ঐহিক অমরতায় রণদা প্রসাদ সাহা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দানবীর রণদা প্রসাদ সাহাকে তাঁর গ্রামের ছোট–বড় সবাই ডাকে জেঠামনি। অবিভক্ত ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া উপাধি ছিল রায়বাহাদুর। সে নামেও তাঁকে ডাকতেন অনেকে। কিন্তু তিনি সেই অভিজাত সম্বোধন পছন্দ করতেন না। তবে আর পি সাহা নামটিই ছিল সাধারণের মধ্যে অধিক পরিচিত। দাতা বা দানবীর এই মানুষটি মির্জাপুরবাসীর কাছে আজও জেঠামনি হিসেবেই যেন ঘরের মানুষ, প্রাণের ভালোবাসার মানুষটি। এক উচ্চতর মূল্যবোধের অধিকারী, বিস্ময়কর রকম শক্তিমান মানুষ ছিলেন দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা। তাঁর প্রাণশক্তি, শ্রমশক্তি ও চিন্তাশক্তি ছিল বিস্ময়কর। আর বোধের জায়গাটিতে—মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করাকে তিনি মানবীয় কর্তব্য মনে করতেন। পৃথিবীকে সবার জন্য সুখকর করে তোলা সম্ভব এই বিশ্বাসেই তিনি জনহিতকর কাজ করে যেতেন অক্লান্তভাবে। এই ব্রত থেকেই লাভ করেছিলেন ‘দানবীর’ অভিধা। তাঁর কীর্তির চেয়ে অনেক বড় ছিলেন তিনি।

রণদা প্রসাদ সাহার জন্ম ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর, টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কম্পাউন্ড থেকে পুত্র ভবানী প্রসাদসহ তাঁকে রাতের গভীরে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তারপর তাঁদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। ৭৪ বছরের কর্মময় জীবন রণদা প্রসাদ সাহার।

মির্জাপুর তখন একেবারেই অজপাড়াগাঁ। পিতা দেবেন্দ্র সাহার নির্দিষ্ট কোনো পেশা ছিল না। রুটিরুজির সন্ধানে বারবার তাঁকে পেশা বদল করতে হয়েছে। বেশির ভাগ সময়ে দলিল লেখকের কাজ করেছেন তিনি।

প্রসবকালে ধনুষ্টঙ্কারে অকালে মারা যান মা কুমুদিনী দেবী। তিনি রোগশয্যায় না পেয়েছেন এতটুকু ওষুধ-পথ্য, না পেয়েছেন সেবাযত্ন। শৈশবের এই অসহ্য স্মৃতি রণদা প্রসাদকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এমনভাবে যে পরবর্তীকালে তাঁকে তা একজন সেবকে পরিণত করেছিল। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুস্থ মানুষের সেবাপ্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী’।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অতুলনীয় মাতৃভক্তির কথা আমরা সবাই জানি। রণদা প্রসাদ বিদ্যাসাগরের মতো মাতৃভক্তি দেখানোর সুযোগ পাননি। তিনি মাকে হারান মাত্র সাত বছর বয়সে। মায়ের স্নেহের আঁচল জড়িয়ে ধরতে না ধরতে তিনি বিদায় নেন। অভাবের সংসারে প্রসূতি মায়ের যত্ন দূরে থাকুক, উপযুক্ত আহারই সময়মতো জোটেনি। চিকিৎসার জন্য সারা গ্রাম খুঁজে একজন ডাক্তারও সেদিন মেলেনি কিংবা অর্থাভাবে কোনো ডাক্তার আনা যায়নি। প্রসবকালে ধনুষ্টঙ্কারে অকালে মারা যান মা কুমুদিনী দেবী। তিনি রোগশয্যায় না পেয়েছেন এতটুকু ওষুধ-পথ্য, না পেয়েছেন সেবাযত্ন। অশৌচের অসিলায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুই ছিল তখনকার দিনে মেয়েদের এক মর্মান্তিক নিয়তি। মায়ের এই মৃত্যুদৃশ্যের নীরব দর্শক ছিল সাত বছরের অবোধ বালক রণদা প্রসাদ। শৈশবের এই অসহ্য স্মৃতি রণদা প্রসাদের নিদ্রা-জাগরণের প্রতিটি মুহূর্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এমনভাবে যে পরবর্তীকালে তাঁকে তা একজন সেবকে পরিণত করেছিল। নিজের মায়ের জীবন দেখে তিনি নারী জীবনের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করেন এবং নারী জাতির কল্যাণ্যে কিছু করার সংকল্প গ্রহণ করেন। সামর্থ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই দুঃখ-স্মৃতিকে রূপ দিয়েছিলেন দুস্থ মানুষের সেবাপ্রতিষ্ঠান ‘কুমুদিনী’তে—স্থাপন করেছিলেন মাতৃভক্তির এক অনন্য নজির।

