কবি আবুল হাসানের সঙ্গে এক জার্মান শিল্পীর অসম্ভব বন্ধুত্বের কাহিনি

আজ ৪ আগস্ট কবি আবুল হাসানের ৭৬তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয়েছে বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী: এক অবিশ্বাস্য বন্ধুত্ব শিরোনামে এক বই। এতে আবুল হাসানের জার্মান শিল্পী বন্ধু রাইনহার্ট হেভিকে লিখেছেন কবির জার্মান জীবনের অজানা গল্প। সেই লেখা থেকে রইল নির্বাচিত অংশ। সঙ্গে আছে আবুল হাসানের অপ্রকাশিত চিঠি। এ আয়োজনে আরও থাকছে আবুল হাসানের অগ্রন্থিত কবিতা।

রাইনহার্ট হেভিকে l জার্মান থেকে অনুবাদ: আব্দুল্লাহ আল-ফারুক

রাইনহার্ট হেভিকে

১৯৭৪ সালের কথা। তারিখ ২০ নভেম্বর। বুধবার। রোববার রাত থেকেই আমি আবার শারিটে হাসপাতালে আছি। কোনো চিকিৎসকই ঠিক বুঝতে পারছেন না, আমার ঠিক কী হয়েছে!

আমার হৃদ্‌যন্ত্র এখন শান্ত, পেটের খিঁচুনিও আর নেই। মাথার ভেতর সেই চাপ আর ঢিপঢিপ করাটাও নেই। মাথাঘোরাও বন্ধ হয়েছে। বিছানা থেকে উঠতে যাব, এমন সময় এক রোগী প্রবল বেগে ঢুকে পড়ল আমার রুমে। মোটা আর বেশ লম্বা দেখতে। তার দুই হাতেই ব্যান্ডেজ বাঁধা। ভারী গাঢ় কণ্ঠে কিছুটা উত্তেজনার আভাস। একেবারে বার্লিনের অকৃত্রিম কথ্য ভাষা প্রয়োগ করে সে বলে উঠল, ‘এই শোনো, ওইখানে ফ্লোরে কে একজন বসে আছে। পায়ে মোজা নেই, শুধু স্যান্ডেল পরা। আমার সঙ্গে বকবক করেই চলেছে। কিন্তু ওর ভাষা তো আমি বুঝতে পারছি না। তুমি হয়তো সাহায্য করতে পারবে।’

মাথা নেড়ে আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, হয়তো।’

আমি স্লিপার পরে নিলাম, গায়ে চড়ালাম ড্রেসিং গাউন। আমার দৃষ্টি পড়ল জানালার দিকে। চেয়ে দেখি, বরফ পড়ছে। রাতারাতি কেমন ঠান্ডা পড়ে গেছে। শীত চলে এল। দরজা খুলে ওয়ার্ডের ফ্লোরে এলাম। আমার দরজার ঠিক মুখোমুখি একটু বাঁ দিকে বেশ বড়সড় একটা আরামকেদারায় বসে আছে ঠান্ডায় কাতর খুব রোগা চেহারার এক দারুণ সুশ্রী যুবক। প্রকাণ্ড চেয়ারে যেন ডুবে গেছে তার দেহ। মুখ জ্বলজ্বল করছে সোনালি আভায়। মাথার নীলচে কালো চুলের ওপর চিকচিক করছে গলে যাওয়া বরফকণা। ঢেউখেলানো ঠোঁটের লালচে রঙে একটা নরম হালকা বেগুনি ছোপ। গালেও ঠিক তেমনি আভা। তার পটোলচেরা হলুদাভ চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে, সে দৃষ্টি নির্মল, খুবই আন্তরিক আর প্রীতিময়। কোনো মানুষের এমন দৃষ্টির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে কদাচিৎ।

সহজেই কথা শুরু হলো আমাদের। বিশুদ্ধ ইংরেজিতে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, ‘বাংলাদেশ থেকে, আবুল হাসান।’

আমি উত্তর দিলাম, ‘আরব্য রজনীর দিব্যকান্তি রাজপুত্র আবুল হাসান!’

