ইতিহাসের নিরিখে যেভাবে আত্মপরিচয় খোঁজ করেছিলেন রণজিৎ গুহ
গত ২৮ এপ্রিল প্রয়াত হয়েছেন সমকালীন দুনিয়ার প্রভাবশালী ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ। ইতিহাসের প্রচলিত বয়ানকে প্রশ্ন করার মধ্য দিয়ে তিনি উন্মোচন করেছিলেন নিম্নবর্গের ইতিহাসের অনালোচিত এক ভুবন। তাঁর রচনায় একই সঙ্গে মিশেছিল সাহিত্য, দর্শন আর ইতিহাস। এই সবকিছুর ভেতর দিয়ে আদতে কোথায় পৌঁছুতে চেয়েছিলেন এই ইতিহাসকার?
খুব চমৎকার একটি কথা বলেছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়; প্রাচীন অশ্বত্থ, বট, নদী, চর, আকন্দফুল, পাখি, মানুষ ও বাস্তুভূমির সম্পর্কের ছবি আঁকতে আঁকতে লিখেছিলেন, ‘সেই সব বাণী, সেই সব ইতিহাস আমাদের আসল জাতীয় ইতিহাস। মূক জনগণের ইতিহাস, রাজরাজড়াদের বিজয়কাহিনি নয়।’ কথাগুলো বলেছিলেন ১৯৫০ সালে ইছামতী উপন্যাসের শুরুর দিকটায়। তার ঠিক চার বছর পর ‘মেদিনীপুরের লবণ-শিল্প’ নামের প্রবন্ধে এক তরুণ লিখলেন, ‘বাঙালির ঐতিহাসিক প্রতিভা আজও প্রধানত রাজনৈতিক উত্থান–পতনের কাহিনির বর্ণনায় সীমাবদ্ধ।’ আশার জমিনে পা রেখে আরও বললেন, ‘দেশীয় অর্থনীতি ও সমাজই যে জাতীয় ইতিহাসের মৌলিক উপাদান,’ সে সত্য ক্রমেই ‘স্বীকৃতি লাভ করছে’। তার মানে আগের দৃষ্টিভঙ্গিতে ছিল অস্বীকৃতি। ১৯৫৪ সালে যে তরুণের হাত থেকে লিপিবদ্ধ হয়েছিল এই সব অক্ষর, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বখ্যাত ইতিহাসকার। পঞ্চাশের দশকের তরুণ সেই লেখকের নাম রণজিৎ গুহ। পূর্ববঙ্গের মানুষ তিনি। বরিশালের বাখরগঞ্জের জল, মাটি আর হাওয়ার গন্ধ তাঁর গতরে।
সদ্য প্রয়াত এই ইতিহাসকারের বুদ্ধিবৃত্তির ইতিহাস ঘাঁটতে ঘাঁটতে বিভূতিভূষণের কথাটিই মনে পড়ল সবার আগে। বিভূতিভূষণের মতোই রণজিৎ পথ খুঁড়েছিলেন ভিন্ন এক পটভূমিতে; যেখানে দেশ, কাল, জনতা, অঞ্চল ও প্রকৃতির মিলনমোহনায় দাঁড়িয়ে থাকেন একজন ঐতিহাসিক। তিনি গড়ে তোলেন না তথ্যের স্তূপ; পুঞ্জীভূত তথ্যের অহমিকায় ইতিহাসকে করে তোলেন না কণ্টকিত। বরং তিনি উপহার দেন ইতিহাসের অনাঘ্রাত এক কুসুম।
রণজিৎ গুহ আমাদের জন্য হাজির করেছিলেন নতুন সৌরভ, যার কুঁড়ি গড়ে উঠছিল তরুণ বয়সে। তখন তিনি মার্ক্সবাদী, কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য। দ্বান্দ্বিক দৃষ্টির কারণে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতেন না পার্টির প্রত্যাদেশ। রাশিয়া যখন হাঙ্গেরিতে আগ্রাসী আক্রমণ চালাল, সে সময় কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে তিনি প্রবেশ করেছেন বিদ্যায়তনের সুস্থির গবেষণায়। রণজিতের মনে হয়েছিল, ভারতীয় উপমহাদেশের যে ইতিহাস লেখা হয়েছে, তা মূলত ওপর থেকে লেখা ইতিহাস। দেখা ও লেখার প্রেক্ষণবিন্দুটির মর্মে আছে উচ্চবর্গের ক্ষমতা। যাঁরা এই ভাবাদর্শের অধীন, তাঁরা লেখেন উচ্চবর্গের জয়গাথা, ‘রাজরাজড়ার বিজয়কাহিনি’ অথবা ‘রাজনৈতিক উত্থান–পতনের কাহিনি’।
