রাজ্জাক কেন জনগণের ‘নায়ক’

আজ ২১ আগস্ট নায়করাজ রাজ্জাকের মৃত্যুদিন। ১৯৬৬ সালে কলকাতা থেকে এ দেশে এসে চলচ্চিত্রাভিনয়ের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের মানুষের অন্তরে স্থান করে নিলেন। কীভাবে সম্ভব হলো এ ঘটনা? রাজ্জাক কেন হয়ে উঠলেন জনগণের ‘নায়ক’?

রাজ্জাক বলতেই তাঁর এই চিরচেনা নায়কোচিত অভিব্যক্তি ভেসে আসে আমাদের চোখেছবি: সংগৃহীত

১৯৬৪ সালে দাঙ্গায় কলকাতা ছেড়ে যখন ঢাকায় আসেন রাজ্জাক, তখন তাঁর কাছে সম্বল বলতে ছিল পীযূষ বসুর দেওয়া একটি চিঠি ও পরিচালক আবদুল জব্বার খান ও শব্দগ্রাহক মণি বোসের ঠিকানা। পরিচালক আবদুল জব্বার খানই তাঁকে সুযোগ করে দেন এবং চলচ্চিত্রে তিনি প্রথম কাজ শুরু করেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। সেই শুরু। পরে তিনি আবির্ভূত হলেন ‘নায়ক’ হিসেবে।

‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে রাজ্জাক ও সুচন্দা
ছবি: সংগৃহীত

এই যে ভারতের টালিগঞ্জের ছেলেটাই বাংলাদেশের নায়করাজ রাজ্জাক হয়ে উঠলেন, আসলে তা কীভাবে সম্ভব হলো? কেন বাংলাদেশের জনগণের ‘নায়ক’ হয়ে উঠলেন তিনি?

প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজতে গেলে নানা বিষয়ই সামনে আসবে। তবে আমার মতে, প্রথমে যে বিষয়টা সামনে আসে, তা হলো, রাজ্জাক একেকটা চরিত্রে এমনভাবে নিজেকে ফুটিয়ে তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন, যা আপামর জনসাধারণের মনস্তত্বে তাঁকে ‘নায়ক’ উপাধি এনে দিয়েছিল।

‘নীল আকাশের নিচে’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে রাজ্জাক আবির্ভূত হলেন রোমান্টিক নায়ক হিসেবে
ছবি: সংগৃহীত

১৯৬৬ সালে পরিচালক জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ চলচ্চিত্রে রাজ্জাক যখন লখিন্দর হয়ে এলেন, তখন এ দেশের মানুষ যেন তার শিকড় খুঁজে পেল সিনেমাটির মধ্যে। কেননা, যে লখিন্দরের গল্প আজন্ম শুনে এ জাতি বড় হয়েছে, রাজ্জাক সেই লখিন্দরকে পর্দায় মূর্ত করে তুললেন। তাঁর অভিনয়নৈপুণ্য আর পরিচালকের মুনশিয়ানার কারণে বাঙালির মন এতকাল ধরে যে লখিন্দরকে লালন করেছে, তাকে এবার যেন চাক্ষুষ করতে পারল দর্শক। এরপর জহির রায়হানেরই আরেকটি সিনেমা ‘আনোয়ারা’য় রাজ্জাক এলেন বিখ্যাত লেখক মোহাম্মদ নজিবর রহমান রচিত ক্ল্যাসিক উপন্যাস ‘আনোয়ারা’র নূর ইসলাম চরিত্রে—মানে আনোয়ারার স্বামী হয়ে। মানুষের কাছে ক্ল্যাসিক উপন্যাসের আবেদন সব সময় পৃথক, অভিনয়শিল্পী যখন সেই উপন্যাসের চরিত্রের প্রতি সুবিচার করে, মানুষ তখন সেই কুশীলবে মুগ্ধ ও মগ্ন হয়ে যায়।