এ কথা শুনে মৃদু হেসে বলল, ‘আমি বহু ঘণ্টা প্লেনে কাটিয়েছি। এক্ষুনি হাত-মুখ ধুতে হবে, টয়লেটে যেতে হবে।’

আমি ওকে দেখিয়ে দিলাম। তারপর গেলাম ওয়ার্ডে চিকিৎসক আর নার্সদের রুমে। মা–বাবাকে ফোন করে বলতে হবে, গরম জাঙ্গিয়া, উলের লম্বা মোজা, একটা ফুলপ্যান্ট আর একটা সোয়েটার নিয়ে আসতে; আমার সদ্য পরিচিত মানুষটির জন্য।

দুপুরের বিশ্রামের পর চার বেডের রুমে আমি শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল। একটু ঘুম এসে গিয়েছিল আমার। আমার কাছাকাছি জানালার সামনের বেডটা তখনো খালি। নার্সরা রুমে ঢুকে খালি বেডটা ঠেলে আমার পাশ দিয়ে দরজার দিকে নিয়ে গেলেন। যেতে যেতে আমাকে জানালেন যে আমার পাশের বেডে নতুন এক প্রতিবেশী পাচ্ছি। তার নাম হাসান। ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক মনে করেন, আমিই একমাত্র রোগী যে তার কথা বুঝতে সক্ষম। মুখ হাঁ করা অবস্থায় আমি বিছানায় শুয়ে ছিলাম। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না। এমন সময় সেখানে ঢোকানো হলো একটা বেড। পায়ের ওপর পা তুলে বিছানায় বসে আছে হাসান। তার ডানে-বাঁয়ে অল্প কিছু জিনিসপত্র, তার কাপড়চোপড় আর একখানা মলিন স্যুটকেস। যেন তার ভেতর এক ঐশ্বর্য লুকানো। রাজার মতো সগর্ব উদ্ভাসিত চোখে তাকাল সে আমার দিকে।

রাত যখন অনেক গভীর হয়ে এল, আমরা ঘুমাতে গেলাম। সন্ধ্যা হতে না হতেই আমি সাংঘাতিক ক্লান্তি অনুভব করতাম। তাই ঘুমিয়ে পড়তাম বেশ তাড়াতাড়ি।

হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতার কারণে হাসানের পায়ে ব্যথা হচ্ছিল, খিঁচুনি ধরছিল, চাপ অনুভব করছিল। মালিশ করে সে ব্যথা কিছুটা উপশমের চেষ্টা করল। আমিও সাহায্য করলাম তাকে। তার পায়ের নিচে দুই-তিনটা বালিশ দিয়ে উঁচু করে দিলাম। এতে ব্যথা কমল কিছুটা।

কষ্ট হচ্ছিল হাসানের। এ রকম অবস্থায় স্বস্তিই-বা কী করে পাবে সে?

‘এসো আমরা আজ এই পৃথিবীতে আমাদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেহ থেকে আনন্দময় প্রস্থান নিয়ে প্রথম যৌথ কবিতাটি রচনা করি। এ কবিতা হবে গানের মতো।’ এই বলে আমার দিকে সে তাকিয়ে বাংলায় কী যেন গুনগুন করে উঠল। আবার বলে উঠল, ‘আমাদের নশ্বর এই দেহের আবরণ মিলিয়ে যায়, সৃষ্টি হয় গাছগাছালি, পাতা, ফুল, পাখি, ফল, সরোবর, যেখানে উলঙ্গ বালিকারা ঝাঁপ দেয়, লম্বা খোলা চুল তাদের।’

আমাদের ভাবনাগুলো শব্দের রূপ পেল। ইংরেজিতে লিখে ফেললাম আমরা। পৃষ্ঠাগুলো রাখলাম পাশাপাশি। বদলে যেতে লাগল কবিতার লাইন, দৈর্ঘ্য, স্তবকের সংখ্যা। তার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠতে লাগল নিটল কবিতা। হাসান বলল, সে চায় জার্মান ভাষায় যেন উজ্জ্বল আর সুরেলা শোনায় এই কবিতা।

