‘কাবিননামা’ মুসলিম বিবাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলক আইনি দলিল, যা শুধু বিবাহ নিবন্ধনেই সীমাবদ্ধ নয়—এটি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। অনেকটা ইংরেজি ‘সিভিল ম্যারেজ’–এর মতো এই দলিল একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র, যা আরবি ভাষায় পরিচিত ‘আক্দ’ বা ‘নিকাহ্’ নামে।
এই চুক্তির একটি অপরিহার্য উপাদান হলো মোহর—স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রীর জন্য নির্ধারিত একটি আর্থিক মূল্য, যা স্ত্রীর অধিকার হিসেবে বিবেচিত। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী, মোহর সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত থাকে: তাৎক্ষণিকভাবে আদায়যোগ্য অংশকে বলা হয় আশু দেনমোহর বা ‘মুয়াজ্জল’, আর পরবর্তীকালে আদায়যোগ্য অংশকে বলা হয় বিলম্বিত দেনমোহর বা ‘মৌয়াজ্জল’। উনিশ ও বিশ শতকের কাবিননামা দলিলপত্রে মোহরের এই বিভাজনের উল্লেখ সুস্পষ্টভাবে পাওয়া যায়।
১৮৭২ সালে ‘ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট’ প্রণীত হলে রেজিস্টার বইয়ে কাবিননামা নথিভুক্ত করার চল শুরু হয়। ১৯৩৯ সালের মধ্যে কাবিননামা একটি নির্দিষ্ট ফরমের আদলে মুদ্রিত হতে শুরু করে। পরে ১৯৬১ সালের ‘মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ’ কার্যকর হলে এ ব্যবস্থায় নতুন কিছু পরিবর্তন আনা হয়, যদিও সে সময় এ আইন শরিয়াবিরোধী আখ্যায় সমালোচিত হয়।
‘কাবিননামা’ মুসলিম বিবাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বাধ্যতামূলক আইনি দলিল, যা শুধু বিবাহ নিবন্ধনেই সীমাবদ্ধ নয়—এটি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব নির্ধারণেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। অনেকটা ইংরেজি ‘সিভিল ম্যারেজ’–এর মতো এই দলিল একটি আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র, যা আরবি ভাষায় পরিচিত ‘আক্দ’ বা ‘নিকাহ্’ নামে।
ড. দেবীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘দলিল লিখন ও রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মুসলমানদের বিবাহের সময় সম্পাদিত কাবিননামায় স্ট্যাম্প মাশুল দিতে হতো না। এটি ‘সিডিউল ১এ’, আর্টিকেল-৫৮-এর ‘রেহাই’ অংশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। তবে ১৯৫৯ সালের এক রায়ে বলা হয়—শুধু বিবাহ অনুষ্ঠানের সময় সম্পাদিত কাবিননামাগুলোর ক্ষেত্রেই এই স্ট্যাম্প কর মওকুফ প্রযোজ্য হবে। বিবাহের আগে বা পরে যেসব কাবিননামা ‘ঘোষণাপত্র’ (ডিক্লারেশন) হিসেবে তৈরি হয়, সেগুলো স্ট্যাম্পযুক্ত হতে হবে এবং তাতে আর্টিকেল-৫৮ অনুযায়ী স্ট্যাম্প মাশুল প্রযোজ্য হবে।
এই স্ট্যাম্প কর অব্যাহতির বিষয়ে তৎকালীন ‘মহামেডান লিটারারি সোসাইটি’র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কাবিননামায় স্ট্যাম্প কর আরোপের বিরোধিতায় সংগঠনটি একটি প্রতিনিধিদল সরকারের কাছে প্রেরণ করে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতেই সরকার আগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়।
আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গে প্রচলিত কাবিননামাগুলো ভাষা ও কাঠামোর দিক থেকে ছিল বৈচিত্র্যপূর্ণ। এসব দলিল সাধারণত নানা ধরনের স্ট্যাম্প পেপারে লেখা হতো এবং ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে ছিল আরবি, ফারসি ও বাংলা। কখনো কখনো ফারসির পাশাপাশি ইংরেজিতেও কাবিন প্রস্তুত করা হতো। অধিকাংশ কাবিননামায় বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা, দেনমোহরের পরিমাণ, সাক্ষীদের নাম, কাজির সিল ও স্বাক্ষর, রেজিস্ট্রার বা ডেপুটি রেজিস্ট্রারের অনুমোদনসহ অন্যান্য বিবরণ অন্তর্ভুক্ত থাকত।
