টিনএজার শিক্ষার্থীরা কেন আত্মহত্যা করেন?

এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন হাসিখুশি মুখ দেখা যায়, তেমনি কারও কারও আত্মহত্যার সংবাদও শোনা যায়। কেন এই টিনএজার শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করেন?

শিক্ষার্থীরা ক্রমাগত আমোদ পাওয়ার এক চক্রে আটকে আছেন।ছবি: প্রথম আলো

এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, টেলিভিশনের পর্দা বা পত্রিকার পাতায় হাসিখুশি মুখগুলো দেখে মন জুড়িয়ে যায়। গ্রেডিং পদ্ধতির আগে ফলাফল প্রকাশের দিন মানেই ছিল মিষ্টির দোকানগুলোয় ভিড়। পরীক্ষার্থীরা পাস করলেই পাড়া–মহল্লার বাড়ি বাড়ি পৌঁছে যেত মিষ্টি–মিঠাই। পড়াশোনার ধাপ পেরোনোর উদ্‌যাপন উৎসবে রূপ নিত। এখন উদ্‌যাপনের ঘনঘটা অতটা চোখে পড়ে না বটে, তবে হাসিখুশি মুখগুলো দেখে ভালো লাগে।

নাটোরের লালপুরের মোমো এ বছর পাস করেছিল ঠিকই, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত জিপিএ ফাইভ পায়নি। আর এর পরপরই নিজের ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস নেয় সে। পরিবারের মানুষজন বুঝে ওঠার আগেই একটি ১৬ বছরের জীবনের অবসান ঘটে যায়। জিপিএ ফাইভ না পাওয়ার ব্যর্থতা কেন এত ভারী হয়ে উঠল এই ছোট্ট মেয়ের জন্য, যার জীবন এখনো শুরুই হয়নি?

গেল কয়েক বছরে ভয়াবহভাবে এই আত্মহত্যার প্রবণতা কেবল বাড়তেই দেখছি আমরা। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে স্কুল–কলেজ পর্যায়ে আত্মহত্যা করেছেন ৪৪৬ শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে স্কুল ও সমমানের পর্যায়ে ৩৮০ জন, কলেজ ও সমমানের পর্যায়ে ১০৬ জন এবং শুধু মাদ্রাসার শিক্ষার্থী রয়েছেন ৫৪ জন। এ ছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ৮৬ শিক্ষার্থী আঁচল ফাউন্ডেশনের হিসাবে গত বছর আত্মহননের পথ বেছে নেন। তাদের সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি হেঁটেছেন জীবনাবসানের পথে। এ বছরের সমীক্ষা এখনো আঁচল ফাউন্ডেশন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি। তবে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সংখ্যাটি আনুমানিক ২৩৫। চলতি বছরও কিশোর–তরুণ তথা টিনএজারদের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। আত্মহত্যার পেছনের কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মান–অভিমানই তাঁদের আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। এদের মধ্যে বড় অংশের অভিমান ছিল পরিবারের প্রতি।

বিশ্বজুড়েই ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বিষণ্নতা মহামারির আকার ধারণ করেছে। পশ্চিমা দেশগুলোয় বিষণ্নতার জন্য কাউন্সেলিং বা ওষুধ গ্রহণ এখন স্বাভাবিক ব্যপার। একে একটি সাধারণ স্বাস্থ্যসমস্যা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা তৈরির জন্য নানা প্রচারাভিযানও চলানো হয়। তবে কিশোরদের বিষণ্নতা, মানসিক চাপ কিংবা আত্মহনন প্রবণতার স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়ায় আমরা কি এ সমস্যার আর্থসামাজিক পদ্ধতিগত কারণগুলো এড়িয়ে যাচ্ছি? কেন আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছেন কিশোরেরা?

শিক্ষার্থীরা ক্রমাগত আমোদ পাওয়ার এক চক্রে আটকে আছেন। মুক্ত বাণিজ্য অর্থনীতিতে এখন নিশ্চিত হয়েছে ‘অবাধ তথ্যপ্রবাহ’। ফলে আমরা সবাই সব সময় ডুবে থাকছি এন্তার তথ্য ও ছবির মধ্যে। ডিজিটাল যুগের আগের সময়ে আপনাকে কোনো বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়ার জন্য পত্রিকা, সাময়িকী, বইপত্র পড়তে হতো; কিংবা সরাসরি কথা বলতে হতো মানুষের সঙ্গে। আর এখন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক, ইউটিউব, ভিডিও গেমের সিরিঞ্জ দিয়ে প্রতিনিয়ত ফোঁটায় ফোঁটায় আমোদ ঢুকছে সবার ধমনিতে। বিশেষ করে কিশোরেরা এই আমোদচক্রের বাইরে নিজেদের কোনো অস্তিত্বই আর দেখছেন না। তাই তাঁরা মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা হারাচ্ছেন। আর এই মনোনিবেশ করতে না পারাই তাঁদের যেকোনো কিছুতে খুব দ্রুত নিরুৎসাহিত করে তুলছে।