আমার আবৃত্তি করার সহজাত প্রতিভা এবার কাজে এল। কবিতার পঙ্‌ক্তিগুলো আমি জার্মানে সুর করে পড়লাম সাধ্যমতো। আমরা কবিতা রচনার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম ইংরেজি ভাষায়। ফলে বিষয়বস্তু তার জানা ছিল। কবিতা একেবারে সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা বাংলা, ইংরেজি আর জার্মান ভাষার মধ্যে ঘোরাফেরা করেছি। হাসান নিজেও আমাদের কবিতা জোরে জোরে পড়ল। হেসে উঠল তারপর। আমরা লক্ষ করিনি, রাতের আকাশ ভেদ করে কখন ভোরের আলো ফুটে উঠেছে।

১৯৭৪–’৭৫–এ রাইনহার্ট হেভিকের আঁকা প্রতিকৃতিতে আবুল হাসান (৪ আগস্ট ১৯৪৭—২৬ নভেম্বর ১৯৭৫)

ক্লান্ত, শ্রান্ত আমরা। তবে একধরনের আনন্দে উদ্ভাসিত। ১৯৭৫ সালের এই নতুন বছরের শুরুতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।

আমি যেহেতু দিনের বেলায় কাজ করতে অভ্যস্ত, তাই ঘুম হলো মাত্র কয়েক ঘণ্টা। আমার মাথার ভেতর যেন জাঁতাকল ঘুরছে। হাসানের মুখে নিরুদ্বেগ আনন্দের এক আভাস। নিশ্বাস নিচ্ছে সে ধীরে ধীরে। গাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন। আমাদের কবিতা রচনার আনন্দের জন্য আর সময় রয়েছে ৫০ দিনের মতো। দূতাবাসের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে ফেব্রুয়ারির শেষ বা মার্চের প্রথম দিকে বার্লিন-শোয়েনেফেল্ড থেকে ঢাকায় যাওয়ার ফ্লাইট পাবে হাসান।

মা–বাবা আমার আঁকার তুলি, রং রাখার টেবিল, ইজেল—সবই বৈঠকখানার জানালার পাশে রেখে দিয়েছিলেন। ফলে কাজের একেবারে যথাযথ সুযোগ পেয়েছিলাম আমি। তেলরঙের গন্ধের মধ্যে আমাদের ঘুমাতে হয়নি। হাসানের অনেকগুলো স্কেচ করেছি। ওকে একটা প্যানেলের সামনে বসিয়ে একখানা প্রতিকৃতির স্কেচ করেছিলাম। আঁকার সময় সে প্রায়ই আমাকে দেখত। তারপর হঠাৎ করেই একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, ‘আহ্, কী দারুণ এই ব্যাপারটা! রং আর তুলির টানে কালো একটা স্পেস কীভাবে বদলে যায়, ধীরে ধীরে একজন মানুষ সাকার হয়ে ওঠে!’

সাধারণত মা আমাদের জন্য দুপুরের খাবার প্রস্তুত করতেন। তারপর আমরা ঘুমিয়ে নিতাম দুই-এক ঘণ্টা।

মা তখন বলতেন, ‘ভালো করে ঘুমাও তোমরা।’

আমি যখন ঘুমাতাম, হাসান আমার পাশে শুয়ে লিখত। ঘুম ভাঙত যখন, সে তার নিজের দুটি কবিতার বই থেকে একটি বা দুটি কবিতা পড়ে শোনাত। তারপর কবিতার বিষয়বস্তু জানিয়ে দিত ইংরেজিতে। আমি সেটা নিয়ে কিছু মন্তব্য লিখে রাখতাম।

সপ্তাহান্তে অথবা সপ্তাহের মধ্যে আমার বাবার যখন অবসর থাকত এবং আমার ভাইও উপস্থিত থাকত, আমাদের সবাইকে কবিতা পড়ে শোনাত হাসান। আমার বাবা আদতে ছিলেন অভিনেতা। যেসব জার্মান কবির কবিতা হাসানের পছন্দ, সেগুলো তিনি পড়ে শোনাতেন। তারপর আমরা প্রায়ই আলোচনা করতাম ঈশ্বর আর বিশ্বচরাচর নিয়ে।

বাংলাদেশের একটা প্রতীকী ছবি আঁকতেও হাসান আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ছবি শেষ হওয়ার পর সে নিজে ছবিটা দেখেছিল এবং তার ভালোও লেগেছিল।

আবুল হাসানকে নিয়ে আমার প্রহর আর দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল স্বপ্নের মতো।

বৃহস্পতিবার। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫। দূতাবাসের মিনিস্টার হায়দার আমাদের বাড়িতে ফোন করে জানালেন যে রোববার খুব সকালে হাসানের ফ্লাইট যাবে ঢাকায়।

আমরা যেন প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলাম। আমার মা তাকে জানালেন, সে আমাদের কাছেই থাকতে পারে।

না, তা কী করে হয়! দেশে এখনো তাকে প্রয়োজন, বিশেষ করে দেশের সাধারণ মানুষের। যদিও সে জানত যে আমাদের কাছে তার জীবনটা কাটছে আন্তরিকতার এক নিরাপদ পরিবেশে।

হাসান নিজেকে আমার কাছে এক চমত্কার মানুষ আর কবি হিসেবেই শুধু মেলে ধরেনি, এই পৃথিবী আর তার দেশ নিয়ে প্রায় প্রতিদিন তার কাছ থেকে নানা বক্তব্য শুনে আমার তাকে যেন এক দৈবজ্ঞ বলেও মনে হয়েছে।

আর এই সবকিছু আমাকে আমার আর্টের কাজে অনুপ্রাণিত করেছে। আবার খুবই চাপও সৃষ্টি করেছে, নার্ভাস করে তুলেছে।

ফলাফল নিশ্চিত জেনেই দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল হাসান। যদিও তার শরীরের অবস্থা বাঁচার মতো নয়। দেশের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক অবস্থার কথাও তার অজানা ছিল না। আমার কাছে মনে হয়েছিল, এ যেন একজন শহীদের দৃষ্টিভঙ্গি।

আমাদের কাছ থেকে হাসানের বিদায় ঘনিয়ে আসছিল, এ কথা ভেবে আমি কষ্ট পাচ্ছিলাম। জানতাম, এই যে ছোট্ট দেশে আমার বাস, সে দেশ তার নাগরিকদের একধরনের সীমিত সামাজিক নিরাপত্তা দিচ্ছে। তবে সমাজতন্ত্রী নয়, এমন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দেশগুলোয় যাওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে। বাংলাদেশও তেমন দেশের মধ্যে পড়ে। ফলে আমাদের জন্য এ বিদায় চিরকালের মতো।

হাসান আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টায় বলে ওঠে, ‘প্রতি সপ্তাহে আমরা হায়দার সাহেব মারফত চিঠি পাঠাব। দূতাবাসের মাধ্যমে চিঠি পৌঁছে যাবে অনেক তাড়াতাড়ি আর নির্বিঘ্নে। আর যদি ধরো, আমি তোমাকে আর চিঠি লিখতে পারছি না অথবা আমি মারা গেছি, তাহলে আমার স্নেহময়ী, মধুর স্বভাবের বোনদের কেউ একজন অথবা আমার কোনো কবি বান্ধবী তোমাকে লিখবে।’

জানুয়ারি ২০১১, বার্লিন, ইয়োহানিসথাল, জার্মানি

রাইনহার্টের বাড়িতে আবুল হাসানের বিশ্রাম, বার্লিন, পূর্ব জার্মানি, ১৯৭৫
ছবি: ইয়োয়াখিম হুবনার

যেভাবে উন্মোচিত হলো আবুল হাসানের অজানা অধ্যায়

আনিসুর রহমান

১৯৭৪ সালের কথা। জার্মানি তখন পুঁজিবাদী আর সমাজতান্ত্রিক দুই দেশে বিভক্ত। হৃদ্‌যন্ত্রের চিকিত্সার জন্য সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানির বার্লিনে গেলেন কবি আবুল হাসান। নভেম্বরের শীতে তখন পুরো বার্লিন শহর তুষারাবৃত। সেখানে শারিটে হাসপাতালে হাজির হলেন জবুথবু অবস্থায়। গায়ে নেই পর্যাপ্ত গরম কাপড়। জার্মান ভাষাও জানেন না। আশপাশে পেলেন না ইংরেজি জানা কাউকেই। পড়লেন মহা বিপাকে। অসহায় সেই মুহূর্তে দেবদূতের মতো হাজির হলেন এক তরুণ জার্মান শিল্পী—রাইনহার্ট হেভিকে। বাড়িয়ে দিলেন বন্ধুত্বের হাত।