তবে এসব কাবিননামায় ভাষা, কাঠামো ও শর্তাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য অমিল দেখা যায়, যা সংশ্লিষ্ট পরিবারের আর্থসামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় জ্ঞানের স্তর এবং আঞ্চলিক রীতিনীতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে কিছু দলিল ছিল সুসংহত ও নির্ভুল, আবার অনেক দলিল ছিল বিভ্রান্তিকর, খণ্ডিত ও অসম্পূর্ণ।
কাবিননামায় স্ট্যাম্প কর অব্যাহতির বিষয়ে তৎকালীন ‘মহামেডান লিটারারি সোসাইটি’র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কাবিননামায় স্ট্যাম্প কর আরোপের বিরোধিতায় সংগঠনটি একটি প্রতিনিধিদল সরকারের কাছে প্রেরণ করে। তাদের দাবির প্রেক্ষিতেই সরকার আগের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়।
এই বিশৃঙ্খল অবস্থা দূরীকরণে সৈয়দ মোয়াজ্জম হোসেন ১৯১৯ সালে রচনা করেন তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘কাবিন-নামা’। গ্রন্থটির ভূমিকায় তিনি লেখেন:
‘মুছলমানদিগের বিবাহ রেজিষ্টরী করার আইন প্রবর্ত্তিত হওয়ার পর হইতে প্রায় সর্ব্ব শ্রেণীর মুছলমানদের মধ্যেই বিবাহে কাবিন লিখার প্রথা প্রচলিত হইয়া গিয়াছে। কাবিন লিখার জন্য ভাষা ও শরীয়াতে উপযুক্ত দখল থাকা আবশ্যক...গত ৮ মাস আমি প্রায় ৫০০ কাবিন রেজিষ্টরী করিয়াছি, ইহার মধ্যে ২৫ খানা কাবিনও এরূপ পাই নাই যাহা শুদ্ধভাবে লিখা হইয়াছে।’
এই বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি একটি নির্দেশনামূলক পুস্তিকা প্রকাশ করেন, যাতে বিভিন্ন ধরনের কাবিননামার পাঠ, কাঠামো ও আবশ্যকীয় শর্ত সংকলিত হয়। উদ্দেশ্য ছিল—কাবিন লেখকেরা যেন শরিয়তসম্মত ও নির্ভুল দলিল প্রস্তুত করতে পারেন।
সৈয়দ মোয়াজ্জম হোসেনের গ্রন্থে উল্লেখিত প্রচলিত চারটি মূল শর্ত ছাড়াও আরও কিছু ব্যতিক্রমধর্মী ও সময়োপযোগী শর্ত কাবিননামায় অন্তর্ভুক্ত হতে দেখা যায়, যেমন—
স্ত্রীর পিতৃগৃহে অবস্থানের অধিকার: স্ত্রী ইচ্ছানুযায়ী পিত্রালয়ে গিয়ে দীর্ঘদিন অবস্থান করতে পারবেন; স্বামী এতে বাধা দিতে পারবেন না এবং যাতায়াতসহ প্রয়োজনীয় খরচ বহন করতে বাধ্য থাকবেন।
পারিবারিক ব্যয়ভার: স্বামী শুধু যাতায়াত নয়, বরং স্ত্রীর পিত্রালয়ে অবস্থানকালীন যাবতীয় খরচও বহন করবেন।
বিদেশ অবস্থানে স্ত্রীর ভরণপোষণ: স্বামী বিদেশে থাকলেও স্ত্রীর ভরণপোষণের দায় তারই ওপর বর্তাবে।
দেনমোহর পরিশোধ: দেনমোহরের বাকি অর্থ ওজর ছাড়াই দিতে হবে; ব্যর্থ হলে স্ত্রীর পক্ষে স্বামীর সম্পত্তি বিক্রি করে তা আদায়যোগ্য হবে।
কটু ভাষা ব্যবহার নিষিদ্ধ: স্ত্রীকে গালিগালাজ বা অবমাননাকর শব্দ ব্যবহার করা যাবে না।
তালাকের অধিকার: স্ত্রী প্রয়োজনে নিজেই তালাক গ্রহণ করতে পারবেন এবং এতে স্বামীর আপত্তি আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না।
এমনকি ঘরজামাই প্রসঙ্গেও বিশেষ শর্ত যুক্ত থাকত, যেমন:
ঘরজামাইয়ের শপথ: ‘আমাদের বিবাহ বন্ধন কায়েম থাকা পর্য্যন্ত আমি আপনার জীবন-যাত্রা নির্ব্বাহ করিব; কস্মিনকালেও আপনার পিত্রালয় ছাড়িয়া অন্য কোন স্থানে গিয়া বসত বাস করিতে পারিব না এবং আপনার ও আপনার ওলীর অসম্মতিতে আমি আপনাকে আপনার পিত্রালয় হইতে স্থানান্তর করিতে পারিব না।’
১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কাবিননামার কাঠামো ও আইনি ভিত্তি নিয়ে শুরু হয় গভীর আলোচনা ও পর্যালোচনা। ওই বছরের ৩০ মার্চ ও ১৫ এপ্রিল ‘পাক্ষিক আহমদী’-তে প্রকাশিত ‘বিবাহ ও পারিবারিক আইন কমিশন’-এর প্রশ্নাবলির উত্তরে কাবিননামা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে সর্বসম্মত মত প্রকাশ করা হয়। এ প্রেক্ষিতে কমিশনের পক্ষ থেকে একটি খসড়া নিকাহনামার নমুনা প্রণয়ন করে তা কমিশনের সচিবের কাছে প্রেরণ করা হয়।
