ভিক্টর হুগোর সমাধি কোনো অন্ধ গলি নয়

এআই/প্রথম আলো

১৮৮৫ সালের ২২ মে। এক বিকেলে প্যারিসের ফুটপাত ধরে মলিন পোশাকে হেঁটে যাচ্ছিলেন ভিক্টর হুগো। কোথাও যাওয়ার তাড়া ছিল না। উদ্দেশ্যহীন হাঁটছিলেন। সে সময় একটি মেয়ে তাকে দেখে দৌড়ে কাছে এসে বলল, কী আশ্চর্য! তোমাকে তো দেখতে একদম ভিক্টর হুগোর মতো লাগছে। আমি তো ভেবেছিলাম কোন কালে মরে গেছেন তিনি। মেয়েটির কথা শুনে ভয়ে কেঁপে উঠলেন হুগো। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলেন এবং সে রাতেই তার মৃত্যু হয়।

ভিক্টর হুগো মৃত্যু সম্পর্কে বলেছিলেন—যখন আমি কবরে যাই, তখন আমি বলতে পারি, অন্য অনেকের মতো, আমি আমার কাজ শেষ করেছি, কিন্তু আমি বলতে পারি না যে, আমি আমার জীবন শেষ করেছি। আমার দিনের কাজ পরের দিন সকালে শুরু হবে। আমার সমাধি কোনো অন্ধ গলি নয়। এটি একটি রাস্তা। কারণ হুগো নিজেই বলছেন, মনে হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট অন্ধকার সময় এগিয়ে আসছে আর বেহেশতের নূর তাদের মধ্যে বিচ্ছুরিত হয় যারা ইতোমধ্যে এ জগতের আলো ত্যাগ করছেন। তারা চলে যাচ্ছেন অন্য রাস্তায়।

ভিক্টর হুগোর লা মিজারেবল উপন্যাসের এক জায়গায় আছে এরকম একটা অনুভুতি, ‘মৃত্যু কিছুই নয়; বেঁচে না-থাকা ভয়ংকর’। এই উক্তিটি মৃত্যুকে ভয় পাওয়ার চেয়ে অর্থপূর্ণ জীবনযাপনের গুরুত্বের ওপর জোর দেয়। এই উক্তিটি ইংগিত দেয়, মৃত্যু জীবনের একটি স্বাভাবিক অংশ, যেখানে নিজের পূর্ণ সম্ভাবনার সাথে বেঁচে থাকতে ব্যর্থ হওয়া একটি সত্যিকারের ট্র্যাজেডি।

১৮০২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিখ্যাত ফরাসি লেখক ও সাহিত্যিক ভিক্টর হুগো জন্মেছিলেন। ‘টয়লার্স অব দ্যা সি’ বা সাগরের শ্রমিক, ‘দ্যা ম্যান হু লাফ‘ বা হাসতো যে লোকটি ভিক্টর হুগোর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। উনবিংশ শতাব্দের প্রথমার্ধে ইউরোপের যে তিনজন লেখকের মধ্যে তুলনা চলে, ভিক্টর হুগো তাদের মধ্যে অন্যতম। বাকি দুজন হলেন, জার্মান লেখক গ্যেটে ও রুশ লেখক লিও তলস্তয়।

হুগো রাজনীতিবিদও ছিলেন, সংসদ সদস্য হয়েছেন। টয়লার্স অফ দ্যা সি ভিক্টর হুগোর একটি উপন্যাস। এই বইটি তিনি গেরনসি দ্বীপকে উৎসর্গ করেছেন। যেখানে তিনি তার জীবনের ১৯ বছর কাটিয়েছেন। রাজনীতি করতে হলে যে নির্বাসিত জীবন অপরিহার্য এ বিষয়ের ইংগিত রয়েছে উপন্যাসে।

রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং ফরাসি সরকারের বিরোধিতার জন্য নির্বাসিত করা হয়েছিল হুগোকে। বিশেষ করে নেপোলিয়ন তৃতীয়ের রাজত্বকালে। তিনি ১৮৫১ সালে অভ্যুত্থানের একজন সোচ্চার সমালোচক ছিলেন এবং সাধারণ ক্ষমা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে কারাবাস এবং তারপর নির্বাসনের সম্মুখীন হন।

তাঁর সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস লা মিজারেবল। এ উপন্যাসেও দেখা যায় সামাজিক কাঠামো-বিধি-ব্যবস্থার কারণে এক প্রধান চরিত্রকে বারবার দুর্ভোগ পোহাতে হয়। চরিত্রের নাম, জাঁ ভালজাঁ। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করেও সংসার চালাতে পারছিল না। গরিব ছিল। শেষপর্যন্ত সাতটি ছোট্ট শিশুকে ক্ষুধার জ্বালা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সে রুটি চুরি করে। এরপর তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়।

একদিন লা মিজারেবলের প্রকাশককে একটি চিঠি লিখেছিলেন হুগো, সেখানে কিছুই লেখা নেই, শুধু একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?) ছাড়া। প্রকাশকও উত্তর দিলেন শুধু বিস্ময়কর চিহ্ন (!) দিয়ে। এর মানে ভিক্টর হুগো প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, কেমন বিক্রি। প্রকাশক বিস্ময়কর চিহ্ন দিয়ে জবাব দেন, বিক্রি অবিশ্বাস্য।

এমন বিচারে সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এল জাঁ ভালজাঁর মনে। এই সমাজ গরিবকে কাজ দিতে পারে না, ক্ষুধার্তকে অন্ন দেয় না, কিন্তু নিতান্ত পেটের দায়ে যদি চুরি করে, তাকে নির্মম শাস্তি দিতে মুহূর্ত দেরি করে না। সাজা মেনে নিতে না-পেরে বারবার পালাতে লাগল জাঁ ভালজাঁ, কিন্তু ঘটনাক্রমে প্রতিবারই ধরা পড়ে গেল। আর প্রতিবার তার সাজার মেয়াদও বাড়তে লাগল। শেষপর্যন্ত পাঁচ বছরের সাজা খাটতে এসে সে বের হয় উনিশ বছরের সাজা খেটে!

