নাসরীন জাহান: ‘উড়ুক্কু’ এবং অতঃপর

আজ কথাসাহিত্যিক নাসরীন জাহানের ৬০তম জন্মদিন। ‘উড়ুক্কু’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে পাঠককে নতুন এক জগতের বাসিন্দা করে তোলেন এই লেখক। কেন ‘উড়ুক্কু’ উপন্যাসটি ভালো লাগে, নাসরীন জাহানের জন্মদিনে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই প্রজন্মের এক লেখক।

নাসরীন জাহানের ছবি অবলম্বনে কোলাজ

তখন সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। নতুন করে প্রাতিষ্ঠানিক চাপ শুরু হয়ে যাওয়ার আগেই পড়ে শেষ করব বলে সাজিয়ে নিয়েছি একরাশ গল্প, উপন্যাস। স্কুলজীবনের ইংরেজি শিক্ষক, যিনি আমার পাঠচর্চার গুরুও বটে, একদিন নানান আলাপের মাঝখানে বললেন, ‘তোমার পাঠের তালিকায় “উড়ুক্কু” যোগ করে নাও।’ আমি বললাম, ‘তথাস্তু’! সেই প্রথম, আমার পড়ার টেবিলে, বিছানার শিয়রে, বইয়ের তাকে শব্দের শরীর নিয়ে আবির্ভূত হলেন নাসরীন জাহান।

পড়তে শুরু করলাম ‘উড়ুক্কু’। উপন্যাসটি আমার তত দিনের পাঠের পৃথিবী থেকে আলাদা, এমনকি আলাদা আমার চেনা চারপাশ থেকেও। গদ্যই তো পড়ছি আমি, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন শেষ না হওয়া কোনো কবিতা, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। শব্দের সুষমায় যে দৃশ্য তিনি আঁকছেন, আমার পড়ার ঘরের দেয়ালে তারই মূর্ত ছবি দেখছি যেন; তিনি বর্ণনা দিচ্ছেন অমসৃণ গলির; আর আমার ভেতর ভ্রম তৈরি হচ্ছে, এই শোবার ঘরের জানালা দিয়ে তাকালেই সেই গলি আমি স্পষ্ট দেখতে পাব। চরিত্রের মনোজগতের চলাচল বর্ণনায় যে আশ্চর্য উপমার ব্যবহার তিনি করেন, আমার সেই বয়সেও এটুকু স্পষ্ট বুঝতে পারি, এই মুনশিয়ানা অভিনব; আমার অন্য অন্য পাঠের চেয়ে আলাদা এর সুর।

উপন্যাসটি আমার তত দিনের পাঠের পৃথিবী থেকে আলাদা, এমনকি আলাদা আমার চেনা চারপাশ থেকেও। গদ্যই তো পড়ছি আমি, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন শেষ না হওয়া কোনো কবিতা, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। শব্দের সুষমায় যে দৃশ্য তিনি আঁকছেন, আমার পড়ার ঘরের দেয়ালে তারই মূর্ত ছবি দেখছি যেন; তিনি বর্ণনা দিচ্ছেন অমসৃণ গলির; আর আমার ভেতর ভ্রম তৈরি হচ্ছে, এই শোবার ঘরের জানালা দিয়ে তাকালেই সেই গলি আমি স্পষ্ট দেখতে পাব।

আমার কাছে নাসরীন জাহানের বার্তা বয়ে নিয়ে এল ‘উড়ুক্কু’; কিন্তু আমি জেনে গেলাম, লেখক-পাঠকের এই যূথবদ্ধ ভ্রমণ চলতেই থাকবে। এরপর ক্রমেই আমার বয়স বাড়তে থাকল, জীবনের সঙ্গে যুক্ত হলো হরেক মানুষ, একাধিক প্রতিষ্ঠান।

সময়ের নিয়মে, জীবন থেকে ঝরেও পড়ল কত কী! জীবনে ক্রমবর্ধমান অভিজ্ঞতা আর আংশিক-সম্পূর্ণ অন্যান্য পাঠের সঙ্গে বেশ বিরতি দিয়েই পড়েছি নাসরীন জাহানের সাহিত্য। আর জেনেছি, চরিত্রকে কোনো আরোপিত শিকলে বাঁধেন না এই কথাশিল্পী; বরং চরিত্রকে নির্মাণ করেন গভীর মমতায়, রক্তে-মাংসে-প্রেমে এবং নিজেরই সঙ্গে নিজের দ্বন্দ্বে।

গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লিটাসের বাণী হিসেবে জেনেই, একটা চমকে ওঠার মতো কথা পড়েছিলাম; ‘নো ম্যান এভার স্টেপস ইন দ্য সেম রিভার টুয়াইস, ফর ইটস নট দ্য সেম রিভার অ্যান্ড হি ইজ নট দ্য সেম ম্যান,’ যার অনুবাদ করলে দাঁড়াতে পারে এমন: একই নদীতে একই ব্যক্তি দুবার নামতে পারেন না। কারণ, সময়ের অভিঘাতে, ততক্ষণে সেই ব্যক্তি এবং নদী উভয়ই, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি আর নদীতে পরিণত হয়েছে। আমি যখন প্রথম নাসরীন জাহানকে পড়েছি, তখন আমি কৈশোর পেরোনোর পথে। আমি জানি, আজকে বসে যখন আমি তাঁকে পড়ি, তখন নতুন এক অভিজ্ঞতা হয় আমার।

তাই লেখকের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ হই পাঠ করার আনন্দে; লেখকের প্রতি আমি আবারও কৃতজ্ঞ হই পুনঃপাঠের আনন্দে। লেখকের সঙ্গেই আমি সেই ভূখণ্ডে ভ্রমণ করতে সমর্থ হই, যেখানে আমার কখনো অস্তিত্ব ছিল না; কেবল লেখকের কারণেই আমরা সেই সময়কে দেখতে পাই, যেখানে আমরা কোনো দিন যেতে পারিনি।

আজ নাসরীন জাহানের ৬০তম জন্মদিন। এদিনে অভিবাদন জানাই বিদগ্ধ সাহিত্যস্রষ্টা নাসরীন জাহানকে। অভিবাদন জানাই তাঁর দীর্ঘ কর্মময়তাকে, তাঁর সৃষ্টির সুকুমার তৃষ্ণাকে। আপনার সবকিছুই শুভ হোক।