এগিয়ে চলেছে সংগীত, সমাজ এখনো পেছনে
আজ মারা গেছেন সংগীতশিল্পী, গবেষক ও লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী। গান, লেখালেখি আর গবেষণা—এসব নিয়ে ছিল তাঁর বর্ণিল জীবন। প্রথম আলোয় এই লেখা তিনি লিখেছিলেন ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর। এ লেখায় সমাজের বাস্তবতা ও সংগীতকে অন্য এক চোখে নিরীক্ষণ করেছেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর লেখাটি আবার প্রকাশিত হলো।
সংগীতপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ। তাঁর একটি গানে পাওয়া যাচ্ছে, ‘গান আমার যায় ভেসে যায়, দে তারে বিদায়’। গানই যেখানে ভেসে চলেছে, সেখানে ‘সংগীতচিন্তার’ অবস্থা অথবা আমাদের ক্ষুদ্র নিবন্ধের কতটুকু আর অবস্থান। সবই যেন ভেসে যাচ্ছে, অথবা ভেস্তে যাচ্ছে। কিন্তু ‘নেতি’ নয়, আমরা এগিয়ে চলেছি, এ ভাবটা বজায় রাখতে এই নিবন্ধ।
রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের গ্রামে-বন্দরে দেখতেন তাঁর গান কূল পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে গলায় তুলে নেয়নি শুধু, অন্তরে স্থান দিয়েছে। রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন চলছে শুধু পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণে নয়, সারা বছরই। মফস্বল শহরগুলোতেও। সংগীতপ্রেমিকদের উদ্বুদ্ধ করেছে বৈকি।
মূল সংগীতের ক্ষেত্রে যদি এমনটি হতো, তাহলে আক্ষেপের কারণ থাকত না। পরিকল্পনার অভাব ও সংস্কৃতি-পরিকল্পকদের কলকে না পাওয়া। পরিকল্পনাই নেই, কাজও শুরু হয়নি। হয়েছে খানিকটা বিচ্ছিন্নভাবে। বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টস, সংগীত মহাবিদ্যালয়, অন্যান্য বিদ্যায়তন আছে। যা নেই তা হলো অর্থের ছাড়। সবই খুঁড়িয়ে। শিক্ষার্থী এসেছে; কী তাদের কণ্ঠ, কী প্রক্ষেপ, কী বিপুল সম্ভাবনা! নতুন কুঁড়িরা ফুটে উঠেছে, পদ্মকুঁড়ি দল মেলতে পারেনি। নেই ভালো ওস্তাদ, রাগ-রাগিণীরা কেঁদে মরেছে। ৫০ বছরে কজন আর শাস্ত্রীয় সংগীতের শিল্পী বের হয়েছে! সংগীতের পথ তাই অবরুদ্ধ।
২.