রণজিৎ দেখালেন, ইতিহাসের বহু স্বরের ভেতর কান পাতলে অন্য একটি কণ্ঠস্বরও শোনা যাবে। তার নাম ‘কৃষকচৈতন্য’। উপনিবেশিত ভারতীয় উপমহাদেশে কৃষকদের উচ্চারিত স্বর উচ্চবর্গের চেয়ে স্বতন্ত্র ও মৌলিক। এত দিনকার ঐতিহাসিকেরা শুনতে পাননি সেই ধ্বনি। নতুন প্রস্তাবনায় রণজিৎ জানালেন, আমাদের শুনতে হবে ‘তাহাদের কথা’। অদ্ভুতুড়ে বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বাংলার কৃষক হঠাৎ সহিংস আর ছন্নছাড়া হয়ে ওঠে, এটা তাদের রাজনৈতিক লড়াইয়ের ধরন। জাতীয়তাবাদী ইতিহাসকার কিংবা ভাবুকেরা বিশ্বাস করেন রাজনৈতিক দেনদরবার, সমঝোতা আর ক্ষমতার বণ্টনে। কিন্তু কৃষক–জনতাও কি চায় তেমন বিন্যাস? রণজিৎ জবাব দেবেন, না। কৃষকেরাও কি ক্ষমতাবানদের সহায়ক হয়ে ওঠেন না? সবার বাস্তব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ বলবে, হ্যাঁ। রণজিৎও সম্মতি দিয়ে বলেছেন, কৃষকেরা তা করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পক্ষে ঝান্ডা হাতে নেমে গেছেন অগণিত কৃষক।
ইতিহাসের কোলাহলময় পরিপ্রেক্ষিত মনে রেখে রণজিৎ দেখান, এখানেই নিহিত ইতিহাসবিদ্যার সংকট। উচ্চবর্গ ঠিকভাবে পড়তে পারে না নিম্নবর্গের মন। তাই উচ্চবর্গের বয়ানে বদলে যায় নিম্নবর্গের কণ্ঠস্বর। তাহলে নতুন ইতিহাসকার কী লিখবেন? তিনি লিখবেন আত্ম ও অপরের ইতিহাস, লিখবেন অপরায়নের বৃত্তান্ত। ইতিহাসযাত্রায় রণজিৎ একাকী পথিক হননি; তিনি নেমেছেন গোষ্ঠীবদ্ধ চর্চায়। এই গোষ্ঠীর নাম হয়ে দাঁড়াল নিম্নবর্গের ইতিহাসকার কিংবা সাবঅলটার্ন ঘরানার ইতিহাসকার। বিদ্যায়তনিকভাবে অভিষিক্ত হলো তারা।
আবার বিতর্কও এল। জাতীয়তাবাদী কি মার্ক্সবাদী—উভয় মহলই কটাক্ষ করল। নারীবাদীরাও তুললেন যৌক্তিক প্রশ্ন। রণজিৎ গুহরা অভিযোগ আমলে নিলেন, খণ্ডন করলেন এবং তাত্ত্বিক সীমাবদ্ধতার সংশোধনীও টানলেন। তত দিনে বিদ্যায়তন ও তার বাইরে ছড়িয়ে পড়েছে নিম্নবর্গীয় ইতিহাসগোষ্ঠীর খবরাখবর। সাহিত্য, নৃবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, সাংস্কৃতিক অধ্যয়নের মতো বিদ্যাশাখা গ্রহণ করে নিয়েছে এই ঘরানার চিন্তাভঙ্গিকে। আর এই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে নিবিড়ভাবে কাজ করে যাওয়া মানুষটি হলেন রণজিৎ গুহ। তাঁর ভূমিকা একই সঙ্গে ব্যক্তিক ও সামষ্টিক।