বার্লিন থেকে দেশে ফিরে আসার কয়েক মাস পর ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর পিজি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান আবুল হাসান। তারপর কেটে গেল কয়েক দশক। কিন্তু রাইনহার্টের বুকের মধ্যে জীবিত রয়ে গেলেন এই বাঙালি কবি। দূর দেশে কবি বন্ধুর স্মৃতি আগলে রইলেন রাইনহার্ট।

২০০৯ সালে বার্লিনে বসবাসরত শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় হলো রাইনহার্টের। কথায় কথায় বেরিয়ে এল এই কবি ও শিল্পীর অজানা বন্ধুত্বের এক অসাধারণ গল্প। রাইনহার্টকে তিনি অনুরোধ করলেন, তাঁদের বন্ধুত্বের গল্প লিখে দিতে। রাইনহার্ট লিখলেন বার্লিনে কাটানো তাঁদের বন্ধুত্বের স্মৃতি নিয়ে।

২০১১ সালে ওয়াকিলুর রহমানের হাতে তুলে দিলেন জার্মান ভাষায় লেখা একটি পাণ্ডুলিপি। সঙ্গে তাঁর আঁকা আবুল হাসানের প্রতিকৃতি, তাঁকে লেখা হাসানের চিঠি ও হাসানের দুষ্প্রাপ্য কিছু ছবি।

এই সবকিছু নিয়ে একটি বই করার পরিকল্পনা চলতে থাকল তখন থেকে। তবে সমস্যা হয়ে দাঁড়াল, জার্মানি থেকে রাইনহার্টের লেখাটির উপযুক্ত বাংলা অনুবাদ। পিছিয়ে যেতে থাকল কাজ। এর মধ্যে করোনার মহামারির সময় মৃত্যু হলো রাইনহার্টের।

অবশেষে ওয়াকিলুর রহমানের সম্পাদনায় বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী: এক অবিশ্বাস্য বন্ধুত্ব শিরোনামে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত এই বইয়ে উন্মোচিত হলো কবি আবুল হাসানের এক অজানা অধ্যায়।

রাইনহার্ট হেভিকেকে লেখা আবুল হাসানের চিঠি

আবুল হাসান, ঢাকা, ১০.৩.৭৫

প্রিয় রাইনহার্ট,

আশা করি শরীরে-মনে সুস্থ আছ। তোমার চিঠি এবং সেই সঙ্গে তোমার পাঠানো জ্যাকেট আর ফুলের পাপড়ির চা-ও পেয়েছি। জ্যাকেটগুলো এখানে কাজে লাগবে না। তুমি পারোও বটে! কেন যে কষ্ট করে ওগুলো পাঠালে! তোমার কাছ থেকে এমন একটা উপহার পেয়ে দারুণ অস্বস্তিতে পড়েছি। আসলে কী জানো, আমার দেশে ওখানকার মতো এত শীত পড়ে না। তবু তোমার সহৃদয়তার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

চিঠিতে তোমার দরকারি কয়েকটা জিনিসের কথা লিখেছ। আমার এক বন্ধু দু-তিন দিনের মধ্যে কলকাতায় যাচ্ছে। আমার মনে হয়, এসব জিনিস (যেমন রং) সে ওখানেই পেয়ে যাবে। সে ঢাকায় ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সেগুলো তোমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেব, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

তুমি যোগব্যায়ামের বইয়ের কথা লিখেছ। ঢাকার বইপত্র সবই বাংলায় লেখা আর সেগুলোর ছবিও তেমন স্পষ্ট নয়। কলকাতায় এ-সংক্রান্ত ইংরেজি বই পাওয়া গেলে সেটাই বরং তোমার অনেক বেশি কাজে আসবে।

কখনো ভেবো না যে দূরে আছি বলে আমি তোমাকে ভুলে গেছি। তা-ও কি হয়, রাইনহার্ট! আমি তো মানুষ; স্বাস্থ্য আর সম্পদ আমার নাই-বা থাকল, তবু তো আমি রক্ত-মাংসেরই মানুষ। তোমার আত্মার উষ্ণতা আমি অনুভব করতে পারি। তোমার নিঃসঙ্গ, সুন্দর হৃদয়ের উষ্ণতা ও কোমলতা আমি ঠিকই অনুভব করতে পারি।

