সাকিবরা জিতলে কেন সবাই ‘আমরা’ হয়ে যাই

আমাদের মধ্যে অনেক বিভক্তি। অধিকাংশ বিষয়েই একমত হতে পারি না আমরা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা সামনে এলেই ঘটে তেলেসমাতি কাণ্ড; সব বিভেদ ভুলে এক হয়ে যাই দেশের সবাই। কিন্তু কেন?

খেলা ছাড়া আর কে পারে সমস্ত বিভেদ ভুলিয়ে ‘আমরা জিতছি’ বলে পরস্পরকে আলিঙ্গন করাতে?ছবি: এএফপি

বেশ কিছুদিন আগের কথা। এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গেছি। বাংলাদেশ পুরুষ দলের ক্রিকেট খেলা চলছিল। রাত হয়ে যাওয়ায় শেষ কয়েক বল বাকি থাকতেই বিদায় নিলাম। নিচে নামতে নামতে খেলার শেষ বল। বাড়ির সদর দরজায় এক পক্বকেশ বয়স্ক দারোয়ান। কানে রেডিও।

বলটা হতেই ওনার সে কী উল্লাস! শুধু কি তা-ই! আমাকে দেখে উনি বলে উঠলেন, ‘আমরা জিতছি মামা, আমরা জিতছি!’ ওই রকম একটা অবস্থায় নিজেকে খোলসে ধরে রাখা কঠিন। আমিও সেই বৃদ্ধকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘আমরা জিতছি! আমরা...!’

এরপর স্মৃতির মণিকোঠায় বহুবার সেই দারুণ দৃশ্য ধরা দিয়েছে। যে বয়সে লোকটার অবসর যাপনের কথা, সেই বয়সে উনি পরিশ্রম করছেন। মুখের বলিরেখাগুলো যেন বলে উঠছে, ‘তুমি কি দেখেছ কভু, জীবনের পরাজয়’, আর মাথার টুপি আর জীর্ণ অথচ সফেদ পোশাক বলছে, ওনার সমস্ত বিশ্বাস, আবেগ আর অভিযোগ কেবলই মহান সৃষ্টিকর্তার পানে। অথচ এই মানুষটা সামান্য ক্রিকেট খেলা নিয়ে এত উত্তেজিত কেন হলেন? কোন আবেগের ফল্গুধারায় শিহরিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘আমরা!’ আর শ্রেণি কিংবা সামাজিক অবস্থান আর বয়সের ব্যাপক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও সেই ‘আমরা’য় বিলীন হলো দুজন মানুষ!

কী সেই শক্তি! কী সেই প্রেরণা!

ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বেনেডিক্ট এন্ডারসন ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’ বা কল্পিত সম্প্রদায়ের ধারণা দেন। আধুনিক যুগে ছাপাখানা চালু হওয়ার পর কিছু ধারণা, বিশ্বাস ও সাদৃশ্য বিভিন্ন এলাকার মানুষকে এক করে তোলে। এন্ডারসনের ভাষায়, বিভিন্ন রকম অসাম্য ও শোষণ চালু থাকলেও এক গভীর ও আনূভূমিক আপনবোধ এক সুতায় গেঁথে একধরনের সম্প্রদায় তৈরি করে।

এ ধরনের সম্প্রদায় আদি যুগের ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বা গোত্র থেকে আলাদা। এ সম্প্রদায়ের নাম রাষ্ট্র। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রেও একজন সদস্যের পক্ষে বাকি সবাইকে চেনা সম্ভব নয়, যা গোত্রের বেলায় হতো।

আরেকটু পিছিয়ে যদি আমরা চিন্তা করি, তবে আমরা দেখব, মানুষ আসলে এই কল্পিত সম্প্রদায় তৈরি করার ক্ষমতার কারণেই অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা। অন্য প্রাণীদের জীবনের ছক নির্দিষ্ট, কিন্তু মানুষের কল্পনা তাঁকে শক্তি দেয় নানা রকম বিশ্বাসে যুক্ত হওয়ার। ভৌগোলিক, ভাষাগত, ঐতিহাসিকসহ নানা বিষয় মিলে তৈরি হয় একধরনের আপনবোধ। সেখান থেকেই আদি গোত্রভিত্তিক সমাজের বিবর্তন হয়ে আধুনিক রাষ্ট্রধারণার জন্ম।

রাষ্ট্র তো হলো, এই রাষ্ট্র এখন টিকবে কীভাবে? আপনবোধের গভীরতা না থাকলে তো রাষ্ট্রের সঙ্গে এর নাগরিকের সম্পর্ক ঢিলে হয়ে যাবে।