বিষয়টির জবাব খুঁজে পাওয়া যেতে পারে ব্রিটিশ তাত্ত্বিক ও লেখক মার্ক ফিশারের বইয়ে। মার্ক ফিশার তাঁর বই ‘ক্যাপিটালিস্ট রিয়েলিজম: ইজ দেয়ার নো অল্টারনেটিভ’–এ তুলে ধরেছেন নিজের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা। শিক্ষকতার সুবাদে দীর্ঘদিন কিশোরদের পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছে তাঁর। তিনি লক্ষ করেছেন, শিক্ষার্থীরা ক্রমাগত আমোদ পাওয়ার এক চক্রে আটকে আছেন। মুক্তবাণিজ্য অর্থনীতিতে এখন নিশ্চিত হয়েছে ‘অবাধ তথ্যপ্রবাহ’। ফলে আমরা সবাই সব সময় ডুবে থাকছি এন্তার তথ্য ও ছবির মধ্যে। ডিজিটাল যুগের আগের সময়ে আপনাকে কোনো বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়ার জন্য পত্রিকা, সাময়িকী, বইপত্র পড়তে হতো; কিংবা সরাসরি কথা বলতে হতো মানুষের সঙ্গে। আর এখন ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টিকটক, ইউটিউব, ভিডিও গেমের সিরিঞ্জ দিয়ে প্রতিনিয়ত ক্রমাগত ফোঁটায় ফোঁটায় আমোদ ঢুকছে সবার ধমনিতে। বিশেষ করে কিশোরেরা এই আমোদচক্রের বাইরে নিজেদের কোনো অস্তিত্বই আর দেখছেন না। তাই তাঁরা মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা হারাচ্ছেন। আর এই মনোনিবেশ করতে না পারাই তাঁদের যেকোনো কিছুতে খুব দ্রুত নিরুৎসাহিত করে তুলছে।

বলা বাহুল্য, এই আমোদচক্রের পেছনে বাজার অর্থনীতি তথা পুঁজিবাদের একটি ভূমিকা রয়েছে। আর এই ব্যবস্থায় আমোদভোগী ব্যক্তি যেমন ক্রমেই বিচ্ছিন্ন ও একা হয়ে পড়ছেন, তেমনি পরিবার বা সমাজের সঙ্গে অর্থপূর্ণ যোগাযোগ স্থাপনেও অনেক ক্ষেত্রে সক্ষম হচ্ছেন না এবং এই অক্ষমতা তাঁকে ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক করে তুলছে। ফলে যেকোনো কিছু কিনতে পারা বা ভোগ করাকেই তাঁরা আনন্দ ও সফলতার মাপকাঠি হিসেবে দেখতে শিখছেন।

এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর এমন হাসিখুশি মুখগুলো দেখে মন জুড়িয়ে যায়
ছবি: প্রথম আলো

নব্য উদারনীতির সমাজব্যবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য এখন শিক্ষার্থীদের সুশৃঙ্খল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা নয়, বরং লক্ষ্য পূরণ করা বা ব্যবসায়িক সাফল্য নিশ্চিত করাই মূল হয়ে দাঁড়ায়। বেসরকারি বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী মানেই ভোক্তা—যিনি অর্থের বিনিময়ে সেবা ভোগ করছেন। আবার একই সঙ্গে শিক্ষার্থীর সাফল্যের ওপরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরও ভোক্তা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়া যখন নির্ভর করছে, তখন বিষয়টি যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনার অধীন, তাতে আর কোনো রাখঢাক থাকে না।

প্রায় একই রকম কথা খাটে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও। এই একই মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে পরিবারেও। আর সে কারণেই আমোদচক্রে আটকে থাকা ১৩ থেকে ১৯ বছরের শিক্ষার্থী, যাঁরা ভোক্তা বা ক্রেতা তথা বিনিয়োগ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছেন, তাঁরা সনদকেই স্বীকৃতি মনে করছেন। তাই তাঁদের বেঁচে থাকা বা না থাকার মাপকাঠি হয়ে দাঁড়াতেই পারে একটি পরীক্ষার সনদ।