জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধা
দিনলিপির দর্পণে তাজউদ্দীন আহমদ
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি শুধু তাঁর ব্যক্তি-প্রতিকৃতি নয়, রাজনৈতিক অভিযাত্রার অনন্য দলিল। এই নিবন্ধে উদ্ভাসিত হয়েছে তাজউদ্দীনের দূরদর্শিতা।
তাজউদ্দীন আহমদ যে নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন, এ তথ্যটা আমরা প্রথম জানতে পারি বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থটি পাঠের সূত্রে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হওয়ার আগেই, ১৯৭০ সালে। এর আগে তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পারিবারিক পরিমণ্ডলের কারও কারও তাজউদ্দীনের এই ডায়েরি লেখার অভ্যাসটির কথা জানা থাকতে পারে। কিন্তু তাঁরাও খুব সম্ভবত এর ঐতিহাসিক মূল্য বা গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। বদরুদ্দীন উমরই প্রথম ভাষা আন্দোলন নিয়ে তাঁর বিশাল গবেষণাধর্মী কাজের প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় তাজউদ্দীনের এই ডায়েরির ‘অপরিসীম গুরুত্বের’ উল্লেখ করে লেখেন, ‘তাঁর ডায়েরিতে প্রতিটি দিনের একটি হিসাব আছে এবং সেটা থেকে বহু সভা-সমিতি ও ঘটনার সময় এবং তারিখ নির্ধারণ আমার পক্ষে সহজ হয়েছে। ছোট ছোট অনেক ঘরোয়া সভার বিবরণ এবং অংশগ্রহণকারীদের নামধামও তাঁর ডায়েরি থেকেই আমি পেয়েছি।’
বস্তুত ভাষা আন্দোলন ও সমকালীন রাজনীতি নিয়ে গ্রন্থ রচনার কাজে সহযোগিতার ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদের নাম ‘প্রথমেই উল্লেখযোগ্য’ বলে উমর তাঁর এ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন। উমর জানাচ্ছেন, ডায়েরি ছাড়াও ‘বহু ইস্তাহার ও রাজনৈতিক প্রচার পুস্তিকা দেখার সুযোগ’ তাজউদ্দীন তাঁকে দিয়েছেন। ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ বইয়ের তিনটি খণ্ডেই তাজউদ্দীনের ডায়েরি ও তাঁর সরবরাহ করা দলিলপত্র ছাড়াও উমরকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেও অনেক তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে।
তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত প্রতিদিনের ডায়েরি নিয়মিত রেখেছিলেন।...আমি কিছু কিছু পাতা উল্টিয়ে বুঝতে পারি যে তৎকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস ঠিকমতো লেখার ক্ষেত্রে ডায়েরিটা খুব সাহায্য করবে।—বদরুদ্দীন উমর
অনেক পরে যখন বদরুদ্দীন উমরের ‘ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ: কতিপয় দলিল’ বইটি (১৯৮৪) প্রকাশিত হয়, তখন তাতেও উমর তাজউদ্দীনের ডায়েরির দলিলমূল্য বিবেচনায় তার কতকাংশ অন্তর্ভুক্ত করেন। বইটির ভূমিকায় উমর লিখেছেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৪৬ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত প্রতিদিনের ডায়েরি নিয়মিত রেখেছিলেন।...আমি কিছু কিছু পাতা উল্টিয়ে বুঝতে পারি যে তৎকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস ঠিকমতো লেখার ক্ষেত্রে ডায়েরিটা খুব সাহায্য করবে।’ তাজউদ্দীনের এই ডায়েরিগুলোর মধ্যে বছরওয়ারি বিন্যাসে কয়েকটি ইতিমধ্যে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। আর বাংলাদেশের সমকালীন রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসচর্চার পক্ষে সেগুলোর গুরুত্ব ‘পাতা উল্টিয়ে’ই যে কেউ বুঝতে পারবেন। উল্লিখিত কালপর্বের যে ডায়েরিগুলো হয়তো পাওয়া যায়নি বলেই প্রকাশিত হয়নি, সেগুলো না পাওয়ার ক্ষতি যে কত বিরাট ও অপূরণীয়, প্রাপ্ত ডায়েরিগুলো পাঠে তা সহজেই উপলব্ধ হয়। ডায়েরি লেখার এই অভ্যাস তাজউদ্দীন পরবর্তীকালেও বজায় রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার কঠিন দায়িত্ব পালনের ফাঁকেও তিনি নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে ডায়েরি লিখেছেন। ১৯৭৫ সালের কারাবন্দী জীবনেও লিখেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য, সেগুলো উদ্ধারের সম্ভাবনা হয়তো চিরতরেই তিরোহিত হয়েছে। বলাই বাহুল্য, সেগুলো পাওয়া গেলে আমাদের ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ পর্ব সম্পর্কে অনেক ধোঁয়াশা ও প্রহেলিকার অবসান সহজ হতো।
২.
