মাজহারুল ইসলাম: পরিবেশসচেতন স্থাপত্যের পুরোধা
আমাদের এই অঞ্চলের প্রথম প্রশিক্ষিত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। এককভাবে এখানে তিনি আধুনিক স্থাপত্যের প্রবর্তনের পাশাপাশি সংহত করেছিলেন। এই স্থপতির জন্মদিন সামনে রেখে তাঁর স্থাপত্যভাবনার স্বরূপ অন্বেষণ।
সম্প্রতি যেসব বিষয় বিশ্ব স্থাপত্যের আলোচনায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে, তার বহু কিছুই বেশ আগে থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আলোচ্যসূচিতে ছিল, যার একটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের অন্যতম, যেখানে গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র মিলিত হয়েছে। আর তা হয়েছে মূলত অগ্রগণ্য স্থপতি মাজহারুল ইসলামের কারণে। ১৯৫০-এর দশকে কর্মজীবনের শুরু থেকেই তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন জলবায়ুসংবেদনশীল স্থাপত্য, ঔপনিবেশিক চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসা, সামাজিক অংশগ্রহণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে। এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও মাজহারুল ইসলামের কাজ খুব কমই পরিচিত, এমনকি এই ভারতীয় উপমহাদেশেও। বিশ্ব স্থাপত্যের মানচিত্রে এই ফাঁকা জায়গাটির নিরসন করা প্রয়োজন।
মাজহারুল ইসলাম (১৯২৩-২০১২) ছিলেন আজকের এই বাংলাদেশ অঞ্চলের প্রথম প্রশিক্ষিত স্থপতি। তিনি এককভাবে এখানে আধুনিক স্থাপত্যের প্রবর্তনের পাশাপাশি সংহত করেন। তাঁর নিজের কাজগুলো দিয়ে তো বটেই, পাশাপাশি লুই কান, পল রুডলফ ও স্ট্যানলি টাইগারম্যানদের মতো তৎকালীন পশ্চিমের আধুনিক স্থাপত্যের নায়কেরা যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিকাশ লাভ করেছিলেন, তাতেও ইসলাম সাহেবের সরাসরি অবদান রয়েছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের বর্তমান স্থাপত্যচিত্রে তাঁর প্রভাব সুস্পষ্ট। তাঁর ইতিহাস, ভূগোল ও সমাজ থেকে সযত্ন নেওয়া দৃষ্টিভঙ্গির প্রাসঙ্গিকতা মহাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে।
মাজহারুল ইসলামের বেড়ে ওঠা পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপের শিরা-উপশিরার মতো নদীনালার মধ্যে। ১৯৪০-এর দশকে তিনি কলকাতায় প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক হন। সেই সময়ই তিনি নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাশাপাশি মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় প্রভাবিত হন। রবীন্দ্রনাথ এবং বাঙালি রেনেসাঁর ভিত্তি ছিল আলোকিত অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ, স্থানীয় ও বৈশ্বিক দিকগুলোর পাশাপাশি অতীত ও বর্তমানের মধ্যে ভারসাম্য অর্জনের লক্ষ্যে যা সারা বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ‘ঘরে–বাইরে’র (১৯১৬) মতো বইয়ের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের সামাজিক রূপান্তরের ধারণায় না ছিল প্রাদেশিক পশ্চাদপসরণ, না ছিল সর্বজনীন নীতিগুলোর অন্ধ আত্তীকরণ। বরং তাঁর ধারণার মূলে ছিল ‘দুটোই এবং আরও’ পদ্ধতি অবলম্বন করা। মাজহারুল ইসলাম তাঁর সমসাময়িকদের আন্তর্জাতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘তোমাকে একাধারে হতে হবে বাঙালি ও বিশ্বমানব, অন্যথায় সম্ভব নয়...’ ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বিভাজনে সেতুনির্মাতা হিসেবে মাজহারুল ইসলাম সমাজ ও স্থাপত্য আলোচনার মধ্যে উভয় অর্থেই একটি কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করেছেন।
বিশ্বপল্লী ও জ্ঞানের আধার
মাজহারুল ইসলাম যখন আবাসন ও নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশ্বপল্লীর কথা বলেছেন, তখন তিনি আসলে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বদৃষ্টিরই প্রতিধ্বনি করেছেন। আলগা ও গুচ্ছের মতো প্যাভিলিয়ন–সমন্বিত উঠান মাজহারুল ইসলামের অনেক নকশাতেই দেখতে পাওয়া যায়, যা একাধারে বসবাস ও কাজের জায়গা হিসেবে কাজ করে, আর তার পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে একটি প্রতিবেশীসুলভ গ্রামমণ্ডলী গঠন করে। একটি বাগানে স্বাচ্ছন্দ্য বসানো বাংলোর ক্ষেত্রেও একই কথা। প্যাভিলিয়নগুলো তাদের যথাযথ অভিযোজনের কারণে উষ্ণ ও আর্দ্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুর জন্য আরামদায়ক এবং তার জন্মভূমির সম্প্রদায়গতভাবে সংগঠিত গ্রামীণ কাঠামোর সামাজিক মূল্যবোধ—এই দুই বিষয়েই মাজহারুল ইসলাম সব সময় সচেতন ছিলেন। আবদ্ধ ইতালীয় অলিন্দ বা উত্তর আফ্রিকার অভ্যন্তরীণ প্রাঙ্গণের বিপরীতে মাজহারুল ইসলাম সাহেব বাঙালি আঙিনার ধারণাকে আত্তীকরণের মূর্ত স্থানিক নীতি হিসেবে দেখেছেন, যা সম্পূর্ণভাবে রুদ্ধ না হয়েও সুরক্ষা ও স্বাতন্ত্র্য দেয়। তিনি নিঃসন্দেহে সচেতন ছিলেন যে এই সমাজের যেমন সুদৃঢ় রূপান্তর দরকার, তেমনি দরকার দূরের জায়গাগুলো থেকে প্রগতিশীল ধারণা অন্তর্ভুক্ত করা।
১৯৪৭-৪৮ সালে, ভারতীয় উপমহাদেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয় এবং উত্তাল অস্থিরতার মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান আলাদা হয়। ১৯৪০-এর দশকে কলকাতায় দুর্ভিক্ষের মতো ঘটনাগুলো সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ ও কার্ল মার্ক্সের সঙ্গে মিলে মাজহারুল ইসলামের সামাজিক সাম্যের ধারণা এবং বাংলাদেশের মুক্তির অঙ্গীকারের পেছনের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে মাজহারুল ইসলাম দেশের বাইরে পা রাখেন। একটি বৃত্তি তাঁকে স্থাপত্য অধ্যয়নের সুযোগ দেয়, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানে যা অসম্ভব ছিল। স্থাপত্য, যা কিনা কেবল ভবনের প্রযুক্তিগত দিকগুলোই নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধও অন্তর্ভুক্ত করতে পারে—মাজহারুল ইসলামের কাছে তা সমাজ পরিবর্তনের উপযোগী হাতিয়ার বলে মনে হয়েছে। ওরেগনে স্নাতক শেষ করে তিনি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং এ দেশের সেবায় এই গাঙ্গেয় বদ্বীপে প্রথম আধুনিক ভবন নির্মাণ করেন।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আধুনিকতার পথিকৃৎ
