‘হাত ছাইড়া দেও সোনার দেওরা রে…’

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘দেওরা’ গানটি লিখেছেন ফজলুল হক। তিনি পেশায় কৃষক ও মাঝি। ফজলু মাঝি হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত। গানটিতে সুরারোপও করেছেন তিনি। গানটি অনবদ্যভাবে পরিবেশন করেছেন ইসলাম উদ্দিন পালাকার। কিশোরগঞ্জের গ্রামে গ্রামে তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। গ্রামবাংলার পালাগানের নাট্যরস ও স্বতন্ত্র ভঙ্গিমাকে যথাযথভাবেই তুলে ধরেছেন তিনি। কিন্তু মাটিমাখা এই গ্রামীণ গানগুলো শহরে এসে কি তার নিজস্বতা হারাচ্ছে?

‘দেওরা’ গান পরিবেশন করছেন ইসলাম উদ্দিন পালাকারছবি: সংগৃহীত

দাসত্বের শৃঙ্খলের নিচে যাদের শত শত বছরের সংগীত ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য চাপা পড়ে গিয়েছিল, সেসব কৃষ্ণাঙ্গ ও তাঁদের সন্তানেরা উনিশ শতকের শেষ ভাগে এসে জড়ো হলেন নিউ অরলিন্সের রাস্তায়। তাঁরা নতুন এক সংগীতধারার জন্ম দিলেন, যাকে কেবলই নিজেদের বলতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল এ সংগীতধারা, যাকে আমরা জ্যাজ বলে জানি।

এরও প্রায় অর্ধশতক পর ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা নামের শতভাগ ইতালীয় এক গায়ক শ্বেতাঙ্গদের জড়িয়ে ফেললেন জ্যাজের জালে। নিজের সম্পূর্ণ শ্বেতাঙ্গবাদক দল নিয়ে তিনি গাইলেন এবং সর্বকালের সেরা জ্যাজশিল্পীদের একজন হয়ে উঠলেন নিজ গুণেই। কিন্তু এই সংগীতধারার সঙ্গে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক কোনো সম্পর্ক ছিল না তাঁর। গায়কির ধাঁচ আর বাদনে তিনি যুক্ত করেছিলেন পশ্চিমা অনেক অনুষঙ্গ। আর ব্যাপক সমাদর পেয়েছিলেন শ্বেতাঙ্গ শ্রোতাদের কাছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সংগীত–ইতিহাসে এমন ঘটনা অহরহই চোখে পড়ে। কৃষ্ণাঙ্গদের ঢঙে গান গেয়ে শ্বেতাঙ্গ শিল্পীরা বিলবোর্ডের শীর্ষ শতকে রাজত্ব করে গেছেন। কৃষ্ণাঙ্গ শিল্পীরা নিজ গোষ্ঠীতে পরিচিতি পেলেও বৃহত্তর শ্রোতৃসমাজের কাছে অচ্ছুত রয়ে গেছেন। আর তাই ‘রক অ্যান্ড রোল’–এর রাজা কেন এলভিস প্রিসলি, চাক বেরি নন—এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে।

জ্যাজ সংগীত পরিবেশন করছেন এক শিল্পী
ছবি: সংগৃহীত

কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে না জেনেই তাঁদের সংগীতধারাকে শ্বেতাঙ্গ শ্রোতার কানের উপযোগী করে উপস্থাপন ও জনপ্রিয় করে তোলার এই ঐতিহ্য বেশ পুরোনোই। আর প্রবণতাকে তাত্ত্বিকেরা বলছেন ‘জেন্ট্রিফিকেশন’, বাংলায় যাকে বলা চলে ‘মৃদূকরণ’। ১৯৬৪ সালে ব্রিটিশ সমাজবিদ রুথ গ্লাস এই তত্ত্বের জন্ম দেন। নিজের বই ‘লন্ডন: আসপেক্টস অব চেঞ্জ’–এ গ্লাস লেখেন, ‘এক এক করে, লন্ডনের নিম্নবিত্তদের বাড়িগুলোর দখল নিচ্ছে উচ্চ ও নিম্নমধ্যবিত্তরা…কোন জেলায় এই ‘মৃদূকরণ’ প্রক্রিয়া একবার শুরু হলে মূল বাসিন্দাদের (নিম্নবিত্ত) উৎখাত এবং গোটা জেলার সামাজিক চরিত্র আমূল না পাল্টানো পর্যন্ত থামে না।’ ব্রিটিশ অভিজাত শ্রেণিকে বলা হয় ‘জেন্ট্রি’ আর সেখান থেকেই ‘জেন্ট্রিফিকেশন’ শব্দটি ধার করেন গ্লাস।

সংগীত সব সময় বিনোদনের মাধ্যম নয়, তা তুলে ধরে একটি জাতিগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক পরিচয়, রাজনৈতিক অবস্থান ও সংঘাতের ইতিহাস। অনেক সময় এই সংগীত হয়ে ওঠে একটি জাতির অস্তিত্বের স্মারক। আমাদের নাগরিক ক্ষমতা এবং ক্ষমতাসীনের দাপটে সেই সংগীতও হয়ে যেতে পারে বেহাত, তাই নয় কি!

