুনিয়ার রোমান্সমূলক আখ্যানের জন্মের কাল। আর পণ্ডিতদের কথা অনুযায়ী আরব্য রোমান্সগুলো গড়ে উঠতে প্রায় আট শ বছর সময় লেগেছিল এবং বিগত তিন শ বছর ধরে পশ্চিম দুনিয়া জয় করে বিশ্বসাহিত্যে ক্ল্যাসিক সৃষ্টি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে বিষয়বস্তুর দিক থেকে এত বিচিত্র কাহিনির সমাহার পৃথিবীর আর কোনো সাহিত্যে নেই। বিচিত্র সব জীবজন্তু, কৌতুক-কাহিনি, বাদশাহি বিষয়, অদৃষ্টের লীলা, ইসলাম ধর্মের খুঁটিনাটি ও বিশদ মহিমা, অভিযাত্রা, প্রেম-লালসা-স্বপ্ন প্রভৃতির সঙ্গে এতে রয়েছে বাস্তব জীবনেরও নানা বিষয়। মানুষের মূঢ়তা-মূর্খতা, দয়াদক্ষিণা, ইন্দ্রিয় রতি, নীতি-দুর্নীতি, ছলনা-প্রতারণা, আশা-নিরাশা, অভাব-অভিযোগ, মিথ্যাচার-ধূর্ততা, খুনখারাবি, উপকার-প্রত্যুপকার প্রভৃতি আরব্য রজনীর পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় বর্ণিত। সবচেয়ে আকর্ষণীয় যা রাজা-রাজকন্যার সমারোহ, জিন-ইফ্রিত-মন্ত্রসিদ্ধ আংটি, জাদুকর, জাদুর গালিচা, মায়ানগরী, মরু-বন-উপত্যকা-পাহাড়, ঘন নীল দরিয়া ইত্যাদির মিলিত রহস্যঘেরা কল্পজগৎ। এই কল্পজগতের মায়ায় পড়ে নারীতে অবিশ্বাসী বাদশাহ শাহারিয়ার জেগে জেগে রাতের পর রাত শুনেছেন কিস্সাগুলো; দণ্ডিত উজিরকন্যা নববধূ শেহেরজাদিকে খুন করার ফুরসতও পাননি। বরং এসব কিস্সার বদৌলতে শেহেরজাদি বাদশাকে তো বশ করলেনই, তার ওপর বেগম হলেন; আর বাদশার হাতে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে আরবের যত মেয়েকেও রক্ষা করলেন। আরব্য রজনীর চিরায়ত আবেদনের বাইরে এর বিশেষ গুরুত্ব মুসলমান-জগতের দিগন্ত উন্মোচনও, সে হিসেবে মুসলমানদের কাছে তার ঐতিহ্যিক ও সাহিত্যিক মূল্য একটু বেশি।
সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে বিষয়বস্তুর দিক থেকে এত বিচিত্র কাহিনির সমাহার পৃথিবীর আর কোনো সাহিত্যে নেই। বিচিত্র সব জীবজন্তু, কৌতুক-কাহিনি, বাদশাহি বিষয়, অদৃষ্টের লীলা, ইসলাম ধর্মের খুঁটিনাটি ও বিশদ মহিমা, অভিযাত্রা, প্রেম-লালসা-স্বপ্ন প্রভৃতির সঙ্গে এতে রয়েছে বাস্তব জীবনেরও নানা বিষয়।
তাহলেও বাঙালি মুসলমানের কাছে আরব্য রজনী এসেছে অনেক পরে; আর এই পরে আসার পেছনে মুসলমানদের সাহিত্যিক সমস্যাকে প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুযায়ী আবির্ভাবের শত বছরের মাথায় আরব বণিকদের মাধ্যমে বাংলায় ইসলাম প্রবেশ করে; তবে ধর্মমতের প্রসারে সুফিসাধকদের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। বাংলায় ইসলামের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নসহ সমাজ-সভ্যতা ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব পড়তে সময় লাগে প্রায় পাঁচ শ বছর। এই সময়ের ভেতরে আরব্য রজনীকে তো পাওয়াই যায় না, বরং তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় ষোলো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তা–ও আরব্য রজনীর সহস্র এক রাতের দুই শ চৌষট্টিটি কিস্সার একটির মাত্র কাব্যরূপের জন্য। এটি কবি দোনা গাজীর সৈফুল্-মুলুক ও বদীউজ্জমান।