১৯৫৩–৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মাজহারুল ইসলামেরই নকশা করা লাইব্রেরি ভবনের সমান্তরালে নির্মিত চারুকলার অগ্রগামী ভবন কমপ্লেক্সটিকে তাঁর প্রাথমিক কর্মদর্শনের দৃষ্টান্ত বলা যায়। সর্বজনীন আধুনিক রীতি অনুসারে ধারণকৃত ভবনটির সাদা কাঠামোর কঙ্কাল মিশে গেছে তাঁর স্বদেশের স্পর্শসংবেদী নির্মাণ–ঐতিহ্যের সঙ্গে। এই সংকর পদ্ধতি, যা গোঁড়া আধুনিকতার ওপর জোর না দিয়ে বরং স্থানিকতার আশ্রয় নেয়—আর্ট কলেজটিকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আধুনিকতার একটি মূল কাজ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। মাজহারুল ইসলামের পরবর্তী কাজগুলোয় ভূমিকা রাখার মতো অনেক কিছুরই সূচনা এই ভবন থেকে হয়েছে যেমন স্থানীয় নির্মাণ, সমাজ ও জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য ধারণ করা জ্যামিতিক পরিসর।
ল্যান্ডস্কেপ ও শহর সমান গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর নকশায়। উন্মুক্ত পরিসরবিন্যাস যেমন পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলে সহায়তা করে, পাশাপাশি ব্যবহারকারীর ও পরিপার্শ্বের ভেতর ল্যান্ডস্কেপ আর শহরের প্রাণবন্ত বিনিময়কেও উৎসাহিত করে। মাজহারুল ইসলামের লক্ষ্য ছিল স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের সংরক্ষণ ও বিকাশ, যেখানেই সম্ভব প্রাঙ্গণের কোনো গাছ না কাটা এবং এই বদ্বীপের সর্বত্র বিরাজমান পানিকে পুকুরের আকারে নকশায় অঙ্গীভূত করা। মাজহারুল ইসলামের নকশায় আধুনিকতার যুক্তিবাদী স্থাপত্যের প্রবাহ শুরু হয়, কয়েক দশক পর ক্রিশ্চিয়ান নরবার্গ শুলজের মাধ্যমে একটি আলোচনা শুরু হয়, যাঁকে তিনি বলেন, ‘জিনিয়াস লোকাই’। ইতিমধ্যেই ১৯৫০-এর দশকে স্থানিকতাভিত্তিক উন্নয়ন ছিল মাজহারুল ইসলামের জন্য মুখ্য প্রভাবক।
এই ভবনের সামনের দিকের শেষ মাথা কলেজের কার্যাবলিকে ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গে শহুরে রাস্তার পরিবেশে একটি যোগ্য সম্বোধন এবং উপযুক্ত মনুমেন্টালিটি প্রদান করে, শ্রেণিকক্ষের সরু উইংগুলো আলতোভাবে আশ্রয় নেয় ছায়াময় গাছপালায়। ভবনটি হয়ে ওঠে শহুরে ও গ্রামীণ পরিবেশের মধ্যে একটি মধ্যস্থতাকারী। এভাবে মাজহারুল ইসলাম শিল্প ও প্রকৃতির আধুনিক অন্তর্বিরোধের মীমাংসা করেন।
সংলাপ যখন প্রতিরোধ
এটা আপাতবিরোধী মনে হতে পারে যে চারুকলা ভবনের মতো একটি জলবায়ুসংবেদনশীল কাজ শেষ করার পর মাজহারুল ইসলাম লন্ডনে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় স্থাপত্যের ওপর কোর্সে অংশ নেন। স্পষ্টতই তিনি একাডেমিকভাবে তাঁর জ্ঞানকে একীভূত করার জন্য এবং একজন অপরিচিতের দৃষ্টিতে বৈশ্বিক দক্ষিণ সম্পর্কে অন্যদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। উপনিবেশ–পরবর্তী ধাক্কাকে যতই প্রতিরোধ করুন না কেন, মাজহারুল ইসলাম সাহেব সচেতন ছিলেন যে আত্মবিচ্ছিন্নতা বা ঝাপসা দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তা এড়ানো সম্ভব নয়। ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য পাশ্চাত্য–প্রধান আলোচনাকেও সমান গুরুত্বে দেখতে হবে।
