হাওর অঞ্চলে মহররম-সংস্কৃতির নিজস্ব রূপান্তর

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

কিশোরগঞ্জের সর্বপূর্বের উপজেলা অষ্টগ্রাম। পুব দিকের একই কাতারে (উত্তর-দক্ষিণ) আছে আরও দুই উপজেলা—ইটনা ও মিঠামইন। সবই হাওর-অধ্যুষিত। একসময় অষ্টগ্রামে যে পনিরের উৎকর্ষ সাধিত হয়েছিল, তার মূল কারণ মহিষের আধিক্য। বিস্তীর্ণ চারণভূমিতে তখন পালকে পাল, অগণন মহিষ চরে বেড়াত। অধুনা নগরবাসী অষ্টগ্রামের যে পনির দ্বারা রসনা তৃপ্ত করেন, সম্প্রতি তাতে গরুর দুগ্ধজাত পনিরও যুক্ত হয়েছে।

এই জনপদে মহররমের শোকানুষ্ঠান এক ভিন্নমাত্রা লাভ করেছিল। এই বৈশ্বিক সংস্কৃতিটি বাংলাদেশে একটি জাতীয় অবয়ব পেয়েছে। তার মধ্যে অষ্টগ্রামে ঘটেছে এর বিশিষ্ট এক স্থানীয়করণ। সবই প্রাবল্য, বাহুল্য ও আতিশয্য। মহররমের ট্রেনযাত্রায় ছিলাম একা, অন্য সময় কেউ না কেউ সহযাত্রী হন। বই-খাতার ভারে নুইয়ে পড়া বোঁচকা আর ডিএসএলআরের ওজন কুলিয়ারচর ঘাটে গিয়ে বোঝা হয়ে গেল। আজ অষ্টগ্রাম থেকে কোনো স্পিডবোট আসবে না, যেগুলো গেছে সেগুলো যাত্রী না পেয়ে ঘুমাচ্ছে আটগাঁওয়েই। হেতু জিজ্ঞাসা না করেই জানতে পারি কাল আশুরা, অষ্টগ্রাম থেকে কারও কোনো নড়নচড়ন নেই।

অষ্টগ্রামের আশুরা
ছবি: লেখক

কুলিয়ারচরের বন্ধুপ্রতিম আইয়ূবকে ফোন করেও কাজ হলো না। তখনই বুঝে নিলাম, তাঁদের ১৫০ বছরাধিক সময় ধরে চলে আসা মহররম উৎসবের মাহাত্ম্য, মাতম-রোদন-শোকের তীব্রতা। অগত্যা আড়াই-পৌনে তিন ঘণ্টার চরম বিরক্তিকর লঞ্চভ্রমণই নিয়তি হয়ে গেল। ধৈর্যে কুলায়নি, তাই মূল ঘাটের আগেই কাস্তুলে নেমে পড়ি, ইউএনও হারুন-অর-রশিদের বদান্যে সদরে পৌঁছাই। তাঁদের নয়নমনোহর বাংলোর জানালা গলিয়ে বাইরে তাকালেই গরু-মহিষের চারণভূমি, সেকি এক নৈসর্গিক দৃশ্যপট! সাগর বলেছিল, প্রথম মিছিলটি তো হয়ে গেল স্যার, দেখতে পারেননি ক্ষতি নেই, এই যে দেখুন ভিডিও, সদ্য ড্রোন দিয়ে করেছেন একজন। দেখে মনে হলো শিয়া-অধ্যুষিত বাহরাইন, ইরান কিংবা ইরাকে আছি। উড়ছে তাদের বাহারি পতাকা, রক্তাক্ত না হলেও সমানে চলছে বুক চাপড়ানো, তারা সব যদিও সুন্নি মুসলমান!

