মারিও বার্গাস য়োসা: জীবন দিয়ে সাহিত্য আর সাহিত্য দিয়ে জীবন
লাতিন আমেরিকার নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক মারিও বার্গাস য়োসা মারা গেছেন ১৩ এপ্রিল। লেখালেখির মতো এই লেখকের জীবনও কম বর্ণিল ছিল না। পেরুতে জন্ম নেওয়া এ কথাসাহিত্যিক সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন, দাঁড়িয়েছিলেন নির্বাচনে। আবার তাঁর বন্ধু আরেক জগৎখ্যাত ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে ঘুষি মারার ঘটনায়ও তিনি ছিলেন আলোচিত। তাঁর জীবন ও সাহিত্য নিয়ে লিখেছেন এনামুল রেজা
‘পেরুর এখন দুঃসময়, আর যে কেউ এমন সময়ে দেশের জন্য এগিয়ে আসতে পারেন। আপনি আমাকে বলতে পারেন জরুরি অবস্থার প্রার্থী।’ ১৯৮৯ সালে মার্কিন সাংবাদিক এড ব্র্যান্ডির মুখোমুখি বসে মারিও বার্গাস য়োসা নিজের সম্পর্কে এ কথা বলেছিলেন। তত দিনে লোকটা বিখ্যাত লেখক, সাহিত্যে নোবেল ছাড়া সম্ভাব্য আর সবকিছুই জয় করেছেন, নিজের দেশ ছাপিয়ে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়েছে লাতিন আমেরিকাসহ গোটা এস্পানলভাষী অঞ্চলে, ইউরোপে আর উত্তর আমেরিকায়ও। সেই লোক লড়ছিলেন নিজ দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য, তখন তিনি আর বামও নন, পেরুর মধ্যম ডানপন্থী কোয়ালিশন ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের মুখপাত্র।
শুধু পেরু নয়, মারিওর প্রজন্মে লাতিন আমেরিকার প্রায় সব দেশের লেখকেরাই রাজনৈতিকভাবে দারুণ সক্রিয় ছিলেন। য়োসার তো পরিবারটাই ছিল রাজনৈতিক। ওঁর নানা ছিলেন তৎকালীন পেরুর প্রধানমন্ত্রী হোসে বাসতামানতে ই রিভিয়েরোর নিকটাত্মীয়। ১৯৪৮ সালে এই বাসতামানতের সরকারকে সরিয়েই ক্ষমতা দখল করেন সেনা কর্মকর্তা মানুয়েল ওদরিয়া। ওদরিয়ার আট বছরের শাসনকাল পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে তর্কসাপেক্ষে য়োসার সেরা উপন্যাস কনভার্সেশন ‘ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’-এর ভিত্তি।
খালি চোখে দেখলে তাঁর লেখালেখির জীবন ভরে আছে তুখোড় সব রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক আখ্যানে, যেখানে কখনো তিনি মিশিয়েছেন থ্রিলারের উপাদানও, করেছেন স্বৈরতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির সমালোচনা, উঠিয়ে এনেছেন কাল্ট আন্দোলন, রাজনৈতিক ঘটনা ও ব্যক্তিত্বদের সংগ্রাম। আর এসব উপন্যাসের বিষয়বস্তু পেরুকে ছাপিয়ে গেছে; কখনো ব্রাজিলে, কখনো গ্রেটার ক্যারিবিয়ান অঞ্চল, এমনকি আয়ারল্যান্ডের ইতিহাসেও। কিন্তু একটু গভীরে তাকালে বোঝা যায়, এককালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের মতো য়োসার লেখালেখিও তাঁর জীবন অভিজ্ঞতা থেকেই উৎসারিত। আর তাঁর জীবনও যেন উৎসারিত তাঁর সাহিত্যকর্ম থেকে।
কেন প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন য়োসা
পেরুর প্রধানমন্ত্রী হতে চাওয়ার পেছনে সম্ভবত য়োসার একটা প্রতিজ্ঞা ছিল। সংক্ষেপে এটা নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে।
যৌবনের কড়া বামপন্থী চিন্তাভাবনা থেকে ধীরে ধীরে উদার ও মধ্যম ডানে বদলে যাওয়া তাঁর যে মতাদর্শ, এর পেছনে অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি ফিদেল কাস্ত্রোকে তিনি উদাহরণ হিসেবে টেনেছেন। কারণ, কিউবার বিপ্লবের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন য়োসা ও তাঁর বন্ধুরা। সরকার গঠনের পর কাস্ত্রো প্রশাসনের কাজকর্ম য়োসা দেখতে থাকেন হতাশার চোখে। বিশেষ করে, ১৯৭১ সালে কিউবান কবি এবেরত হুয়ান পাদিইয়াকে যখন সরকারের সমালোচনার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে কাস্ত্রো প্রশাসন, য়োসা কাস্ত্রোকে সরাসরি চিঠি লেখেন। মানুষের স্বাধীন জীবনযাপনের জন্য সাম্যবাদ উপযুক্ত নয়, এই ধারণা তাঁর মনে ধীরে ধীরে বদ্ধমূল হয়ে যায় এবং পেরুতে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটা লক্ষ্যও অনুমান করা যায় যে নিজের দেশে বামপন্থার বিকাশের বিরুদ্ধে তিনি লড়বেন। এটা ধীরে ধীরে আরও নিশ্চিত এক ঘটনা হয়ে ওঠে যেন তাঁর নিজের কোনো রাজনৈতিক থ্রিলার উপন্যাসের মতোই।
দীর্ঘ প্রায় এক যুগের সেনাশাসন (১৯৬৮-১৯৮০) পেরুকে বিধ্বস্ত করে তুলেছিল। ১৯৮০ সালে এর পতন হলে জনগণের ভোটে প্রধানমন্ত্রী হন ফার্নান্দো বেলাউন্দে, যিনি সেনাশাসনের আগের মেয়াদেও এই দায়িত্বে ছিলেন। মধ্যডান বেলাউন্দের শাসনামলকে অস্থির করে তুলেছিল এর মধ্যেই ভেঙে পড়া অর্থনৈতিক কাঠামো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আর চরমপন্থী মাওবাদী গেরিলা সংগঠন শাইনিং পাথ। ১৯৮৫ সালের নির্বাচনে তাই জিতে যায় অ্যালান গার্সিয়ার পপুলিস্ট বামপন্থী সরকার। কিন্তু পেরুর দুরবস্থা কাটে না। শাইনিং পাথের অসহযোগ ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডও ব্যাপক বেড়ে যায়। সেই সংকটময় অবস্থায়ই গণবুদ্ধিজীবী ও লেখক হিসেবে য়োসার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে পেরুতে। সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী কর্মপন্থার অন্যতম সমালোচক ছিলেন তিনি। ১৯৮৭ সালের দিকে লিবার্টি মুভমেন্ট নামের ডানপন্থী দলের নেতা হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন এবং ১৯৯০ সালের নির্বাচনে ডানপন্থী কোয়ালিশনের প্রধান হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন।
তবে য়োসার রাজনৈতিক জীবনের মূল মোচড়ের কিছু বাকিও ছিল। পুরো নির্বাচনী প্রচারণায় বিজয় সুনিশ্চিত ভেবে আসা য়োসা এমনকি প্রথম দফায় মূল প্রতিপক্ষ আলবার্তো ফুজিমোরির চেয়ে বেশি ভোটে এগিয়েও যান। যেহেতু পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোটের দরকার সরকার গঠনের জন্য, তাই নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা শুরু হয়। ভদ্র–নম্র কণ্ঠের কৃষি কর্মকর্তা ফুজিমোরি খুব দ্রুত পেরুর সংকট সমাধান করে ফেলবেন। ধনীদের নয়, তিনি হবেন দরিদ্রের সরকার; বিশেষত প্রান্তিক জনগণ, কৃষক ও শ্রমিকদের কাছে এই আশ্বাস বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। অন্যদিকে য়োসার নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল রাষ্ট্রের খোলনলচে পাল্টে দিয়ে পুনর্গঠনের কথা। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তিমালিকানায় দিয়ে অর্থনৈতিক পতন ঠেকানোর পরিকল্পনা। এর সঙ্গে য়োসাকে সমর্থন করছে যুক্তরাষ্ট্র; এটিও ফুজিমোরি নিজের নির্বাচনী প্রচারণায় যোগ করেন, যার মূল কৌশলই ছিল য়োসাবিরোধী এমন প্রচারণা চালানো যে ওই লোক আসলে এলিট, ধনীদের পক্ষে হবে তাঁর অবস্থান, গরিবদের কথা তিনি ভাববেন না। মূলত এই লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিই ফুজিমোরিকে নির্বাচনে জিতিয়ে দেয়।
যখন তিনি হেরে গেলেন
রাজনৈতিকভাবে পরাজিত য়োসা এক ভয়ংকর হতাশা নিয়ে চলে যান স্পেনে। ফুজিমোরির ক্ষমতায় আরোহণ পেরুর জন্য খুব একটা আনন্দের ঘটনা ছিল না। কেননা ফুজিমোরি, যাঁকে ভালোবেসে এল চিনো (চীনা) বলে ডাকত গরিব আমজনতা, তিনিও ১৯৯৩ সালে ক্ষমতাকাণ্ডে একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন (২০০০ সালে পতন ও পলায়ন অবধি), যা ধীরে ধীরে বদলে যায় স্বৈরশাসনে, য়োসা প্রস্তাবিত যে কড়া অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের সমালোচনা করে ফুজিমোরি ক্ষমতায় বসেছিলেন, তার চেয়ে ভয়াবহ পরিবর্তন জনগণের ওপর তিনি খুব দ্রুতই চাপিয়ে দেন। চরমপন্থী শাইনিং পাথকে অবশ্য দমন করা সম্ভব হয় তাঁর আমলে।
পেরুর এই দুর্দিনে য়োসা বরাবরের মতোই সরকারের কড়া সমালোচকের ভূমিকা পালন করে গেছেন। কিন্তু নিজের জনগণের হাতে প্রতারিত হয়েছেন, এমন অনুভূতিও কি তাঁকে গ্রাস করেনি? কেননা রাজনীতিতে আর কখনোই ফেরেননি তিনি, লেখালেখি শুরু করেন নতুন উদ্যমে। নব্বইয়ের ওই উত্তাল সময়ের পরবর্তী এক দশকে বিভিন্ন নন-ফিকশনের পাশাপাশি প্রকাশিত হয় তাঁর দুটি প্রধান উপন্যাস ‘ডেথ ইন আন্দেজ’(১৯৯৩) ও ‘দ্য ফিস্ট অব গোট’ (২০০০), যা আজও হয়ে আছে সর্বকালের সেরা এক স্বৈরতন্ত্রনির্ভর উপন্যাস। ডমিনিকান স্বৈরশাসক রাফায়েল ট্রুজিল্লোর হত্যাকাণ্ড আর এর পরবর্তী ঘটনাক্রম যে তিনি লেখেন, সেখানে আসলে প্রতিফলিত হয় তাঁর নিজের দেশের বাস্তবতাও; সারা জীবন ক্ষমতাকাণ্ডের যে বাস্তবতার বিরুদ্ধে তিনি লড়াই করেছেন।
য়োসার সাহিত্য, মার্কেসের সঙ্গে বিবাদ ও অন্যান্য
বহু নাটকীয় ব্যক্তিজীবন থেকে য়োসার সাহিত্য কখনোই বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না। প্রথম উপন্যাস ‘টাইম অব দ্য হিরো’ যেমন ছিল তাঁর মিলিটারি স্কুলে পড়ার অভিজ্ঞতার দলিল, মিলিটারি প্রশাসনের সমালোচনায় তা এমন টনটনে সমালোচনায় মুখর ছিল যে খুব অল্প বয়সেই তিনি সেনাবাহিনীর চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। কথিত আছে, ক্যান্টনমেন্ট চত্বরে তাঁর বইটা আয়োজন করে পোড়ানো হয়েছিল। আর এসব সঙ্গে করেই চিরায়ত দক্ষিণ আমেরিকান ঐতিহ্যের অনুসারী হিসেবে প্রবল প্রেম ও কামের আধার ছিল তাঁর একান্ত জীবন। মাত্র উনিশ বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন বয়সে দশ বছরের বড় হুলিয়া আর্কাদিকে, যিনি ছিলেন য়োসার দুঃসম্পর্কের খালা। এই অভিজ্ঞতাকে আরও পরিণত বয়সে ‘আন্ট হুলিয়া অ্যান্ড দ্য স্ক্রিপ্টরাইটার’ নামের এক আশ্চর্য সজীব কমিকাল/// উপন্যাসে রূপ দেন তিনি।
আর এই প্রেম ও কামের ভূমিকা আছে সম্ভবত তাঁর জীবনের আরও এক আলোচিত ঘটনায়। ১৯৭৬ সালের মেক্সিকো সিটির এক নরম সকালে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে প্রবল এক ঘুষি মারেন য়োসা। এই এক ঘুষিতে শেষ হয়ে যায় লাতিন আমেরিকান বুমের দুই প্রধান লেখকের গভীর বন্ধুত্বও। কী যে কারণ ছিল এই মারামারির, এ নিয়ে দুজনের কেউই কখনো মুখ খোলেননি। কিন্তু সাংবাদিকেরা থেমে থাকবেন কেন! যা হয়েছিল, তা বের করতে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা। এক চোখে কালশিটে পড়া মার্কেসের বিখ্যাত ছবিটা ইন্টারনেট ও বইপত্র ঘাঁটলে সহজেই পাওয়া যাবে। ছবিটা তুলেছিলেন তাঁদের পরিচিত আলোকচিত্রী রদ্রিগো ময়া, যিনি অকুস্থলে ছিলেন না। তাঁর মতে বিষয়টা ছিল এমন, ‘গাবিতো আর ওনার বউ মারসেদেস এলেন, আর বললেন, “আমার এই কালো চোখের একটা ছবি তুলে দাও।”’
য়োসা রমণীমোহন লোক ছিলেন। মেয়েরা পছন্দ করত ওঁকে। সুদর্শন, প্রাণবন্ত। বার্সেলোনা থেকে এল কালাওয়ে ফেরার পথে জলযাত্রায় এক মেয়ের সঙ্গে খুব ভাব হয় তাঁর। এবং তাঁরা ঠিক করেন যে বিয়ে করবেন। ওই সময় তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী প্যাট্রিসিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে দেন। যদিও নতুন প্রেম টেকে না বেশি দিন। তাই একসময় আবার সব ঠিক হয়ে যায়, প্যাট্রিসিয়ার কাছে মারিও ফিরে আসেন। ঘটনাক্রমে একদিন, হয়তো মজার ছলেই প্যাট্রিসিয়া বলেন, ‘তুমি আমাকে তেমন পছন্দ না–ও করতে পারো, তোমার বন্ধুরা কিন্তু করে। যেমন গাবো (গার্সিয়া মার্কেস)।’ মারিও ধরে নেন, তিনি দূরে থাকার সময় হয়তো গাবো তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কিছু করার চেষ্টা করেছেন। এবং তারপরই ওই ঘুষিকাণ্ড ঘটে।
য়োসা আর মার্কেস দুজনেরই বন্ধুস্থানীয় গুলিয়েরমো আনহুয়েলো, বিখ্যাত অনুবাদক গ্রেগরি রাবাসা কিংবা সাংবাদিক প্লিনিও এপুলেও মেন্দেজা—সবার কাছাকাছি ভাষ্য পাওয়া যায় এই ঘটনার। সেসব মেলালে যা দাঁড়ায়, তা কিছুটা এ রকম—
য়োসা রমণীমোহন লোক ছিলেন। মেয়েরা পছন্দ করত ওঁকে। সুদর্শন, প্রাণবন্ত। বার্সেলোনা থেকে এল কালাওয়ে ফেরার পথে জলযাত্রায় এক মেয়ের সঙ্গে খুব ভাব হয় তাঁর। এবং তাঁরা ঠিক করেন যে বিয়ে করবেন। ওই সময় তিনি তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী প্যাট্রিসিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে দেন। যদিও নতুন প্রেম টেকে না বেশি দিন। তাই একসময় আবার সব ঠিক হয়ে যায়, প্যাট্রিসিয়ার কাছে মারিও ফিরে আসেন। ঘটনাক্রমে একদিন, হয়তো মজার ছলেই প্যাট্রিসিয়া বলেন, ‘তুমি আমাকে তেমন পছন্দ না-ও করতে পারো, তোমার বন্ধুরা কিন্তু করে। যেমন গাবো (গার্সিয়া মার্কেস)।’ মারিও ধরে নেন, তিনি দূরে থাকার সময় হয়তো গাবো তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কিছু করার চেষ্টা করেছেন। এবং তারপরই ওই ঘুষিকাণ্ড ঘটে।