এই ধারণাসংগত দৃষ্টিভঙ্গি চূড়ান্ত হয়েছিল লুই কান, পল রুডলফ, স্ট্যানলি টাইগারম্যানের মতো পশ্চিমা নায়কদের আমন্ত্রণের মাধ্যমে, যাঁদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে ইয়েলে অধ্যয়নের সময়। তাঁদের সঙ্গে মাজহারুল ইসলামের মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এর মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেন যে উত্তর ঔপনিবেশিক দেশগুলো আর পশ্চিমা হুকুমের অধীন নয়, বরং নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে এবং যৌথভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎ গঠন করতে পারে।
মাজহারুল ইসলাম নিঃস্বার্থভাবে এবং দূরদৃষ্টির সঙ্গে লুই কানকে একটি দায়িত্বভার দেন, যার প্রস্তাব মূলত তিনিই পেয়েছিলেন। এভাবে তিনি আধুনিকতার সবচেয়ে বহুমুখী উন্নয়নের একটি নির্মাণের পথ প্রশস্ত করেছিলেন, আর সেটি হলো ঢাকার সংসদ ভবন। তিনি উদারভাবে দেখিয়ে গেছেন, কীভাবে স্থাপত্য কখনোই একক ব্যক্তির কাজ নয়, বরং প্রকৃত অগ্রগতি স্বদেশ ও বিদেশ এই দুইয়ের সমন্বয়েই করতে হবে।
ইয়েল থেকে ফিরে আসার পর ইসলাম সাহেব তাঁর অফিস ‘বাস্তুকলাবিদ’–এ প্রাথমিকভাবে চারুকলার মতো মুক্তভাবে দাঁড়ানো প্যাভিলিয়নকে একটি মৌলিক প্রকার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের নতুন ভবন (১৯৬৫-৬৯) আধুনিক বাংলোকে আসল বাঙালি কুটিরের আদর্শ সঙ্গী হিসেবে উপস্থাপন করে। সেটি ছিল লম্বা লম্বা পায়ের ওপর দাঁড়ানো টুপির মতো আবৃত কংক্রিটের কাঠামো। এতে তাঁর মার্কিন শিক্ষকদের প্রভাব স্পষ্টভাবে ও সরাসরি প্রকাশিত। বিপরীতে মাজহারুল ইসলাম কীভাবে তাঁর অতিথিদের বাংলার স্থাপত্য, নৈসর্গিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং নতুন সাংস্কৃতিক অঞ্চলে তাদের যাত্রাকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেটিও উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। এই বদ্বীপে তাঁদের নকশার ভাষা আর ইসলাম সাহেবের নকশার ভাষা যে সমান্তরাল, তা সুস্পষ্ট। জলবায়ু এবং সামাজিকভাবে ভবনগুলো অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক এবং তারা আরও সর্বজনীন বিমূর্ততা প্রকাশ করে।
বাতাস নিয়ে নকশা
মাজহারুল ইসলামের ওপর অর্পিত বৃহত্তর কর্মভারগুলোর মধ্যে একটি পরিবর্তন স্পষ্ট হতে শুরু করে, যা স্বতন্ত্র একক ফাংশনের বাইরে চলে যায় এবং তাকে কঙ্কালের মতো প্যাভিলিয়নের ধরন থেকে সরে আসতে হয়। এ ক্ষেত্রে তিনি ভবনগুলোকে আলগা স্বতন্ত্র ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করার পরিবর্তে, সমাজসেবায় আরও জোরালোভাবে স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন।
