দস্তয়েভস্কি: মানব-অস্তিত্বের নিখুঁত দ্রষ্টা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

১৮৪৯-এর ২২ ডিসেম্বর। তীব্র শীতের মধ্যে সেন্ট পিটার্সবার্গের পিটার অ্যান্ড পল দুর্গের বন্দিশালা থেকে কয়েকজন রাজনৈতিক বন্দীকে বের করে আনা হয়েছে। আট মাস ধরে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়েছে এদের ওপর। তাদের নিয়ে যাওয়া হলো সেমেনোভস্কি কোয়্যারে, যেখানে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ডের রায় শোনানো হলো তাদের। চাষিরা যেমন পরে, তেমন লম্বা আলখাল্লা পরানো হলো, মাথায় পরানো হলো টুপি। প্রথম তিন বন্দীকে তিনটি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা হলো। তাদের চোখ বাঁধতে গেলে তিনজনের একজন প্রত্যাখ্যান করল, উদ্যত বন্দুকের নলের দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকল সে। গুলি ছোড়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ঊর্ধ্বশ্বাসে ঘোড়া ছুটিয়ে এক বার্তাবাহক এল জারের ফরমান নিয়ে। তিন বন্দীর মৃত্যুদণ্ডের আদেশ রহিত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন জার। আসলে মৃত্যুদণ্ড, ফায়ারিং স্কোয়াড, শেষ মুহূর্তের রায়—সবই ছিল সাজানো এবং বন্দীদের শাস্তিরই অংশ। যে তিন তরুণ কঠিন এই অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, তাদের একজনের চুল রাতারাতি সাদা হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়জন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয়জন কারাভোগ শেষে লিখেছিল এক উপন্যাস, যার নাম ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’। ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি তাঁর নাম।

দুনিয়ায় এমন লেখক হাতে গোনা, যাঁরা সাহিত্যে নতুন কোনো জনরার জন্ম দেন এবং তাঁদের প্রভাব অনুভূত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। ভিক্তর হুগো, লিও তলস্তয়, চার্লস ডিকেন্স, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে আছেন এই দলে। এর বাইরে কিছু লেখক আছেন, যাঁরা কেবল সাহিত্যের নতুন আঙ্গিকেরই কেবল জন্ম দেন না, বহু বিচিত্র বিষয়ে উন্মোচন করেন নতুন দিগন্তেরও। এঁদের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ দস্তয়েভস্কি, যাঁর লেখা কেবল সাহিত্যমহলেই নয়; দার্শনিক ও মনস্তত্ত্ববিদদেরও মধ্যেও দারুণ সমাদৃত। তাঁর সম্বন্ধে ফ্রেডরিখ নিৎশে বলেছিলেন, ‘একমাত্র এই মনস্তত্ত্ববিদের কাছ থেকেই কিছু শিখতে পেরেছি আমি।’ অনেকে বলেন, ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসটির মাধ্যমে অস্তিত্ববাদের জন্ম দিয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি। কামু, কাফকা, সার্ত্রেকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল তাঁর লেখা।

মৃত্যুদণ্ড, ফায়ারিং স্কোয়াড, শেষ মুহূর্তের রায়—সবই ছিল সাজানো এবং বন্দীদের শাস্তিরই অংশ। যে তিন তরুণ কঠিন এই অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে গিয়েছিল, তাদের একজনের চুল রাতারাতি সাদা হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয়জন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয়জন কারাভোগ শেষে লিখেছিল এক উপন্যাস, যার নাম ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’।

জীবনটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না তাঁর, নানাবিধ দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এসব যন্ত্রণা মানব মনস্তত্ত্ব বোঝার ব্যাপারে দস্তয়েভস্কির মধ্যে জন্ম দিয়েছিল সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গির, প্রশ্ন তুলেছিলেন মানব–অস্তিত্ব নিয়েই। জারের রাশিয়ার সমালোচনা করার অপরাধে ফায়ারিং স্কোয়াডে যখন বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়াতে হয়েছিল, দস্তয়েভস্কির মনে হয়েছিল, তাঁর অস্তিত্বের এখানেই সমাপ্তি। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরার সেই দুঃসহ স্মৃতি বাকি জীবন ভুলতে পারেননি। সেদিন নতুন করে জন্ম হয়েছিল তাঁর। এরপর চার বছর সাইবেরিয়ার শ্রমশিবিরে কাটাতে হয়েছে তাঁকে। এসব অভিজ্ঞতা মানবজীবনের সত্যিকারের মূল্য সম্বন্ধে নতুন ভাবনার উদ্রেক করেছিল তাঁর মনে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জীবন ও মৃত্যু নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে ঘোরতর এক অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি আমরা সবাই। কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে মহাকালের অংশ হওয়া থেকে আমাদের আটকে রাখছে অনিশ্চয়তার পলকা একটা সুতো। জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতা রোমান্টিক এক সাদামাটা তরুণকে পরিণত করল কঠোর বাস্তববাদী মানুষে। ধর্মীয় চেতনা গাঢ়তর হলো তাঁর মনে। কারারক্ষকদের নির্মমতা তাঁকে বোঝাল উপযোগবাদী, সমাজতন্ত্রী আর উদারপন্থীরা মানবপ্রকৃতি সম্বন্ধে যে আশাবাদী ধারণা পোষণ করেন, সেটি বাস্তবে সত্যি নয়। দার্শনিকদের ধারণার তুলনায় মানুষের বাস্তব জীবন মৌলিকভাবেই ভিন্ন। তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’ উপন্যাসের সমালোচনা লিখতে গিয়ে দস্তয়েভস্কি লিখেছিলেন, ‘আমাদের সামাজিক-চিকিৎসকেরা যেমন ধারণা করেন, অশুভ তার চেয়ে অনেক গভীরভাবে প্রোথিত মানব–অস্তিত্বে। কোনো সামাজিক কাঠামোই অশুভকে মুছে দিতে পারবে না। মানবাত্মা যেমন আছে, রয়ে যাবে তেমনই। চূড়ান্ত বিচারে মানবাত্মার বিধিবিধানগুলো আসলে আমাদের খুব কম জানা, বিজ্ঞানের কাছে তারা এতই অস্পষ্ট, অসংজ্ঞায়িত আর রহস্যময় যে (ঈশ্বর ছাড়া) কারও পক্ষে এর চূড়ান্ত চিকিৎসক বা বিচারক হওয়া সম্ভব নয়।’

নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরার সেই দুঃসহ স্মৃতি বাকি জীবন ভুলতে পারেননি। সেদিন নতুন করে জন্ম হয়েছিল তাঁর। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জীবন ও মৃত্যু নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে ঘোরতর এক অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি আমরা সবাই। কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে মহাকালের অংশ হওয়া থেকে আমাদের আটকে রাখছে অনিশ্চয়তার পলকা একটা সুতো।

দস্তয়েভস্কির চরিত্রেরা জটিল ও বহু বর্ণিল। তাদের অনিশ্চিত কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য আচরণ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আওতার বাইরেও যে সহজাত একটি মানবমন আছে, তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে সচেতন করে আমাদের। আমরা বুঝতে পারি, কেবল নিজের সুবিধা নিশ্চিত করাই নয়, মানুষের অনেক আচরণের অর্থই সাধারণভাবে দুর্জ্ঞেয়। কখনো কখনো মানুষ নিজেকে শিকারে পরিণত করে স্রেফ নৈতিকভাবে উচ্চ অবস্থানে থাকার জন্য। ‘দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ’ উপন্যাসে ফাদার জোসিমা বলেন, ‘ক্ষুব্ধ বা রাগান্বিত হওয়াটা কখনো কখনো খুবই আনন্দদায়ক।’ এর উত্তরে ফিওদর পাভলোভিচ বলেন, ‘কখনো কখনো এটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় আচরণও।’ চরিত্রগুলোর অনিশ্চিত আচরণ ও মেজাজ–মর্জি দস্তয়েভস্কির এ বিশ্বাসেরই প্রতিফলন ঘটায় যে সে যে ইট-কাঠ-পাথরের মতো সাধারণ কোনো বস্তু নয়, সেটি প্রমাণের জন্য মানুষ যেকোনো কাজ করতে পারে, এমনকি তা আত্মবিধ্বংসী হলেও।

দস্তয়েভস্কির লেখার খাতা
ছবি: সংগৃহীত

‘দ্য হাউস অব দ্য ডেড’ উপন্যাসের কথকের বর্ণনায়, কারাবন্দীরা অনেক সময় আপাতদৃষ্টে কোনো কারণ না থাকলেও হঠকারী আচরণ করতে পারে। কঠিন শাস্তির খড়্গ নেমে আসতে পেরে, এটি জেনেও অযৌক্তিক কোনো কাজ, যেমন কোনো কারারক্ষীকে আক্রমণ করে বসতে পারে। কেন? উত্তর হচ্ছে, অন্যকে বিস্মিত করার সম্ভাবনার মধ্যেই নিহিত আছে মানবীয়তার নির্যাস। ভৌতবস্তুকে প্রাকৃতিক আইনের দ্বারা সংজ্ঞায়িত ও ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু মানুষ ভৌতবস্তু নয়। সে যে এটি নয়, তা প্রমাণের জন্য যত আত্মবিধ্বংসীই হোক, যেকোনো কিছু করার ক্ষমতা রাখে সে।

