সমসাময়িককালে বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকদের একজন পাওলো কোয়েলহো। পরিসংখ্যানের বিচারে, নিঃসন্দেহে ব্রাজিলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বেস্ট সেলিং লেখক তিনিই। জীবনদর্শনমূলক ও মিস্টিক ফিকশন ঘরানার বইয়ের লেখক হিসেবে দারুণ খ্যাতিমান এই লেখকের বই সারা বিশ্বে অনূদিত হয়েছে ৮০টির বেশি ভাষায়। দুনিয়াব্যাপী তাঁর রচিত বিভিন্ন বই বিক্রি হয়েছে ৩৫ কোটি কপির বেশি। চুম্বকের মতোই বিপুলসংখ্যক পাঠককে কাছে টেনেছে পাওলো কোয়েলহোর জীবনদর্শন বা আত্ম-অনুসন্ধানমূলক বইগুলো।
কিন্তু কী এমন আছে পাওলো কোয়েলহোর বইয়ে, যা তাঁকে বিশ্বব্যাপী বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকদের একজনে পরিণত করেছে? কেন এত এত মানুষ অনুপ্রেরণা লাভ করছেন কোয়েলহোর বইগুলোয় প্রচারিত জীবনদর্শন থেকে?
আসলে পাওলো কোয়েলহোর নিজের জীবনই তাঁর বই লেখার প্রাথমিক অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি তাঁর পুরো জীবন বলতে গেলে মৃত্যুর সঙ্গে করেছেন ঠাট্টা, মুক্ত হয়েছেন উন্মত্ততা থেকে, মাদককে নিয়ে করেছেন ছেলেখেলাও। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন আলকেমি আর জাদু নিয়ে, পর্যবেক্ষণ করেছেন দর্শন আর ধর্মকে, পড়াশোনা করেছেন সীমাহীন, বিশ্বাস হারিয়ে আবার ফিরে পেয়েছেন এবং লাভ করেছেন ভালোবাসার বেদনা ও সুখের অভিজ্ঞতাও। এই বহুমাত্রিক ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা ভিত গড়ে দিয়েছে ও সমৃদ্ধ করেছে তাঁর জীবনদর্শনকে। সেই দর্শনগুলোই ফুটে উঠেছে তাঁর রচিত বিভিন্ন বইয়ে যা পড়ে, বুঝে ও হৃদয়ঙ্গম করে নিজেদের সমৃদ্ধ ও উন্নত করার চেষ্টায় ব্যাপৃত হয়েছে পাঠককূলও।
দ্য আলকেমিস্ট বইয়ের একটি বিখ্যাত উক্তি—‘যখন তুমি মন থেকে কিছু চাও, পুরো বিশ্ব সেই লক্ষ্যপূরণে তোমার সাহায্যে এগিয়ে আসে।’ এই ছোট কিন্তু দারুণ তাৎপর্যময় উক্তি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মহাবিশ্বের সঙ্গে আমরা এমনভাবে সম্পর্কিত যে আমাদের লক্ষ্যপূরণের পথে এমন এক শক্তি এগিয়ে আসতে পারে, যা আমরা হয়তো কখনো কল্পনাই করিনি।
কোয়েলহো বিভিন্ন জীবনদর্শন পাঠকের কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি, সেসব জীবনদর্শন ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে, জীবনের লক্ষ্য পূরণ করতে এবং জীবনকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করার তাগিদ দিয়েছেন বারবার। সে হিসেবে লেখক দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী মানুষও বটে!