ঢাকায় তো প্রয়োজনীয় সবকিছু পাওয়া যায় না। ছবি আঁকার ভালো রঙের অভাব এখানে প্রকট: না আছে চায়নিজ কালি, না আছে ভারতীয় রং। কেবল দেশে তৈরি রংই এখানে পাওয়া যায়। দেরিতে হলেও তোমার দরকারি রংগুলো ঠিকই তোমার হাতে পৌঁছে যাবে। কলকাতা তো আমাদের এখান থেকে খুব দূরে নয়, যাতায়াতও অবারিত। ওখান থেকেই আমি রং আনিয়ে নিতে পারব।

বাই এয়ারে পাঠানো তোমার দ্বিতীয় চিঠিটা আট দিনের মাথায় আমার হাতে পৌঁছেছে। আমিও একটা চিঠি পাঠিয়েছি, তবে ডাকযোগে নয়, ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে। ওটা সময়মতো পেলে কি না জানিয়ো।

আমার দিনগুলো খুব একা একা কাটছে। তোমার বন্ধুত্ব, আমার প্রতি বাড়িয়ে দেওয়া তোমার সহযোগিতার হাত আর যত্ন-আত্তির কথা আমার সব সময়ই মনে পড়ে। তোমার মা, তোমার বাবা, তোমার ভাই—তাঁদের কথা আমি কখনোই ভুলতে পারব না। আমার হৃদয়ে তাঁরা মূল্যবান স্মৃতি হয়ে আছেন। তাঁরা আমার কাছে আর্তমানবতার সেবায় নিবেদিত মানুষ ও কবি হয়ে ওঠার প্রেরণা।

প্রিয় বন্ধু, দুর্ভাগ্যবশত আমি জন্মেছি এমন একটা দেশে, যেখানে মানুষ এখনো না খেতে পেয়ে মারা যায়। তুমি তো জানো না, শহরজুড়ে হাজার হাজার গৃহহীন ভিখারির ভিড় দেখে আমার কী রকম মন খারাপ হয়! আমি জানি না, কবে এসব নিঃস্ব মানুষের মুখে হাসি ফুটবে, কবে তাদের স্বপ্নপূরণ হবে। আমার দেশের মানুষদের জন্য তুমি প্রার্থনা কোরো রাইনহার্ট, যাতে তারা শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারে; দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে শান্তি আর সম্প্রীতি গড়ে তোলার কাজে নিজেদের যুক্ত করতে পারে।

হয়তো মাসখানেকের মধ্যেই তোমার চাহিদামতো সব কটা রং আমি পাঠাতে পারব আর সেই সঙ্গে বাঁশি এবং যন্ত্রসংগীতের গোটা কয়েক রেকর্ড। আমার বিশ্বাস, রবিশঙ্করসহ অন্যান্য বিখ্যাত ওস্তাদের বাজানো সেতার আর সারেঙ্গি তোমার ভালো লাগবে।

আমি এই চিঠির সঙ্গে হেরমান হেসের সিদ্ধার্থ অবলম্বনে তৈরি সিনেমা থেকে কিছু ছবিও পাঠাচ্ছি। এগুলো থেকে তুমি সিনেমা আর মূল বইয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কেও একটা ধারণা পাবে।

তোমার মা–বাবার প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা এবং তোমার ভাই কার্সনের প্রতি ভালোবাসা রইল। শিগগিরই উত্তর দিয়ো। 

ইতি

তোমারই হাসান

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: রেজাউল করিম সুমন

আবুল হাসান l রাইনহার্ট হেভিকে
বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী: এক অবিশ্বাস্য বন্ধুত্ব

সম্পাদক: ওয়াকিলুর রহমান

অনুবাদ: আব্দুল্লাহ আল–ফারুক রেজাউল করিম সুমন

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২৩, প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা, দাম: ৪০০ টাকা।

বাঙালি কবি জার্মান শিল্পী: এক অবিশ্বাস্য বন্ধুত্ব বইটি সংগ্রহ করতে অর্ডার করুন: prothoma.com