এখানেও মানুষের কল্পনাশক্তি। মানুষ বিশ্বাস করতে ভালোবাসে সে শ্রেষ্ঠ। শুধু তা-ই না, যেহেতু এই প্রাণীর কল্পনা ও চিন্তার ক্ষমতা অতি তীব্র, তাঁকে কোনো না কোনো কিছু আঁকড়ে ধরে থাকতে হয়। স্রেফ একবার ভাবুন তো, আপনি কি পিঁপড়া কিংবা মৌমাছির মতো জীবন কাটাতে পারবেন! একঘেয়েভাবে শ্রম দিয়ে যাওয়া, সময়মতো শীতনিদ্রা দেওয়া, আবার জেগে উঠে খাবারের খোঁজ, এমনকি যৌনসংগমটাও ঋতুর সঙ্গে মিলিয়ে!

আধুনিক পুঁজিবাদ আমাদের ওই জীবনই কাটাতে বলে, মেহনতি মানুষকে শ্রমিক পিঁপড়ার বেশি কিছু ভাবে না। তবে সেই আলোচনা অন্যত্র। এমনিতেই খেলার আলাপে কঠিন কঠিন তত্ত্বকথা চলে আসছে।

কথা হচ্ছে, মানুষের পক্ষে সেই ‘পাশবিক’ জীবন কাটানো সম্ভব নয়। তাঁকে এমন কিছুকে আঁকড়ে ধরতে হয়, যা তাঁর জীবনের চেয়ে দামি। যুগে যুগে মানুষ পরিবার, গোত্র কিংবা ধর্মবিশ্বাসের মতো ব্যাপারগুলোকে এই অবলম্বন পেয়েছে।
রাষ্ট্রকে টিকে থাকতে হলে ঠিক এ জায়গা নিতে হয়। সে তাঁর নাগরিকদের এমনভাবে প্রস্তুত করে, যাতে মনে হয়, রাষ্ট্রের পবিত্রতা জীবনের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা ইত্যাদি বিষয় হয়ে উঠে পবিত্রতার প্রতীক। আর নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার যে মানবপ্রকৃতি, তার জোরে মানুষ বিশ্বাস করে তাঁর দেশই শ্রেষ্ঠ। ‘সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।’

একটা সময় এই শ্রেষ্ঠত্ব কায়েম হতো যুদ্ধের ময়দানে। অপর রাষ্ট্র বা জাতিকে হারিয়ে, পদানত করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার ব্যাপারটা ছিল সুস্পষ্ট। কিন্তু আধুনিক যুগে তো আর তা সম্ভব নয়! তবে!

এখানেই আন্তর্জাতিক খেলাধুলা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এ মঞ্চ কোন দেশ সেরা, তা নির্ধারণ করে দেয়, আসলেই কে শ্রেষ্ঠ। যুদ্ধের জিঘাংসার মুখোমুখিও হইতে হলো না, আবার শ্রেষ্ঠ ভাবার যে প্রবৃত্তি, তাঁরও একটা মীমাংসা হলো।

খেলাধুলা ব্যাপারটাকে গ্রিকরা বলত ‘অটোলেটিক’। যে কাজের আনন্দ কিংবা উদ্দেশ্য কেবল সেই কাজটা করাতেই সীমাবদ্ধ। একজন সাধারণ মানুষ যখন একটা বলে লাথি মেরে আনন্দ পান, সেই আনন্দ সেখানেই সীমাবদ্ধ। একটা ভালো সাহিত্য কিংবা একটা ভালো সিনেমার বেলাতেও তা–ই।

বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, সব প্রাণীর মধ্যেই এ আনন্দ অর্জনের একটা চেষ্টা থাকে। বাড়ির পোষা কুকুর বা বিড়ালটা তো বটেই, ডলফিন, বাঘ, এমনকি হাতিরাও বল নিয়ে খেলে আনন্দ পায়। নানা সময়ে দেখা গেছে, বনের পশুরা শিকারের বাইরেও কেবল বিনোদনের জন্য একে অপরকে তাড়া করে, নানা রকম কসরত করে।

আন্তর্জাতিক খেলাধুলা একই সঙ্গে অটোলেটিক এবং রাজনৈতিক। ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা দেখাটার মধ্যেও একধরনের নিখাদ আনন্দ আছে। এ আনন্দ বহুগুণে বেড়ে যায় মানুষের আদি শিকারি সত্তার কারণে। খেলাধুলায় রাজনীতি টেনে আনবেন না বলে যে বোকা বোকা কথাটা বলা হয়, তার কারণ কিন্তু এই অটোলেটিক প্রবৃত্তি আর আদিম শিকারি সত্তার দুর্দান্ত সংমিশ্রণ। ব্যাপারটা একেবারেই জীবসত্তার বিষয়।

অন্যদিকে ম্যারাডোনা যখন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে গোল করেন, তা কেবল অটোলেটিক থাকে না, তা হয়ে পড়ে ফকল্যান্ড আইল্যান্ড দখলের জবাব। যুদ্ধে হারের শোধ। গ্লোবালাইজেশন আর পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের দুনিয়ায় ব্যাপারটা যদ্দুর সম্ভব ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হলেও রেশটা থাকেই।

রাজনীতি অংশটা বিলীন করা যায় না। দুইটা দেশ যখন পরস্পরের বিরুদ্ধে খেলে, তখন একেবারে স্বতঃস্ফূর্ত জীবসত্তা থেকে উচ্চমাত্রার রাজনৈতিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। মানবজীবনের অনেক কিছুর মতোই এখানে জীবসত্তা, রাজনীতি, ইতিহাসসহ নানা বিষয়ের জটিল মিথস্ক্রিয়া হয়।

এই মিথস্ক্রিয়াও আবার খেলার মতোই। কেউ কেউ হয়তো ক্রিকেট খেলায় কেবল কয় রান হলো, কয় উইকেট পড়ল, এইটুকুই বোঝেন; কেউ হয়তো বোঝেন ইয়র্কার কী, স্ট্রেট ড্রাইভ কোনটা, আবার কেউ কেউ হয়তো প্রতিটা ফিল্ডিং পজিশন মুখস্থ বলতে পারেন। অথচ এই কথা বলার কিন্তু জো নেই যে আমি শুধু রান আর উইকেট বুঝি আর আপনি খেলাটার দিগ্‌গজ পণ্ডিত তাই আপনার থেকে আমি কম আনন্দ পাই, এই নিয়ে আপনার চেয়ে আমার আবেগ কম! ব্যাপারটাই খেলার শক্তি!

দীর্ঘদিন ধরে ক্রিকেট মাঠের প্রেসবক্সে বসে তো আমার প্রায়ই এমন মনে হয়, চাকরির কারণে এই এসি রুমে বসে আমি নাহয় খেলা দেখছি, গাঁটের পয়সা খরচ করে, রোদে পুড়ে, নিজের কর্মঘণ্টা নষ্ট করে কেন মানুষ পাগলের মতো খেলা দেখে?
আজকে যে বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ডের খেলা হবে, তখন কোনো একটা টেলিভিশনের শো রুম বা জনতাকে খেলা দেখাচ্ছে, এমন কোনো জায়গার সামনে গিয়ে দেখেন তো কতজন রিকশাচালক কাজ বাদ দিয়ে খেলা দেখছেন? কতজন দিনমজুর, মেহনতি মানুষ!

দিনের ইনকাম লস দিয়েও এই আপাত অর্থহীন কাজের কারণ মানুষ আনন্দ পেতে চায়, মানুষ নিজেকে শ্রেষ্ঠ তথা জয়ী হিসেবে দেখতে চায়। শুধু তা–ই নয়, সেই আনন্দ সে গোষ্ঠীর সবার সঙ্গে ভাগ করতে চায়। এই আকাঙ্ক্ষা তার জীবনের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে। আর তাই জিতলে সে দুনিয়াছাড়া আনন্দ করে, হারলে ভেঙে পড়ে।
ব্যাপারটা এক হিসাবে প্রবঞ্চনা। আদতে এই মেহনতি মানুষগুলোকে ভুলিয়ে রাখার নেশা। আকাঙ্ক্ষিত গ্রামের শ্যামলিমায় মনের আনন্দে খেলে বেড়ানোর মানবিক স্বপ্নের বদলে কংক্রিটের জঙ্গলে সাজানো বিনোদনে সম্মোহিত করে ধোঁকাবাজি।

কিন্তু খেলা ছাড়া আর কার সেই অসীম ক্ষমতা আছে অনুভূতির তীব্রতম স্তরে আঘাত করে এক অনির্বচনীয় আপনবোধ তৈরিতে?

খেলা ছাড়া আর কে পারে এভাবে সমস্ত বিভেদ ভুলিয়ে ‘আমরা জিতছি’ বলে পরস্পরকে আলিঙ্গন করাতে? এক অপরিচিত যুবক আর বৃদ্ধ দারোয়ানের যৌথ আনন্দ–অশ্রু ঝড়াতে?

ইতিহাস সাক্ষী, খেলা যেমন মানুষকে বুঁদ করিয়ে রাখে, এই ‘আমরা জিতছি’র অনুভূতি একবার দাবানলের মতো ছড়িয়ে গেলে, তা দেবালয়ও গ্রাস করে ফেলতে পারে।