অষ্টগ্রামের দেওয়ানবাড়িই আঞ্চলিক কথনে ‘হাবেলি বাড়ি’। মহররম উৎসবের স্মৃতিধন্য এই বাড়ির এখন হাল ধরেছেন বাবু চেয়ারম্যান—সৈয়দ ফাইয়াজ হাসান বাবু। তাঁর পূর্বপুরুষ সৈয়দ আবদুল করিম আলাই মিয়া প্রতিষ্ঠিত ইমামবাড়া এখনো এই সাধক পুরুষের স্মৃতি বহন করে চলেছে। আলাই মিয়ার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন হবিগঞ্জের মানুষ। আলাই মিয়া কর্তৃক মহররম উৎসব প্রবর্তনের পেছনে বৈশ্বিক মুসলিম ঐতিহ্যের প্রেরণা নিশ্চয়ই ছিল। বলা হয়ে থাকে তিনি ছিলেন সৈয়দ নাসিরউদ্দিন সিপাহসালারের বংশধর। সৈয়দ নাসিরউদ্দিন সিপাহসালার আবার হজরত আলীর বংশধর বলে কথিত। আলাই মিয়া পাঞ্জাতন পারের এক উচ্চ স্তরের আশেক ছিলেন বলে বিদিত। তাঁর পূর্বপুরুষ নবীবংশ (রচনাকাল ১৫৮৪ সাল) প্রণেতা সৈয়দ সুলতান। সৈয়দ সুলতানের নির্দেশে কবি মুহম্মদ খান ‘মক্তুল হোসেন’ তথা ‘হোসেন-বধ’ কাব্য রচনা করেছিলেন। মহররমের বিয়োগান্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে যে মর্সিয়া সাহিত্য রচিত হয়েছিল, এগুলো তার অন্যতম। এসব যুদ্ধকাব্য সাধারণত জঙ্গনামা (ফারসি) এবং গানগাথাগুলো ‘জারি’ নামে পরিচিত।

সন্ধ্যার পর হাবেলি বাড়ির আঙিনায় পা দিতেই বাবু চেয়ারম্যান সম্ভ্রমে স্বাগত জানান। বয়সে অনেক ছোট, তাই বাবুর বিনয়ের শুরু দেখি, শেষ নেই। দীর্ঘক্ষণ মহররম উৎসবের ইতিহাস-বিবর্তন-স্বরূপ নিয়ে আলাপ হয় আবদেল মাননান-সহযোগে। লেখক-গবেষক আবদেল মাননান এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে, তিনি সাধু-সন্তের মতো দেখতে হলেও একজন আধুনিক মানুষ। হাবেলি বাড়ির প্রকাশনাগুলো মুদ্রণে ব্যাপক সহায়তা করছেন। অতঃপর নৈশাহারে বসলে দেখি, কেবলই নিরামিষ। নানা ব্যঞ্জনে সমৃদ্ধ, কিন্তু অতীব সুস্বাদু। জীবনে প্রথম স্বাদ পেলাম বরুণপাতার ভর্তার। বাবুকে বললাম, ‘এত সুস্বাদের কারণ কী?’

‘বুঝলেন না, সবই ভক্তদের বাড়ি থেকে পাঠানো। সে জন্যই ভক্তকুলের বউ-ভগ্নিরা আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করেছেন এত সব রসনাতৃপ্তির ভর্তা-ভাজি-সালুন।’

হাবেলি বাড়ির বিশাল চত্বরে ‘হায় হোসেন’ মাতম
ছবি: লেখক

জানলাম, এ সময়ে কেউ আমিষ খান না, অতীতে নাকি চুল-দাড়ি-নখও কাটতেন না কেউ, আর পুরুষেরা যেতেন না স্ত্রী-সংসর্গে। কমবেশি সবাই রোজা রাখেন আশুরা পর্যন্ত। মহররমের চাঁদ দেখার আগেই প্রতি পরিবারে সাধ্যানুযায়ী চিড়া-মুড়ি প্রস্তুত করা হয়, চাঁদ দেখার পর থেকে ১২ দিন ঢেঁকিতে ধান-চাল কোটা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ। আশুরার দিবাগত রাতে জীবনহানির আশঙ্কায় অতিপ্রয়োজনেও কেউ ঘর থেকে বের হন না। এতদ্ব্যতীত আলাই মিয়ার মাজারসহ বিভিন্ন পাড়ার দরগাহগুলো ‘চাটার তৈলের’ প্রদীপ জ্বালানো হয় (মৃৎপাত্রে শর্ষের তেলে সুতা-সলিতায় অগ্নিসংযোগ)। অবলোকন করলাম নয়া সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি, যা ধর্মাচারকে ছাপিয়ে যায়। আর এই যে শত শত নগ্নপদ নারী-পুরুষ দেখছি শুয়ে-বসে আছেন উঠানে, বিভিন্ন ঘরের মেঝেতে, বারান্দায় তাঁদের শয্যা দিলেও নেবেন না। কারণ, এখন আশুরা, দুনিয়াটা নত হয়ে যাবে কষ্টে ও বিষাদে, এ সময়ে আরাম কিসের? তাঁরা সব এসেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ প্রভৃতি জেলা থেকে।

অন্য এক বিষাদসিন্ধুর তীরে যেন দাঁড়িয়ে আছি। রাতে আলাই মিয়ার (১২১৪-১৩০৯ বঙ্গাব্দ) মাজারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম অভূতপূর্ব এক কৃত্যানুষ্ঠান। সারা অষ্টগ্রাম থেকে মিছিলগুলো একটার পর একটা এসে হাবেলি বাড়ির বিশাল চত্বরে ‘হায় হোসেন’ বলে বলে বুক চাপড়ে কাতর হচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর মাইকে চিৎকার দিয়ে ঘোষণা করা হচ্ছে, বলো ভাইও ইমাম-ই-লস্কর...। অমনি কয়েক সেকেন্ড পর মিছিলটি থেমে যাচ্ছে। ওরা যুদ্ধের ময়দান থেকে দা, নেজা, বল্লম, লাঠি নিয়ে বিদায় হচ্ছে। অধুনা এসব যুদ্ধাস্ত্রে সংযুক্ত হয়েছে হকিস্টিক। তরুণসমাজ নিজেদের মতো করে এসব হাতিয়ারের আধুনিকায়ন করেছে। আর এই হেন বর্ণাঢ্য দৃশ্য নীরবে গোগ্রাসে গেলার মতো অবস্থা হয়েছে আগত অতিথি রমণীকুলের।

এরই মধ্যে গোলাপজলের ছিটায় শরীর নেয়ে উঠেছে, জামাটা শুকালেও মনে হলো লাশ বিদায়ের গন্ধ! অতঃপর মধ্যযামে শুরু হয় গাস্ত (তাওয়াফ/চক্কর)। তাঁরা একটি নাতিদীর্ঘ তাজিয়া নিয়ে ইমামবাড়ার চারপাশে সাতপাক দিলেন। পাক শেষে তাজিয়াটি স্থাপন করতেই বহুজন এটির পাদদেশে লম্বা হয়ে শুয়ে মাথা ঠেকিয়ে ভক্তি জানালেন। নিজ চোখে না দেখলে সম্ভব হতো না এই আতিশয্য বোঝা। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে যায় আসল মাতম দিবস, রাতের ভেতর ঢুকে যায় দিন। নিশি রাইত, কী আর করা, যেখানে রাত, সেখানেই কাত। বাড়ির সবাই মেঝেতে শায়িত; কিন্তু অতিথির জন্য তাঁরা ব্যবস্থা করেছেন পালঙ্ক।

বাতায়ন পাশের হাওরের বাতাসে নিদ্রা মন্দ হয়নি। নিশ্চিত, আজ সবাই সিয়াম সাধনায়। বাড়ির সামনে চোট্টানে গিয়ে দেখলাম, দুজন গায়েন মর্সিয়া গাইছেন, এ জারিগান বংশপরম্পরায় চলমান, এতে মিশ্রিত হয়েছে বহু স্থানীয় ডায়লেক্ট (উপভাষা), নিজস্ব কথ্য বাচনভঙ্গি, প্রস্বর। তাই অঞ্চলবাসী ছাড়া অন্যদের হৃদয়ঙ্গম হচ্ছে না; কিন্তু সেই কী আবেগ! মর্সিয়ার পালা শেষ হলে আবার শুরু হয় একই উন্মত্ত মিছিল ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’।