তৎকালীন কাবিননামাগুলোতে একটি বিশেষ দিক ছিল দ্বিতীয় বিবাহসংক্রান্ত শর্তাবলি। যদিও ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ সাপেক্ষে একজন পুরুষের একাধিক (সর্বোচ্চ চারটি) বিবাহ বৈধ, তথাপি পূর্ববঙ্গে চালু অনেক কাবিননামায় দ্বিতীয় বিবাহের ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর পূর্বানুমতি আবশ্যক বলে উল্লেখ করা হতো। পরবর্তীকালে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে এই প্রবণতারই প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণ ঘটে। কাবিননামার সামাজিক তাৎপর্য উপলব্ধি করতে গেলে ব্যক্তিগত ও সাহিত্যিক অভিজ্ঞতার দৃষ্টান্তগুলো বিশেষভাবে গুরুত্ববহ। এই প্রেক্ষাপটে আবুল ফজলের গল্প ‘মা’-এর একটি কাবিননামা উদ্ধৃতি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ:
‘প্রথম সর্ত্ত এই যে, শ্রীমতী মজকুরার বিনানুমতিতে অন্য স্ত্রী গ্রহণ করিব না এবং গোপনে কোন উপপত্নি না রাখিব, যদি করি বা রাখি বলিয়া প্রকাশ হয় তবে উক্ত স্ত্রীর উপর তিন তালাক বর্ত্তিবেক।’
যদিও ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ সাপেক্ষে একজন পুরুষের একাধিক (সর্বোচ্চ চারটি) বিবাহ বৈধ, তথাপি পূর্ববঙ্গে চালু অনেক কাবিননামায় দ্বিতীয় বিবাহের ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর পূর্বানুমতি আবশ্যক বলে উল্লেখ করা হতো। পরবর্তীকালে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে এই প্রবণতারই প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণ ঘটে।
উনিশ ও বিশ শতকে কাবিন রচনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ‘মুসাবিদা’। মুসাবিদা অর্থ ‘খসড়া দলিল’। শওকত ওসমানের একটি গল্পে এর উল্লেখ পাওয়া যায়:
‘দেন-মোহর ঠিক হইল। কাবিননামার সাক্ষী ঠিক হইল। মৌলবী সাহেব সভায় পূর্ব্বেই হাজির ছিলেন...কাবিননামার মুসাবিদা পড়া হইল।’
এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, বিবাহপূর্ব আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কাবিননামার খসড়া দলিল—অর্থাৎ মুসাবিদা—সাক্ষীদের উপস্থিতিতে পাঠ ও যাচাই করার রীতি এক সময় প্রচলিত ছিল। এই প্রক্রিয়া কেবল দলিলের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করত না, বরং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও বিধান করত।
ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘নজরুল ইসলাম: কবিমানস ও কবিতা’ গ্রন্থে বর্ণিত একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা কাবিননামার এই সামাজিক তাৎপর্য আরও স্পষ্ট করে তোলে। কাজী নজরুল ইসলামের বিয়ের সময় কাবিননামায় একটি শর্ত রাখা হয়—তিনি কনের পিত্রালয় দৌলতপুর গ্রামে থাকবেন, তবে কনেকে অন্যত্র নিতে পারবেন না। এই শর্ত কবির স্বাধিকার ও আত্মমর্যাদায় আঘাত করায় তিনি বিয়ের আসর ত্যাগ করেন এবং সেই রাতেই পায়ে হেঁটে কুমিল্লায় ফিরে যান। পরিণতিতে সেই বিয়েটি আর সম্পন্ন হয়নি।
কাবিন নিয়ে টানাপোড়েনের আরেকটি চিত্র আমরা দেখতে পাই ১৯১৪ সালে প্রকাশিত মোহাম্মদ নজিবর রহমান রচিত সামাজিক উপন্যাস ‘আনোয়ারা’তে। উপন্যাসের নায়িকা আনোয়ারা ও তার স্বামী নূরুল ইসলামের সংলাপে কাবিনের সামাজিক তাৎপর্য স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। আনোয়ারা স্বামীর উদ্দেশে বলেন:
‘আপনাকে নগদ টাকা-পয়সা কিছুই দিতে হয় নাই, কেবলমাত্র তিন হাজার টাকার কাবিন দিয়াছেন। আমি শুনিয়াছি, আপনি এই কাবিন দিতে অনেক ওজর-আপত্তি করিয়াছিলেন। আমাকে পাওয়া যদি এতই বাঞ্ছনীয় হইয়াছিল, তবে শুধু কাবিন দিতে এত ইতস্ততঃ করিয়াছিলেন কেন?’