পাওলো কোয়েলহোর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আলোচিত বই ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত ‘দ্য আলকেমিস্ট’ সারা বিশ্বে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি বাংলাদেশেও অসম্ভব পাঠকপ্রিয় একটি বই। ‘দ্য আলকেমিস্ট’ হলো জীবনের অর্থ ও ব্যক্তিগত নিয়তির অনুসন্ধানকে কেন্দ্র করে লেখা ছোট পরিসরের কিন্তু শক্তিশালী বক্তব্যের এক উপন্যাস। এই কাহিনির মূল চরিত্র সান্তিয়াগো, এক তরুণ আন্দালুসীয় মেষপালক, যে বারবার এক স্বপ্ন দেখে এবং বিশ্বাস করে যে তার ভাগ্য তাকে গুপ্তধনের সন্ধানে ডাকছে। স্বপ্নের টানে সে নিজ ভূমি ছেড়ে দূর মরুভূমিতে যাত্রা শুরু করে। যাত্রাপথে পরিচয় হয় বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে, যারা প্রত্যেকে তাকে দেয় জীবনের নতুন শিক্ষা।
সান্তিয়াগো প্রথমে পরিচিত হয় রহস্যময় রাজা মেলকিজেদেকের সঙ্গে, যিনি তাকে ‘পার্সোনাল লিজেন্ড’ বা ব্যক্তিগত কিংবদন্তির ধারণা দেন। পরে সে এক ইংরেজ ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করে, যে আলকেমি শিখতে চায় এবং তাকে জ্ঞানের নতুন দিগন্ত দেখায়। মরুভূমিতে সান্তিয়াগো ভালোবাসার মানুষ ফাতিমার সঙ্গে পরিচিত হয়, যে তাকে শেখায় ভালোবাসা কখনো স্বপ্নকে বাধা দেয় না বরং তা পূরণের শক্তি জোগায়। শেষে সে আলকেমিস্টের সাক্ষাৎ পায়, যে তাকে প্রকৃত আত্মোপলব্ধি ও মহাবিশ্বের ভাষা বোঝার পথে এগিয়ে দেয়।
দ্য আলকেমিস্ট আমাদের শেখায় যে প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটি স্বপ্ন বা নিয়তি আছে, আর সেই স্বপ্নকে অনুসরণ করাই হলো প্রকৃত জীবনের পথ। সাহস, বিশ্বাস, ভালোবাসা ও ধৈর্য—এসবই হলো জীবনের আসল দর্শন, যা সান্তিয়াগোর যাত্রার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন কোয়েলহো।
এই বইয়ের একটি বিখ্যাত উক্তি—‘যখন তুমি মন থেকে কিছু চাও, পুরো বিশ্ব সেই লক্ষ্যপূরণে তোমার সাহায্যে এগিয়ে আসে।’ এই ছোট কিন্তু দারুণ তাৎপর্যময় উক্তি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মহাবিশ্বের সঙ্গে আমরা এমনভাবে সম্পর্কিত যে আমাদের লক্ষ্যপূরণের পথে এমন এক শক্তি এগিয়ে আসতে পারে, যা আমরা হয়তো কখনো কল্পনাই করিনি।
পাওলো কোয়েলহোর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি তাঁর কাব্যিক ভাষার মাধ্যমে গভীর জীবনদর্শনগুলোর সঙ্গে মানুষকে পরিচিত করিয়ে দেন, অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়। অতি সহজেই মানুষ তাঁর বই পড়ে নিতে পারে জীবনের দীক্ষা ও সামনে এগোনোর অনুপ্রেরণা। ঠিক এই কারণেই লেখকের জীবনদর্শন পাঠকমহলে এত জনপ্রিয়, তাঁদের দেয় অপরিমেয় অনুপ্রেরণা।
‘দ্য আলকেমিস্ট’ অনেক বেশি খ্যাতি পেয়েছে পাঠকদের কাছে। কিন্তু জীবনদর্শনের গভীরতার দিক দিয়ে কোয়েলহোর অন্যান্য বইও কম নয়। যেমন তাঁর আরেকটি প্রভাবশালী জীবনদর্শনমূলক বই ‘ম্যানুসক্রিপ্ট ফাউন্ড ইন আক্রা’। জীবনের গভীর অর্থ খোঁজার এক দার্শনিক গ্রন্থ। ১০৯৯ সালে ক্রুসেডারদের আক্রমণের ঠিক আগমুহূর্তে জেরুজালেমের মানুষদের উদ্দেশে গ্রিক দার্শনিক কপ্ট প্রজ্ঞাময় অনেক বাণী উচ্চারণ করেন। তাঁর কাছে শহরের বাসিন্দারা নানা প্রশ্ন তোলেন—ভালোবাসা, ভয়, ব্যর্থতা, একাকিত্ব কিংবা সৌন্দর্যের প্রকৃতি নিয়ে। কপ্ট তাঁদের বোঝান যে প্রকৃত শক্তি কোনো অস্ত্র বা বাহ্যিক বিজয়ে নয়, বরং অন্তরের শান্তি, মানবিকতা ও ভালোবাসার মধ্যেই নিহিত।
কপ্ট শেখান যে ভয় আমাদের বাধা দেয়, অথচ ভালোবাসা মানুষকে মুক্তি দেয়। ব্যর্থতা ধ্বংস নয়, বরং শেখার পথ। জীবনের অর্থ হলো, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য খুঁজে পাওয়া এবং প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করা। এই গ্রন্থ পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেয় যে প্রকৃত জয় মানে নিজের অন্তর্গত সত্যকে খুঁজে পাওয়া ও ভালোবাসায় স্থিত হওয়া। কোয়েলহোর এই রচনায় মানবজীবনের মূল দর্শন হলো—শান্তি, সহনশীলতা ও আত্মজ্ঞান।
এই বইয়ের কিছু উক্তি ও উপদেশ তো রীতিমতো বাঁধাই করে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখার মতো—
‘যে হাল ছেড়ে দেয়, সে-ই পরাজিত; জয়ী তো আর বাকি সবাই…করুণা করো তাদের, যারা কখনো পরাজিত হয়নি! তারা এই জীবনে কখনো জয়ী হবে না।’
‘ভালোবাসা কী জিনিস, তা কেবল পরাজিতরাই জানে... কেননা, জীবনের প্রথম লড়াইটা আমরা ভালোবাসার দুনিয়াতেই লড়ি, আর সাধারণত পরাজিতই হই!’