যদিও এই ঘটনাকে কেউই কৌতুকের রেশ ছাড়া বর্ণনা করেননি। মার্কেসের স্ত্রী মারসেদেস বার্চা বলেছিলেন, ‘ব্যাপারটা আসলে বিশ্বাসযোগ্য নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে গাবিতোর একটু ফ্লার্ট করার স্বভাব আছে, তবে ও শুধুই খুব সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করে।’ গ্রেগরি রাবাসার ধারণা ছিল, ‘সম্ভবত সম্পর্কের অমন বেহাল দশায় প্যাট্রিসিয়া গাবোর কাছে পরামর্শ চেয়েছিল, আর গাবো বলেছিল, “মারিওর সঙ্গে কোনো সম্পর্কই রেখো না, ছেড়ে দাও।” এটা শুনেই মনে হয় পরে খুব রেগে গিয়েছিল মারিও।’ প্লিনিও এপুলেও মেন্দেজা অবশ্য আরেকটি ভদ্রস্থ ভাষ্য দিয়েছিলেন, ‘প্যাট্রিসিয়া স্পেন থেকে নিজের শহরে ফিরছিল, এয়ারপোর্টে তাকে এগিয়ে দিতে গিয়েছিল গাবো। রাস্তায় কিছুটা দেরি হলে প্রচল ক্যারিবীয় কৌতুকের ছলে গাবো বলেছিল, “প্লেন যদি তোমাকে ছেড়েই উড়াল দেয়, চিন্তা করবে না, ঘরে ফিরে আমরা বিষয়টা উদযাপন করব, কী বলো?”’ প্যাট্রিসিয়া কথাটি ভুল বুঝে থাকবে।’
যদিও সম্পর্কচ্ছেদের আগেই মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার এক শ বছর’ নিয়ে অভিসন্দর্ভ লেখা হয়ে গিয়েছিল য়োসার। তাঁদের মুখোমুখি আলাপটি কয়েক বছর আগে রফিক উম-মুনির চৌধুরীর বাংলা অনুবাদে পড়ার সুযোগ হয়েছিল। লাতিন সাহিত্য কীভাবে নিজস্ব ভূগোলসহ সারা পৃথিবীতে একটা সাহিত্যিক জাগরণ তৈরি করেছিল, তা নিয়ে দুজনের ধারণাই ছিল খুব শক্ত ও বাস্তবিক। ওঁরা দুজনই একমত হয়েছিলেন যে লাতিন সাহিত্যের জাগরণ আসলে লাতিন পাঠকের জাগরণ, পাঠকেরা প্রস্তুত হয়েছিলেন অভিনব কিছু পড়ার জন্য। আর সেই চাহিদাই তাঁদের হাত ধরে পূরণ হয়ে চলেছিল।
আজ এতকাল পরে এসে ভাবি, সময় ঝাপসা হয়ে উঠল, স্মৃতি ব্যাবিলনের মতো হয়ে গেছে ছাই। গেল শতাব্দীর শেষার্ধ্ব মাতানো লাতিন আমেরিকান বুমের পুরোধা লেখকদের মধ্যে একমাত্র জীবিত লেখক ছিলেন মারিও বার্গাস য়োসা। চার প্রধান ঘোড়সওয়ারির প্রথমজন আর্হেন্তিনার হুলিও কোর্তাসার বিদায় নেন ১৯৮৪ সালে, মেক্সিকোর কার্লোস ফুয়েন্তেস ২০১১ আর কলোম্বিয়ার মার্কেস ২০১৪ সালে। বুমের জনপ্রিয় ধারা জাদুবাস্তবতাবাদ থেকে সচেতন দূরত্ব মেপে চলেও য়োসা আশ্চর্য এক সাহিত্যিক জগৎ নির্মাণ করে গেছেন, লিখে যেতে পেরেছেন দক্ষিণ আমেরিকান ভূগোলের নিপীড়িত ও ক্ষমতাধরদের দ্বন্দ্বের এক কুটিল ঐতিহাসিক ক্রমধারা, যেখানে মেলে সব শ্রেণির রহস্যময় মানুষের অভাবনীয় আর নাটকীয় উত্থান-পতনের গল্প।
বড় রঙিন আর বর্ণাঢ্য এক জীবন কাটিয়ে বিদায় নিলেন লোকটা অবশেষে। পেরুর কোচাবাম্বায় কাটানো শৈশব থেকে লিমায় বয়সজনিত মৃত্যু। মাঝখানে ধরা রইল গোটা এক মহাদেশ, ইউরোপ আর আমেরিকা। ৮৯ বছর কম নয়। আর ৮৩ বছর বয়সে ‘হার্শ টাইমস’-এর মতো একটা রাজনৈতিক উপন্যস লেখাও সহজ কিছু ছিল না। করুণ, রগরগে ও কৌতুকময় কোনো উপন্যাসের মতো লাগে প্যাট্রিসিয়ার সঙ্গে পঞ্চাশ বছরের দীর্ঘ সংসার ভেঙে ইসাবেল প্রেসলারের সঙ্গে তাঁর প্রেমকথাও। ‘ইন প্রেইজ অব স্টেপ মাদার’-এর লেখক শেষ বয়সে হয়ে গিয়েছিলেন বিখ্যাত স্পেনীয় গায়ক এনরিকে ইগলেসিয়াসের সৎবাবা।
একে যদি জীবন দিয়ে সাহিত্য করা আর সাহিত্য দিয়ে জীবন না বলি, আর কাকে বলব?