তথ্য, সত্য ও তত্ত্বকে ঐতিহাসিক কোন সুতায় বাঁধবেন? ইতিহাসের জন্য এটি এক মৌলিক প্রশ্ন। অনেক ঐতিহাসিক তার জবাব জানেন না। কিন্তু রণজিৎ জানতেন। তাঁর ছিল এক সামগ্রিক বিশ্ববীক্ষা, যা শাণিত হয়েছে দার্শনিক ও সমাজতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে। আধিপত্য ও নিপীড়নের বাইরে এক মানবিক পৃথিবী নির্মাণের বাসনা তাঁকে তাড়িত করেছে। তাঁকে আলোড়িত করেছে আত্ম ও অপরকে জানার অফুরন্ত ইচ্ছা। ভারতীয় দর্শনে আত্ম ও অপর জ্ঞানের যেসব ধারা প্রবাহিত হয়েছে, তার স্রোতে অবগাহন করতে তাঁর কোনো সংশয় ছিল না। রণজিতের লেখায় আমরা দেখতে পাই ব্যক্তির ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক আত্মপরিচয় অন্বেষণের ইশারা। বলা বাহুল্য, ব্যক্তি তো সমষ্টির সঙ্গেই বিজড়িত। এ কারণেই রণজিতের দেখায় বিষয় হয়ে ওঠে বিরাটসংখ্যক, বহুধাবিভক্ত জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের ইতিহাস।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্রপাত কিংবা ‘রামমোহন রায় ও আমাদের আধুনিকতা’ প্রসঙ্গে রচিত দয়ায় আত্মপরিচয়ের প্রশ্নগুলোই দানা বেঁধে উঠেছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইতিহাসকে তিনি পিছিয়ে নিয়ে গেছেন আরও একটু অতীতে—১৭৬৫ সালে, যখন ‘প্রবল ক্ষুধায় কোম্পানির রাজস্বনীতি দেওয়ানি হাতে পেয়েই বাংলার আদিম কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়।’ রামমোহন প্রসঙ্গে রণজিৎ দেখালেন আধুনিকতা, লৌকিক জ্ঞান ও দয়ার সম্পর্ক। ভারতীয় উপমহাদেশের আধুনিকতায় দয়ার ধারণাও যেন বহন করছে ‘অন্য আধুনিকতার সম্ভাবনা’। রণজিতের মীমাংসা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে। কিন্তু আত্মপরিচয় খোঁজার নতুন বীজসূত্র দেয় তাঁর প্রস্তাব।
ইতিহাসের এই পরিক্রমায় রণজিৎ খুঁজে বেড়িয়েছেন নিজের পরিচয়ও। প্রতিটি অনুসন্ধানের পেছনে কী করে যুক্ত থাকে ঐতিহাসিকের ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা, তার ‘কৈফিয়ত’ তিনি দিয়েছেন; বলছেন, ‘শিল্পী ও সাহিত্যিকদের কাজ যেমন তাঁদের জীবনীর আলোকে বিশদ হয়, ঐতিহাসিকের অভিজ্ঞতাও তেমনি তাঁর আঁকা অতীত চিত্রকে আলোকিত করতে পারে।’ আলোকায়নের এই কাজে রণজিতের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে ছিল কৃষিভিত্তিক পূর্ববঙ্গের জীবন এবং তার সঙ্গে লিপ্ত থাকা জমিদারি ধারার কর্তৃত্ববাদী পারিবারিক অভিজ্ঞতা। যে যুগ্ম বৈপরীত্যের কথা তিনি তাঁর লেখায় বারবার বলেছেন, সেই যুগ্ম বৈপরীত্যের প্রথম দেখা যেন তিনি পেয়েছিলেন শৈশবে; ‘প্রজা’ ও ‘মনিব’—এই দুই যুগ্ম বিভাজনের সত্যকে ভুলে যাননি। সত্তরের দশকে দেশে ফিরে নকশাল আন্দোলনের উত্তরঙ্গ হাওয়ায় তিনি খুঁজে পেলেন ‘প্রজা’দের ভিন্ন পরিচয়।