জবাবে নূরুল ইসলাম বলেন—
‘কাবিনে বড় ভয় হইয়াছে। বাপজান শেষে আবার বিবাহ করিয়া অর্ধেক তালুক কাবিন দিয়া গিয়াছেন; শুনিতে পাইতেছি মা নাকি সেই সম্পত্তি লইয়া পৃথক হইবেন। তিনি অর্ধেক ও আপনি তিন হাজার আদায় করিলে, কালই আমাকে পথে বসিতে হইবে।’
এই সংলাপ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—কাবিন কেবল একটি আইনি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং তা পুরুষের আর্থসামাজিক নিরাপত্তাবোধ এবং নারীর মর্যাদা ও অধিকারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক জটিল বাস্তবতা। আনোয়ারা উপন্যাসের নায়িকা শেষ পর্যন্ত নিজেই কাবিননামা ছিঁড়ে বিবাহের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন—শুধু স্বামীর দায় লাঘবের উদ্দেশ্যে। এই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই তিনি হয়ে ওঠেন এক প্রতীকী চরিত্র—যুগে যুগে যাঁরা পারিবারিক শান্তি ও পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর চাপ সামলে আত্মোৎসর্গের পথ বেছে নিয়েছেন।
কাজী নজরুল ইসলামের বিয়ের সময় কাবিননামায় একটি শর্ত রাখা হয়—তিনি কনের পিত্রালয় দৌলতপুর গ্রামে থাকবেন, তবে কনেকে অন্যত্র নিতে পারবেন না। এই শর্ত কবির স্বাধিকার ও আত্মমর্যাদায় আঘাত করায় তিনি বিয়ের আসর ত্যাগ করেন এবং সেই রাতেই পায়ে হেঁটে কুমিল্লায় ফিরে যান।
কালের পরিক্রমায় এই সামাজিক অভিজ্ঞতা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলেছে। মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৪-এর অধীন ২০০৯ সালে প্রণীত বিধিমালায় ২৫টি তথ্য সংযুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী সম্প্রতি ফরমের ৫ নম্বর দফার ভাষাগত সংশোধনের মাধ্যমে ‘কন্যা কুমারী’ শব্দবন্ধটি পরিবর্তন করে ‘কন্যা অবিবাহিত’ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা নারীর মর্যাদাবোধ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতি অধিক সংবেদনশীল মনোভাবের প্রকাশ।
একই ধারায়, নিকাহ রেজিস্ট্রারদের (কাজি) শিক্ষাগত যোগ্যতা আলিম থেকে বাড়িয়ে ফাজিল পর্যায়ে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত এবং ইউনিয়ন বা পৌর এলাকায় একাধিক অফিসের পরিবর্তে একটি নির্দিষ্ট অফিস প্রতিষ্ঠার বিধানও প্রস্তাবিত হয়েছে।
ফরমের ২১ নম্বর দফাতেও আনা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন। আগে যেখানে কেবল উল্লেখ থাকত বর অন্য বিবাহে আবদ্ধ হতে সালিসি কাউন্সিলের অনুমতি নিয়েছেন কি না; সেখানে এখন বর অবিবাহিত, বিবাহিত, তালাকপ্রাপ্ত বা বিপত্নীক কি না—এমন তথ্যসহ, বর্তমানে বরের কতজন স্ত্রী রয়েছেন এবং অতিরিক্ত বিবাহের ক্ষেত্রে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী তিনি যথাযথ অনুমতি নিয়েছেন কি না, সেসব তথ্যও অনিবার্যভাবে দিতে হবে।
এই সব ভাষাগত, কাঠামোগত ও নীতিগত পরিবর্তন কেবল প্রশাসনিক সংশোধন নয়—বরং তা নারীর অধিকারের স্বীকৃতি এবং সামাজিক মর্যাদাকে আইনগত কাঠামোর ভেতরে প্রতিষ্ঠিত করার এক সচেতন প্রয়াস। এসব উদাহরণ স্পষ্ট করে যে কাবিননামা সময়ের প্রয়োজনে কেবল ধর্মীয় অনুশাসনের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা এক বহুমাত্রিক সামাজিক বিধিতে পরিণত হয়েছে।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে কাবিননামা আসলে একটি সমকালীন চেতনার দলিল, যা আইনত বাধ্যতামূলক হলেও তার অন্তর্নিহিত স্তরে নিহিত রয়েছে নারী-পুরুষের সম্পর্ক, পারিবারিক মূল্যবোধ এবং সমাজের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের এক অনুপম ধারাবাহিকতা।