৪৬ বছরের ভালজাঁ কারাগার থেকে বের হয়ে বিশপ মিরিয়েলের সাহায্য নিয়ে অলঙ্কারের ব্যাবসা করে অল্প সময়ে ধনী হয়ে যাওয়ার পরও শান্তি পায় না। এক মিথ্যা মামলায় আবারও আদালতে যেতে হয় জাঁ ভালজাঁকে, সেখানে তাকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এই সাজা আর মেনে নিতে না-পেরে পালিয়ে যায় কারাগার থেকে। পরিচয় আত্মগোপন করে কোজেত নামের এক এতিম মেয়েকে নিজের মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করে নতুনভাবে জীবন শুরু করে সে।

আপনজনকে কাছে পাওয়ার সুযোগ ভাঁলজা কখনোই পায়নি। তাই কোজেতকে নিজের মেয়ে হিসেবে পেয়ে যেন নতুন এক জগৎ খুলে যায় তার কাছে। কিন্তু সেই কোজেতও মারিয়াস নামক এক যুবককে বিয়ে করে অন্য ঘরে চলে যায়। মেয়ে দূরে চলে যাওয়ায় এমনিতেই খুব কষ্ট পেয়েছিল সে, এরপর মারিয়াসও যখন তাকে ভুল বোঝে তখন সে পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। বুকভরা কষ্ট নিয়ে পৃথিবীকে বিদায় জানানোর অপেক্ষায় থাকে জাঁ ভালজাঁ।

এ উপন্যাসটি রাতারাতি জনপ্রিয়তা এনে দেয় হুগোর জীবনে। আলফ্রেড নোবেল ভিক্টর হুগোর ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। দেখা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্যারিসে জুলিয়েট অ্যাডাম ল্যাম্বার নামে একজন একটি প্রকাশনা সংস্থা চালাতেন। আলফ্রেড নোবেল ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ। জুলিয়েটের বাড়িতে মাঝেমধ্যে সাহিত্যসভা বসতো। সেই সভাতেই জুলিয়েট আলফ্রেডের সাথে আলাপ করিয়ে দেন সে যুগের বিখ্যাত কবি-ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগোর। প্রথম আলাপেই হুগোর ফ্যান হয়ে যান আলফ্রেড। হুগোর প্রতি প্রবল অনুরাগ জন্মে আলফ্রেডের। প্রকাশক জুলিয়েটের বাড়িতে কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডায় যেমন হাজির হতেন আলফ্রেড নোবেল ও ভিক্টোর হুগো, তেমনি আসতেন পিয়ের লতি, পল বর্জে আর মোপাসাঁর মতো সাহিত্যিকেরাও। সেসব আড্ডায় আলফ্রেড নোবেলকে হুগো ডাকতেন গ্রেট ভ্যাগাবন্ড বলে।

লা মিজারেবল প্রকাশের পর একটি মজার ঘটনা ঘটে। সে সময় স্বভাবতই চিঠিপত্রের যুগ। একদিন লা মিজারেবলের প্রকাশককে একটি চিঠি লিখেছিলেন হুগো, সেখানে কিছুই লেখা নেই, শুধু একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন (?) ছাড়া। প্রকাশকও উত্তর দিলেন শুধু বিস্ময়কর চিহ্ন (!) দিয়ে। এর মানে ভিক্টর হুগো প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, কেমন বিক্রি। প্রকাশক বিস্ময়কর চিহ্ন দিয়ে জবাব দেন, বিক্রি অবিশ্বাস্য। চিঠিটি বিশ্বের সবচেয়ে ছোট চিঠির তালিকায় গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লিখিয়েছে।

শান্তিনিকেতনের এক নথি থেকে জানা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদা সত্যেন্দ্রনাথের কাছ থেকে ভিক্টর হুগোর লেখা পড়ার জন্যেই ফরাসি ভাষা শেখেন। সাহিত্যের পথে বইতে সংকলিত সাহিত্যরূপ (১৯২৮) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের হুগো সম্পর্কিত মন্তব্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দান্তে ও গ্যেটের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ হুগোর নাম নিয়েছেন।

হুগো তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন: হয় আমি লেখক ও রাজনীতিবিদ হব, অথবা কিছুই হব না। এর কারণ হিসেবে তিনি লিখেছিলেন: আমার বাবা নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হতো। তাকে আমি দেখেছি যুদ্ধে কীভাবে গুলির সামনে দাঁড়াতে হয়। এসবই দাবার গুটির মতো। সেজন্যই রাজনীতিবিদেরা যে পাশাখেলা খেলেন সেই ক্ষমতা-কাঠামো ভেঙে দেওয়ার জন্যই আমি রাজনীতি করেছি। আবার নিজের সংবেদনশীলতাকে ধরে রাখতে লিখেছি। আমি একবার কোনো অপরাধ না-করেই গ্রেফতার হতে যাচ্ছিলাম, এরপরই আমার ভেতর কাজ করে এই নোংরা সমাজে জাঁ ভালজাঁর (লা মিজারেবলের চরিত্র) মতো নিরপরাধ চরিত্রগুলো যে ভিকটিম হয় তাদের জীবন পদে পদে কত দুর্বিষহ হয়ে ওঠে সেসব ভাবনা। আমি মানুষকে বুঝতে চেয়েছি বারবার। এর বেশি কিছু নয়।