গত শতকের আশির দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত দ্বৈত কণ্ঠের একটি গান ভীষণভাবে জনপ্রিয় হয়। আমরা ছোটবেলায়ও সেই গান শুনেছিলাম। নতুন করে জনপ্রিয় হওয়া গানটি ছিল—‘পৃথিবী আমারে চায়/ রেখো না বেঁধে আমায়/ খুলে দাও প্রিয়া/ খুলে দাও বাহুডোর’। টেলিভিশনের জন্য গানটি গেয়েছিলেন কাদেরী কিবরিয়া ও সাবিহা মাহবুব।
গানের মূল কারিগর কম্পোজার কমল দাশগুপ্ত ও গীতিকার মোহিনী চৌধুরী।
‘আমি বনফুল গো’ সব প্রজন্মের কাছেই প্রিয় গান। আমরা জানতাম, শ্রোতাদের একটা বড় অংশ জানতেন, এটা কাজী নজরুল ইসলামের গান। এখনো অনেকে তা–ই জানেন। অথচ কালজয়ী এই গানের কম্পোজার কমল দাশগুপ্ত ও গানের কথা লিখেছেন প্রণব রায়।
অনেক গানের প্রয়োজন নেই, ‘পৃথিবী আমারে চায়’ ও ‘আমি বনফুল গো’ গান দুটির সুরের ভিন্নতা ও গভীরতাই বলে দেয় কমল দাশগুপ্ত কত বড় মাপের সুরকার ছিলেন।
পুরো নাম কমল প্রসন্ন দাশগুপ্ত। ১৯১২ সালের ২৮ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। পিতা তারাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত, উচ্চাঙ্গ সংগীত চর্চা করতেন। বড় ভাই বিমল দাশগুপ্ত ও ছোট ভাই সুবল দাশগুপ্তও সংগীতজগতের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব।
কাজী নজরুল ইসলামের কাছে গান শিখেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের অপার স্নেহ পেয়েছেন। কবির লেখা অনেক গানে সুর দিয়েছেন। রেকর্ডের জন্য নজরুলসংগীত গেয়েছেন। কিছু গান যূথিকা রায়ের সঙ্গেও গেয়েছেন। যূথিকা রায়ের সঙ্গে গাওয়া নজরুলসংগীতের মধ্যে আছে: ‘প্রিয় আসিল রে’, ‘মোরা কুসুম কাঁদি কুঞ্জবনে’, ‘রুমঝুম রুমঝুম’ ইত্যাদি।
পিতার কাছেই গান শেখার শুরু। পরে বড় ভাই বিমল দাশগুপ্তের কাছে গানে তালিম নেন। সংগীত শিক্ষায় কৃষ্ণচন্দ্র দে-র স্নেহ পেয়েছিলেন। ওস্তাদ জমীরুদ্দীনকে মূল গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন।
ব্রজেন গঙ্গোপাধ্যায় ও অনাদি দস্তিদারের কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন। দিলীপকুমার রায়ের কাছে পাশ্চাত্য সংগীত সম্পর্কে জেনেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের কাছেও গান শিখেছেন।
প্রচুর রবীন্দ্রসংগীত জানা থাকলেও, রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড করেননি। তিনি মনে করতেন, রবীন্দ্রসংগীত তাঁর কণ্ঠে ভালো শোনাবে না।
রবীন্দ্রসংগীত না গাইলেও, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুতে শোকাহত কমল দাশগুপ্ত কবির সম্মানে দুটি গানে সুর দিয়েছেন, গেয়েছেন। দুটি গানেই তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ দিয়েছেন যূথিকা রায়। একটি গান প্রণব রায়ের লেখা, ‘দিন চলে যায়, হে কবি বিদায়’, অন্যটি শৈলেন রায়ের লেখা ‘সন্ধ্যা নামিল গঙ্গার তীরে’।
কাজী নজরুল ইসলামের অপার স্নেহ পেয়েছেন। কবির লেখা অনেক গানে সুর দিয়েছেন। রেকর্ডের জন্য নজরুলসংগীত গেয়েছেন। কিছু গান যূথিকা রায়ের সঙ্গেও গেয়েছেন।
কমল দাশগুপ্তের গাওয়া নজরুলসংগীতের মধ্যে আছে: ‘আধো আধো বোল’, ‘প্রিয়তমা এস ফিরে’, ‘চল রে চপল তরুণদল’, ‘প্রভাত বীণা তব বাজে হে’, ‘চম্পা পারুল যূথি’, ‘শঙ্কাশূন্য লক্ষ কণ্ঠে’, ‘এসো আনন্দিতা ত্রিলোক’, ‘আমি চাঁদ নহি অভিশাপ’, ‘তব মুখখানি খুঁজিয়া ফিরি গো’, ‘তুমি হাতখানি যবে’, ‘গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়’ ইত্যাদি।
যূথিকা রায়ের সঙ্গে গাওয়া নজরুলসংগীতের মধ্যে আছে: ‘প্রিয় আসিল রে’, ‘মোরা কুসুম কাঁদি কুঞ্জবনে’, ‘রুমঝুম রুমঝুম’ ইত্যাদি।
প্রণব রায়ের লেখা পছন্দ করতেন। তাঁর লেখা প্রচুর গানে তিনি সুর দিয়েছেন। ১৯৩৪ সালে কমল দাশগুপ্তের সুরে প্রণব রায়ের কথায়, যূথিকা রায় দুটি গান রেকর্ড করলেন। গানদুটি—‘আমি ভোরের যূথিকা’ ও ‘সাঁঝের তারকা আমি’। এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। গানে কোনো তালবাদ্য ব্যবহার করেননি। যূথিকা রায়ের দুটি গানই আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পায়।
প্রণব রায়ের লেখা কমল দাশগুপ্তের সুরে জনপ্রিয় হওয়া অনেক গানের মধ্য থেকে কয়েকটি : ‘কতদিন দেখিনি তোমায়’, ‘ফুরাবে এ মধু চৈতালী বেলা’, ‘এসেছিল মধু যামিনী’, ‘কণ্ঠ আমার নিশিদিন’।
কাজী নজরুল ইসলাম ও প্রণব রায় ছাড়াও অন্য যাঁদের লেখায় কমল দাশগুপ্ত সুর দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য—অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায়, সুবোধ পুরকায়স্থ, মোহিনী চৌধুরী, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত।
কমল দাশগুপ্ত সৃষ্ট কিছু জনপ্রিয় গান: ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন’, ‘সাঁজের তারকা আমি’, ‘মেনেছি গো হার মেনেছি’, ‘আমি ভোরের যূথিকা’, ‘তুমি কী এখন দেখিছ স্বপন’, ‘আমি বনফুল গো’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারী করেছে’, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’, ‘তোমার জীবন হতে’, ‘ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখ’।
কমল দাশগুপ্ত হিন্দি গান, ভজনেও সুর দিয়েছেন। যাঁদের লেখায় সুর দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন—মীরা, কবির, সুরদাস, কামাল আমরোহি, মহম্মদ বকস, পণ্ডিত মাধুর, ভূষণ, ফৈয়াজ হাশমি, হসরত জয়পুরি, রাজেশ্বর গুরু, মুনির আলম।
শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের সিনেমা ‘পাতালপুরী’র সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন কমল দাশগুপ্ত। এভাবেই সিনেমার সংগীত পরিচালনায় তিনি যুক্ত হন। ১৯৩৬ সালে প্রথম এককভাবে সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন। সিনেমার নাম ‘পণ্ডিত মশাই’। এরপর বেশ কিছু সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন। এর মধ্যে আছে—‘যোগাযোগ’, ‘পণ্ডিত মশাই’, ‘গরমিল’, ‘ভাবীকাল’, ‘বিদেশিনী’, ‘মধুমালতী’, ‘গোবিন্দদাস’, ‘গিরিবালা’, ‘প্রার্থনা’, ‘মন্দির’ প্রভৃতি। তিনি কিছু হিন্দি ছবিরও সংগীত পরিচালনা করেছেন।
কমল দাশগুপ্ত ও সুবল দাশগুপ্ত একটি কাওয়ালি দল করেছিলেন। দলের নাম ছিল ‘চাঁদ সবুজ’। হামদ-নাতও করেছেন। বলা যায়, সংগীতের প্রায় সব ধারায় তিনি যুক্ত ছিলেন।
কমল দাশগুপ্ত সৃষ্ট কিছু জনপ্রিয় গান: ‘এমনি বরষা ছিল সেদিন’, ‘সাঁজের তারকা আমি’, ‘মেনেছি গো হার মেনেছি’, ‘আমি ভোরের যূথিকা’, ‘তুমি কী এখন দেখিছ স্বপন’, ‘আমি বনফুল গো’, ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারী করেছে’, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’, ‘তোমার জীবন হতে’, ‘ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখ’, ‘আমি ভুলে গেছি তব পরিচয়’, ‘শতক বরষ পরে’।
কমল দাশগুপ্ত ও ফিরোজা বেগম ১৯৫৬ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
কমল দাশগুপ্ত প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন; কিন্তু রাখতে পারেননি। এই প্রসঙ্গে তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাফিন আহমেদ তাঁর জীবন নিয়ে লেখা ‘পথিকার’ গ্রন্থের লেখককে বলেছেন, ‘আব্বার এরকম ইনকামের টাইমে—যখন গানের জগতে চরম পদচারণ চরমভাবে সাকসেসফুল, তখন তার এক বন্ধু একটা ব্যাংক খুলল। ভদ্রলোকের নাম ছিল নীল। ব্যাংক খুলেছে, তার মানে প্রচুর অর্থ আছে তার। সে রিকোয়েস্ট করল আব্বাকে “কমল, তুই ব্যাংকে টাকা রাখ।” তার তো অ্যাকাউন্ট দরকার, সদ্য ব্যাংক খুলেছে। আব্বা ফ্রেন্ডের ব্যাংকে টাকা রাখতে শুরু করল। আস্তে আস্তে দেশও মডার্ন হচ্ছে। একসময় ক্যাশ রাখত বাসায়; এখন ব্যাংকে। সেই ব্যাংক ক্র্যাশ করল। কলাপস করল। ব্যাংকটা টিকল না। আব্বার সমস্ত সেভিংস; যা কিছু সঞ্চয় ধূলিসাৎ হয়ে গেল।’
কমল দাশগুপ্তের সৃষ্টি নিয়ে শাফিন আহমেদ জানাচ্ছেন, ‘চল্লিশে একেবারে ফাটাফাটি, পঞ্চাশটাও চমৎকার যেতে যেতে পঞ্চাশের মাঝামাঝি সময় থেকে ডিক্লাইন শুরু হলো। বিভিন্ন কারণে; স্বাস্থ্যগত সমস্যা ইত্যাদি ইত্যাদি।’
কমল দাশগুপ্তের অসুস্থতা ও সেই সময়ে সুর করা নিয়ে ‘বাঙালির কলের গান’ নামক গ্রন্থের জন্য গ্রন্থের লেখক আবুল আহসান চৌধুরীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যূথিকা রায় বলেছেন, ‘তার একটা গলস্টোন ছিল। সেটা তিনি অপারেশন করলেন না। মানে তার মা চাইলেন না, সেইজন্য তিনি সেটা অপারেশন করলেন না। তারপর থেকে তিনি আর সুর করতে পারতেন না কোনো। সোজাভাবে দাঁড়াতে পারতেন না—কাঁপতেন।
আর সুর করার সময় তার সেই নোটেশনগুলো, যেটা আমরা পেতাম—তারপর অন্য রকম হয়ে যেত। সে জন্য উনি নিজেই আমাদের গান রেকর্ড করা বন্ধ করেছিলেন।’
কলকাতায় বিপুলভাবে ব্যস্ত সময় কাটানো সংগীতস্রষ্টা ঢাকায় অনেকটা অলস সময় কাটিয়েছেন। সংগীত নিয়ে নতুন করে কোনো চেষ্টা তাঁর তরফ থেকে দেখা যায়নি। শেষ বয়সে ব্যবসায় যুক্ত হন। হাতিরপুলের মোড়ে তাঁর স্টেশনারির দোকানে কাগজপত্র, কলম-পেনসিল ইত্যাদি বিক্রি হতো।
কমল দাশগুপ্তের সুরে গান না পেয়ে, যূথিকা ওই সময়ে অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গান গেয়েছেন।
ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে কমল দাশগুপ্তের পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিল। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিলেন ফিরোজা বেগম। ১৯৬৭ সালে সন্তানদের নিয়ে তিনি কলকাতা থেকে রাজশাহী এলেন। ফিরোজা বেগমের ভাই আসাফউদদৌলা তখন রাজশাহীর ডেপুটি কমিশনার। ভাইয়ের বাসায় কয়েক দিন থেকে ফিরোজা বেগম সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। ঢাকার ভূতের গলির ভাড়া বাসায় উঠলেন। কিছুদিন পর কমল দাশগুপ্ত কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন।
কলকাতায় বিপুলভাবে ব্যস্ত সময় কাটানো সংগীতস্রষ্টা ঢাকায় অনেকটা অলস সময় কাটিয়েছেন। সংগীত নিয়ে নতুন করে কোনো চেষ্টা তাঁর তরফ থেকে দেখা যায়নি। এমনকি ফিরোজা বেগম যখন রেওয়াজ করতেন, তিনি শুনতেন; কিন্তু কোনো মন্তব্য করতেন না। শেষ বয়সে ব্যবসায় যুক্ত হন। কমল দাশগুপ্ত ও ফিরোজা বেগম আলোচনা করে একটি স্টেশনারির দোকান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দোকানের নাম ঠিক করা হয় ‘পথিকার’। হাতিরপুলের মোড়ে এই স্টেশনারির দোকানে কাগজপত্র, কলম-পেনসিল ইত্যাদি বিক্রি হতো। কমল দাশগুপ্ত ব্যবসা পরিচালনা করতেন।
মানুষের জীবন কত বিচিত্র হতে পারে তার একটা উজ্জ্বল উদাহরণ কমল দাশগুপ্ত। শাফিন আহমেদ যথার্থই বলেছেন, ‘জীবন বড়ই বিচিত্র। অদ্ভুত। কোথা থেকে কোথায়। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে মিউজিক করে দুনিয়া কাঁপিয়ে দিয়ে এসে হাতিরপুলে দোকান। ট্র্যাজিক! ইট ইজ ভেরি ট্র্যাজিক!!’
২০ জুলাই ১৯৭৪, কমল দাশগুপ্ত ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।