রণদা প্রসাদ সাহা কোলাজ
লেখকের সৌজন্যে

মির্জাপুরে রণদা প্রসাদের নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ হয়েছিল। সারা জীবনে এইটুকুই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। কুমুদিনী দেবীর মৃত্যুর কিছুদিন পরেই দেবেন্দ্র সাহা পুনরায় বিয়ে করেন। অভাব–অনটনের মধ্যে সৎমায়ের সংসারে রণদা ও তাঁর ভাই-বোনদের থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। রণদার আশ্রয় হয় মামাবাড়ি, সাভারের অদূরে শিমুলিয়ার কাছৈড় গ্রামে। মাতৃহারা রণদার মন পিতা ও বিমাতার আচরণে এমনিতেই বিষিয়ে উঠেছিল। স্নেহের কাঙাল শিশুমন টিকল না সেখানেও। তিনি পালিয়ে গেলেন নিরুদ্দেশে, যখন সবেমাত্র কৈশোরে পা দিয়েছেন। অনেক দিন পর জানা গেল নতুন জীবনের সন্ধানে সবার অলক্ষে রণদা প্রসাদ পৌঁছে গেছে কলকাতায়। কলকাতা তখন কেবল বাংলারই না, ছিল সারা ভারতের রাজধানী। ১৯১২ সালে ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নেওয়া হয়। তারপরও কলকাতার গুরুত্ব কমতে সময় লেগেছে। সে অবস্থায় আত্মীয়-বান্ধবহীন, সহায় সম্বলহীন, কপর্দকহীন অজপাড়াগাঁয়ের এক কিশোর পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ নগরী কলকাতায় গিয়ে কীভাবে আত্মরক্ষা করল, সেই সঙ্গে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল, সে এক বিস্ময়কর ঘটনা।

কিশোর বয়সে কলকাতায় প্রতিকূল পরিবেশের পায়ে মাথা খুঁড়তে হয়েছে তাঁকে প্রতিনিয়ত। শুধুই বন্ধ দরজা, কোথাও আশ্রয় নেই। না পাওয়ার বেদনায় ভরে উঠেছে জীবনের পেয়ালা। দেশের অবস্থাও তখন তেমনি। একদিকে বিপ্লবের অস্থিরতা, অন্যদিকে বিফলতার গ্লানি। সে সময়ে স্কুল-কলেজের শিক্ষা প্রসারের ফলে ইংরেজ সৃষ্ট মধ্যবিত্ত সমাজে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে উঠেছে। কিন্তু সে অনুপাতে চাকরি জুটছে না। অথচ পল্লিকেন্দ্রিক মানুষ ইংরেজি শিক্ষা লাভ করে আর পল্লিগ্রামে ফিরে যেতে চাইছে না। অবহেলিত ও পরিত্যক্ত পল্লিবাংলায় তখন ব্যাপক ম্যালেরিয়া বিস্তার লাভ করেছে। গ্রামবাংলার কুটিরশিল্প নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং শহরে কলকারখানা প্রসারের ফলে অশিক্ষিত মানুষও শহরে এসে ভিড় করছে। শহরেও চাকরির অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে। এরই ভেতর দানা বেঁধে উঠেছে ইংরেজ খেদাও বিপ্লব। রণদা প্রসাদকে বিপ্লব হাতছানি দিল এবং তিনি জড়িয়ে পড়লেন তাতে। এই সময়ে জঠরজ্বালা নিবৃত্তির জন্য নির্দ্বিধায় তিনি সব কাজই করেছেন—কুলিগিরি থেকে শুরু করে ফেরিওয়ালা কখনোবা রেলস্টশনে খবরের কাগজ বিক্রি। হতাশা কখনোই তাঁকে কাবু করতে পারেনি। জীবনকে তিনি হালহীন নৌকার মতো ভেসে যেতে দেননি। নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য জীবনকে তিনি কর্মের মন্ত্রে বেঁধেছিলেন। দেশসেবায় আত্মনিবেদন ছিল সেই জীবনসংগ্রামেরই স্বাভাবিক পরিণতি। স্বদেশি আন্দোলনের সশস্ত্র ধারাটাই তাঁকে আকর্ষণ করেছিল। অচিরেই পুলিশের নজরে পড়লেন তিনি। কয়েকবার পুলিশের হাতে মারধর খেলেন, কিছুদিন জেলেও থাকলেন। মাতৃভূমির যে স্বাধীনতা ছিল সেদিনের মানুষের একান্ত আকাঙ্ক্ষায়, তাতে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল রণদা প্রসাদের হৃদয়। সৎমায়ের অত্যাচার আর বাবার অবহেলায় ঘরছাড়া কোমল হৃদয় ছেলেটির মনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনালগ্নে দেশপ্রেমের যে বীজটি উপ্ত হয়েছিল, পরবর্তীকালে জনকল্যাণের কর্মকাণ্ডে তাঁর আত্মনিয়োগ তারই ফল।

