লাকী আখান্দের গান কেন পুরোনো হয় না

সংগীতশিল্পী লাকী আখান্দের জন্মদিন আজ। ‘আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না’, ‘এই নীল মণিহার’, ‘কে বাঁশি বাজায় রে’, ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’সহ অসংখ্য শ্রোতৃপ্রিয় গানের সুরকার তিনি। জনসংস্কৃতির এমন কোন উপাদান আছে তাঁর গানের ভেতরে, কেন এখনো বারবার শোনা হয় এই শিল্পীর গানগুলো?

লাকী আখান্দছবি: সংগৃহীত

কয়েক দিন ধরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির তেজ মাঝে মাঝে শহর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, এমন অবস্থা। এ রকম দিনেই হয়তো ‘দ্য ট্যাম্বুরিনম্যান’ কিংবা ‘ফেমাস ব্লু রেনকোট’ শোনা যায়। আমিও হয়তো তেমন কিছুই ভাবছিলাম। হঠাৎ এর মধ্যেই কে যেন বলল, লাকী আখান্দ মারা গেছেন। অন্য সবকিছু মুহূর্তেই ভুলে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো, লাকী আখান্দ তো মারা গেছেন ১৯৮৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর। আমার জন্মের আরও বছরখানেক আগে। যেদিন হ্যাপী আখান্দ মারা গিয়েছিলেন। এরপর লাকী আখান্দ আরেকবার মারা গেলেন ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল। যেটাকে আমরা আক্ষরিক অর্থেই মৃত্যু বলি।

এর আগে শুনেছিলাম, লাকী আখান্দ কাউকে চিনতে পারছেন না। তখন মনে হয়েছিল, এমনই তো হওয়ার কথা ছিল যে লাকী আখান্দ অন্যদের চিনতে পারবেন না। তাঁর চোখের ভেতরে ভেসে থাকবে ব্লার হয়ে আসা একটা আকাশ। আমিও হয়তো একদিন এভাবে কাউকে চিনব না। সেদিন নিশ্চয়ই আমি অন্ধ থাকব না। আমার চোখের সামনে এক টুকরো বরফ, যার ধোঁয়ায় আমি চিনে নেব ঈষৎ বসন্তকাল। আর আমার মনে পড়বে, লেমন থেকে ধীরে ধীরে ইয়েলো হয়ে যাওয়া সন্ধ্যাগুলো। রেডিওর নব ঘুরিয়ে তুমি শুনতে থাকবে ‘মি. টাম্বুরিনম্যান’ কিংবা ‘নীল মণিহার’–এর শেষ কিছু লাইন। আমি সম্ভবত আরেকবার চোখ খুলতে চেষ্টা করব অথবা আরেকবার শীতে গড়িয়ে পড়ব। এসব ভাবনার মধ্যেই আমার মূলত লাকী আখান্দকে মনে পড়ে।

বাংলাদেশের সংগীত আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তাতে লাকী আখান্দের অবদান অনেক। আধুনিক বাংলা পপ গানের অন্যতম রূপকারদের একজন তিনি। ১৯৭৫ সালে ভাই হ্যাপী আখান্দের জন্য যে অ্যালবামটিতে তিনি সংগীত আয়োজন করেন, সেখানেই নিজেকে  চিনিয়েছিলেন লাকী।

স্কুলে থাকতেই এমন কোনো এক সন্ধ্যায় হয়তো শুনেছিলাম, ‘আগে যদি জানিতাম’। আচ্ছা, আগে জানলে কী এমন হতো? হ্যাপী তো চলেই গেল। যাকে ভেবে এই গান লেখা, সেই শম্পা রেজাও তো ফিরে তাকালেন না। তবুও লাকীর এই গান মানুষ শুনেছে। কোনো এক বসন্তদিনে এই সব গান শুনেই আমরা বড় হতে থাকি। আমাদের গানের খাতায় আরও অনেক গান যুক্ত হতে থাকে। আমরা ক্যাসেটের ‘এপিঠ-ওপিঠ’-এ সেসব গান রেকর্ড করে আনি। এসব নতুন গানের ভিড়ে পুরোনো অনেক গান চাপা পড়ে যেতে থাকে। তবে ‘নীল মণিহার’ কিংবা ‘আগে যদি জানিতাম’ এই গানগুলো আর পুরোনো হয় না, যেমন পুরোনো হয় না ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’ অথবা ‘ফেয়ারওয়েল অ্যাঞ্জেলিনা’। আমরা বারবার ক্যাসেটের পিঠ উল্টিয়ে কিংবা রেডিওর নব ঘুরিয়ে এসব গান শুনতে থাকি।