দস্তয়েভস্কির অভিজ্ঞতা বলে, মানুষকে কারাবন্দী করার মাধ্যমে তার ইচ্ছা ও বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু নির্বাচনের স্বাধীনতাই মানবতার নির্যাস। বন্দী তাই পরিণাম জেনেও প্রহরীকে আঘাত করে তার যে স্বাধীন একটা ইচ্ছাশক্তি আছে, তা প্রমাণের জন্য। নিজের ভালো থাকা, এমনকি নিজের জীবনের চেয়েও এই প্রমাণ করাটিই তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। দস্তয়েভস্কির ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর নামহীন কথক জোর দিয়ে বলেন, ‘মানব আচরণকে নির্ভুলভাবে সংজ্ঞায়িত করার ব্যাপারে সমাজবিজ্ঞানীদের প্রয়াস মানুষকে পিয়ানোর চাবি বানিয়ে ফেলার হুমকির মুখে ফেলেছে।’ তার ভাষায়, ‘কোনো দিন যদি আমাদের সকল আকাঙ্ক্ষা আর ভাবনার মর্মোদ্ধারের ফর্মুলা মানুষ আবিষ্কার করে ফেলে, তাহলে সবাই বুঝবে যে প্রকৃতির আইন মেনে সবকিছু নিজেই নিজেকে পরিচালিত করে। এ আইন সবাই জেনে গেলে মানুষ আর নিজের কাজের জন্য দায়ী থাকবে না। আইনের ধারা মেনে সকল মানব আচরণকে অ্যালগরিদমের সারণির মতো গাণিতিকভাবে বর্ণনা করা যাবে। বিশ্বকোষের মতোই বড় বড় গ্রন্থ লেখা হবে যেখানে এমন নিখুঁতভাবে সবকিছু গণনা ও সংজ্ঞায়িত করা থাকবে যে দুনিয়ায় রোমাঞ্চকর বলে আর কিছু থাকবে না, নির্মিত হয়ে যাবে কল্পরাজ্যের স্ফটিকনির্মিত প্রাসাদ। রোমাঞ্চ থাকবে না, কারণ কোথাও কোনো অনিশ্চয়তা থাকবে না। যেকোনো পরিস্থিতিতে কেবল একটি ঘটনাই ঘটতে পারবে। বিস্ময় থাকবে না কোনো, চমক থাকবে না। এ কথাটিই যুদ্ধ ও শান্তিতে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন তলস্তয়, ‘মানবজীবন পুরোপুরিভাবে যুক্তি দ্বারা পরিচালিত হবে—যদি আমরা এই উপসংহারে উপনীত হই, তাহলে জীবনের সব সম্ভাবনাই ধ্বংস হয়ে যাবে।’ দস্তয়েভস্কি বলেন, এমনটি ঘটলে বেছে নেওয়ার অনিশ্চয়তা বলেও কিছু থাকবে না। থাকবে না অনুতাপ বা অপরাধবোধ, যেহেতু এ দুয়েরই উৎস হচ্ছে এই ধারণা যে যা করেছি তার চেয়ে ভিন্ন কিছু করতে পারতাম। ফলে যা করতেই হবে তার অভিজ্ঞতা পাব বটে, কিন্তু অর্জন করতে পারব না কিছুই। দস্তয়েভস্কির সাহিত্যের মূল নির্যাস এটিই।

কারাবন্দীরা অনেক সময় আপাতদৃষ্টে কোনো কারণ না থাকলেও হঠকারী আচরণ করতে পারে। কঠিন শাস্তির খড়্গ নেমে আসতে পেরে, এটি জেনেও অযৌক্তিক কোনো কাজ, যেমন কোনো কারারক্ষীকে আক্রমণ করে বসতে পারে। কেন? উত্তর হচ্ছে, অন্যকে বিস্মিত করার সম্ভাবনার মধ্যেই নিহিত আছে মানবীয়তার নির্যাস।

দস্তয়েভস্কি চান না, সব বিস্ময় আর অসম্ভাব্যতার রোমাঞ্চকে ঝেড়ে ফেলে ইট–কাঠ পাথর হয়ে যাক মানুষ, যেহেতু এটি মানুষের মানবীয়তাকে কেড়ে নেয়। তাঁর দৃষ্টিতে, অনিশ্চয়তার সম্ভাবনাকে হত্যা করার চেয়ে মানবতার বড় অপমান আর কিছু হতে পারে না। ‘গোটা জীবন প্রাকৃতিক আইনের দ্বারা অসম্মানিত হয়েছি আমি,’ দস্তয়েভস্কির ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যান’ বলে। মানবীয়তার যেকোনো প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করবে মানুষ, তার ধারণা। দস্তয়েভস্কি একবার লিখছিলেন, ‘লোকে আমাকে মনস্তত্ত্ববিদ বলে। এটি সত্যি নয়। আমি স্রেফ এক প্রখর বাস্তববাদী। মানবাত্মার যাবতীয় গভীরতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করি আমি।’

দস্তয়েভস্কি বুঝেছিলেন, মনস্তত্ত্ব বা সমাজতত্ত্ব দিয়ে মানুষের আচরণকে ব্যাখ্যা করার যতো চেষ্টাই করা হোক, তারপরও কিছু একটা রয়ে যায়, এই রয়ে যাওয়া জিনিসটাই প্রকৃত মানবতা। এই অব্যাখ্যেয় মানবতাকেই উদ্‌যাপন করে তাঁর লেখা, যে লেখা আরও সহস্র বছর ধরে উদ্বেলিত করবে অজস্র মানুষকে।