অনুমান করতে অসুবিধা নেই যে মুসলমান সভ্যতা ও পারস্য সংস্কৃতির মাধ্যমে ভারতের মতো বাংলায়ও আরব্য রজনীর কিছু কাহিনি প্রচার পেয়েছিল। তখন ছিল বাংলা ভাষায় মুসলমানদের সাহিত্যচর্চার সূচনা-যুগ; ধর্মকেন্দ্রিক ও দেবদেবী-কথার বাইরে বাংলা সাহিত্যে তারা প্রথম মানুষকে উপজীব্য করে সাহিত্যচর্চায় আসেন। এর প্রধান কারণ, মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাস মতে দেবপরিকল্পনার সুযোগ নেই; তাই তাদের পক্ষে প্রচলিত ধারার সাহিত্য রচনাও সম্ভব ছিল না। অথচ মানুষের সাহিত্যিক ক্ষুধা নিবারণের জন্য নবগঠিত সমাজে সাহিত্যবস্তু প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাই মুসলমান সমাজে এই অভিনব রোমান্টিক প্রণয়কাব্য ধারার সূচনা করেন শাহ্ মুহম্মদ সগীর। এই ধারার প্রথম কাব্যকর্ম ‘ইউসুফ-জুলেখা’। প্রণয়কাব্য ধারার প্রায় সব আখ্যানই ছিল অনুবাদমূলক। দোনা গাজীও তাঁর কাব্যটি ফারসি থেকে অনুবাদ করেছিলেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে বাংলা আরব্য রজনীর সূত্রপাত আরবি উৎস থেকে নয়, ফারসি ধারা থেকে। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রথম বাংলা আরব্য রজনীর যে মানুষ ও সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় হলো, সে মরুবাসী বেদুইনের নয়, বরং বসরা-বাগদাদ-দামেস্ক-কায়রো নিবাসী আরবের।
রোমান্টিক প্রণয়কাব্যের ধারার বাইরে এসে আঠারো শতকে যে দোভাষী পুঁথিসাহিত্যের উদ্ভব হয়, তারও প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে আরব্য রজনীর কিস্সাগুলো। লায়লী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, বাহার দানেশ, চাহার দরবেশ, গোলে বকাওলি, হাতেম তাই প্রভৃতি কিস্সা পয়ার ছন্দে মুসলমান সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মিশ্র ভাষারীতির এসব পুঁথিসাহিত্য হয় আরবি, নয়তো ফারসি থেকে অনূদিত ও সৃজিত। বলা যায়, বাংলার সাধারণ মুসলমান সমাজে কাব্য ও পুঁথিপাঠের মাধ্যমেই বাংলা আরব্য রজনীর প্রবেশ ও পরিচিতি। আর আরব্য রজনীর রোমান্সমূলক আখ্যানগুলো মুসলমান সমাজে বিস্ময় তৈরি করেছিল এবং দারুণ আস্বাদও এনেছিল। এসব আখ্যানের প্রসার ও জনপ্রিয়তা তার বড় প্রমাণ।
প্রণয়কাব্য ধারার প্রায় সব আখ্যানই ছিল অনুবাদমূলক। বাংলা আরব্য রজনীর সূত্রপাত আরবি উৎস থেকে নয়, ফারসি ধারা থেকে। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রথম বাংলা আরব্য রজনীর যে মানুষ ও সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় হলো, সে মরুবাসী বেদুইনের নয়, বরং বসরা-বাগদাদ-দামেস্ক-কায়রো নিবাসী আরবের।
আরব্য রজনীর কিস্সাগুলোর আদি রূপ ও মালিকানা নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। তাহলেও এগুলোর ভিত্তি আরবি লোকগল্প এবং বাগদাদ, দামেস্ক, সিরিয়া, মিসর তথা পারস্যে এসে তা বর্ণাঢ্যতা পায়। মধ্যযুগব্যাপী আরব্য রজনীর যেসব কিস্সা বা আখ্যান বাংলার মুসলমান সমাজে এসে পৌঁছায়, তা ওই পারস্য থেকে। তবে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলায় ক্ষমতাকাঠামো পরিবর্তন, আর ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তৃত হলে যে ইংরেজি শিক্ষার পত্তন হয়, সে সূত্রে আরব্য রজনীর উৎস হয়ে যায় খোদ ইউরোপ। আর এটা তো জানা কথা যে ইউরোপীয় আরব্য রজনী পুনর্কথিত হয়েছিল সাহেবদের মন-মর্জি অনুযায়ী; ইউরোপীয় জীবনচর্যা ও রুচি অনুযায়ী। ইউরোপে এসে আরব্য রজনীতে সবচেয়ে উৎকট যেসব জিনিস যুক্ত হয়, তা আদিরস আর প্রাচ্যের ক্লিশে রূপ।