তাঁর এ অবস্থান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৫-৭১) এবং সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৯৬৭-৭১) মাস্টারপ্ল্যানে গভীরভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলো ধরনের ফর্মের জলবায়ুগত সুবিধাগুলো অগ্রাহ্য না করে, তার অনুসন্ধান পরবর্তীকালে প্রধান ফর্মগুলোর ওপর দৃষ্টি নিবন্ধন করে, যা কিনা তাদের শহুরে প্রভাবের কারণে নতুন পরিচয় তৈরি করতে পারে। সবুজ মাঠের মধ্যে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয় দুটির জন্য এটি একটি নতুন দিক ছিল। যদিও প্রাথমিকভাবে উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনগুলো বিস্তৃত সবুজ ঘাসের মধ্যে বড় বড় প্যাভিলিয়নের আদলে বসানো বলে মনে হয়, তবে পুনরাবৃত্তি এবং নিবিড় বিন্যাস আলাদা কিছুই তৈরি করে; একক হচ্ছে সমষ্টির অধীন। তারপরও ছাত্র ও শিক্ষকদের পরিচালনাযোগ্য নৈকট্যে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।
কমিউনিটি ভবনের আঙিনাগুলো ছাড়া অবস্থানের জলবায়ু এবং টপোগ্রাফিক দিকগুলো নকশার ধাঁচ তৈরি করে। বদ্বীপীয় শীতল মনোরম দখিনা বাতাস এ ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। মেঝের পরিকল্পনা ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ফিনিশিংয়ে এবং সৌকর্য রক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে দৃঢ় জ্যামিতিক ছাঁচের মোটিফ, প্রথম নজরে এর পেছনে নান্দনিক অনুপ্রেরণা আছে বলে মনে হতে পারে। কারণ যা-ই হোক, ঘনিষ্ঠ পরিদর্শনে এদের আরও হৃদয়গ্রাহী লাগে।
চট্টগ্রামের ঢেউখেলানো ভূখণ্ডে শুধু বায়ুপ্রবাহের দিকই নয়, ভূসংস্থানও একটি নির্ধারক হিসেবে কাজ করেছে, যার পরিণতি দেখা যাবে উইংগুলোর জন্য চিত্তাকর্ষক ছেদবহুল সোপানের সমাধানে, যেগুলো ঢালুর দিকে এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে। সাভারের স্থাপত্যে মৌলিক বর্গাকার গ্রিডকে ৪৫ ডিগ্রি ঘোরানো হয়েছে, যেন আঙিনার সব উপাদান সূর্য ও বাতাসের আদর্শ দিক অনুসারে সাজানো থাকে। বাতাসের অবাধ প্রবাহের উপযোগী উত্তর-দক্ষিণের নিবিড় সন্নিবদ্ধতা, যা সরাসরি ব্লকগুলোর ঘোরানো পরিধির মুখোমুখি গিয়ে পড়ে, বয়ে চলে কৌণিক প্রান্তওয়ালা লম্বাটে মেঝের পরিগঠনের দিকে। ঘেরা বারান্দা আর আলাদা করা প্রবেশতোরণ প্রজাপতি আকারের ছাত্রাবাসে দারুণ ছন্দ তৈরি করে। আরেকটি বিশেষ আকর্ষণীয় উপাদান হলো, ক্যাম্পাসের উত্তরে কর্মচারীদের ভবনগুলোর মধ্যে প্ররোচিত জ্যামিতিক সংঘাত। উত্তর-দক্ষিণের ঘন শিয়ার ওয়ালের সমারোহ মূল জ্যামিতিক প্রসারকে ছেদ করেছে, যা স্থানীয় দালানকোঠার ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত। ফলে তা একটি প্রভাব বিস্তারের সম্ভাবনা তৈরি করে। দক্ষিণের শীতের বাতাসকে যথাযথ ব্যবহার করার জন্য ভবনের ইটের দেয়ালে অসংখ্য ফাঁক আর জোড়া রয়েছে। জানালা খোলা থাকা অবস্থায় ভেতর থেকে বাইরে পর্যন্ত শিয়ার ওয়ালগুলোর উল্লম্ব দৈর্ঘ্য স্নিগ্ধ ছায়ার সঞ্চার করে, বর্ষাকালে দেয় সুরক্ষা। দেয়ালগুলো নিশ্চিত করে যে উল্লম্বভাবে সংগতিপূর্ণ দালানগুলো ক্যাম্পাসের সবুজ গাছপালাকে তার পরিসর দিয়ে আলিঙ্গন করে রেখেছে।