১৯৪৬ সালে তাজউদ্দীন যখন ডায়েরি লিখতে শুরু করেন, তখনো তিনি ছাত্র। মুসলিম লীগের তরুণ কর্মী হিসেবে কামরুদ্দীন আহমদ, নাইমউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখের সঙ্গে মিলে দলের কায়েমি নেতৃত্বের বিরোধিতা এবং একটি বিকল্প বা নতুন রাজনীতির ধারা সৃষ্টির প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। এ উদ্দেশ্যে একটি ইশতেহার বা ঘোষণাপত্র প্রণয়নের কাজে তাঁদের আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও শ্রমশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় সে সময়ের একটি ডায়েরির অনেকটা অংশজুড়ে। গণ আজাদী লীগের আগে নতুন এই রাজনৈতিক সংগঠনের নাম তাঁরা দিতে চেয়েছিলেন ‘ইস্ট পাকিস্তান ইকোনমিক ফ্রিডম লীগ’। অর্থাৎ পাকিস্তানোত্তর রাজনীতিতে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নটিই তাঁদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোড়াতেই নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এই দেশে অসাম্প্রদায়িক ধারায় রাজনীতিচর্চার লক্ষ্যে ছাত্র ও যুব সংগঠনের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়ার এবং এসব সংগঠনকে কোনো রাজনৈতিক দলের পকেট সংগঠন হতে না দেওয়ার ব্যাপারে তাজউদ্দীন ও তাঁর সঙ্গীদের প্রচেষ্টার কথা নানা সূত্রে ইতিহাসে কমবেশি উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তির ওপর তাঁদের এভাবে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি তাজউদ্দীনের ডায়েরির বাইরে আর কোথাও পাওয়া যায় কি?
৩.
যা আমাদের আশ্চর্য করে তা হলো, প্রতিদিনের রোজনামচার শুরুতে বা শেষে সেদিনের আবহাওয়ার উল্লেখ। প্রাচ্যদেশীয় রীতিতে যা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী ব্যাপার। এটা কি মানুষের জীবনে আবহাওয়া বা বৃহত্তর অর্থে প্রকৃতির প্রভাব সম্পর্কে তাজউদ্দীনের সচেতনতার প্রমাণ দেয়?
একদিন তিনি যে ইতিহাসের সারথির ভূমিকা নেবেন, প্রকাশিত ডায়েরিগুলো লেখার সময় তাজউদ্দীন কিংবা তাঁর বন্ধু ও সহকর্মীদের কারও দূর কল্পনায়ও তেমন ধারণা স্থান পেয়েছিল বলে মনে হয় না। তিনি নিজেও খুব সম্ভব তাঁর এই ব্যক্তিগত দিনলিপির গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন না। অন্তত বদরুদ্দীন উমরের কাছে ডায়েরিগুলো হস্তান্তরের সময় এমন মনোভাবই তিনি ব্যক্ত করেছিলেন। বার-তারিখ ধরে তাঁর প্রতিদিনের কার্যবিবরণী তিনি এসব ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করেছেন। কোথায় বা কার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, সেখানে কী আলাপ হলো, কোন সভা বা অন্য সাংগঠনিক কার্যক্রমে অংশ নিলেন কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন—এসবের উল্লেখ যেমন আছে, তেমনি অনেক নিতান্ত ব্যক্তিগত ও ছোটখাটো প্রসঙ্গের উল্লেখও আছে নাতিদীর্ঘ রচনাগুলোতে। যেমন কখন ঘুম থেকে উঠলেন, কোথায় নাশতা করলেন; এ ছাড়া নিত্যদিনের কেনাকাটা, দরজি ও ঘড়ি মেরামতের দোকানে যাওয়া, নিজের জন্য লজিং খোঁজা ইত্যাদি। আছে পাটসহ কৃষিপণ্যের মূল্য, দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি, চিকিৎসার অব্যবস্থার তথ্যও। তবে যা আমাদের আশ্চর্য করে তা হলো, প্রতিদিনের রোজনামচার শুরুতে বা শেষে সেদিনের আবহাওয়ার উল্লেখ। প্রাচ্যদেশীয় রীতিতে যা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী ব্যাপার। এটা কি মানুষের জীবনে আবহাওয়া বা বৃহত্তর অর্থে প্রকৃতির প্রভাব সম্পর্কে তাজউদ্দীনের সচেতনতার প্রমাণ দেয়?
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে ব্রিটিশরা তাদের শাসনভার অর্পণ করে। সে অনুযায়ী ভারত ১৫ আগস্ট আর পাকিস্তান ১৪ আগস্ট দিনটিকে তাদের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে বেছে নেয়। এ তথ্য আমাদের জানা। কিন্তু পূর্ব বাংলায় ক্ষমতা হস্তান্তর এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খাজা নাজিমুদ্দিনের শপথ গ্রহণের ঘটনাটি ঘটে ১৫ আগস্ট সকালে। সময়টা ছিল বর্ষাকাল, তাই ঢাকা শহরে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে নির্মিত তোরণগুলোর বেশির ভাগ কাগজের পরিবর্তে পাতা দিয়ে সাজানো হয়েছিল। তবে ১৫ দিনের একটানা বৃষ্টিপাতের পর সেদিনকার সকালটা ছিল রৌদ্রকরোজ্জ্বল। এ প্রসঙ্গে ডায়েরিতে তাজউদ্দীনের মন্তব্য, ‘২০০ বছর আগের একজন পৌত্তলিক হলে আমি একে দেব-দেবীর কৃতিত্ব বলে কুসংস্কার জোরদার করতাম।’ অনেক দিনই দিনশেষে এই মর্মে আক্ষেপ ব্যক্ত করেছেন, ‘আজ লেখাপড়া কিছুই হলো না।’
৪.
বলা হয় একজন মানুষের ব্যক্তি-প্রতিকৃতি বা তার মানস-জগতের সঠিক প্রতিফলন—তার ভাষণ-বিবৃতিতে তো নয়ই, এমনকি আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথাতেও ততটা নয়, যতটা ঘটে তাঁর ব্যক্তিগত রোজনামচায়। তাজউদ্দীনের আদর্শবাদী চরিত্র, অনমনীয় ব্যক্তিত্ব ও আত্মপ্রচারবিমুখ স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যায় তরুণ বয়সে লেখা তাঁর ডায়েরিগুলোতে। সমকালীন রাজনৈতিক নেতাদের সারিতেও যা তাঁকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাজউদ্দীন আহমদ দেশের স্বাধীনতার বিষয়ে স্থিরনিশ্চয় হয়েও দেশটির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়াপন্ন ছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর সে সময়ের একান্ত সচিব ফারুক আজিজ খান লিখেছেন, ‘তবে দেশ কতটা বাসযোগ্য হবে, সে নিয়ে তাঁর সন্দেহ ছিল। তিনি যখন বিষণ্ন থাকতেন, তখন মাঝেমধ্যেই আমাকে বলতেন, “আমি জানি না, তুমি দেশে বাস করতে পারবে কি না।” আমি তাঁকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তাতে সফল হইনি। “তুমি দেখে নিয়ো” বলেছিলেন তিনি।’ (বসন্ত ১৯৭১) তাজউদ্দীনের এই সংশয় বা আশঙ্কা যে অমূলক ছিল না, পরবর্তী ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে। তরুণ বয়সের লেখা তাঁর ডায়েরি এবং পরবর্তীকালে দল ও সরকারের নেতা হিসেবে তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতি তাজউদ্দীনের এই প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেয়। দলে ও সরকারে তিনি ছিলেন প্রায় একা। তানভীর মোকাম্মেল যে তাজউদ্দীনকে নিয়ে তাঁর প্রামাণ্যচিত্রটির নাম দিয়েছেন ‘নিঃসঙ্গ সারথী’, আমার কাছে তা খুবই সুপ্রযুক্ত বলে মনে হয়েছে। ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও পরবর্তীকালে মুজিব সরকারের মন্ত্রী ড. মফিজ চৌধুরীও নাকি তাজউদ্দীনকে ‘এক নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী’ সৈনিক বলে অভিহিত করেছিলেন। (ফা.আ.খা, প্রাগুক্ত)
জন্মশতবর্ষে দেশের এই ব্যতিক্রমী রাজনীতিকের প্রতি গভীর ও সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।