নায়করাজকে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত দর্শক দারুণভাবে গ্রহণ করেন পরিচালক জহির রায়হানের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’–এর মাধ্যমে। গণ–অভ্যুত্থান এবং আইয়ুব খানের সামরিক শাসন নিয়ে প্রবলভাবে রাজনৈতিক বক্তব্যসমৃদ্ধ এই ছবিতে রাজ্জাককে পরাধীন দেশের একজন সচেতন নাগরিক ফারুক চরিত্রে দেখা যায়। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির এই চলচ্চিত্রকে ‘বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী চলচ্চিত্র’ বলে অভিহিত করেন।

রাজ্জাকের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়নি। তারপর ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’ অথবা আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘জুলেখা’ চলচ্চিত্রে রাজ্জাককে মানুষ খুঁজে নেয় নতুনভাবে। আবার ‘নীল আকাশের নিচে আমি’ গেয়ে গেয়ে সুদর্শন রাজ্জাক ‘মামুন’ চরিত্রে কবরীর প্রেমে বিভোর হোন রোমান্টিকধর্মী ‘নীল আকাশের নিচে’ চলচ্চিত্রে। রাজ্জাক-কবরী জুটি দর্শকনন্দিত হয়, আর রাজ্জাক ‘প্রেমের নায়ক’ হিসেবে দর্শকের মানসপটে শক্ত জায়গা করে নেন এ–যাত্রায়।

পরিণত বয়সে নায়করাজ রাজ্জাক
ছবি: প্রথম আলো

তবে নায়করাজকে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত দর্শক দারুণভাবে গ্রহণ করেন পরিচালক জহির রায়হানের কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’–এর মাধ্যমে। গণ–অভ্যুত্থান এবং আইয়ুব খানের সামরিক শাসন নিয়ে প্রবলভাবে রাজনৈতিক বক্তব্যসমৃদ্ধ এই ছবিতে রাজ্জাককে পরাধীন দেশের একজন সচেতন নাগরিক ফারুক চরিত্রে দেখা যায়। বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা আলমগীর কবির এই চলচ্চিত্রকে ‘বাংলাদেশের প্রথম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী চলচ্চিত্র’ বলে অভিহিত করেন। এই চলচ্চিত্র রাজনীতিসচেতন দর্শকের কাছেও নায়করাজকে পৌঁছে দেয় দারুণ অভিনয়শিল্পী রাজ্জাক হিসেবে। এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ে পরিচালক চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রও একটি মাইলফলক। রাজ্জাক তত দিনে মানুষের অনেক কাছের ‘নায়ক’।

রাজ্জাক বলতেই তাঁর এই চিরচেনা নায়কোচিত অভিব্যক্তি ভেসে আসে আমাদের চোখে
ছবি: সংগৃহীত

রাজ্জাক সেই সবকিছুই সিনেমার পর্দায় করে দেখান, যা বাস্তবে মানুষ করতে চেয়ে পারেনি, তাঁর অভিনয় সাধারণ মানুষকে সম্মোহিত করে। নিপীড়িত মানুষমাত্রই নায়ককে নিজের পক্ষের একটা শক্তি হিসেবে দেখতে চায় সিনেমার পর্দায়। রাজ্জাক একাধারে রোমান্টিক সিনেমার নায়ক হিসেবে যেমন সফল ছিলেন, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক চলচ্চিত্রের প্রোটাগনিস্ট হিসেবেও উতরে গেছেন, নিজেকে ঢেলে দিয়ে চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে সফল হয়েছিলেন তিনি। টানা কয়েক দশক ধরে রাজ্জাক তাই দুর্দান্ত প্রতাপের সঙ্গেই সিনেমার পর্দা মাতিয়েছে, টিকে গেছেন এবং আজও প্রাসঙ্গিক রয়েছেন, আছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আলোচনায়।

আদতে বাংলাদেশের মানুষের মনে নায়করাজ রাজ্জাক এখনো এমন একটি নাম, এমন একটি মুখ, যা হয়তো ম্লান হবে না আরও বহু দশক পরেও। জনগণকে তৃপ্ত এবং আমজনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পেরেছিলেন বলেই জনগণ এই অভিনেতার কপালে ‘নায়ক’–এর রাজটিকা পরিয়েছিল।