ইউরোপে প্রথম আরব্য রজনী পৌঁছায় ফরাসি অনুবাদে ও ফরাসিদের দ্বারা। ফরাসি প্রাচ্যবিদ আঁতোআন গালাঁ দ্য থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস নামক বারো খণ্ডের পুনর্কথনটি প্রকাশ করেন ১৭০৪ থেকে ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। মূলে সিরীয় থেকে অনূদিত এই আরব্য রজনীর রুচি ও জীবনদৃষ্টিতে পড়ে ফরাসি ছাপ। ফরাসি সংস্করণ প্রকাশের চার বছরের মাথায় অনামা লেখকের ইংরেজি সংস্করণ প্রকাশিত হয় ‘দ্য অ্যারবিয়ান নাইটস এন্টারটেইনমেন্টস’ নামে এবং তার মাধ্যমে অপরাপর ইউরোপীয় ভাষায় আরব্য রজনী ছড়িয়ে পড়ে। গালাঁর আরব্য রজনী ছিল অসম্পূর্ণ এবং তিনি অন্য সূত্রে প্রাপ্ত কিছু গল্পও তাতে জুড়ে দিয়েছিলেন। যা পরে ইউরোপের, এমনকি ভারতীয় ভাষাগুলোকে অনূদিত আরব্য রজনীর অঙ্গীভূত হয়ে যায়। গালাঁকে অনুসরণ করে যেসব সংক্ষিপ্ত আরব্য রজনীর সংস্করণ প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে জনাথন স্কটের ছয় খণ্ডের ইংরেজি অনুবাদ দ্য অ্যারবিয়ান নাইটস এন্টারটেইনমেন্টস (১৮১৮) সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য।
ইউরোপে প্রথম আরব্য রজনী পৌঁছায় ফরাসি অনুবাদে ও ফরাসিদের দ্বারা। ফরাসি প্রাচ্যবিদ আঁতোআন গালাঁ দ্য থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস নামক বারো খণ্ডের পুনর্কথনটি প্রকাশ করেন ১৭০৪ থেকে ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। মূলে সিরীয় থেকে অনূদিত এই আরব্য রজনীর রুচি ও জীবনদৃষ্টিতে পড়ে ফরাসি ছাপ।
মূলত মিসরে আরবি ভাষার আলিফ লায়লা পুস্তকের আধুনিক পূর্ণতা পেয়েছিল, সেটি ষোলো শতকের মামলুক বংশীয় সুলতানদের আমলে। মিসরীয় এই সংকলনটিতে প্রাচীন ও অর্বাচীন আরবি ভাষার নমুনা লক্ষিত হয়; লেখকদেরও সবাই ছিলেন অজ্ঞাতনামা। সংকলনটিকে আরব্য রজনীর মূল বা প্রধান সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তখনো পৃথিবীর কোথাও আরবি আলিফ লায়লা মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়নি। ১৮১৪-১৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় সিরীয় সংস্করণের প্রথম আংশিক মুদ্রণ হয়; এটি সম্পাদনা করেন আরব দেশ থেকে আগত আলেম শেখ আহমদ ইবনে মহমুদ শিরওয়ানি। অন্যদিকে আলিফ লায়লার প্রথম পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ প্রকাশিত হয় মিসরের বুলাক শহর থেকে ১৮৩৫-৩৬ খ্রিষ্টাব্দে। আর মিসর থেকে আনীত সম্পূর্ণ হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি ১৮৩৯-৪২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। চার খণ্ডে প্রকাশিত সংকলনটি সম্পাদনা করেন বাংলার তৎকালীন ব্রিটিশ সিভিলিয়ান উইলিয়াম এইচ ম্যাকনাটেন। বুলাক ও ম্যাকনাটেন সংস্করণের বাইরে আরও অতিরিক্ত কিস্সা আরবের হাতে লেখা বিভিন্ন পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায়, যা আরব্য রজনীভুক্ত হয় পড়ে। মজার বিষয় হলো, ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ ও ‘আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ’ কিস্সা দুটি গালাঁর সংস্করণে থাকলেও মিসরীয় সংস্করণে তা পাওয়া যায়নি। তবে কিস্সা দুটি সিরীয় সংস্করণে ছিল।