কেন? নিয়াজ মুহাম্মদ চৌধুরী? তাঁর ছাত্রছাত্রী? ধরা যাক, শখানেক? সেখান থেকে ১০ জন বেরিয়ে আসতে পারত না? পারত। কিন্তু উচ্চাঙ্গসংগীত—রেডিওতে, টেলিভিশনে, শিল্পকলায়, মাহফিলে—কোথাও স্থান পায়নি পরিকল্পকদের অনীহায়। সংগীত যে আসলে উচ্চাঙ্গসংগীত, সেই বোধটুকুই জাগ্রত হয়নি। যাঁরা ভারতে গান শিখতে গিয়েছিলেন তানপুরা হাতে, তাঁরা ফিরে এসে তানপুরা ফেলে গিটার বা ব্যাঞ্জো ধরেছেন। বেঁচে থাকতে হবে তো! অথচ নিয়াজের কণ্ঠ মেহেদি হাসানের চেয়েও এক ধাপ ভালো, সমগ্র ভারতেও তাঁর মতো কণ্ঠ আমি এখনো খুঁজে পাই না। কত কষ্টে, কত ধৈর্যের সঙ্গে এখনো শিল্পী তাঁর তানপুরায় সুর বাঁধেন, তা আমি স্বচক্ষে দেখে এসেছি। শিল্পীর স্ত্রী, নিজেও একজন বড় ওস্তাদের মেয়ে। সলজ্জ কণ্ঠে বললেন, ‘আমি ওস্তাদের মেয়ে (ওস্তাদ জাকির হোসেন), ওস্তাদের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, দোয়া করবেন যেন ছেলেকে সংগীতের তালিম দিয়ে যেতে পারি।’ একটি সকাল তাঁদের বাড়িতে কাটিয়ে এসেছি। খুব ভালো লাগল। কেন, সেটা বলছি। নিয়াজের ছেলের নাম ফৈয়াজ। কী সুন্দর কণ্ঠ! কী সুন্দর দেখতে! যখন তানপুরা বেঁধে ‘আ’ করল, ছোট ঘরটি যেন গমগম করে উঠল। মনে পড়ল পুরানা পল্টনের ‘হিরামন মঞ্জিলে’ যখন ওস্তাদেরা আসতেন, সেটা গুল মুহাম্মদ খানই হন অথবা বারীণ মুজমদার অথবা নাজাকাত-সালামাত হন, এমনি করে সুরে ভরে যেত ঘরটি। সুরে না ভরলে বৃথা সব আয়োজন।
ফৈয়াজ বলল, ‘আমি গান গাইতে ভালোবাসি। আমি নিয়াজ মুহাম্মদ চৌধুরীকে ছাড়িয়ে যেতে চাই। কিন্তু সমাজ তো তা দেবে না।’
নিয়াজ বললেন, ‘আটটি টিভি চ্যানেল আছে। সবার জানা, ক্লাসিক্যাল গানই আসল বস্তু। টাকা ছাড় দেবে না। ইন্টারভিউ নিতে চায়। তারপর... আমাকে ছুড়ে ফেলে দেবে। এই তো?’
এবার চা এল, ধূমায়িত চা। সঙ্গে ঘরে তৈরি পায়েস। চা-টা যখন সুরের বিস্তারে জমে উঠেছে, তখন আমার সঙ্গে আনা ক্যামেরা ‘ক্লিক’ ‘ক্লিক’ করে উঠল। বললাম, ‘নিয়াজ, জানেন, কোন দিনে আপনার বাসায় এসেছি?’ নিয়াজ বললেন, ‘না, কী করে জানব?’
বললাম, “আজ ৮ ডিসেম্বর। আমার জন্মদিন। সত্তরটি বসন্তের সমাহার। এসেছি দুজনের কাছে। আপনার বাড়ি, তারপর ‘গানের পিতা’, ‘আমার পিতা’, আব্বাসউদ্দীনের বাড়ি। আপনার বাড়ি থেকে দুই বাড়ি পরে। আজিমপুর কবরস্থানে।’
নিয়াজ সিক্তনয়ন হয়ে উঠলেন। বললেন, “বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ আছে। যারা গান শিখতে আসে, তাদের কণ্ঠ, বিস্তৃতি, মেহনত বৃথা যাবে না। আপনার বাবা যে জিনিসটি চেয়েছিলেন, তার জন্য আমিও মেহনত করছি। সংগীতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মেহনত দরকার। আমি শিখিয়ে যাচ্ছি। আমি ‘একুশ’ বা ‘স্বাধীনতা’র জন্য গান শিখিনি। আমি সংগীতকে ভালোবেসেছি বলেই ওস্তাদ হয়েছি। আজও তিন ঘণ্টা রেয়াজ করেছি। কণ্ঠকে বশে রেখেছি। নিজেকে শৃঙ্খল পরিয়েছি। অর্থ নয়, যশ নয়, সম্মান নয়, শুধু সংগীতকে ভালোবেসেছি।”
৩.
যদি পিতা আব্বাসউদ্দীন বেঁচে থাকতেন, তাহলে আমাদের লোকসংগীতের বর্তমান অবস্থা দেখে কী বলতেন? আমাদের গ্রামের গানগুলো, শিল্পীগুলো মাঝেমধ্যে টেলিভিশনের পর্দায় উঠে আসেন বৈকি। তাদের রং মাখিয়ে সং সাজিয়ে গানগুলো শুনিয়ে যখন উপস্থাপক সাফল্যের হাসি হাসেন, তখন বলার আর কিছুই থাকে না। শহুরে শ্রোতারা এখনো উপলব্ধি করেনি তাদের মর্ম। তবে ভালো দিক বলা যায়। তাহলো, সমান্তরালভাবে লোকসংগীত এখনো গ্রামীণ মানুষের আনুকূল্যে বেঁচে আছে। আরিফ দেওয়ান আমাকে বললেন, ‘আব্বাসী ভাই, আপনাদের টিভির এক-দুই হাজার টাকা না হলেও আমাদের চলে। প্রতি অনুষ্ঠানে সারা রাতে আমি ২৫ হাজার টাকা অনায়াসে পাই।’ অন্য গায়কেরা, বয়াতিরা একই কথা বললেন। ওদের সংখ্যা শতাধিক। ভাগ্য ভালো, টেলিভিশনের বিভীষণ এখনো গ্রামে তেমনটা দাগ ফেলতে পারেনি। প্লাস পয়েন্ট।
৪.
মেহেদি হাসান ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁকে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘ব্যান্ডগান আপনার ভালো লাগে?’ উনি বললেন, ‘ওয়ো, না চিজ হ্যায়’, অর্থাত্ ওটি কোনো বস্তুই নয়। আমি তা বলি না। চিত্কারও সংগীত বৈকি। বিশেষ করে আফ্রিকায় ‘চিত্কার’ও সংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। আগে বুঝতাম না। পরে আমাকে বোঝানো হলো, আদিমতা, চিত্কার, উদ্দামতা—এগুলো সংগীতের প্রাথমিক প্রকাশ।
বিদ্রোহ-এর জন্য প্রয়োজন চিত্কার, অনেক শব্দ। ঝংকার ও উদ্দাম ছন্দ? সেটারও প্রয়োজন, কারণ উদ্দাম ছন্দ না হলে মানুষ হয়ে যাবে স্থবির। ভাওইয়ার জন্মভূমিতে আমি এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রেখেছি। মদনের জাগৃতি না হলে সৃষ্টি থেমে যাবে। তাই আমি ব্যান্ডের সপক্ষে। তবে রক ব্যান্ড নয়। সহনীয়, রোমান্টিক, সাধু বাঙালি মননের সঙ্গে যা খাপ খায়, তার সপক্ষে।
যদি পিতা আব্বাসউদ্দীন বেঁচে থাকতেন, তাহলে আমাদের লোকসংগীতের বর্তমান অবস্থা দেখে কী বলতেন? আমাদের গ্রামের গানগুলো, শিল্পীগুলো মাঝেমধ্যে টেলিভিশনের পর্দায় উঠে আসেন বৈকি। তাদের রং মাখিয়ে সং সাজিয়ে গানগুলো শুনিয়ে যখন উপস্থাপক সাফল্যের হাসি হাসেন, তখন বলার আর কিছুই থাকে না। শহুরে শ্রোতারা এখনো উপলব্ধি করেনি তাদের মর্ম।
৫.