পরিচয় খুঁজতে খুঁজতেই সম্ভবত রণজিৎ শেষ পর্যন্ত হাত খুলে লিখতে বসেছিলেন বাংলা ভাষায়। মোটামুটি ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছিলেন, ইংরেজিতে আর লিখবেন না। এখন থেকে বাংলায় লিখবেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি বাংলায় ভাবি। মানে, প্রথম যে কথাগুলো মনে আসে, সেটা ইংরেজি নয়, বাংলা।’ আর বিপুল বিস্ময় নিয়ে আমরা দেখতে পেলাম, রণজিৎ পাঠ করতে বসেছেন খাঁটি সাহিত্য। তাঁর বড় একটি অংশ জুড়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; তাঁকে নিয়ে দুটি বই—কবির নাম ও সর্বনাম এবং ছয় ঋতুর গান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ ও উৎপলকুমার বসুর কবিতা নিয়ে লিখেছেন আস্ত একটি বই—তিন আমির কথা। ইতিহাস ও সাহিত্যের যুগলবন্দী পুস্তক হিসেবে প্রকাশিত প্রেম না প্রতারণায় পাওয়া গেল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে।
কেউ কেউ ভাবতে পারেন, একেই বলে বিদ্যায়তনের সীমানা লঙ্ঘন! রণজিৎ হয়তো ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেয়েছেন। জ্ঞানের বিভাজনে বিশ্বাসীরা এ রকম ভাবতে পারেন। কিন্তু বিদ্যাচর্চার ইতিহাসে পলিম্যাথ ছিলেন, আছেন; যাঁরা একই সঙ্গে বহু বিদ্যায় আগ্রহী ও পারদর্শী। রণজিৎ গুহকে আমাদের মনে হয় তেমনই একজন, যিনি ইতিহাসে সীমানায় পা রেখে উঁকি দেন দর্শনের জানালায়, মগ্নপাঠের আনন্দে কড়া নাড়েন সাহিত্যের অন্দরমহলে।
তাঁর সাহিত্য সমালোচনায় মিশে আছে বহুদর্শীর প্রজ্ঞা ও দর্শন। তিনি কথা বলেন অন্তর্লীন স্বরে। দীক্ষিত সাহিত্যপাঠক বলেই তিনি সমালোচনার জন্য তৈরি করে নিয়েছেন নিজস্ব পরিভাষা। ভারতীয় দর্শন ও কাব্যশাস্ত্রের সহায়তা গ্রহণে সংশয় বোধ করেননি। অথচ আধুনিক হওয়ার হুজুগে, বাসনায় উনিশ শতক থেকেই এসব ধারণা পরিহার করার মানসিকতা তৈরি হয়েছিল। ইতিহাসের ক্ষেত্রে রণজিৎ যেমন উল্টো পথে হেঁটেছেন, সাহিত্যের সমালোচক হিসেবেও তিনি যেন বিপ্রতীপ পথের পথিক। তাই তাঁর কাছে মান্য হয়ে ওঠে প্রাচীন ভারতীয় মনীষী ভর্তৃহরি, আনন্দবর্ধন ও অভিনবগুপ্তের দীক্ষা। সতত প্রশ্নের খেলায় তিনি পাঠ করতে চান কবিতাকে।
কবির নাম ও সর্বনাম বইটিতে আছে রণজিতের তিনটি প্রধান প্রশ্ন—এক. কবিতায় প্রতিফলিত আমি-তুমির ‘চলার বেগ ও অস্থিরতায় উৎক্রান্তি’র ধারণা কীভাবে গড়ে ওঠে? দুই. তত্ত্ব ও অনির্দেশ্য বিশ্ব কেমন করে উৎক্রান্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি করে? তিন. ‘আমি-তুমির ব্যাকরণ’ কী করে চূড়ান্ত অর্থে ‘উৎক্রান্তির কাব্যে’ পরিণত হয়? জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমি-তুমির দ্বৈত যদি সে ইতিহাসের সামগ্রী হয়, তা হলে কাব্যজিজ্ঞাসাকেও ফিরে যেতে হবে অস্তিত্বের উন্মেষমুহূর্তে’। রণজিৎ বলেন, শিল্পসাহিত্য–দর্শনে লেখা হয় ‘নিজেকে জানার সংগ্রাম’ এবং ‘অস্তিত্বের ইতিহাস’। রবীন্দ্রনাথের গদ্য, পদ্য ও গানের পসরা থেকে রণজিৎ চয়ন করেছেন কবিত্ব-আমিত্ব, আমি ও অন্য আমির লড়াইয়ের ইতিহাস।
ইতিহাসের মতো করেই রণজিৎ আত্মপরিচয়ের দ্বান্দ্বিকতাকে ব্যবহার করেছেন সাহিত্যপাঠের ক্ষেত্রে। ছয় ঋতুর গান বইটিতে স্থান পেয়েছ দ্বান্দ্বিকতার নতুন এক বর্গ ‘জড় প্রকৃতি’। রণজিতের ভাষ্যে, ‘আমি ও তার অপর এখানে সাক্ষাৎ জড় প্রকৃতির মুখোমুখি। প্রাণের প্রাচুর্যে ভরা চপলতা ও নিষ্প্রাণ নির্বিকার বিপরীতের দ্বন্দ্ব।’ রবীন্দ্রনাথ ছাড়িয়ে তিনি যখন নেমে আসেন তাঁর সমকালের কবিদের সৃষ্টিসম্ভারে, তখনো তাঁকে বিদীর্ণ করে সেই ভাব, ‘মানুষ তার স্বভাবের বশে, মনুষ্যত্বের শর্ত হিসেবে, অর্থাৎ মানুষ বলেই নিত্য একাকী। সেই একাকিত্বের ভার লাঘব করার জন্যেই আমার আমিকে নিরন্তর খুঁজে বেড়াতে হয় তার অপর আমিকে।’ আর এই ভাবসূত্রেই রচিত হয়েছে তিন আমির কথা, যার ভাবনাবীজের জোগানদাতা নিম্নবর্গের ভাবুক ও সাধক প্রিয় লালন। রণজিৎ লিখেছেন, ‘দ্বিখণ্ডিত সত্তার এই আমি ও অপরের খোঁজাখুঁজির রহস্য নিয়েই রচিত হয়েছে লালনসংগীতের সেই আশ্চর্য কাহিনি, যখন প্রতিবেশী হয়েও আরশিনগরে এ দুই আমির সাক্ষাৎকার আর কিছুতেই ঘটে ওঠে না।’
আমাদের জাতীয় ইতিহাসেও পরস্পরের এই সাক্ষাৎকার ঘটে না। আত্মপরিচয়ের সীমানা ও সংজ্ঞার্থ নির্ধারণে আমরা কুণ্ঠিত হই। অথবা পরিচিতির সঙ্গে গড়ে তুলি আধিপত্য ও নিপীড়নের ভাবাদর্শ। রণজিৎ গুহ প্রকৃতপক্ষে আত্মপরিচয়কেই করেছিলেন তাঁর বিশ্লেষণের আধার ও আধেয়। জাতীয়তাবাদী অতীত আবিষ্কারের মোহ কিংবা অতীত পুনর্গঠনের আবেগ তাঁকে স্পর্শ করেনি। নিজের পারিবারিক ও সামাজিক পরিচয় প্রকাশেও তাঁর দ্বিধা ছিল না। ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে ভুলে যাননি, তিনি পূর্ববঙ্গের মানুষ অভিজাত পরিবারের সদস্য। সমর সেন বিষয়ক একটি লেখায় বলেছিলেন, বাবুজন্মের কথা মনে না রেখে বিপ্লবী হতে চাইলে, বিপ্লব হয়ে যায় ‘বাবুগিরি’। তাই বাবুত্বকে মনে রাখতে হয়। রণজিৎ গুহ মনে রেখেছেন। স্মৃতির পক্ষে যা কিছু যত দূর পর্যন্ত ধারণ করা সম্ভব। কিন্তু সেই স্মৃতিকেও প্রশ্ন করতে হয়। পদ্ধতিগতভাবে নিয়ে যেতে হয় দ্বান্দ্বিক ব্যাখ্যায়।
রণজিতের পছন্দ ছিল ইতিহাসের যুগ্ম বৈপরীত্যময় বাস্তবতা ও পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যার আওতায় নিয়ে আসা। উপনিবেশিত বাঙালির ‘অসংগতি-প্যারাডক্স’ তাঁকে আকর্ষণ করত। ইতিহাসলেখকের ব্যক্তি–অভিজ্ঞতা ও গড়ন এই প্যারাডক্সের বাইরে নয়। বাঙালি মধ্যবিত্তের ইতিহাস খুঁজতে গেলেও উঠে আসবে দ্বিধাদীর্ণ মনের বিপুল ফিরিস্তি। কৃষকচৈতন্যেও যেমন পাওয়া যাবে বহুমাত্রিক প্যারাডক্স। বিরোধাভাস সত্য, পরিচয়ও সত্য।