এবার আসা যাক ‘মিউজিক্যাল জেন্ট্রিফিকেশন’ বা ‘সাংগীতিক মৃদূকরণ’ প্রসঙ্গে। সহজ করে বললে, সামাজিকভাবে নিচুশ্রেণির মানুষের সংগীতচর্চা ও ঐতিহ্য যখন তাঁদের থেকে সামাজিকভাবে তুলনামূলকভাবে উঁচু বা ক্ষমতাধরেরা দখল করে নেন, তখন তাকে বলে ‘সাংগীতিক মৃদূকরণ’।

‘দেওরা’ গানের একটি দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

এবার আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আসা যাক। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া গান আমাদের গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের ঐতিহ্য। আরও রয়েছে পালাগান, কিচ্ছাপালা, যাত্রাপালা, কীর্তন, বাউলগান। বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই গানগুলোকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত গ্রাহকের শ্রবণোপযোগী করে তোলার একটা চল আমাদের দেশেও বিদ্যমান।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া ‘দেওরা’ গানটির কথাই ধরা যাক। ‘হাতে লাগে ব্যথা রে, হাত ছাইড়া দেও সোনার দেওরা রে…’ —গানটি যে সারিগান, সেটা হয়তো এই গানে কোমর দোলানো অনেক শ্রোতারই অজানা। বইঠার তালে তালে হাতের বাদ্যে খালি গলায় গাওয়া হয় এই গান, পরিশ্রমকে ছন্দে বেঁধে ফেলার এক প্রয়াস এই গান।

ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা, ১৯৪৩
ছবি: সংগৃহীত

‘দেওরা’ গানটি লিখেছেন ফজলুল হক, তিনি পেশায় কৃষক ও মাঝি। ফজলু মাঝি হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত। গানটিতে সুরারোপও করেছেন তিনি। গানটি অনবদ্যভাবে পরিবেশন করেছেন ইসলাম উদ্দিন পালাকার। কিশোরগঞ্জের গ্রামে গ্রামে তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। গ্রামবাংলার পালাগানের নাট্যরস ও স্বতন্ত্র ভঙ্গিমাকে যথাযথভাবেই তুলে ধরেছেন তিনি।

বিভিন্ন ম্যাগাজিনে এলভিস প্রিসলি
ছবি: সংগৃহীত

কিন্তু ঐতিহাসিক–সাংস্কৃতিক–সামাজিক প্রেক্ষাপট ছাড়া শহুরে গ্রাহকের উপযোগী করে তুলতে এই গানে জুড়ে দেওয়া হয়েছে পপসংগীতের নানান অনুষঙ্গ। অনেকে এই প্রয়াসকে দেখতে চাইছেন এই গ্রামীণ সংগীতধারাকে একধরনের ‘সুযোগ’ করে দেওয়া হিসেবে। কিন্তু সেই ‘সুযোগ’ কি আদৌ তাঁদের প্রয়োজন? বরং তাঁরাই সংগীতের পণ্যায়নের অংশ হয়ে উঠছেন সাংগীতিক মৃদূকরণের মাধ্যমে। সামাজিক বিন্যাসে যাঁরা নিজেদের স্থান উঁচুতে বলে মনে করছেন, এই প্রক্রিয়ায় তাঁরা কি নিজের মতো করে কেটেছেঁটে বানিয়ে নিচ্ছেন শত শত বছরের ঐতিহ্যকে?

সংগীত সব সময় বিনোদনের মাধ্যম নয়, তা তুলে ধরে একটি জাতিগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক পরিচয়, রাজনৈতিক অবস্থান ও সংঘাতের ইতিহাস। অনেক সময় এই সংগীত হয়ে ওঠে একটি জাতির অস্তিত্বের স্মারক। আমাদের নাগরিক ক্ষমতা এবং ক্ষমতাসীনের দাপটে সেই সংগীতও হয়ে যেতে পারে বেহাত, তাই নয় কি!

আমাদের শহুরে সংবেদনশীলতায় ‘গ্রাম্য’ এই গানগুলোকে আমরা হাত ধরে টেনে এনে ‘জাতে’ তুলছি। ক্ষমতাকাঠামোর ওপরতলায় থাকা আমাদের শহুরে নাগরিকতাকে যদি ‘সোনার দেওরা’ হিসেবে ধরে নিই, তাহলে তার কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য গ্রামদেশ থেকে উঠে আসা মাটিমাখা সুরের গানগুলোই কি আজ জানাবে এই ফরিয়াদ, ‘হাতে লাগে ব্যথা রে... হাতে লাগে ব্যথা রে... হাত ছাইড়া দেও সোনার দেওরা রে…’!