গিটার হাতে লাকী আখান্দ
ছবি: সংগৃহীত

লাকি আখান্দ্‌ স্বাধীনতা–পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মিউজিশিয়ানদের একজন। হ্যাপী মারা যাওয়ার আগে এই দুই ভাই যেখানেই হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলেছে। সে সময়ে তাঁদের হাত দিয়ে তৈরি হওয়া প্রতিটি গানই জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

তবে মূলত ১৯৮৭ সালের যে ডিসেম্বের হ্যাপী মারা গেলেন, ওই ডিসেম্বরের পর আক্ষরিক অর্থে মৃত্যু হয়েছে লাকীর সংগীতজীবনেরও। এরপর ১৯৯৮ সালে তিনি আবারও ফিরে এলেও তখন তিনি ছিলেন আগের লাকীর ছায়া। তবু রক্ত-মাংসের লাকীকে গান গাইতে দেখাটাও নিশ্চয় আমাদের জন্য কম প্রাপ্তি ছিল না।

হ্যাপী আখান্দ
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের সংগীত আজ যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, তাতে লাকী আখান্দের অবদান অনেক। আধুনিক বাংলা পপ গানের অন্যতম রূপকারদের একজন তিনি। ১৯৭৫ সালে ভাই হ্যাপী আখান্দের জন্য যে অ্যালবামটিতে তিনি সংগীত আয়োজন করেন, সেখানেই নিজেকে  চিনিয়েছিলেন লাকী। এ অ্যালবামের ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’ ও ‘কে বাঁশি বাজায় রে’ গানে কণ্ঠ দেন হ্যাপী আখান্দ। একই অ্যালবামের ‘স্বাধীনতা তোমাকে নিয়ে’ ও ‘পাহাড়ি ঝরনা’ গানে কণ্ঠ দেন হ্যাপী ও লাকী দুজনেই। এই গানগুলো প্রতিটি সময়কে অতিক্রম করে গেছে। শুধু এই গানগুলোয় নয়, লাকীর সুর করা ‘কাল কী যে দিন ছিল’, ‘লিখতে পারি না কোনো গান,’ ‘ভালোবেসে চলে যেয়ো না’, ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘হৃদয়ের দুর্দিনে যাচ্ছে খরা’র মতো গানগুলোও বছরের পর বছর ধরে প্রতিদিনই নতুন নতুন শ্রোতাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে নিচ্ছে।

এই গানগুলো তৈরির ২৫-৩০ বছর পর আমি নিজে যখন গানগুলো শুনতে শুরু করি, তখন সেগুলো নতুন কিছু হিসেবেই আমার কাছে ধরা দিয়েছে। আমি এখনো এই গানগুলোর মধ্য দিয়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। শৈশবের সেই অদ্ভুত সময়টাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি, যখন প্রথমবারের মতো এই গানগুলো শুনে শিহরিত হয়েছিলাম।

কিন্তু এসব ভালো লাগার বাইরে আরেকটি কারণেও লাকী আখান্দ্‌ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি যখন গান করতে আসেন, তখন তিনিসহ হাতে গোনা কয়েকজন ছিলেন এই পথের যাত্রী। লাকীর জন্য রাস্তা এতটা সহজ ছিল না। একে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, তার ওপর অস্থির সময়। তার আঁচ তখনকার মানুষের মধ্যেও পড়েছিল। এদিকে মাত্রই তখন মধ্যবিত্ত নতুন মাত্রায় বিকশিত হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে সেই সময় এবং তখনকার মধ্যবিত্তের ‘মন’কে পড়তে পারা অত সহজ ছিল না। এর সঙ্গে ছিল আক্রমণ—পাশ্চাত্য ঘরানার পপ মিউজিক করতেন বলে লাকীর ওপর আক্রমণও হয়েছে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। সুতরাং লড়াইটা যতটা ভেতরের ছিল, ততটাই বাইরের। বিশেষত ‘ক্ল্যাসিক্যাল’দের রক্তচক্ষুর ভয় তো সব সময়ই ছিল।

এই গানগুলো তৈরির ২৫-৩০ বছর পর আমি নিজে যখন গানগুলো শুনতে শুরু করি, তখন সেগুলো নতুন কিছু হিসেবেই আমার কাছে ধরা দিয়েছে। আমি এখনো এই গানগুলোর মধ্য দিয়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। শৈশবের সেই অদ্ভুত সময়টাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি, যখন প্রথমবারের মতো এই গানগুলো শুনে শিহরিত হয়েছিলাম।

তবে এ–যাত্রায় একা ছিলেন না লাকী। পাশে পেয়েছেন আজম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফিরোজ সাঁই, পিলু মমতাজ, জানে আলমদের নিয়ে গড়া ‘ঝিঙ্গা শিল্পীগোষ্ঠী’ ও ‘উচ্চারণ’-এর আজম খানের মতো মহিরুহকে। বিশেষ করে আজম খানের কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। শুরুতে অনেকেই আজম খানকে পাত্তা দিতে না চাইলেও একটা পর্যায়ে আজম খান মানেই ছিল তারুণ্যের উপচে পড়া ভিড়। মঞ্চ পরিবেশনার মাধ্যমে সংগীতকে কেবল শোনার না দেখার বিষয়েও পরিণত করেছিলেন এই রকস্টার। ওপেন এয়ার কনসার্টের দর্শকেরাই একসময় আজম খানকে নিজেদের ‘গুরু’ হিসেবে গ্রহণ করে নিল। এভাবেই বাংলা রক মিউজিক ছড়িয়ে পড়ল লাখো তরুণের শিরায় শিরায়। ঢাকার বাইরেও তৈরি হচ্ছিল নতুন নতুন রক প্রজন্ম। যেখান থেকে পরবর্তী সময়ে সোলস, ওয়ারফেজ, এলআরবি, নগর বাউল, মাইলসসহ অনেক জনপ্রিয় ব্যান্ডের সৃষ্টি। এখনো এই ধারায় যখন কোনো তরুণ গিটার হাতে রকের ভাষায় গল্প বলতে সামনে এগিয়ে আসেন, তাঁর পেছনে অনুপ্রেরণা হয়ে জ্বলজ্বল করে স্বর্ণোজ্জ্বল সেসব ঘটনা।

আরও পড়ুন
যৌবনে লাকী আখান্দ
ছবি: সংগৃহীত

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, লাকীর করা গানগুলোর মধ্যে এমন কী ছিল, যা তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করেছে। প্রথমত, সুরের দিক থেকে গানগুলো ছিল দারুণ শ্রুতিমধুর। যেসব গান লাকী তৈরি করেছেন, তার কথাগুলোও দারুণ, সেই সঙ্গে সুরের বৈচিত্র্যও চমৎকার। এ ছাড়া সে সময় নতুন নতুন ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষার ব্যাপার তো ছিলই। সব মিলিয়ে তাঁর করা প্রতিটি গান গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে শ্রোতাদের কানে নতুন একটা স্বাদ দিতে পেরেছিল, যা ওই সময়ের তরুণদের মধ্যে দারুণভাবে সাড়া ফেলেছিল।

আরেকটা বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, যে সময় বাংলা পপ-রক মিউজিক বিস্তার লাভ করছিল, সে সময় পাশ্চাত্যেও রক মিউজিকও ছিল তুঙ্গে। ‘রক অ্যান্ড রোল’ যুগ তখন মধ্যগগনে। ১৯৭৩ সালে এলভিস প্রিসলির একটি গান স্যাটেলাইটে দেড় বিলিয়ন দর্শক প্রথমবারের মতো উপভোগ করে। ১৯৮২ সালে মাত্র মাইকেল জ্যাকসনের ‘থ্রিলার’ মুক্তি পেয়েছে। এর আগে ১৯৭৯ সালে বাজারে আসে পিঙ্ক ফ্লয়েডের ‘দ্য ওয়াল’, ১৯৮১ সালে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘মেটালিকা’। তা ছাড়া জিম মরিসন, চাক বেরি ও ‘বিটলস’সহ অন্য রকস্টারদের প্রভাব ভালোভাবেই পড়ছিল মিউজিকে বিপ্লব ঘটাতে চাওয়া এ দেশের তরুণদের মধ্যে। তাই এসব বাস্তবতাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লাকীসহ অন্যদের গানের মধ্যে ছিল।

বাংলা পপ-রক সংগীতে যাঁরা বিপ্লব নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে হ্যাপী আখান্দ্‌ আগেই বিদায় নিয়েছেন। এরপর গেলেন লাকীও। কিন্তু তাঁরা যে রাস্তা তৈরি করে গেছেন, সেখান থেকে তৈরি হয়েছে মিউজিক্যাল লড়াইয়ের নতুন আরেকটি ধারা। পরবর্তীকালে শিল্প হিসেবে বাংলা পপ ও ব্যান্ডসংগীত শক্ত মাটিতে দাঁড়ানোর পেছনে লাকী আখান্দের অবদান অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই।

এই লেখা শেষ করতে করতে আমার আরেকটি দৃশ্যের কথা বারবার মনে পড়ছে, আজ থেকে কয়েক প্রজন্ম পরে কোনো এক শ্রাবণসন্ধ্যায় কারও বারান্দা থেকে ভেসে আসছে, ‘আমায় ডেকো না, ফেরানো যাবে না’। এমন একটি দৃশ্যের গায়ে হাত রেখে আরও অনেক দিনই তো বেঁচে থাকা যেতে পারে, তাই না!