স্থাপত্যে নিহিত বিশ্বাস
উত্তরঙ্গে জয়পুরহাটের শ্রমিকদের জন্য আবাসন (১৯৭৮-৮৪) জাতীয় ১৯৬০-৮০-এর দশকে সম্পন্ন অন্যান্য ডিজাইনের মতো সাভারের ভবনগুলো তুলে ধরে যে মাজহারুল ইসলাম তাঁর মৌলিক ডিজাইনের নীতিকে কত গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। এক ঢিলে তাঁকে অনেক পাখি মারতে হতো এবং তিনি স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা মাথায় রাখতেন। তাঁর ভাবনায় জলবায়ুগতভাবে অনুপ্রাণিত সহজ প্রযুক্তির নকশার সঙ্গে মিশেছে স্থানিক প্রেক্ষাপট এবং সর্বজনীন প্রাসঙ্গিকতা। জলবায়ু, পরিসর ও সমাজের দিকগুলো মীমাংসা করা হয়েছে একটিই উপায়ে, তা হলো জ্যামিতিক উপায়। এই স্থপতি যে সংবেদনশীল উপায়ে নগর-পরিকল্পনার সন্নিবেশকে মানুষের মাপকাঠিতে ভাঙতে পেরেছিলেন, তা অসম্ভব নিপুণ।
একই কথা প্রযোজ্য তাঁর ব্যবহৃত উপকরণের ক্ষেত্রেও। মাজহারুল ইসলামের দক্ষতায় ইটের গাঁথুনি নিশ্বাস–প্রশ্বাসযোগ্য পোশাকের বুনটের মতো নিজেকে মেলে ধরে। ওপরে উল্লেখিত ছিদ্রাবলির পাশাপাশি কোণ ও প্রান্তগুলো যেখানে শেষ হয়েছে, তার মধ্যেও এই কমনীয়তা দেখা যায়। মাজহারুল ইসলাম এভাবে দৃঢ়তা ও ভঙ্গুরতার মাঝখানে দোলাচলের সুযোগ করে দেন, একটি পাললিক দেশে প্রাকৃতিক পাথরের স্থাপনা ছাড়াই শতাব্দীপ্রাচীন নির্মাণ–ঐতিহ্যের দুই ভিন্ন ধারা আধুনিকতায় একীভূত হয়। বিরাটকায় ইট ও পোড়ামাটির ঐতিহ্য মিশে যায় সচরাচর মাটি ও বাঁশে গড়া আঞ্চলিক প্যাভিলিয়নের সঙ্গে।
মাজহারুল ইসলাম সব সময় ভবনের ব্যবহার এবং নকশা করার বাসনার সীমানার মধ্যে কাজ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, স্থাপত্যকে সব সময় সংক্ষিপ্ত করে অপরিহার্যতার ভেতর নিয়ে আসা উচিত, যেখানে সেটির অভিব্যক্তি কাজের প্রয়োজনীয়তার মধ্যে প্রকাশ পাবে। মাজহারুল ইসলাম প্রতীক ও অলংকারকে খোলাখুলি প্রত্যাখ্যান করেছেন, এভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার সেবায় স্থাপত্যকে যেকোনো ধর্মীয় প্রতীকবাদ থেকে মুক্ত করেছেন। তবে নকশার মধ্যে তিনি গভীর ব্যক্তিত্ব উন্মোচন করেছেন। কাজের পরিপ্রেক্ষিতে অনুপাত, আলোকনির্দেশ আর টেকটোনিকস বিস্তীর্ণ পরিসীমায় সাড়া দিতে সক্ষম।
১৯৬৬ ও ১৯৭৮ সালের মধ্যে মাজহারুল ইসলাম এবং তাঁর সহকর্মী ছাত্র স্ট্যানলি টাইগারম্যানের সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিকল্পিত ও নির্মিত পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট দেখিয়ে দিয়েছে একটি রিজিড বিল্ডিং ব্লক স্থানিকতা ও নকশার সম্ভাবনায় কতটা বৈচিত্র্যময় হতে পারে। সেই লক্ষ্যে এই দুই ইয়েল গ্র্যাজুয়েট গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ভবনের জন্য এমন এক উপাদান–উপযোগী সম্পদনির্ভর প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছিলেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে যা সূক্ষ্মভাবে খাপ খেয়ে যায়।