‘পঁচিশ বছরের পারস্পেকটিভ প্ল্যানের (Perspective Plan) কথা আগেও বলেছি। যা হয়নি, তা নিয়ে কেঁদে কী হবে? ওই প্ল্যান নিয়ে বসেছিলেন যাঁরা, তাঁরা কেউ আর নেই, কেউ জাঁদরেল পিএসপি, কেউ সামরিক ব্যক্তি। ওঁরা কী জানে সংস্কৃতির? আজ নৈরাজ্যের অন্ধকারে সংগীতকেই বা বাদ দেব কেমন করে? সাফল্যের গান গাইব কোন সেতারে, কোন দোতারায়? আশা ছেড়ে দিলে তো কিছুই থাকে না। সম্ভাবনার দেশ এই বাংলা। যখন আমেরিকায় যাই, আমাদের সম্পন্ন ছেলেমেয়েদের কণ্ঠে আব্বাসউদ্দীনের, আবদুল আলীমের গান নতুন চেতনায় প্রস্ফুটিত হতে দেখি। তখন আশায় বুক বাঁধি। টেলিভিশনের ‘খুদে গানরাজ’ আর রিকশাওয়ালাদের কণ্ঠেও যখন বাংলা গানের জাদু উচ্চকিত হয়, তখনো বুঝি, এই বাধা চিরদিনের নয়। আমরা জয়ী হবই।
৬.
তাহলে কী করতে হবে? সা রে গা মা থেকে শুরু করি। গাড়ি-বাড়ির কমপিটিশন না করে গানের স্কুল খুলি, যা জানি শেখাই, ওদের জন্য টাকা ছাড় করি, ওদের গান শেখার ব্যবস্থা করি। স্কুলে গান-বাজনা-নৃত্য শেখানোর জন্য মাস্টারদের মাইনের ব্যবস্থা করি। শুদ্ধ সংগীত, মানবিক সংগীত শেখানোর ব্যবস্থায় অংশ নিই সবাই।
যে মসজিদে যাই, শুক্রবার, সেখানে বলা হচ্ছে: গান-বাদ্য হারাম। টেলিভিশন দেখে যারা, তাদের মসজিদে এসে কী লাভ? কী বৈপরীত্য দেখুন! অগ্রসর চিন্তার অবকাশ নেই কোথাও, হতাশ মন নিয়ে বাড়ি ফিরি। কোথায় যে যাই! টেলিভিশনের একটি চ্যানেল (কিউ টিভি) থেকে একজন ব্রিটিশ মাওলানা বলছেন (আমার বন্ধু), সংগীত মানুষকে আরও মহত্ হতে শেখায়। মানুষ সেরা জীব; সে জানে, কোন সংগীত তাকে মহত্ হতে সাহায্য করবে।
নজরুল, আব্বাসউদ্দীন, আলাউদ্দীন খাঁ—এঁরা গান শেখালেন, কাব্য শেখালেন। মহত্ত্ব অনুধাবনের শিক্ষা তো অর্জন করতে হয়। নানা কনফারেন্সে গেলাম গত বছর—দিল্লি, ইস্তাম্বুল, তেহরানে। ওরা বলছে, সংগীত রুহের খাদ্য। মহত্ সংগীত নিয়ে আসে মহান আল্লাহর নৈকট্য। আমি মাঝামাঝিতে এসেছি। ভালো যা কিছু, তা-ই ভালো; যা মন্দ, তা-ই মন্দ। গানও মন্দ হতে পারে। আমি তার থেকে দূরে।
৭.
সমাজ নেয়নি বলে আমরা তিনজন সংগীতকে পেশা হিসেবে নিতে পারিনি। সবচেয়ে ভালো ছিলেন আসাফ্উদ্দৌলাহ্; যেমন কণ্ঠ, তেমনি শিক্ষা, রুচি। তিনি হলেন জাঁদরেল সিএসপি। আনোয়ারউদ্দীন খান; সুরেলা কণ্ঠ, যেমন সুরকার, তেমনি পরিবেশনা। হলেন ব্যাংকের ম্যানেজার। বাকি আমি। হীরা-কাঞ্চন কিছুই ধরতে পারিনি। শুধু সংগীতপ্রেমিক। প্রেমটুকুই সব। যত দিন বাঙালি আছে—সংগীত আছে, থাকবে।