দীর্ঘদিন ধরে গালাঁর সংস্করণই ছিল ইউরোপে আরব্য রজনীর আদর্শ। উনিশ শতকে সে বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে আরবি আলিফ লায়লা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন হেনরি ডব্লিউ টরেন্স (১৮৩৮), এডওয়ার্ড ডব্লিউ লেন (১৮৩৯-৪২), জন পেইন (১৮৮২-৮৪) প্রমুখ প্রাচ্যবিদরা। ডব্লিউ টরেন্স অনুবাদ করেছিলেন মিসরীয় সংস্করণ থেকে; ‘দ্য বুক অব থাউজেন্ড নাইটস অ্যান্ড ওয়ান নাইট’ নামে। তাঁর অবলম্বন ছিল উইলিয়াম এইচ ম্যাকনাটেন। সব কটি খণ্ড প্রকাশের অভিপ্রায় থাকলেও তিনি একটিমাত্র খণ্ড প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। এডওয়ার্ড লেন নির্ভর করেছিলেন শেখ আহমদ ও বুলাক সংস্করণ। তাঁর সংকলনের নাম ছিল ‘দ্য অ্যারবিয়ান নাইটস এন্টারটেইনমেন্টস’ এবং এটি তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয়। জন পেইনের অনুবাদকর্মটি সুবৃহৎ ছিল, ‘দ্য বুক অব থাউজেন্ড নাইটস অ্যান্ড ওয়ান নাইট’ নামে এটি নয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়। তিনি কলকাতার সংস্করণগুলো অনুসরণ করেছিলেন। ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত হয় রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টনের সতেরো খণ্ডের প্রামাণ্য ‘দ্য বুক অব থাউজেন্ড নাইটস অ্যান্ড ওয়ান নাইট’। তিনি ম্যাকনাটেন ও বুলাক সংস্করণের বাইরে যুক্ত করেন গালাঁসহ অপরাপর সংস্করণের/পাণ্ডুলিপির অতিরিক্ত কিস্সাগুলো। বার্টনের সংকলনে স্থান পায় সর্বমোট চার শ ছাব্বিশটি কিস্সা। এর মধ্যে আরব্য রজনীর দুই শ একত্রিশটি কিস্সাকে দশ খণ্ডে এবং বাদ বাকি কিস্সাগুলোকে পরিশিষ্ট আকারে আরও সাত খণ্ডে ঠাঁই দেন। এটি যথাযথ ও সম্পূর্ণ অনুবাদ এবং বার্টন একে নিখাদ সাহিত্য হিসেবেই উপস্থাপন করেন। বার্টনের বইটি প্রকাশিত হয় বারানসি থেকে, ইউরোপ থেকে নয়। ভিক্টোরীয় নীতিবোধের কারণে তিনি ইংল্যান্ডে বইটি ছাপাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
মিসরে আরবি ভাষার আলিফ লায়লা পুস্তকের আধুনিক পূর্ণতা পেয়েছিল, সেটি ষোলো শতকের মামলুক বংশীয় সুলতানদের আমলে। মিসরীয় এই সংকলনটিতে প্রাচীন ও অর্বাচীন আরবি ভাষার নমুনা লক্ষিত হয়; লেখকদেরও সবাই ছিলেন অজ্ঞাতনামা। সংকলনটিকে আরব্য রজনীর মূল বা প্রধান সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে আরব্য রজনীর উর্দু সংস্করণ প্রকাশিত হয়। শাহের আলি অনূদিত গ্রন্থটির নাম ছিল ‘আলেফ লায়লা’, আর প্রকাশকাল ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ। এর ছয় বছর বাদে প্রকাশিত হয় উর্দু দ্বিতীয় সংস্করণ ‘হাকায়াত আল-জালিলা’ নামে। কলিকাতা মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত বইটির অনুবাদক ছিলেন শামসুদ্দিন আহমদ। উর্দু বিদ্বৎসমাজ এগুলো থেকেই আরব্য রজনীর রস আস্বাদন করতেন, কিন্তু উনিশ শতকের শেষের দিকে আবদুল করিমকৃত চার খণ্ডের ‘আলিফ লায়লা’ প্রকাশের পর এটিই তাঁদের কাছে প্রিয় হয়ে ওঠে। অনুবাদক গালাঁকে অনুসরণ করেছিলেন আর উর্দু সংস্করণগুলো উৎস ছিল আরবি।