রণদা প্রসাদ সাহার জন্ম ১৮৯৬ সালের ১৫ নভেম্বর, টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা নারায়ণগঞ্জের কুমুদিনী কম্পাউন্ড থেকে পুত্র ভবানী প্রসাদসহ তাঁকে রাতের গভীরে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তারপর তাঁদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রণদা প্রসাদ সাহা সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁকে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর-সেবক সৈনিক হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যুদ্ধ চলাকালে তাঁর কোর ইরাকের মেসোপটেমিয়াতে স্থানান্তরিত হয়। সেখানে তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অগ্নিকাণ্ডকবলিত একটি ফিল্ড হাসপাতালের যুদ্ধাহত সৈনিকদের রক্ষা করেন। বীরত্বের ও মানবসেবার এই দুঃসাহসী দৃষ্টান্ত রণদা প্রসাদকে সামান্য থেকে অসামান্য করে তোলে। তাঁর অকল্পনীয় এই শৌর্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বিশেষ পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করে।

১৯১৭ সালে রণদা প্রসাদ সাহা ৪৬ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টে অস্থায়ী সুবাদার মেজর পদে যোগ দেন। নতুন করে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে বাঙালি পল্টনের সঙ্গে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য যান নওশেরায়। সেখানে মাস তিনেক ট্রেনিং গ্রহণের পর যান করাচিতে। করাচি সেনানিবাসে রণদা প্রসাদের সঙ্গে পরিচয় হয় সৈনিক কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। পরিচয় থেকে কবির সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে উঠেছিল সহজেই। সৈনিক জীবনের শিক্ষা যে তাঁদের দুজনের অভিজ্ঞতাকে প্রসারিত করতে, দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করতে, সর্বোপরি জীবনকে চিনে নেওয়ার প্রস্তুতিকে পূর্ণতা দিতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সৈনিক জীবন যেমন কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলার প্রাদেশিক গণ্ডি ছাড়িয়ে সর্বভারতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক চেতনাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তেমনি সৈনিক জীবনের শৃঙ্খলাবোধ ও সংঘবদ্ধ সমবায়ী জীবনযাপন রণদা প্রসাদ সাহাকে পূর্ণ দায়িত্ববান যুবকে পরিণত করেছিল। সামরিক শিক্ষার পাশাপাশি আরও যে বিষয়টি তিনি তাঁর ভেতরে ধারণ করেছিলেন, তার প্রতিফলন বাস্তব জীবনে আমরা তাঁর নেতৃত্বে দেখতে পাই, সেই সঙ্গে দেখি অদ্ভুত দেশাত্মবোধ।

মুক্তিযুদ্ধে শহীদ দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা ও পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহা
ছবি: সংগৃহীত

পরবর্তীকালে রণদা প্রসাদ সাহা যখন জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, তৈরি করেছেন তাঁর স্বপ্নসৌধ কুমুদিনী হাসপাতাল, যা তখন সুখ্যাতি অর্জন করেছে দেশে-বিদেশে, কবির অসুস্থতার খবর পান সাতচল্লিশ–পরবর্তী সময়ে। তিনি অসুস্থ কবিকে কলকাতা থেকে এনে চিকিৎসা করাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নানা জটিলতায় তখন ভারত থেকে কবিকে এনে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাঁর প্রাণ কাঁদত কবির জন্য। নজরুল-গবেষক অধ্যাপক করুণাময় গোস্বামীর সাক্ষাৎকারে জানা যায়, কবির দুই ছেলে এখানে এলে দেখা করতেন রণদা প্রসাদ সাহার সঙ্গে। আর্থিক সহায়তা ছাড়াও তিনি তাঁদের নানাভাবে সাহায্য করতেন।

বিলাতে রাজকীয় সম্মানের পর সৈনিক রণদা প্রসাদ সাহা
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম মহাযুদ্ধফেরত ভারতীয়দের যোগ্যতা অনুসারে ইংরেজ সরকার কোনো না কোনো সরকারি চাকরির সুযোগ দেয়। রণদা প্রসাদের লেখাপড়া সামান্য হলেও তিনি যুদ্ধফেরত হিসেবে রেলের টিকিট কালেক্টরের চাকরি পান। চাকরিটি বেশি দিন টেকেনি। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে পড়ায় ১৯৩২ সালে তাঁকে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে হয়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে পান কিছু টাকা। ইট-কাঠ-পাথরের শহর কলকাতায় তখন যুক্ত হয়েছে আরেকটি বস্তু—কয়লা। ক্ষতিপূরণের সামান্য অর্থকে পুঁজি করে শুরু করেন কয়লার ব্যবসা। প্রথমে বাড়ি বাড়ি সরবরাহ। তারপরে বড় বড় সাপ্লাই। ধনাঢ্য রণদা প্রসাদের আত্মপ্রকাশের সূচনা ঘটে এভাবে। পাট ব্যবসায়ের জন্য কিনে নেন নারায়ণগঞ্জের জুট বেইলিং অ্যান্ড প্রেসিং মেশিন আর কাঁচা পাট সংরক্ষণের জন্য গুদামসহ বিশাল অ্যান্ডারসন্স কোম্পানি। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা করতে গিয়ে তিনি যুদ্ধের পরে তাদের এই সব পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠান কিনে নিয়ে এগুলোকে সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করেন এবং অত্যন্ত লাভজনক করে তোলেন।

কয়লার ব্যবসার সূত্রে রণদা প্রসাদ লক্ষ করলেন যে তাঁর জনৈক খরিদ্দার, যিনি একজন লঞ্চের মালিক, কিছুদিন থেকে কয়লার দাম পরিশোধ করতে পারছেন না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন যে তাঁর ব্যবসা ভালো চলছে না এবং তিনি লঞ্চ বিক্রির জন্য খরিদ্দার খুঁজছেন। নিজের বাকি টাকা আদায় এবং অপেক্ষাকৃত কম দামে একটি লঞ্চ কিনতে পারা—এই দুইয়ের সদ্ব্যবহারের জন্য তিনি নিজেই সেই লঞ্চটি কেনার প্রস্তাব দেন। এই লঞ্চ দিয়েই তাঁর জলযান ব্যবসার শুরু। কিছুদিন পর তিনি দেখলেন লঞ্চ সারানোর জন্য প্রায়ই ডকইয়ার্ডে প্রচুর অর্থ গচ্চা দিতে হয়। একাধিক লঞ্চ থাকলে খরচ আরও বাড়ে। ডকইয়ার্ড থাকলে নিজের খরচও কমে, অন্যদের কাজও করা যায়। এভাবেই নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যার তীরে তিনি ডকইয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন। ক্রমে নদীপথে মালামাল বহনের জন্য ‘বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানি’ গড়ে তোলেন। তাঁর এই ব্যবসার সঙ্গে যৌথভাবে ছিলেন মহেরার জমিদার নৃপেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরী, রাজনীতিবিদ ও ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়, ধনপতি ও রাজনীতিক নলিনীরঞ্জন সরকার ও জাস্টিস জে এন মজুমদার। বেঙ্গল রিভার সার্ভিস কোম্পানির কাজ ছিল দেশের বিভিন্ন বন্দরে নদীপথে মাল আনা-নেওয়া। এই কোম্পানিই তাঁকে নৌপরিবহন ব্যবসার একজন সফল ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

করাচি সেনানিবাসে রণদা প্রসাদের সঙ্গে পরিচয় হয় সৈনিক কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। পরিচয় থেকে কবির সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে উঠেছিল সহজেই। সৈনিক জীবনের শিক্ষা যে তাঁদের দুজনের অভিজ্ঞতাকে প্রসারিত করতে, দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার করতে, সর্বোপরি জীবনকে চিনে নেওয়ার প্রস্তুতিকে পূর্ণতা দিতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নারায়ণগঞ্জকে তিনি তৈরি করেন তাঁর ব্যবসায়ের কর্মকেন্দ্র হিসেবে। নারায়ণগঞ্জে কুমুদিনী কমপ্লেক্স নামে বিরাট এলাকাব্যাপী ব্যবসায়িক কমপ্লেক্স গড়ে তোলেন।

রণদা প্রসাদ সাহার চরিত্রে ছিল এক আশ্চর্য গুণ। যেসব ব্যবসায় অন্যরা ব্যর্থ হয়ে নামমাত্র মূল্যে বেচে দিত, সেগুলো তিনি কিনে নিতেন এবং দক্ষতা ও ঐকান্তিকতায় তাঁকে সফল করে তুলতেন।

ব্যবসায়ী গোত্রের সন্তান বলেই সম্ভবত তিনি যেকোনো ব্যবসার প্রধান সাংগঠনিক সমস্যাগুলো বুঝতে ও দ্রুত সমাধান করতে পারতেন। ব্যবসার এক পর্যায়ে রণদা প্রসাদ সাহা তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কল্যাণধর্মী কাজের স্বার্থে একটি ট্রাস্টভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন—এর নাম দেন কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট আব বেঙ্গল। ১৯৪৭ সালে থেকে ট্রাস্ট তাঁর সব ব্যবসার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং কল্যাণ ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করে।

রণদা প্রসাদ সাহার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। জীবনের পাঠশালাতেই তাঁর শিক্ষালাভ। পুঁথি-পুস্তকের পাতা থেকে আহরিত বিদ্যার চেয়ে এই বিদ্যা যে আনেক বেশি জীবন্ত ও বাস্তব, এই সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন তিনি জীবনের শুরুতেই। তিনি বলতেন, ‘মানুষের দুটো জাত—নারী ও পুরুষ আর ধর্ম একটাই, মানবধর্ম। আমি মানুষ, এটাই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। মানুষ হতে চেষ্টা করো, এটাই হবে তোমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।’ এভাবেই তাঁর গড়ে তোলা সব কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের তিনি দিয়েছিলেন মানবিক সাম্যের পাঠ।

রণদা প্রসাদের চিন্তাচেতনায় গতির প্রচণ্ড আবেগ লক্ষণীয়। গতানুগতিক ভাবধারা পাল্টে দিয়ে সংস্কারমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য কর্মস্থল হিসেবে তিনি বেছে নিয়ে ছিলেন শহর থেকে বহুদূরে একটি গণ্ডগ্রাম। বিশ শতকের শুরুতে গ্রামটিতে ছিল কিছু বসতবাড়ি আর জলাজঙ্গলের সঙ্গে অশিক্ষা ও প্রচণ্ড কুসংস্কারের বেড়াজাল। ঢাকা থেকে মির্জাপুর ৬৭ কিলোমিটার দূরে হলেও একমুখী স্রোতের লৌহজং নদীটিই ছিল তখনকার সময়ে যাতায়াতের একমাত্র পথ।

১৯৩৮ সালে সেই নদীর পাড়েই কুমুদিনী হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার স্ত্রী কিরণবালা দেবী এ দেশের প্রথম আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেটাই এখনকার ভারতেশ্বরী হোমস। ভারতেশ্বরী দেবী ছিলেন রণদা প্রসাদের প্রপিতামহী।