বিনির্মাণ ও দ্বন্দ্ব
মাজহারুল ইসলামের যুক্তিশীল অথচ সংস্কারমুক্ত পদ্ধতি সংকর মুহূর্তগুলোর কারণে উদ্ভূত আপাত দ্বন্দ্বগুলোকে অতিক্রম করতে পেরেছিল। তাঁর শেষ দিকের কাজে এই গুণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। শেরেবাংলা নগরে লুই কানের ক্যাপিটল কমপ্লেক্সের পাশের জাতীয় আর্কাইভ ও জাতীয় গ্রন্থাগারের (১৯৭৮-৮৪) নকশায় রাষ্ট্রের জন্য একটি নতুন পরিচয় প্রকাশ করা ছাড়া অন্য আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। দুটি যমজ ভলিউম স্থাপন করে—যার মধ্যে শেষ পর্যন্ত শুধু গ্রন্থাগারটি নির্মিত হয়েছিল—মাজহারুল ইসলাম আবারও মুক্তভাবে দাঁড়ানো বাংলো ধরনের গ্রামীণ মুহূর্তকে তুলে ধরেছিলেন, যাতে এর সঙ্গে বহিরাঙ্গিক ভবনগুলোর মনুমেন্টাল ঐতিহ্যের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রাখা যায়, যেগুলোর নজির মেলে পাহাড়পুরের বৌদ্ধ, দিনাজপুরের হিন্দু কিংবা বাগেরহাটের ইসলামি নিদর্শনে।
একটি যথাযথ বর্গাকার গ্রিডের ওপর গড়া গভীর ভলিউম জলবায়ুর দৃষ্টিকোণ থেকে বিনির্মিত। পুরোনো ঢাকার সরু ছায়াময় হাঁটা পথের মতো ইটের গাঁথুনিতে গভীর ছেদগুলো ভবনের কোণ থেকে বেসিক গ্রিডে কোনাকুনি চলে গেছে, যা দিনের আলো–বাতাসকে ভেতরে নিয়ে আসে। একই সঙ্গে মেঝের পরিকল্পনাও যথাযথ। অবস্থান ও কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে গ্রন্থাগারের চারপাশে চারটি কেন্দ্রীয় উইংয়ের প্রতিটির আলাদা চরিত্র রয়েছে। তা ছাড়া ভবনটি দেখিয়ে দেয় যে ডিজাইনের পটভূমিতে যা কোলাজে শেষ হয়েছে, প্রাথমিকভাবে তা আসলে ব্যবহারভিত্তিক। বাস্তবতা ও কবিতা কীভাবে নকশাপ্রক্রিয়ার সহযোগী হতে পারে, মাজহারুল ইসলাম সেটাই দেখান।
পরিপূর্ণ শহুরে মনুমেন্টালিজম সত্ত্বেও গ্রন্থাগার ভবনের নিবিড় পর্যবেক্ষণে একটি অপ্রত্যাশিত ভঙ্গুরতা প্রকাশ পায়, যা বদ্বীপের তরল প্রেক্ষাপট এবং ভবনটি নির্মাণের সময়কে মনে করিয়ে দেয়। বাংলাদেশে সঞ্চয় ও ক্ষয় এক অবিচ্ছেদ্য জুটি। শুধু হাইড্রোলজিক্যাল পরিপ্রেক্ষিতেই নয়, তরুণ এই দেশে পরিবর্তনই একমাত্র ধ্রুব বলে মনে হয়। জাতীয় গ্রন্থাগারের জন্য করা মাজহারুল ইসলামের নকশা আমাদের দেখায় যে সাদা-কালো রং দিয়ে নয়, বরং নিজের মধ্যে দ্বন্দ্বকে সমন্বিত করেই স্থাপত্য কতটা উদ্দীপক হয়ে উঠতে পারে।
ভবিষ্যতে পেছন ফিরে তাকানো
