যেভাবে আপনি সর্বাত্মক নজরদারির অধীন

দুনিয়াই এখন নজরদারির। কীভাবে ডিজিটাল নজরদারির মধ্যে বাস করছেন আপনি?

‘নাইনটিন এইটটি ফোর’ চলচ্চিত্রর এ দৃশ্যের মতোই নজরদারি আছে আমাদের চারপাশেছবি: সংগৃহীত

ভবনটি বৃত্তাকার; একটি লোহার খাঁচা, আলোকিত; একটা কাচের লন্ঠন প্রায় রানালার (একটি প্রাচীন গম্বুজ) আকৃতির; বন্দীরা যাঁর যাঁর ঘরে বেষ্টনীর প্রান্ত দখল করে আছেন; কর্মকর্তারা কেন্দ্রে। পর্দা এবং অন্যান্য কৌশলে বন্দীদের নজরের বাইরে থাকবেন পরিদর্শকেরা। আর এভাবেই একধরনের সর্বত্র বিরাজমান কর্তৃত্বের অনুভব সৃষ্টি হবে; পুরো বেষ্টনী অল্প বা কোনো ধরনের জায়গা পরিবর্তন ছাড়াই পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা সম্ভব।

—জেরেমি বেন্থাম (১৭৯১), প্যানোপটিকন অর দ্য ইন্সপেকশন হাউস।

জেরেমি বেন্থাম।
ছবি: সংগৃহীত

ব্রিটিশ দার্শনিক জেরেমি বেন্থাম যখন প্যানোপটিকনের ধারণার জন্ম দেন, তখন তিনি নিজেও জানতেন না, এটি শত শত বছর পরও কীভাবে প্রভাব ফেলবে। গ্রিক শব্দ ‘প্যানোপটিস’ বা সর্বদ্রষ্টা থেকে এসেছে ‘প্যানোপটিকন’। স্থাপত্যকলায় প্যানোপটিকন বলতে বোঝায়, ভবনের নকশা হবে এমন যেখানে সব বাসিন্দাকে একজন ব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। বিশেষ করে কারাগারের জন্য তিনি এই নকশা ভেবেছিলেন, যেখানে সব বন্দীর সব সময় মনে হতে থাকবে, তিনি নজরদারির মধ্যে আছেন অথচ তিনি কোনো পরিদর্শককে দেখতে পাবেন না। সর্বত্র বিরাজমান কর্তৃত্বের অনুভবই তাঁদের বিনীত করে তুলবে।

এই ধারণার গূঢ় তাৎপর্য তুলে ধরেন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো। তিনি বলেন, প্যানোপটিকন আধুনিক নিয়মতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উদ্ভবের নির্দেশক। তিনি বলেন, আঠারো শ শতকে আর্থরাজনৈতিক শাসনকাঠামোয় পরিবর্তন আসতে শুরু করে। ‘ডিসিপ্লিন অ্যান্ড পানিশ’ নামক বইয়ে ফুকো লিখছেন, যুক্তি দ্বারা পরিচালিত সমাজে শাস্তির মাধ্যম হিসেবে ‘যন্ত্রণা’র স্থান সংকুচিত হয়ে আসছিল। সংশোধনমূলক ব্যবস্থা রাষ্ট্রের আইনি ক্ষমতার বয়ানে প্রোথিত হচ্ছিল। শারীরিক শাস্তির গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকায় রাষ্ট্রকে শাস্তি প্রদানের প্রচ্ছন্ন সব তরিকার দিকে ঝুঁকতে হলো—যেমন, পর্যবেক্ষণ ও নজরদারি। প্যানোপটিকনের বন্দীকে ফুকো ব্যাখ্যা করছেন অসম নজরদারির গ্রহীতা হিসেবে। তিনি বলছেন, ‘সে দৃশ্যমান, কিন্তু সে দেখে না; সে একটি তথ্য প্রদানকারী বস্তু, যে কখনোই যোগাযোগে সক্ষম নয়।’

সিসিটিভি, ফোনে আড়ি পাতা আর ডিজিটাল নজরদারির এই দুনিয়ায় মনে হয়, জর্জ অরওয়েল কি ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন? মেটা দুনিয়ার অ্যালগরিদম এক নতুন ধরনের আরও শক্তিশালী প্যানোপটিকনের জন্ম দিয়েছে কি? আপনি ক্রমাগত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস আপডেট করছেন, চেকইন দিচ্ছেন, প্রতিমুহূর্তে নিজেই নিজের অবস্থানের জানান দিচ্ছেন।

ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল ১৯৪৯ সালে লেখেন ‘নাইনটিন এইটটি ফোর’ উপন্যাসটি, যেখানে তিনি দেখিয়েছেন ভবিষ্যতের এক দুনিয়া, যেখানে ক্রমাগত যুদ্ধ চলছে। আর সর্বত্র সব সময় নজর রাখছে এক ফ্যাসিবাদী সরকার, নিয়ন্ত্রণ করছে প্রত্যেক মানুষের চিন্তা আর স্বাধীনতাকে। সেখানে একটি চরিত্রকে বলতে শোনা যায়, ‘অবশ্যই এটা বোঝার কোনো উপায় ছিল না যে কোন মুহূর্তে আপনাকে দেখা হচ্ছে বা হচ্ছে না… আপনাকে বাঁচতে হচ্ছে…এই ধারণায় যে আপনার প্রতিটি শব্দ কেউ শুনে ফেলছে এবং শুধু অন্ধকারে ছাড়া, প্রতিটি মুহূর্তের ব্যবচ্ছেদ হচ্ছে।’

সিসিটিভি, ফোনে আড়ি পাতা আর ডিজিটাল নজরদারির এই দুনিয়ায় মনে হয়, জর্জ অরওয়েল কি ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন? মেটা দুনিয়ার অ্যালগরিদম এক নতুন ধরনের আরও শক্তিশালী প্যানোপটিকনের জন্ম দিয়েছে কি? আপনি ক্রমাগত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস আপডেট করছেন, চেকইন দিচ্ছেন, প্রতিমুহূর্তে নিজেই নিজের অবস্থানের জানান দিচ্ছেন। আপনার গতিবিধি, আচরণ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বৈশ্বিক তথ্যভান্ডারকে সমৃদ্ধ করছে। এ তথ্য পৌঁছে যাচ্ছে ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, চিকিৎসক, উদ্ভাবক, গবেষক, সর্বোপরি ক্ষমতাসীনের আঙুলের ডগায়। আপনার তথ্যে সে ক্ষমতাযুদ্ধের নতুন নতুন কৌশল নিরুপণ করছে, চাল চালছে। আপনাকে অধীনস্ত করতে রাষ্ট্রকাঠামোর আর সরাসরি শক্তি প্রয়োগ করার বা বর্বর হওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। সর্বব্যাপী নজরদারির ব্যবস্থার অংশ আপনি। যেকোনো মুহূর্তে আপনার স্বাধীনতা বেহাত হওয়ার বোধ আপনাকে সীমায় আবদ্ধ করে রাখছে। একই সঙ্গে আপনি অবচেতনভাবেই অকপট হওয়ার অধিকার হারাচ্ছেন। ক্রমাগত নজরদারিতে থাকার বোধ আপনাকে করে তুলছে কপট, আপনি নিজেকে বারবার ভাঙছেন, গড়ছেন এবং এমনভাবে তৈরি করে উপস্থাপন করছেন যা গ্রহণযোগ্য কোনো না কোনো বয়ানে।

জেরেমি বেন্থামের আঁকা সেই প্যানোপটিকনের চিত্র।
ছবি: সংগৃহীত

জেরেমি বেন্থামের শেষ ইচ্ছা ছিল, তাঁর দেহ ব্যবচ্ছেদ করে জনসম্মুখে প্রদর্শিত হবে। তাঁর ইচ্ছাকে যথাযথ সম্মান জানানো হয়। আজ তাঁর কঙ্কালটি মোমের মাথা এবং পোশাক–পরিচ্ছদে আবৃত করে একটি কাচের বাক্সে রাখা হয়েছে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনে। তাঁর দেহে লাগানো গোপন ওয়েবক্যাম ক্রমাগত ধারণ করতে থাকে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা আর সরাসরি সম্প্রচার করতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পের নাম দিয়েছে ‘প্যানোপটিক্যাম’। এভাবেই বাক্সবন্দী বেন্থাম চালিয়ে যাচ্ছেন নজরদারি।