বাবু চেয়ারম্যানের প্রয়াত পিতা সৈয়দ কুতুব উদ্দিন আহমদ আল হোসাইনী চিশতীও একজন সুফি সাধক ও লেখক-গীতিকার। আমাদের এই বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলে কত যে জন্মেছেন বাউল, গীতিকার, সাধক ও সিদ্ধপুরুষ, কতজনের খবর রাখি আমরা? এসবেরই দালিলিক প্রমাণ পাঁচটি বই একে একে আমার হাতে এল। আবার ভারী হয়ে গেলাম, নিজেরগুলো খালাস করেও লাভ হয়নি। এসব বুকে চেপে অতঃপর ফিরে আসি ডাকবাংলোয়।

মোগল আমলে নির্মিত কুতুব শাহ্ মসজিদে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত সংস্কৃতির ছাপ দৃশ্যমান
ছবি: লেখক

মধ্যাহ্নের আলস্যের ফাঁকে দুটি প্রাচীন পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, আঙিনায় গমনের সুযোগ হয়েছিল। অষ্টগ্রাম জমিদারবাড়ির মসজিদটি অত পুরোনা না হলেও কুতুব মসজিদ মোগল আমলের। মোগলদের ১০ বছর (১৫৭৬-৮৬) অষ্টগ্রামে অবস্থানকালে যে কুতুব শাহ্ মসজিদ নির্মিত হয়, তার কারুকর্মে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত সংস্কৃতির ছাপ দৃশ্যমান। এতে আছে খোদাই করা মঙ্গলঘট, পদ্মফুল। মসজিদসংলগ্ন কবরগুলোর গায়েও পদ্মফুল-মঙ্গলঘট চিত্রায়িত হয়েছে। ওখান থেকে আমাদের হাবেলি বাড়ি পৌঁছানোর আগে আগে এদের তাজিয়া মিছিলটি যাত্রা শুরু করে দেয় মধ্য অষ্টগ্রাম কারবালার প্রান্তর অভিমুখে। আমরাও দ্রুত এদের পিছু নিলাম, লোকজন বলছেন, জুতা খুলতে হবে যে...। তাই তো! দ্রুত গাড়িতে পাদুকা রেখে আমরাও পদব্রজে যাই কারবালার ময়দানে। দেখলাম, চতুর্দিক থেকেই রংবেরঙের দিঘল তাজিয়া ছুটে আসছে কল্পিত কারবালা অভিমুখে। এই কৃত্যাচার দেখার জন্যই অপেক্ষা করে ছিলাম। একে একে প্রান্তরজুড়ে স্থাপিত হলো সিকি শত তাজিয়া। চোখ ফেরানো যায় না, একটার চেয়ে আর একটা বর্ণিল ও চোখধাঁধানো! বাতাসে তখন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মর্সিয়া সংগীত—মহররমের ১০ তারিখে কী ঘটাইলেন রাব্বানা, কলিজা ফাটিয়া যায়রে বলিতে তার ঘটনা, হায়রে বলিতে তার ঘটনা...।

একটু পর জরুরি প্রয়োজনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চলে গেলে তাঁর গাড়িতে চলে যায় আমার জুতাও। এ জন্য জুতা ছাড়া পাঁচ ঘণ্টা হেঁটেছি। ভালোই লাগছে, প্রাণভরে নিচ্ছি প্রাকৃতিক শক্তিপ্রবাহের নির্যাস, জীবনটা হচ্ছে রিফুয়েলিং; কিন্তু কাঁহাতক হাঁটা যায় অসমতল মাটিতে, একটি ইজিবাইক নিয়ে চলে গেলাম হাবেলি বাড়ি। বৃক্ষতলায় উপবিষ্ট চেনাজনেরা বলছেন, ফিইরা আইলেন যে? আরে এসেছি দেখতে বাড়িটার এখন কী অবস্থা। দেখবেন একটু পর একে একে বিদায় হবে সব...! আসলে এসেছি লোকনাথের অবয়বসদৃশ মাননান ভাইয়ের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের উদ্দেশে। বাবু তো ইতিমধ্যে কাবু। তিন দিনের ধকলে শরীর ক্লান্ত-অবসন্ন। উপবাসব্রত তাদের কেবলই ভঙ্গ হলো, তাদের ইফতারের তবারক পেয়েছি—শুকনা খইমুড়ির মধ্যে ডুবানো গুড়ের চাকা, পাকা কলা কাটা কাটা, সংযমেরও আতিশয্য।