‘কখনো কখনো যখন মনে হয় যে একাকিত্ব সবকিছু গুঁড়িয়ে দেবে, তখন প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হলো ভালোবেসে চলা।’
গভীর জীবনদর্শনের প্রখরতা প্রকাশ পেয়েছে কোয়েলহোর আরেকটি বই ‘ম্যানুয়াল অব দ্য ওয়ারিয়র অব লাইট’-এ। এখানেও গল্পের ছলে এক বৃদ্ধ প্রাচীন নারী এক জেলে পরিবারের কিশোরকে শেখায় যে কীভাবে একজন মানুষ হতে পারে আলোকিত যোদ্ধা।
‘একাকিত্বের বুক-আচ্ছাদন ব্যবহার করুন,’ বলে একজন।
‘সাবধানতার ঢাল ব্যবহার করুন,’ বলে আরেকজন।
‘সেরা বর্ম হচ্ছে কোনো কিছুতে জড়িয়ে না পড়া,’ বলে তৃতীয়জন।
কিন্তু তাদের পাত্তা দেয় না যোদ্ধা। নিজের পবিত্র জায়গায় গিয়ে সে গায়ে জড়িয়ে নেয় বিশ্বাসের আলখেল্লা।
বিশ্বাস ফিরিয়ে দেয় সব আঘাতকে। বিষকে স্ফটিক স্বচ্ছ পানিতে পরিণত করে বিশ্বাস।’
পাওলো কোয়েলহো এখানে স্পষ্টতই আমাদের জীবনে বিশ্বাসের গুরুত্ব ও কার্যকারিতাকে উল্লেখ করেছেন। যখন সবকিছুই ব্যর্থ হয়, তখন একজন ‘যোদ্ধা’ অটল বিশ্বাসের শক্তিতে বলীয়ান হলে লক্ষ্য পূরণের পথে তাকে আর কিছুই আটকে রাখতে পারে না।
পাওলো কোয়েলহোর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি তাঁর কাব্যিক ভাষার মাধ্যমে গভীর জীবনদর্শনগুলোর সঙ্গে মানুষকে পরিচিত করিয়ে দেন, অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়। অতি সহজেই মানুষ তাঁর বই পড়ে নিতে পারে জীবনের দীক্ষা ও সামনে এগোনোর অনুপ্রেরণা। ঠিক এই কারণেই লেখকের জীবনদর্শন পাঠকমহলে এত জনপ্রিয়, তাঁদের দেয় অপরিমেয় অনুপ্রেরণা।
‘একদিন, প্রত্যক্ষ কোনো কারণ ছাড়াই, যোদ্ধা বুঝতে পারে যে লড়াই করার জন্য আগের মতো উদ্যম আর তার নেই। প্রতিটি কাজকে মনে হয় অর্থহীন। সে সময় তার থাকে কেবল একটাই বিকল্প; ভালোভাবে লড়াইটাই চালিয়ে যাওয়া। দায়িত্ববোধ, ভয় বা যেকোনো কারণে প্রার্থনা করে সে, কিন্তু পথকে ছেড়ে আসে না।
সে জানে, তার অনুপ্রেরণাদাত্রী দেবদূত স্রেফ চলে গেছে অন্য কোথাও। লক্ষ্যকে কেন্দ্রীভূত রাখে আলোকিত যোদ্ধা আর জান দিয়ে লেগে থাকে। এমনকি যখন সবকিছু একেবারে নিরর্থক মনে হয়, তখনো। শীঘ্রই ফিরে আসবে দেবদূত, আর তাঁর পাখার সামান্য সঞ্চালন ফিরিয়ে আনবে যোদ্ধার মনের আনন্দ।’
‘ব্রাইদা’, ‘লাইক দ্য ফ্লোয়িং রিভার’, ‘দ্য স্পাই, ‘দ্য আর্চার’ ও ‘ভেরোনিকা ডিসাইডস টু ডাই’-এর মতো আরও বেশ কিছু জনপ্রিয় বইয়ের লেখকও পাওলো কোয়েলহো, যেখানেও রাজত্ব করেছে বহুমুখী সব জীবনদর্শন।