আঁতোআন গালাঁর অনুবাদের পর ফরাসি ভাষায় আরব্য রজনীর একাধিক অনুবাদও প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে জোসেফ চার্লস মারদ্রুস নামের একজন চিকিৎসকের অনুবাদকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি অনুবাদ করেন আরবি থেকে এবং তাঁর সংকলনটি প্রকাশিত হয় বারো খণ্ডে ১৮৯৯ থেকে ১৯০৪ এর মধ্যে। মারদ্রুসের সংশোধিত ‘দ্য বুক অব থাউজেন্ড নাইটস অ্যান্ড ওয়ান নাইট’ প্রকাশিত হয় ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে। কিছুটা ভ্রান্তির জন্য সমালোচিত হলেও সাহিত্যিকরা তাঁর অনুবাদকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। মারদ্রুসের অনুবাদেও ফরাসিয়ানার প্রভাব বিদ্যমান এবং তিনি তাঁর কিস্সাগুলোতে ইন্দ্রিয় আসক্ত প্রাচ্যকেই বেশি পরিমাণে বিম্বিত করেছেন।
দেখা যায় ফরাসি, জার্মান, ইংরেজি, তুর্কি প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত ও সংকলিত আরব্য রজনীর মধ্যে সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয় গালাঁ, বার্টন, জনাথন স্কট ও মারদ্রুসের সংকলনগুলো। আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি অনুবাদকেরা মূলত এই চার সূত্র ছাড়াও আরবি, ফারসি ও উর্দু উৎস থেকেও আরব্য রজনী বাংলায় অনুবাদ করেছেন। মাদ্রাসায় শিক্ষিত অনেক বাঙালি আরবি-ফারসি ও উর্দু থেকেই কিস্সাগুলোর স্বাদ গ্রহণ করেছেন।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে আরব্য রজনীর উর্দু সংস্করণ প্রকাশিত হয়। শাহের আলি অনূদিত গ্রন্থটির নাম ছিল ‘আলেফ লায়লা’, আর প্রকাশকাল ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ। এর ছয় বছর বাদে প্রকাশিত হয় উর্দু দ্বিতীয় সংস্করণ ‘হাকায়াত আল-জালিলা’ নামে। কলিকাতা মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত বইটির অনুবাদক ছিলেন শামসুদ্দিন আহমদ।
বাংলা গদ্যভাষায় আরব্য রজনীর কিস্সাগুলো অনুবাদ শুরু হয় উনিশ শতকের বিশের দশক থেকে। অনেকের ধারণা, জোনাথন স্কটের সংস্করণ অবলম্বন করে বাংলায় আরব্য রজনীর কিস্সা অনুবাদের সূত্রপাত। স্কট থেকেই অনূদিত হয়ে কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত বাংলা আরব্য রজনীর নাম হয় এক শ এক আরব্য রজনী (১৮২৬)। অনুবাদকের নাম বইয়ে ছিল না, সম্পাদক ছিলেন রামতনু গাঙ্গুলী। এতে মোট ছত্রিশটি কিস্সা স্থান পায়। পরে অক্ষয়কুমার দত্ত, নবীনচন্দ্র সেন, প্রেমচন্দ্র তর্কভূষণ প্রমুখ বিদ্বান বিভিন্ন কিস্সা অনুবাদ করেন এবং সাময়িক পত্রে প্রকাশ করেন। বিশেষ করে ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’, ‘আলাদিন ও আশ্চর্য প্রদীপ’, ‘সিন্দাবাদ নাবিকের সমুদ্রযাত্রা’ প্রভৃতি কিস্সাগুলো। এসব গদ্য-অনুবাদের সূত্র বিভিন্ন লেখকের ইংরেজি অ্যারাবিয়ান নাইটস। আরব্য রজনীর দ্বিতীয় বাংলা সংকলন শিবচন্দ্র দেব অনূদিত আরব্য উপন্যাস। এটি ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এর চার বছর পর প্রকাশিত হয় পাদরি ডব্লিউ বি স্মিথের অনুবাদ একই নামে। এরপর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের উদ্যোগে ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে মির্জা আলি লুতফের আরব্য রজনী। এর উৎস ছিল আরবি (মতান্তরে ইংরেজি) সংকলন। এসব সংকলনের সবই ছিল আংশিক এবং ভাবানুবাদ।