আত্মপরিচয় নির্মাণের চূড়ান্ত কোনো পদ্ধতি নেই, ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের একমাত্র কোনো নিদান নেই। যা আছে, তা হলো, অবিরাম জিজ্ঞাসা। রণজিৎ বলেন, ‘অতীত জিজ্ঞাসার শেষ নেই। কালক্রমে একই প্রশ্ন নতুন নতুন সমস্যার দিগন্ত রচনা করে। আর তারই প্ররোচনায় ইতিহাসবিদ্যার যাত্রাও শুরু হয় এক অসমাপ্তি থেকে আরেক অপস্রিয়মাণ অসমাপ্তির উদ্দেশ্যে।’ রণজিৎ আমাদের আহ্বান জানান ইতিহাসের বিরোধাভাসমূলক ভুবনে, যেখানে পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে মিশে থাকে তত্ত্ব, তথ্য ও স্মৃতি। ‘অস্তিত্বের বৃহত্তর সার্বিক ইতিহাসের কাঠামোয়’ পরিচয় অন্বেষণ ও নির্মাণের বীজশব্দ তিনি পেয়েছেন লালনের গানে—‘আরশিনগর’ ও ‘আয়নামহল’। আর তাই তিনি তাৎপর্যের সঙ্গে ভাবতে চান ‘মূক জনগণে’র কথা; কারণ এই পড়শিকে আমরা চিনিনি, যুক্ত করিনি আমাদের আত্মপরিচয়ের সঙ্গে। এভাবে ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক বয়ানের দার্শনিক মীমাংসা বিগত এক শ বছরের বাংলায় আর কেউ করেছেন কি না, সন্দেহ! পাঠক হিসেবে আমাদের কাজ হলো, আমিত্ব ও অপরত্বের সত্তাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক জিজ্ঞাসাগুলো জরিপ করা। তাহলেই না বোঝা যাবে বৃহৎ বঙ্গ ও বিশ্বের প্রেক্ষাপটে আমি ও আমাদের অবস্থান ঠিক কোথায়।
রণজিৎ গুহ
নিম্নবর্গের ইতিহাসকার
জন্ম: ২৩ মে ১৯২৩, বাংলাদেশের বরিশালের বাখরগঞ্জের সিদ্ধকাঠি গ্রামে।
মৃত্যু: ২৮ এপ্রিল ২০২৩, অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায়।
উচ্চশিক্ষা: প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর, ১৯৪৬।
রাজনীতি: যুক্ত ছিলেন ভারতের কমিউনিস্ট পাটির (সিপিআই) সঙ্গে; হাঙ্গেরিতে সোভিয়েত আগ্রাসনের প্রতিবাদে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ, ১৯৫৬।
কর্মজীবন: কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ, ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ইংল্যান্ডের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা; ১৯৮১ সাল থেকে ধীরে ধীরে তাঁর সম্পাদনায় ছয় খণ্ডে বের হয় সাবঅল্টার্ন স্টাডিজ–এর প্রবন্ধগুচ্ছ; এ অঞ্চলে ‘নিম্নবর্গ অধ্যায়ন’ বিষয়টির তিনি পথিকৃৎ।
অবসর জীবন: ১৯৯৯ সালে অধ্যাপনা থেকে অবসর নেওয়ার পর অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনার উপকণ্ঠে পুরকেওর্সডর্ফে বসবাস করছিলেন।
লেখালেখি ও উল্লেখযোগ্য বই: আ রুল অব প্রপাটি ফর বেঙ্গল: অ্যান এসে অন দ্য আইডিয়া অব পারমানেন্ট সেটেলমেন্ট (১৯৬৩); এলিমেন্টারি অ্যাসপেক্টস অব প্রেজেন্ট ইনসার্জেন্সি ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া (১৯৮৩); নিম্নবর্গের ইতিহাস (১৯৯৮); কবির নাম ও সর্বনাম (২০০৯); প্রেম না প্রতারণা (২০১৩)।