দেশাচারের প্রতি অন্ধভক্তি এবং অর্থহীন প্রথানুগত্যের বাঁধনে শৃঙ্খলিত সেই সমাজে মেয়েদের বাইরে বেরোনো নিষিদ্ধ ছিল। প্রতিভা থাকলেও পারিবারিক অবরোধের বেড়াজাল ডিঙিয়ে তাদের আত্মবিকাশের পথ ছিল না। এই সব গৃহবন্দী মেয়েদের কথা চিন্তা করেই রণদা প্রসাদ সেই শৃঙ্খলকে ভাঙতে এগিয়ে আসেন। প্রতিকূল সামাজিক পরিস্থিতিতে মেয়েদের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান—ভারতেশ্বরী হোমস প্রতিষ্ঠা সে সময়ে রীতিমতো চ্যালেঞ্জই ছিল, যা তাঁর উদ্যম, উদ্যোগ ও কল্পনাশক্তির জোরে অসাধারণ উন্নতি লাভ করেছে। গোটা দেশে পরিচিতি লাভ করেছে ব্যতিক্রম আদর্শ বিদ্যাপীঠ হিসেবে। শুরুতে ছাত্রীদের তিনি অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রায় জোর করে এনে ভর্তি করিয়েছেন। ছাত্রীদের লেখাপড়া, কাপড়চোপড়, বিছানাপত্র, চিকিৎসা—সবই দিয়েছেন বিনা মূল্যে। আধুনিক শিক্ষাদানের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনকি বেশি সুযোগ–সুবিধা দিয়ে বিদেশ থেকেও অভিজ্ঞ শিক্ষকদের নিয়ে আসতেন। নিয়মিত শরীরচর্চার জন্য ছিলেন বিদেশি শিক্ষক। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এর শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজি। বর্তমানে জাতীয় শিক্ষা কার্যক্রমকেই অনুসরণ করা হচ্ছে।

১৯৪৩ সাল। স্থানীয় লোকজনের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের তেমন কোনো সুযোগ না থাকায় রণদা প্রসাদ মানিকগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করেন ডিগ্রি কলেজ। এটি তাঁর বাবা দেবেন্দ্র সাহার স্মৃতিবাহী ‘দেবেন্দ্র কলেজ’। এই বছরে টাঙ্গাইলে মায়ের নামে প্রতিষ্ঠা করেন কুমুদিনী মহিলা কলেজ। কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। মির্জাপুর এস কে পাইল্ট উচ্চবিদ্যালয়, করটিয়া সাদাত কলেজ, সন্তোষে মওলানা ভাসানী ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ রণদা প্রসাদের দান রয়েছে দেশের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

‘সম্রাট আলমগীর’ নাটকে আলমগীর চরিত্রে রণদা প্রসাদ সাহা
ছবি: সংগৃহীত

শিল্প–সাহিত্যের প্রতি ছিল রণদা প্রসাদের গভীর অনুরাগ। প্রতিষ্ঠানের সবাইকে নিয়ে নানা উৎসবে আয়োজন করতেন নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। পছন্দ করতেন অভিনয় করতে। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জেনেছি, তিনি অভিনয়ে পেশাদার অভিনেতার মতোই চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন। ১৯৬৯ সালে পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ক্ষীরোদপ্রসাদ রচিত আলমগীর নাটকে আলমগীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।

এ-ও ছিল কঠোর কর্মযজ্ঞের মধ্যে তাঁর আনন্দলাভের আরেকটি ধরণ। বলা বাহুল্য, এই শিল্পীমনটি রণদা প্রসাদের চরিত্রে অন্য রকম এক মাত্রা যোগ করেছিল।

১৯৭১ সাল। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের এই দেশ। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে, সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রাণ দিতে হয়েছে দেশের বহু জ্ঞানী-গুণী, মহৎপ্রাণ মানুষকেও। পিতা রণদা প্রসাদ সাহা ও পুত্র ভবানী প্রসাদ সাহাকেও সেদিন শহীদদের মহামিছিলে শামিল হতে হয়েছে। দেশের জন্য তখন বরণ করতে হয়েছে একই রকম মর্মান্তিক ভাগ্য। যাঁরা মানুষকে ভালোবেসে, মানুষের পরিচর্যা করে, মনুষ্যহিতে ব্রতী হয়ে মানুষের মঙ্গলসাধনে স্বার্থত্যাগ ও আত্মোৎসর্গ করেছেন, ইতিহাসে তাঁদের নাম লেখা রবে স্বর্ণাক্ষরে। কালীপ্রসন্ন ঘোষের ভাষায় তাঁরাই পেয়েছেন ‘ঐহিক অমরতা।’

ঐহিক অমরতায় একজন রণদা প্রসাদ সাহার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।