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আরব্য রজনীর কিছু কিস্সা পাঠবইয়েও স্থান পায় এবং সব ধর্ম ও শ্রেণির মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ সময়ে আরব্য রজনীকে জনপ্রিয় করতে তুলতে যাঁদের অনুবাদ ও সৃজন বিশেষ ভূমিকা পালন করে, তাঁরা হলেন সম্বাদ পূর্ণচন্দ্রোদয় সম্পাদক (১৮৩৯), নীলমণি বসাক (১৮৪৯), মুক্তারাম বিদ্যাবাগীশ (১৮৫৩-৫৭), সত্যচরণ গুপ্ত (১৮৭৫-৭৬), যোগেন্দ্রনাথ দে (১৮৮০), অলোকনাথ ন্যায়ভূষণ (১৮৮২), পরাণচন্দ্র দাস (১৮৮৮), জীবনলাল ঘোষ (১৮৯৯) প্রমুখ। এসব সংকলনের ভাষা ছিল সহজ, সরল ও রসপূর্ণ। তবে কিস্সাগুলো ভদ্র পরিবারের পাঠোপযোগী ও শালীন করে লেখা হয়। এঁদের উৎস ছিল আঁতোআন গালাঁ, এডওয়ার্ড ডব্লিউ লেন, এডওয়ার্ড ফর্স্টার, রিচার্ড এফ বার্টন, জন পেইন, জোনাথন স্কট প্রমুখের অ্যারাবিয়ান নাইটস। উর্দু থেকে বাংলায় অনূদিত প্রথম আরব্য রজনীর রোশন আলিকৃত, এটি ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। ১৮৬৪ থেকে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বেশ কটি খণ্ডে উর্দুর অন্য অনুবাদ প্রকাশিত হয় সৈয়দ নাসের আলি প্রমুখের অনুবাদে। দুই সংস্করণই পদ্যভাষায় লেখা। তবে মুসলমান সমাজের কেউ কেউ এ উৎস থেকেও বাংলায় বিচ্ছিন্ন গদ্য রূপ দিয়েছেন এবং তা কলকাতার বটতলা থেকে প্রকাশিতও হয়।
গদ্যভাষায় আরব্য রজনীর কিস্সাগুলো অনুবাদ শুরু হয় উনিশ শতকের বিশের দশক থেকে। অনেকের ধারণা, জোনাথন স্কটের সংস্করণ অবলম্বন করে বাংলায় আরব্য রজনীর কিস্সা অনুবাদের সূত্রপাত। স্কট থেকেই অনূদিত হয়ে কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত বাংলা আরব্য রজনীর নাম হয় এক শ এক আরব্য রজনী (১৮২৬)।
আরব্য রজনীর ইউরোপীয় উৎসের কিস্সাগুলো অনেক ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের উপযোগী করে রচিত। তবে বাঙালি লেখকেরা অনুবাদ ও সৃজনের সময় বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সেসব কিস্সাকে বেছে নিয়েছেন, যাতে রোমান্স বেশি; অর্থাৎ রোমাঞ্চ, বিস্ময়, ভয়, ঐশ্বর্য, অভিযান, সমুদ্র, জাদু ইত্যাদির সমাহার রয়েছে। আলিবাবা, আলাদিন, সিন্দাবাদ প্রভৃতির কাহিনি বাংলায় তখন বেশি জনপ্রিয় হয়। রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিতেও ফারসি তুতিনামার পাশে আরব্য রজনী পাঠ যে সেকালের শিক্ষিত সমাজের সবচেয়ে উপাদেয় পাঠ ছিল, তা–ও জানা যায়। এমনকি মধ্যবিত্ত বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে আরব্য রজনী যে কতটা অন্তর্ভুক্ত হয়, তা–ও জানা যায় তাঁর বই থেকে। রাজনারায়ণ বসু লিখেছেন, ‘আরবি নাইটের পালা হইত, অর্থাৎ তবলা, ঢোলক মন্দিরা লইয়া ইংরাজী পয়ারে লিখিত আরবিয়ান নাইটের গল্প বাসায় বাসায় গান গাইয়া বেড়ান হইত।’ সেই কারণে সাধারণের জন্য বাংলায় আরব্য রজনীর অনুবাদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।
বাংলায় আরব্য রজনী অনুবাদের স্বর্ণযুগ বিশ শতক। হিন্দু-মুসলমান উভয় সমাজে শিক্ষা বিস্তার, রুচিবোধের সম্প্রসারণ ও সাহিত্যমননে উদারনৈতিকতা তৈরি হলে শিশু-কিশোর পাঠের বাইরে এসে নিখাদ সাহিত্যরস আস্বাদনের অভিপ্রায় নিয়ে আরব্য রজনীর অনুবাদ শুরু হতে থাকে তখন। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় দীনেন্দ্রকুমার রায়ের সচিত্র আরব্য রজনী। আর ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের আরব্যোপন্যাস সচিত্র গার্হস্থ্য সংস্করণ। রামানন্দ অনুবাদ করেন রিচার্ড বার্টন থেকে। এখানে কিস্সা-সংখ্যা ছিল ছেচল্লিশটি। বার্টন ও বটতলার বইয়ের কিছু বিষয় বাদ দিয়ে তিনি ভদ্রস্থ করে বইটি রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ এর প্রশংসা করে বিশ্বভারতীতে তা পাঠ্যভুক্ত করেন। তিনি অবশ্য একে শিশুসম্প্রদায়ের পিতামাতার মনোরঞ্জনের জন্য যোগ্য বই বলেও অভিহিত করেছিলেন। ১৯১০ সালে মুসলমান রচিত আদি ও আসল কিস্সা আলেফ লায়লা পদ্যাকারে প্রকাশিত হলে তা জনসমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এটিও বটতলা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এভাবে শতকজুড়ে দুই বাংলায় আরব্য রজনীর বাংলা সংকলন প্রকাশের হিড়িক পড়ে। বেশির ভাগই ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে। বিশ শতকে আরব্য রজনীর একশ দশটি সংকলনের সন্ধান পেয়েছেন এই প্রবন্ধের লেখক। শতকের শেষ বছর ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় বিপ্রদাস বড়ুয়ার শিশুতোষ আরব্য রজনী আর কলকাতা থেকে পুষণ দত্তের সাত সমুদ্রে সিন্দবাদ।
বিশ শতকে আরব্য রজনী নানা স্বাদে ও নানা রূপে অনূদিত হয়। বেশির ভাগ প্রকাশনা বিচ্ছিন্ন কিস্সা বা গল্পের সমাহার এবং তা শিশুতোষ রচনা। জনপ্রিয়তার জন্য অল্পশিক্ষিত পাঠকের জন্যও প্রকাশিত হয়েছে সচিত্র নানা সংকলন। কোনো সংকলন ভদ্রস্থ করে, কোনোটি আবার প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী করে। সাহিত্যগুণ ও সম্পূর্ণতা বিবেচনা করে বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য ভান্ডারকে উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে অনূদিত ও সংকলিত হয়েছে খুব কম। যা হয়েছে তা–ও মূল আলিফ লায়লা থেকে নয় এবং নানা ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ। এ ক্ষেত্রে চারটি সংকলন উল্লেখযোগ্য, যার তিনটি পশ্চিম বাংলা এবং একটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে তারাপদ রাহার আরব্য রজনী প্রকাশিত হয় ১৯৭৯-৮০ খ্রিষ্টাব্দে। ছয় খণ্ডে প্রকাশিত কিস্সাগুলোর পুনর্কথন করেন অনুবাদক। তাঁর আদর্শ ছিল রিচার্ড বার্টন। তিনি বার্টনের সমুদয়টা অনুবাদ করেননি। সংক্ষিপ্ত করেছেন অনেক কিস্সা। বাদও দিয়েছেন কিছু। ক্ষীতিশ সরকারের সহস্র এক আরব্য রজনী প্রকাশিত হয় ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি অনুবাদ করেন জে সি মারদ্রুস থেকে। এটিকে তিনি পূর্ণাঙ্গ আরব্য রজনী বলে দাবি করেছেন। পুরো সংকলনে তিনি চেষ্টা করেছেন তৎকালীন আরবীয় আবহ ও পরিবেশ তৈরি করতে। মূলানুগ এই অনুবাদকর্মের ভাষা অনবদ্য ও সাহিত্যিক গদ্যে উপাদেয়। অনেকে তাঁর গদ্য ও কথকতাকে ‘জাদুকরি’ বলে অভিহিত করেছেন। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় চঞ্চলকুমার ঘোষের এক সহস্র এক আরব্য রজনী, তিনি অনুবাদ করেন রিচার্ড বার্টন থেকে। এ ছাড়া তিনি এডওয়ার্ড লেন থেকেও কিছু ঋণ নিয়েছেন। কিছু ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত ও অভিযোজিত করে তিনি তাঁর সংকলন সাজিয়েছেন। ভাষাগত দিক থেকে তা সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল; উপস্থাপনার দিক থেকে সংস্কৃতিমান পাঠকের উপযোগীও। বাংলাদেশের আরব্য রজনী সংস্করণটি চার খণ্ডে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়, রকিব হাসান অনূদিত ও সম্পাদিত সংস্করণটি এখানকার সর্ববৃহৎ। আরব্য রজনীর গল্প নামের সংস্করণটি করা হয়েছে জে সি মারদ্রুস ও রিচার্ড বার্টনের বই থেকে বাছাই করা কিস্সা নিয়ে। রকিব হাসান আসলের রস ক্ষুণ্ন না করে বাঙালি রুচি অনুযায়ী গল্পগুলো রচনা করেছেন মার্জিত ভাষায়। তাঁর ভাষা সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল; তবে সাহিত্যগুণ তুলনামূলকভাবে কম। অন্যদিকে উভয় বাংলায় প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লিখিত বেশির ভাগ আরব্য রজনীর উৎস ছিল রিচার্ড বার্টন, তবে বার্টনের শিল্পবোধ ও ভাষাগত দক্ষতা অনেক লেখকের ছিল না বলে বেশির ভাগ রচনা নিছক পর্নোগ্রাফির পর্যায়ে পড়ে। ফলে কালান্তরে লোকসমাজে তা ‘অশ্লীল সাহিত্য’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে ‘গুপ্তবই’য়ে পরিণত হয়, আর নিখাদ সাহিত্যের আসর থেকে বিদায় নিতে থাকে। বিশেষ করে আধুনিক সাহিত্যের পাঠকের কাছ থেকে।
বাংলাদেশের আরব্য রজনী সংস্করণটি চার খণ্ডে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়, রকিব হাসান অনূদিত ও সম্পাদিত সংস্করণটি এখানকার সর্ববৃহৎ। আরব্য রজনীর গল্প নামের সংস্করণটি করা হয়েছে জে সি মারদ্রুস ও রিচার্ড বার্টনের বই থেকে বাছাই করা কিস্সা নিয়ে। রকিব হাসান আসলের রস ক্ষুণ্ন না করে বাঙালি রুচি অনুযায়ী গল্পগুলো রচনা করেছেন মার্জিত ভাষায়।
আবার আরব্য রজনীর কিস্সা মুসলমান সমাজে কখনো গ্রহণযোগ্য সাহিত্য হিসেবে মান্যতা পায়নি। বরং অসংস্কৃত মানুষের সাহিত্য হিসেবে তা হেয় করেই দেখা হতো, আর এর পেছনে প্রধান কারণ হলো তা মূলাধীন নয়। দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় রুচির আদলে সৃষ্ট কিস্সাগুলোর বাংলা অনুবাদও মান্য আলিফ লায়লার নয়। ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকেও এমন কিছুর বর্ণনা রয়েছে, যা ইসলাম গণ্য করে না। এ ছাড়া দেশকালহীন ও অপরিচিত আবহের কিস্সার সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের জীবনের কোনো যোগও নেই। তাই জীবনের কাছে তাৎপর্যহীন কিস্সাগুলোকে তাই কেচ্ছাই মনে হয় অনেকের কাছে। অন্যদিকে আধুনিক সাহিত্যের বিচিত্র সমাহারে আরব্য রজনী সাধারণের কাছে গৌণ হয়ে গেছে। তবে ক্ল্যাসিক সাহিত্যের রস যাঁরা অনুসন্ধান করেন, তাঁদের কাছে আরব্য রজনী মূল্যবান ও ঐশ্বর্যময় মণিমুক্তার খনি। তবে দুর্ভাগ্য যে আলিফ লায়লার পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ এখনো হয়নি এবং বাঙালি নিজের ভাষায় সেই অপূর্ব আস্বাদও নিতে পারেনি।