মাজহারুল ইসলামের পরবর্তী সময়ে নেওয়া একটি আমূল পদক্ষেপ এই প্রত্যয় প্রকাশ করে যে উপনিবেশে পর্যবসিত এই সমাজে একটি পরিবর্তন আবশ্যক ছিল। ১৯৮০-র দশক থেকে, ক্রমেই রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুবাদে তিনি ভবনের সক্রিয় কাজগুলো থেকে সরে আসেন, যা তাঁকে নতুন উদ্যোগ থেকে বঞ্চিত করে। কিন্তু ড্রয়িং বোর্ড আর বিল্ডিং সাইট থেকে দূরে থেকেও মাজহারুল ইসলাম আধুনিক ভবনসংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছিলেন। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিক থেকে তাঁকে ঘিরে শিথিলভাবে গড়ে ওঠে ‘চেতনা স্টাডি গ্রুপ’, ১৯৯০-এর দশকে যা হয়ে ওঠে ‘চেতনা সোসাইটি’। বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মের তরুণ স্থপতিদের চিন্তাভাবনা ও কার্যকলাপের রূপায়ণে এর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছে। চলমান প্রবণতা এবং আধুনিকতার মূল তৎপরতা নিয়ে তর্ক–বিতর্কের আয়োজন ছাড়া মাজহারুল ইসলাম গঙ্গা বদ্বীপের শতাব্দীপ্রাচীন ভবনের ঐতিহ্যগুলো এঁকে সেগুলোর একটি তালিকা প্রণয়নের জন্যও চেতনার সদস্যদের উত্সাহিত করেছিলেন। মাজহারুল ইসলাম এবং তাঁর আলোচনার অংশীদারেরা আধুনিকতাকে কেবল বিংশ শতকীয় অভিব্যক্তির সময়কালসম্পর্কিত একটি ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করেননি। তাঁদের কাছে সমসাময়িক কাজ এবং ঐতিহাসিক স্থাপত্যের মধ্যে সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক বা রূপক উপাদানভিত্তিক ছিল না, ছিল কাঠামোগত এবং আদর্শ ও নীতিনির্ভর। তাঁরা নজর দিয়েছিলেন বদ্বীপ অঞ্চলে ভবনের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য এবং অন্তর্নিহিত প্রবণতার দিকে, যা যুগে যুগে ব্যবহার্য একটি সংবেদনশীল ও সময়–অতিক্রমী অপরিহার্য প্রাসঙ্গিকতা তৈরি করবে। অতীত থেকে পাওয়া মৌলিক, সমসাময়িক ও অগ্রগামী নকশার সঙ্গে মাজহারুল ইসলাম সাহেবের কোনো বিরোধ ছিল না।
এ ধরনের পন্থা এখন বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, যেখানে মৌলিক বিষয়ে নজর দেওয়ার প্রয়োজন বাড়ছে। মাজহারুল ইসলাম গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে স্থাপত্যে সেরা সেসব শক্তি রয়েছে, পরিসরের অন্তর্নিহিত সংগতি, অনুপাত, আলোকনির্দেশ ও কাঠামো ব্যবহার করে যা সহজেই অর্জন করা যায়। এটা করতে গিয়ে তিনি প্রযুক্তিঘন বা প্রক্রিয়ানির্দেশিত নির্মাণের বদলে আত্মনির্ভর ও জলবায়ুসংবেদনশীল ভবনের দিকে অগ্রণী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এসব নীতি–নৈতিকতা নিজেদের মনে করিয়ে দিলে আমরা দেখব, আজ অবধি দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপেক্ষিত এই বাঙালি অগ্রনায়কের কাজ থেকে তাঁর মৃত্যুর এক দশক পরও আমাদের নির্দেশনা পেতে পারি। মাজহারুল ইসলামের ভবিষ্যতের দিকে ফিরে তাকানোর পদ্ধতিটিও আমাদের জন্য একটি কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে। তার ধারণাগুলো আলভার আল্টো, বালকৃষ্ণ দোশি বা চার্লস কোরিয়ার চেয়ে কম শক্তিশালী নয়, যা আধুনিক ভবনের প্রায় বিমূর্ত ধারণাটিকে একটি সংবেদনশীল, সহজবোধ্য ও প্রাসঙ্গিক স্থাপত্যে স্থানান্তর করে এবং আবশ্যিকভাবেই এর ব্যবহারকারীদের জীবনকে অন্তর্ভুক্ত করে।
অনুবাদ: হাসান এম রাকিব
নিকলাউস গ্র্যাবার: সুইজারল্যান্ডের স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ।