অতিমারি যখন ‘মেটাফর’

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক রুমান আলম। লিভ দ্য ওয়ার্ল্ড বিহাইন্ড উপন্যাস লিখে সাড়া ফেলেছেন সাহিত্যজগতে। তাঁর নতুন উপন্যাসটি কেন নজর কাড়ল বোদ্ধাদের? এ প্রশ্নের উত্তরসহ রয়েছে তাঁর সাক্ষাৎকার।

করোনাভাইরাস অতিমারির আতঙ্কে যখন আমরা চুপসে আছি, ঠিক সেই সময় হাতে এল রুমান আলমের উপন্যাস—লিভ দ্য ওয়ার্ল্ড বিহাইন্ড। ২০২০ সালের সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থের এটি অন্যতম। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ডের জন্য ‘শর্ট লিস্টেড’ হয়েছিল বইটি। আটলান্টিকের এপারে–ওপারে হেন নামজাদা পত্রিকা নেই যেখানে রুমানের বই নিয়ে প্রবল উচ্ছ্বসিত আলোচনা হয়নি। ইতিমধ্যে নেটফ্লিস্ক ঘোষণা করেছে, ডেনজেল ওয়াশিংটন ও জুলিয়া রবার্টসকে প্রধান ভূমিকায় রেখে তারা বইটির ভিত্তিতে একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করবে।

বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী রুমান তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে, এটি তাঁর তৃতীয় উপন্যাস। সত্তর দশকের গোড়াতে তাঁর মা–বাবা যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন। বাবা স্থপতি, মা চিকিৎসক। সচ্ছল, সুবিধাভোগী পরিবেশেই তিনি বড় হয়েছেন। এই উপন্যাসও একজন শহুরে, শিক্ষিত আমেরিকানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা, যদিও রুমানের হুল ফোটানো পরিহাসে কোনো আমেরিকানের খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার কথা নয়। যে অভিজ্ঞতার বিবরণ এতে মেলে তা আসলে একটি ‘মেটাফর’। সর্বগ্রাসী কোনো সংকট, যার ওপর আমাদের কারও নিয়ন্ত্রণ নেই, তার সম্মুখীন হলে একক বা যৌথভাবে আমরা কীভাবে সাড়া দিই, নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি, মানুষ হিসেবে কীভাবে আমাদের পক্ষপাত অথবা বিরূপতা প্রকাশিত হয়, এই মেটাফরের আড়ালে সেই সত্যটি উন্মোচিত হয়। নিউইয়র্কার–এর হিলারি কেলির কথায়, এটি একটি বিপর্যয়ের কাহিনি, অথচ এখানে কোনো বিপর্যয় নেই।

বইটিকে কেউ ‘থ্রিলার’ বলেছেন, কেউ বলেছেন ‘হিউমার’, যদিও আমাদের চেনাজানা থ্রিল অথবা হিউমার কোনোটাই এখানে বড় দাগে ধরা পড়ে না। সত্যি বলতে, মার্কিন জীবনের বৈপরীত্যসমূহের সঙ্গে অপরিচিত অনেকের পক্ষে বইটির রস আস্বাদন কঠিন হওয়ার কথা।

অতিমারির আগে বই লিখে শেষ করেন রুমান। উপন্যাসের কোথাও করোনাভাইরাসের কথাও নেই। অথচ এই অতিমারির সঙ্গে এক বিচিত্র সাদৃশ্য রয়েছে এমন অভিজ্ঞতার কথাই লিখেছেন তিনি। এই বিপর্যয়ের কাহিনি প্রকাশিত হচ্ছে নিউইয়র্কে, ফলে আমেরিকান জীবনের শ্রেণিবিভাজন ও বর্ণবাদ এই অভিজ্ঞতার অনিবার্য উপাদান। শহরের বাইরে লং আইল্যান্ডে ছুটি কাটাতে এসেছে এক শ্বেতকায় দম্পতি—ক্লে ও আমান্ডা এবং তাদের অল্পবয়সী দুই ছেলেমেয়ে।

অন্তর্জালে বিজ্ঞাপন দেখেছিল, এখানে আসা মানে সারা জগৎকে পেছনে ফেলে আসা। বইয়ের নাম লিভ দ্য ওয়ার্ল্ড বিহাইন্ড সেখান থেকেই নেওয়া। অথচ অবকাশের বদলে তারা এমন এক আকস্মিক সংকটে নিক্ষিপ্ত হয় যে বাস্তবিকই সারা বিশ্ব তাদের নাগালের বাইরে চলে যায়। হঠাৎ জানা গেল, যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল অজ্ঞাত কারণে বিদ্যুৎ–বিভ্রাটে পড়েছে। সারা শহর অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। বড় কোনো ঝড়, আকস্মিক বন্যা, অথবা ৯/১১–এর মতো সন্ত্রাসী বিমান হামলা? কিছুই জানার উপায় নেই। যে বাড়িটি তারা ভাড়া নিয়েছে, তা শহর থেকে অনেক দূরে এক জনবিরল গ্রামে। বিদ্যুৎ নেই, ইন্টারনেট নেই, টিভিতে ছবি নেই, টেলিফোনে সিগন্যালও নেই। সব কাজে পরামর্শ দেওয়ার জন্য রয়েছে গুগল, এখন সেটাও স্তব্ধ। ঠিক এ অবস্থায় একজন আধুনিক মানুষ—নাগরিক আচার-আচরণে অভ্যস্ত পরিবার—কীভাবে নিজেদের সামলে চলে?

অনেকেই রুমানের কথিত অভিজ্ঞতার সঙ্গে অতিমারির সংগতি খুঁজে পেয়েছেন। অভিজ্ঞতার সংগতি যতটা না প্রাসঙ্গিক, তার চেয়ে অনেক প্রাসঙ্গিক এমন একটা আকস্মিক ও সর্বগ্রাসী সন্ত্রাস যদি নাগরিক জীবনকে জব্দ করে, তাহলে মানুষ কীভাবে তার মোকাবিলা করবে, সে প্রশ্ন। প্রথামাফিক ‘হরর’ কাহিনি নয় এটি, এখানে অতিকথন নেই, ভীতি নির্মাণের ব্যাকুল চেষ্টা নেই। এই বইয়ে এমন কোনো কোনো ঘটনা ঘটে, যা আমাদের হকচকিত করে, কিন্তু অসম্ভব বলে তা একঝটকায় আমরা খারিজ করে দিই না।

এই আকস্মিক দুর্যোগের পটভূমিকায় রুমানের উপন্যাসে একসঙ্গে দুটি অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়। একদিকে বাইরের পৃথিবী, যা অভাবিত কোনো দুর্ঘটনার কবলে—তা মানুষকে গৃহবন্দী করে ফেলেছে। অন্যদিকে মনের ভেতরের পৃথিবী—সেখানে দ্বিতীয়বারের মতো আটকা পড়েছে মানুষ, চেষ্টা করেও বেরোতে পারছে না। এই দ্বৈত সংকট সত্ত্বেও সবাই–ই তাদের প্রত্যহিক সব কাজ চালিয়ে যায়। চা বানানো, পেঁয়াজ কাটা, কেবিনেট খুলে হুইস্কি পান—কোনোটাই বাদ থাকে না।

বইয়ের শুরুটা কিন্তু বেশ নাটকীয়। সম্ভবত এটাই বইয়ের একমাত্র নাটকীয় মুহূর্ত। যে শ্বেতকায় পরিবারটি ছুটি কাটাতে এসেছে, তারা থিতু হয়ে বসার আগেই সন্ধ্যায় দরজায় করাঘাত। এক কৃষ্ণকায় দম্পতি জর্জ ও রুথ আশ্রয় নিতে এসেছে। শহরে ব্ল্যাকআউট, অনিশ্চয়তা। এ অবস্থায় এখানেই নিরাপদ। শ্বেতকায় স্ত্রীটি ভাবছে, কালো দুই মানুষ, এরা নিশ্চয় এই বাড়ির পুরোনো পরিচারিকা বা ভৃত্যস্থানীয়। জানা গেল, গৃহপরিচারক তো নয়ই, তারাই এই বাড়ির প্রকৃত মালিক। তাঁদের কাছ থেকেই বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। হাজার ডলার তুলে দিয়ে কৃষ্ণকায় ভদ্রলোকটি বলেন, রাতটা থাকতে দিন, আমরা অতিথিকক্ষে বেশ কাটিয়ে দিতে পারব। এমন চমৎকার বাড়ি, তার মালিক যে এই কৃষ্ণকায় দম্পতি হতে পারে, সে কথায় আস্থা জাগে না। অথচ কথায় ও ব্যবহারে স্পষ্ট বোঝা যায় এটাই তাদের বাড়ি। কোথায় কোন কক্ষে বা দেরাজে কী রাখা আছে, তা নির্ভুল জানে এরা। দেরাজ খুলে হাজার ডলার ধরিয়ে দিতেও ইতস্তত করে না। কালো বলে এই পরিশীলিত দম্পতির প্রতি এমন বিরূপ মনোভাব যে তাদের নিজেদের আজন্মলালিত বর্ণবাদী ব্যবহারের প্রকাশ তা বুঝতে পেরে ক্লে ও আমান্ডার মনে কিঞ্চিৎ ধিক্কারও জন্মে। পরে আলোচনায় যখন জানা যায় কৃষ্ণকায় দম্পতিটি আসলে তাদের দুজনের চেয়ে কেবল অধিক শিক্ষিতই নয়, অধিক অর্থবানও, সেটা জেনে বিব্রত হওয়ার বদলে অনুচ্চ ক্ষোভ জন্মে শ্বেতকায় দম্পতিটির মনে।

কালো মানুষদের প্রতি আমেরিকার শহুরে ও আপাত–উদারনৈতিক শ্বেতকায়দের এই দ্বিমুখী মনোভাব প্রায় প্রাত্যহিক ব্যাপার। রুমান এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, তাঁর নিজেরই এমন অভিজ্ঞতা একবার হয়েছিল। সে সময় এক নামজাদা পত্রিকায় তিনি সম্পাদকীয় সহকারীর দায়িত্বে কর্মরত। সে পত্রিকার সম্পাদক তাঁকে এক জন্মদিনের পার্টিতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সেই পার্টিতে সম্পাদকের মা একজন আমন্ত্রিত অতিথি। তাঁরা একে অপরকে বেশ ভালো করেই চিনতেন, অনেকবার দেখাও হয়েছে। একসময় সে নারী ব্যস্তসমস্ত হয়ে তাঁকে গাড়ি বের করতে বলেন, তিনি ভেবেছিলেন বাদামি এই লোকটি নিশ্চয় তাঁর ড্রাইভার।

উপন্যাসের অধিক সময়জুড়ে রয়েছে এই দুই দম্পতি ও বালক-বালিকা দুটি কীভাবে একই বাড়িতে একে অপরের সঙ্গে নিকট দূরত্বে ক্রমশ সহাবস্থান শিখে নেয়, এর অনুপুঙ্খ বিবরণ। শহুরে মানুষেরা এতটা যান্ত্রিক ও বাস্তব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাবিহীন যে খুব সামান্য, ছোট ছোট সমস্যা সমাধানও তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। বাইরের বিপদ যত প্রকট, তার চেয়েও অধিক প্রকট হয়ে তা প্রকাশিত হয় এদের মনে। গ্রন্থজুড়ে পাওয়া যায় দুই দম্পতির বর্ণ বিভাজন। বর্ণভেদ ঢাকতে তাদের—বিশেষত শ্বেতকায় দম্পতির—চেষ্টার শেষ নেই। কালো দম্পতিটি তাদের চেয়ে অধিক পরিশীলিত, এই কথা ভেবে শ্বেতকায় দম্পতিটি—বিশেষত স্ত্রীটি—প্রতিমুহূর্তেই যেন অজ্ঞাত এক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অথচ তাদের তুলনায় বালক-বালিকা দুটির ব্যবহার শুধু স্বাভাবিক নয়, অধিক বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্নও মনে হয়। তাদের মনে কোনো সংকট নেই, এমনকি বাইরের সংকটকেও তারা ক্রীড়ার আনন্দে গ্রহণ করে।

রুমান আলমের দেখার চোখ তীক্ষ্ণ, ঘরের ভেতর ও বাইরের দৃশ্য বর্ণনায় তাঁর অভিনিবেশ লক্ষণীয়। যে ভাষায় তিনি লেখেন, সেটিও আমাদের কাছে নতুন। পরিহাসময়তা তাঁর বর্ণনার স্বভাবজ লক্ষণ, কখনো কখনো তা প্রবল রকম চিত্রল ও ইঙ্গিতময়। আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে ক্লে। রুমান তাঁর বর্ণনায় যা লেখেন তার অনুবাদ করলে এমন হয়: হি স্লোওড দ্য কার বিকজ দ্য রোড ওয়াজ কারভি, সিডাকটিভ, এ হিপ সুইচড ব্যাক অ্যান্ড ফোর্থ।

আঁকাবাঁকা রাস্তায় গাড়ি চলার সঙ্গে নিতম্বের কামজ মোহনীয়তার সংগতি খুঁজে পাওয়া সম্ভব, তা আমার জানা ছিল না। কিন্তু তাঁর আঁকা চিত্রটি চোখ বুজে দেখুন, মোটেই অতিকল্পনা মনে হবে না।